গণতন্ত্রে ভিন্নমত স্বীকৃত। আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক প্রশস্ত। পরে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতের ভিত্তিতে গৃহীত হয় সিদ্ধান্ত। সম্প্রতি সংশোধনী নাগরিকত্ব বিল নিয়ে ভারতীয় সংসদে সেটাই ঘটেছে। মহামহিম রাষ্ট্রপতি মহোদয়ের দ্বারা স্বাক্ষরিত হওয়ার পর সেটি এখন বিধিবদ্ধ আইনে পরিণত হয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত না মানা বা অস্বীকার করা গণতন্ত্রের মৌলিক শর্তকে ক্ষুন্ন করে এবং বিধিবদ্ধ আইনকে অস্বীকার করাটা সংবিধানিক বিধি ভঙ্গের শামিল। অথচ আমরা দেখছি বিরোধী রাজনৈতিক। দলগুলির প্রত্যক্ষ মদতে বিগত কয়েকদিন ধরে ঠিক সেটাই ঘটে চলেছে।
নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরোধিতায় সবচেয়ে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। তার প্রত্যক্ষ আহ্বানে ও মদতে হার্মাদ ও জেহাদিবাহিনী ডাইরেক্ট অ্যাকশনে নেমে গেছে এবং একের পর এক সারিবদ্ধ বাসে, অটোয়, লরিতে এমনকী রেলগাড়িতে অগ্নি-সংযোগ করা হয়েছে। যেভাবে স্টেশনে ভাঙচুর, লুট করা হয়েছে, বিভিন্ন স্থানে বাড়িঘর, দোকান, ভাঙচুর ও লুঠ করা হয়েছে তাতে স্বাধীনতাপূর্ব মুসলিম লিগের ডাইরেক্ট অ্যাকশনের স্মৃতি জাগরিত হচ্ছে। সেদিন মুসলিম লিগের পাকিস্তানের দাবিকে যারা সমর্থন করেছিল, যারা ক্ষমতার লোভে সেই দাবি মেনে নিয়েছিল এবং যারা প্রত্যক্ষ সংগ্রামে শামিল হয়েছিল—ঠিক তারাই আজ ভারত জুড়ে একইরকম ভাবে নাগরিকত্ব আইনের বিরোধিতায় ময়দানে নেমেছে। সেদিনের সুরাবর্দির ভূমিকায় আমরা মমতা ব্যানার্জিকে দেখতে পাচ্ছি। মহম্মদ আলি জিন্নার জিন যেন মুখ্যমন্ত্রীর কাঁধে ভর করেছে। তিনি আওয়াজ তুলেছেন— ‘বাঙ্গলায় No CAB No NRC, No CAA, No NPR—এখানে ওসব চলবে না। পশ্চিমবঙ্গে সবাই নাগরিক।
এই নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরোধিতাই হতে চলেছে আগামী বিধানসভা নির্বাচনে মমতার ট্রাম্প কার্ড। তাই তিনি নতুন ভাবে উজ্জীবিত হয়ে প্রতিদিন পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে আন্দোলনে নেমেছেন। প্রতিব্লকে ব্লকে এই আন্দোলনকে ছড়িয়ে দেবার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, নাগরিকত্ব আইনের বিরোধিতায় তিনি এত তেড়েফুড়ে নেমেছেন কেন? কারণ এছাড়া তাঁর আর কোনো উপায় নেই। একের পর এক আর্থিক দুর্নীতিতে তিনি ও তাঁর দল জড়িয়ে গেছে। সারদা মামলায় পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমারের গ্রেপ্তারির আশঙ্কায় তাঁর রাতের ঘুম উবে গিয়েছে। সারদা, রোজভ্যালি, নারদায় বড়ো বড়ো টিএমসি নেতা জড়িত হয়ে পড়েছে। গ্রাম পঞ্চায়েতে সীমাহীন দুর্নীতি ধরা পড়েছে। তোলাবাজি, কাটমানি, ঘুষমানিতে পুরো দলটাই আকণ্ঠ নিমজ্জিত। লাগামহীন সন্ত্রাসে গ্রামবাঙ্গলার স্বাভাবিক জীবনযাত্রা রীতিমতো ব্যাহত হয়ে পড়েছে।
ভারতীয় জনতা পার্টি তার ঘাড়ের উপর নিঃশ্বাস ফেলছে। গত লোকসভা নির্বাচনে ১৮টি আসন জিতে বিজেপি তাকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে। এহেন দিশাহীন পরিস্থিতিতে এনআরসি এবং সিএএ বিরোধিতার সুবর্ণ সুযোগ তাকে বেঁচে থাকার এবং ভেসে থাকার অক্সিজেন জুগিয়েছে। তাই সরকার বিরোধী জ্বলন্ত ইস্যুগুলিকে ধামাচাপা দেবার মওকা তিনি হাতছাড়া করবেন না— এটাই স্বাভাবিক। জনমনে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে সাম্প্রদায়িক জিহাদি চেতনাকে উস্কিয়ে দিয়ে মুসলমান ভোটব্যাঙ্ককে সুরক্ষিত রাখা এবং বিভ্রান্তির মাধ্যমে হিন্দু উদ্বাস্তু ভোটকে বিজেপির দিকে সংগঠিত হওয়া রদ করার জন্য তিনি আগামী ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচন পর্যন্ত লাগাতার আন্দোলন চালাতে থাকবেন। কিন্তু মমতা ব্যানার্জির এই সুপরিকল্পিত অপপ্রচারের মোকাবিলায় বিজেপি যদি রাজ্যের মূল ইস্যুগুলিকে ভুলে যায় এবং জনগণের মধ্যে ইস্যুগুলিকে নিয়ে যেতে ব্যর্থ হয় তাহলে গোটা রাজ্যের ভবিষ্যৎ অন্ধকারে ডুবে যাবে।
