নাগরিকত্ব সংশোধন আইন, শ্যামাপ্রসাদ ও আজকের পশ্চিমবঙ্গ

সারা পৃথিবীতেই ইসলামি দেশ থেকে অন্য ধর্মের মানুষেরা বিলীন হয়ে গেছে, আজও হচ্ছে। ভারত বিভাজনের সময়ই শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় এই সমস্যাটি বুঝেছিলেন। ২ মে ১৯৪৭ সালে ভারতের গভর্নর জেনারেল মাউন্টব্যাটেনকে এক পত্রে জানালেন বঙ্গ ভাগের এবং হিন্দু মুসলমান জনবিনিময়ের প্রয়োজনীয়তা। তিনি জানতেন যে ইসলামি শাসনের বাঙ্গলা থেকে হিন্দুরা যে উদ্বাস্তু হয়ে আসতেই থাকবেন, সেই বাঙ্গালি হিন্দু যাবে কোথায়। তিনি পত্রে বললেন যে বঙ্গ ভাগ না হলে ২ কোটি ৬০ লক্ষ হিন্দুকে বাঙ্গলা থেকে সরিয়ে নিতে হবে। আর বঙ্গ ভাগ হলে পূর্ববঙ্গ থেকে ৯০ লক্ষ হিন্দু চলে আসবে আর পশ্চিমবঙ্গ থেকে ৬০ লক্ষ মুসলমান চলে যাবে। তিনি পূর্ববঙ্গ থেকে বিতাড়িত হিন্দুদের জন্য আগেভাগেই তৈরি করলেন। বাঙ্গালি হিন্দুর হোমল্যান্ড পশ্চিমবঙ্গ।

শ্যামাপ্রসাদের ভাবনায় কোনো ভুল ছিল না। পাকিস্তান হবার পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তান থেকে ইসলামি অত্যাচারে হিন্দুরা চলে আসতে থাকলেন। এই উদ্বাস্তুদের জন্য নাগরিকত্বের ব্যবস্থা ছিল নাগরিকত্ব আইন ১৯৫৫-এ। এর ৫নং ধারা অনুযায়ী, যে। ব্যক্তির মা ও বাবা অবিভক্ত ভারতে জন্মেছিলেন, যাকে বলা হয় ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্যক্তি (person of Indian origin)— সেই ব্যক্তি উপযুক্ত ফর্মে আবেদন করে নাম নিবন্ধীকরণ করলে তিনি ভারতীয় নাগরিক বলে গণ্য হবেন। ২০০৪ সালের পর থেকেই ব্যক্তি বেআইনি অনুপ্রবেশকারী হলে তা গ্রাহ্য হবেনা। উপরোক্ত ৫ নং ধারা। অনুযায়ী উদ্বাস্তুরা নাগরিকত্ব পাবার। অধিকারী। ১৯৭১ সালের আগে যে উদ্বাবাস্তুরা পূর্ব পাকিস্তান থেকে এসেছিলেন তাদের নাগরিকত্বের সমস্যা নেই।

শ্যামাপ্রসাদ শুর থেকেই দাবি করেছিলেন জনবিনিময়ের, প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু তা মানলেন না। বরং উলটে বাঙ্গালি হিন্দুর সর্বনাশ করতে ১৯৫০ সালে করলেন নেহরু-লিয়াকত চুক্তি। পশ্চিমবঙ্গ থেকে যা কিছু মুসলমান চলে গিয়েছিলেন তাঁদের বেশিরভাগ ফিরে এলেন। পশ্চিম সীমান্তে পাকিস্তানকে নেহরু কাশ্মীর উপহার দিলেন আর পূর্ব সীমান্তে পাকিস্তানকে নেহর উপহার দিলেন পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে মুসলমান অনুপ্রবেশের। এর পর ১৯৭২-এ পূর্ব পাকিস্তান পালটে হলো বাংলাদেশ। সে বাংলাদেশ নাকি হবে ধর্মনিরপেক্ষ! ফলে কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকার সেই বাঙ্গালি হিন্দুর শত্রু নেহরুর মতোই ভাবলেন যে আর তো। বাংলাদেশ থেকে উদ্বাস্তু আসবে না। ফলে তারা একটি সরকারি নোটিশ করে দিলেন যে বাংলাদেশ থেকে আসা উদ্বাস্তুরা আর নাগরিকত্ব আইনের সেই সুবিধা পাবেন না। ফলে ১৯৭২ থেকে আসা উদ্বাস্তুদের ভারতীয় নাগরিক হবার আর আইনি সুবিধা থাকল না।।

