নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের সাংবিধানিকতা

এবং সংসদের উ চকক্ষ রাজ্যসভায় ‘নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল পাশ হয়ে গেছে। কিন্তু বিরোধী দল এবং তার নেতৃবৃন্দ এই বিলকে সংবিধান বিরোধী বলে দেগে দিচ্ছেন। বিশেষত এই বিল সংবিধানের ৫, ১০,১৪, ১৫, ২৫ এবং ২৬ ধারা বিরোধী বলে মন্তব্য করে বিলটিকে সংবিধানবিরোধী বলে অভিহিত করেছেন। তিনজন বিশিষ্ট আইনজীবী ও প্রাক্তন বিচারপতির মন্তব্য এই প্রসঙ্গে সমীচীন। সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মদন বি লোকুর বলেছেন, ‘বিলটি সংবিধানের ১৪তম অনুচ্ছেদ লঙ্ঘন করছে। যুক্তিসঙ্গত ভেদাভেদ বৈধ নয়। ভারতের প্রাক্তন অ্যাটর্নি জেনারেল সোলি সোরাবজি বলেছেন, “এই বিল সংবিধানের পরীক্ষায় পাশ করবে না। সমানাধিকারই সংবিধানের ভিত। বিলটি সমানাধিকারের বিরোধী।” আর মিজোরামের প্রাক্তন অ্যাডভোকেট জেনারেল বিশ্বজিৎ দেব বিলটিকে সংবিধানের ৫ থেকে ১১ ও ১৪, ১৫ অনুচ্ছেদ বিরোধী বলে দেগে দিয়েছেন। যদিও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ জোরালোভাষায় বলেছেন, বিলটি কোনোভাবেই সংবিধান বিরোধী নয়। তার যুক্তি, সরকার সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১১ অনুযায়ী সংসদে নাগরিকত্ব আইন তৈরি করতে পারে; সেখানে ১৪তম অনুচ্ছেদের সমানাধিকার কোনো বাধা হতে পারে না। আমার মনে হয়, বিরোধী দলগুলির সম্ভাব্য অপপ্রচারের বিরুদ্ধে এবং নাগরিকদের সঠিক আইনি অবস্থান জানানোর জন্য সংবিধানের ওই অনুচ্ছেদগুলি ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন।
ওই অনুচ্ছেদগুলি পরপর ব্যাখ্যা করা যাক। প্রথমেই আসা যাক সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৫-য়ে যেখানে নাগরিকতার সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, যে কোনো ব্যক্তি যিনি সংবিধান প্রবর্তনের সময়। (a) who was born in the territory of India; or (b) either of whose parents was born in the terriory of India; or (c) who has been ordinarily resident in the territory of India for not less than five years immediately preceding such commencement shall be a citizeen of India. এর পরে আসা যাক। ১০নং অনুচ্ছেদে। ওই অনুচ্ছেদে যারা নাগরিক তাদের নাগরিকত্বের অধিকার কীভাবে চালু থাকবে তা আলোচিত হয়েছে। এখন আমরা আসি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ১৪ নং অনুচ্ছেদে। এই অনুচ্ছেদটি হলো। আইনের চোখে সকল নাগরিকের সমানাধিকার সংক্রান্ত। এই অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “The State shall not deny to any person equality before the law or the equal protection of the laws within the territory of India.” 47915 ‘নোটস অন আর্টিকেল ১৪’-তে ‘Citizenship’সংক্রান্ত অংশে বলা হয়েছে, Foreigners do not have a fundamental right to obtain Indian Citizenship. (vide David John Hopkins v. Union of India, AIR 1997 Mad 366 : 1997 Writ LR681). পরবর্তী অংশে, Concept of Equality-তে বলা হয়েছে, “Concept of equality connot be pressed to commit another wrong.”সুতরাং দেখা যাচ্ছে, অনুচ্ছেদ ১৪-তে সমানতার কথা বলা হলেও তা নাগরিকত্ব অর্জনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। সুতরাং যারা বলছেন, আফগানিস্তান, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশ করা, ওখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের কেন নাগরিকত্ব দেওয়া হবে না তারা নিঃসন্দেহেই মিথ্যে চালাকি করতে চাইছেন। তারা যারা অত্যাচার করেছে। এবং যারা অত্যাচারিত হয়েছেন তাদের উভয়কেই একই পর্যায়ভুক্ত করতে চাইছেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘ঘরে-বাইরে’ উপন্যাসে