ভারতের জোরে স্বাধীনতা পেয়ে যথারীতি কয়েক বছরের মধ্যেই ইসলামি সমাজ তার নিজের মূর্তি ধারণ করলো। শুরু হয়ে গেল পাকিস্তানি কায়দায় হিন্দুদের উপর অত্যাচার। সংবিধান পালটে হলো ইসলাম রাষ্ট্র ধর্ম। হিন্দুদের উপর শুরু হলো দৈনন্দিন নিপীড়ন। আবার হিন্দু ঘর ছাড়তে করলো। বাঙ্গালি হিন্দু যাবে কোথায় ? সেই এক গন্তব্য— শ্যামাপ্রসাদের তৈরি হিন্দুর হোমল্যান্ড পশ্চিমবঙ্গ। কিন্তু নেহরর উত্তরসূরিরা তো নেহরুর মতোই বাঙ্গালি হিন্দুর সর্বানাশের জন্য মুখিয়ে আছে। ফলে তারা বাংলাদেশ থেকে আগত হিন্দু উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব পাবার আইনি পথটি বন্ধ করে দিলেন। এবার যারা বাংলাদেশ থেকে আসবে, হিন্দু ও মুসলমান, তাদের জন্য অর্থের বিনিময়ে জাল ভোটার কার্ড, আধার কার্ডের ব্যবস্থা করা হলো।

কিন্তু শ্যামাপ্রসাদের বলিদান বৃথা যায়নি। সেই মনীষীর পুণ্যে আজ গড়ে উঠেছে ভারতীয় জনতা পার্টি,শ্যামাপ্রসাদের প্রতিষ্ঠিত জনসঙ্ঘের হাত ধরে। শ্যামাপ্রসাদের প্রচেষ্টার ফল হিন্দুর হোমল্যান্ড, আর সেই পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু উদ্বাস্তু বেঁচে থাকবে বেআইনি অস্তিত্ব নিয়ে তা কী করে মেনে নেওয়া যায়। সেজন্য নরেন্দ্র মোদীর সরকার নাগরিকত্ব আইন ১৯৫৫ চতুর্থবার সংশোধন করে নিয়ে এল নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন, ২০১৯। এতে বলা হলো ৩১ ডিসেম্বর ২০১৪ সালের আগে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে ধর্মীয় নিপীড়নের কারণে অথবা আশঙ্কায় যেসব ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, জৈন ও পার্সি সম্প্রদায়ের মানুষ ভারতে এসেছেন, যাঁদের পাসপোর্ট আইন ১৯২০ ও বিদেশি আইন, ১৯৪৬ থেকে ছাড় দেওয়া হয়েছে— তাঁরা বেআইনি অনুপ্রবেশকারী বলে গণ্য হবেন না। এই উদ্বাস্তুরা নাগরিকত্ব আইন, ১৯৫৫-র ৫নং ধারা নিবন্ধীকরণ (Registration) অনুযায়ী বা ৬ নং ধারা-স্বাভাবিক করণ (Naturalisation) অনুযায়ী আবেদন করে নাগরিকত্ব পাবেন। তাঁকে ভারতে প্রবেশের পর পাঁচ বছর ভারতে থাকতে হবে। যে ব্যক্তি যেদিন ভারতে প্রবেশ করেছেন সেদিন থেকেই তিনি ভারতের

বেআইনি অনুপ্রবেশ বা নাগরিকত্ব সংক্রান্ত কোনো মামলা থাকলে তা আর গণ্য হবে না। আবেদনকারী ব্যক্তির বর্তমান কোনো সুবিধা বা অধিকার খর্ব করা হবে না।

এক কথায় পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা উদ্বাস্তুরা আগেই নাগরিকত্ব পেয়েছেন, এবার বাংলাদেশ থেকে আসা উদ্বাস্তুরাও নাগরিকত্ব পাবার অধিকার পেয়ে গেলেন। শ্যামাপ্রসাদের পশ্চিমবঙ্গ সব নিপীড়িত বাঙ্গালি হিন্দুর আশ্রয়স্থল। এবার আমাদের দায়িত্ব পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু তথা ভারতীয় সংস্কৃতির ভিত্তিকে দৃঢ় করে তোলা। আমাদের দায়িত্ব বাংলাদেশ থেকে আসা মুসলমান অনুপ্রবেশকারীদের বিতাড়ন। একমাত্র শক্তিশালী হিন্দু পশ্চিমবঙ্গ শ্যামাপ্রসাদের আদর্শকে ধারণ ও লালন করতে পারবে।

মোহিত রায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.