বলেছেন, “যারামারে, তারা ভুলে যায়; কিন্তু যারা মার খায় তারা ভোলে না।” সুতরাং, পূর্ববঙ্গে মার খেয়ে আসা হিন্দু উদ্বাস্তুরা যে সেই মার খাওয়া ভোলেনি তা এই স্বার্থান্বেষী রাজনীতির কারবারীদের মনে রাখতে হবে। এরপরে আসা যাক অনুচ্ছেদ ১৫-তে। সংবিধানের এই ১৫নং অনুচ্ছেদটি হলো ধর্ম, জাতি, সম্প্রদায়, লিঙ্গ অথবা জন্মস্থানের কারণে কারো প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ নিষিদ্ধকরণ সংক্রান্ত। সেখানে পরিষ্কার বলা হয়েছে, No citizen shall, on grounds only of religion, race, caste, sex, place of birth or any of them, be subject to any disability, liability, restriction or condition with regard to– (a) access to shops, public restaurants, hotels and places of public entertainment; or (b) the use of wells, tanks, bathing ghats, roads and places of public resort maintained wholly or partly out of State funds or dedicated to the use of general public. অর্থাৎ কোন কোন ক্ষেত্রে কোন নাগরিকের প্রতি বৈষম্য করা যাবে না তা পরিষ্কার উল্লেখ করা হয়েছে ১৫ নং অনুচ্ছেদে। এক্ষেত্রে নাগরিকত্ব প্রদান। সংক্রান্ত কোনো বিষয়ই নেই। সুতরাং নাগরিকত্ব কাকে দেওয়া হবে আর কাকে দেওয়া হবে না তা সংবিধানের ১৫নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নির্ধারিত হতে পারে না। অনুচ্ছেদ ২৫ এবং ২৬-য়ে স্বাধীনভাব প্রত্যেকের নিজের ধর্মাচরণ করা এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান পরিচালনা সংক্রান্ত। এক্ষেত্রেও নাগরিকত্ব প্রদান সংক্রান্ত কোনো বিষয় এই অনুচ্ছেদ দুটির সঙ্গে যুক্ত নয় কোনোভাবেই। উপরোক্ত বিষয়গুলি বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৫,১০,১৪, ১৫,২৫ এবং ২৬ নতুন নাগরিকত্ব সংশোধন আইন ব্যাহত করে না বা বিরোধী নয়। এবারে আসা যাক ১১ নং অনুচ্ছেদ বিষয়ে। প্রথমেই দেখে নেওয়া যাক কী আছে এই অনুচ্ছেদে। এই অনুচ্ছেদটি হলো, Parliament to regulate the right of citizenship by law, Nothing in the foregoing provisions of this Part shall derogate from the power of Parliament to make any provision with respect to the acquisition and termination of citizenship and all other matters relating to citizenship. অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে , ভারতীয় সংসদ আইনের মাধ্যমে নাগরিকদের অধিকার নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এবং কোনো অনুচ্ছেদই সংসদকে নাগরিকত্ব অর্জন এবং তা ছেদ করার আইন প্রণয়নসহ নাগরিকত্ব সংক্রান্ত যে কোনো আইন প্রণয়নে বাধা দিতে পারে না। এক্ষেত্রে সংসদই ‘সুপ্রিম’। সুতরাং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহনাগরিকত্ব সংশোধনী’আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে ১১ নং অনুচ্ছেদের যে যুক্তি দিয়েছেন তা সম্পূর্ণ সঠিক। সুতরাং এই ‘নাগরিকত্ব সংশোধন আইন’ পুরোপুরি সংবিধান অনুসারী। এছাড়া আইনটি রাষ্ট্রসঙ্ঘের ১৯৫১ সালে গৃহীত উদ্বাস্তু সংক্রান্ত কনভেনশনের ১৪নং অনুচ্ছেদের সঙ্গেও সঙ্গতিপূর্ণ। সেখানে ‘উদ্বাস্তু’র সংজ্ঞা দিয়ে T61263169 A refugee is someone who has been forced to flee his or her country because of persecution, war or violence. A refugee has a well founded fear of persecution for reasons of race, religion, nationality, political opinion or membership in a particular social group. Most likely, they cannot return home or are afraid to do so. War and ethnic, tribal and religious violence are leading causes of refugees fleeing their countries. এখানে স্মর্তব্য যে, ঘোষিত ইসলামি রাষ্ট্র বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং আফগানিস্থানে সংখ্যাগুর মুসলমানদের অত্যাচারিত হবার কথা নয় ধর্মীয় কারণে। আর উপরোক্ত পাঁচটি কারণ ছাড়া অন্যকারণে কেউ দেশত্যাগ করে অন্য দেশে প্রবেশ করলে তাকে অনুপ্রবেশকারী’ বলে ঘোষণা করা হয়েছে রাষ্ট্রসঙ্ঘের ওই কনভেনশনে।
এই প্রসঙ্গে কেন হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ, জৈন, পারসি এবং খ্রিস্টানদের এই আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে এবং কেন মুসলমান সম্প্রদায়কে বাদ দেওয়া হয়েছে তা একটু আলোচনা করা যেতে পারে। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে দেশভাগের পরে স্বাভাবিকভাবেই আশা করা গিয়েছিল স্ব স্ব দেশে বিভিন্ন ধর্মসম্প্রদায়ের মানুষ স্বাভাবিক শান্তি এবং সুস্থিতিতেই বসবাস করবেন অতঃপর। কিন্তু সেটা হয়নি। বিভক্ত ভারতে সেটা সম্ভব হলেও যে ধর্মীয় বিভাজনের কারণে পাকিস্তানের সৃষ্টি করা হয়েছিল সেটা বহাল তবিয়তে বর্তমান ছিল পাকিস্তানের দুটি অংশেই।
পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান সম্প্রদায় সংখ্যালঘিষ্ঠ হিন্দু-বৌদ্ধ- শিখ ও অন্যান্য সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায়কে মেনে নিতে পারেনি। ফলে তারা ধারাবাহিকভাবে হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ, জৈন ইত্যাদি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের উপরে অত্যাচার, গণহত্যা, নারী সম্প্রদায়ের উপর নির্যাতন অব্যাহত রাখে। এরই ফলশ্রুতিতে ওই দেশগুলি এবং আফগানিস্তান থেকে ক্রমাগত হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষ তাঁদের আজন্মলালিত দেশ থেকে বাস্তুত্যাগ করে বিভক্ত ভারতের এই অংশে আসতে বাধ্য হয়। এই উদ্বাস্তুপ্রবাহ রোধ করার জন্য এক চুক্তি স্বাক্ষর করেন দু দেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ও লিয়াকত আলি খাঁ; ৮ এপ্রিল, ১৯৫০-এ স্বাক্ষরিত হয় “নেহরু-লিয়াকত’চুক্তি। এই চুক্তির ফলে এদেশ ত্যাগ করে পাকিস্তানে চলে যাওয়া মুসলমানেরা আবার ফিরে এলেও, পাকিস্তান ত্যাগ করে চলে আসা কিছু হিন্দু ফিরে গেলেও তারা যে আবার শুধু ফিরে আসে তাই নয়, তাদের সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে চলে আসে অবশিষ্ট হিন্দুরাও। আজও সে প্রবাহ থামেনি। জওহরলাল নেহরুর চুক্তি মুসলমানদের স্বস্তি দিলেও হিন্দুদের উপর অত্যাচার থামাতে পারেনি; তাঁদের বাস্তুত্যাগ চলেছে। অবিরাম গতিতে।১৯৭০-৭১ সালে ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে সর্বতোভাবে। সাহায্য করেছে; তারই ফলশ্রুতিতে স্বাধীন হয়েছে বাংলাদেশ।
তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে স্বাক্ষরিত হয়েছে ‘ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি। কিন্তু মুজিবের তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ’ শাসনব্যবস্থাও হিন্দুদের ওপর অত্যাচার থামতে পারেনি। ফল, যথা পূর্বং, তথা পরং। হিন্দুদের উপর অত্যাচার পুরোপুরি বহাল, উবাস্তু প্রবাহ আগের মতোই বলবৎ। প্রমথনাথ বিশীর সেই কবিতাই সবচেয়ে সত্যি— “আমিন ভালো, জমিন ভালো; ভালো শহর ঢাকা। সবার চাইতে ভালো রে ভাই, হিন্দু পল্লী ফাঁকা।” আর ভুললে চলবে না, এই ফঁকা হিন্দু পল্লীর দখল কিন্তু নিয়েছে আরেক শ্রেণীর বাঙ্গালি, মুসলমান বাঙ্গালি। আমাদের এই পশ্চিমবঙ্গে অনেক হিন্দু নেতা কেন অনুপ্রবেশকারী মুসলমানদেরও এই নাগরিকত্ব আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হলো না তাই নিয়ে কুম্ভীরাশ্রু বিসর্জন শুরু করেছেন। তারা ওই দেশগুলির অত্যাচারী মুসলমান সম্প্রদায়কে অত্যাচারিত হিন্দু-শিখ – বৌদ্ধদের সঙ্গে একই পঙক্তিতে বসাতে চাইছেন। যারা অত্যাচার করল, আর যারা অত্যাচারিত হলো— সবাই একই অধিকার পাবে?
বিনয়ভূষণ দাশ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.