এই প্রেক্ষাপটে উত্তরবঙ্গের রাজবংশী ও জনজাতি অধ্যুষিত অঞ্চলের সাধারণ মানুষ কী ভাবছে তার উল্লেখ নিশ্চয়ই অপ্রাসঙ্গিক হবে না। নৃতত্ত্ব ও ইতিহাসগত দিক থেকে পূর্বতন দেশীয়রাজ্য কোচবিহার এবং নিম্ন অসমের আদি জনগোষ্ঠীর মানুষদের মধ্যে নিকট সম্পর্ক রয়েছে। উল্লেখ্য যে, নিম্ন অসমের বিস্তীর্ণ এলাকা এক সময় পূর্বর্তন কোচরাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। বর্তমানেও উভয় অঞ্চলের সাধারণ মানুষদের মধ্যে কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ধর্ম, বেশভূষা, খাদ্যাভ্যাসে যথেষ্ট মিল থাকার কারণে এবং বিভিন্ন সময়ে বহিরাগত জনগোষ্ঠীর মানুষদের অভিবাসন ও বসতি স্থাপন জনিত আর্থ সামাজিক ও রাজনৈতিক মনোভাবনার মধ্যেও মিল খুঁজে পাওয়া যায়।
অতীতে অসমীয় বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক নেতৃবর্গও চেয়েছিলেন— কোচবিহার অংশ যেন অসমের সঙ্গে যুক্ত হয়। সে এক ভিন্ন প্রসঙ্গ।
পূর্বে অসমে বাঙ্গালি খেদাও আন্দোলনের ঢেউ উত্তরবঙ্গের দেশীয় এলাকায় আছড়ে পড়েছিল এবং স্থানীয় বৃহত্তম রাজবংশী সমাজের একাংশকে আতঙ্কিত করেছিল, বর্তমানেও অসমে এনআরসি নিয়ে যে প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছে। এবং সম্প্রতি নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন নিয়ে যে ধরনের প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যাচ্ছে — তার অভিঘাতে স্থানীয় অধিবাসীদের একাংশও প্রভাবিত হয়ে পড়েছে। অসমবাসীদের সুরে তারাও বলতে শুরু করেছে—আমরা এনআরসি চাই, কিন্তু নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন চাই না। কারণ স্পষ্ট। স্বাধীনতার পরবর্তীকালে বিভিন্ন সময়ে পূর্ববঙ্গ থেকে (বর্তমানে বাংলাদেশ) আগত উদ্বাস্তু স্রোত তাদের জায়গা জমি, সামাজিক ও রাজনৈতিক আধিপত্য হারানোর আশঙ্কায় আশঙ্কিত করে তুলেছিল। সেই সঙ্গে কাজ হারানোর জন্য জীবন-জীবিকা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশংকাও ছিল।
তাই আঞ্চলিক দাবি দাওয়া আদায় ও নিজেদের অধিকার সুরক্ষিত রাখার তাড়নায় কয়েকটি সংগঠন গড়ে উঠেছিল সেগুলি কিছুটা হলেও স্থানীয় রাজবংশী মানুষকে প্রভাবিত করেছিল। অতীতে এতদঞ্চলে ত পশিলি আন্দোলন, কামতাপুরি আন্দোলনে বহু মানুষকে শামিল হতে দেখা গিয়েছে। কখনও কখনও সেই সমস্ত আন্দোলন হিংসাত্মক চেহারাও নিয়েছে। অতি সম্প্রতি বৃহত্তর কোচবিহার রাজ্যের দাবিতে গড়ে ওঠা গ্রেটার কোচবিহার পিপলস্ অ্যাসোসিয়েশন বংশীবদন গোষ্ঠী এই আইনের বিরোধিতা করে কোচবিহার শহরে বড়ো মিছিলের আয়োজন করেছিল। যেখানে মুসলমান সম্প্রদায়ের বহু মানুষকে পা মেলাতে দেখা গিয়েছিল। তথ্যসূত্রে জানা গেছে যে, এধরনের আঞ্চলিক ভাবাবেগ দ্বারা পরিচালিত কয়েকটি সংগঠন একসঙ্গে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন বিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। পর্দার আড়ালে অবশ্যই ক্ষমতাসীন দলটির ইন্ধন রয়েছে।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, দীর্ঘকাল ধরে একসঙ্গে বসবাস করার কারণে এবং জনগোষ্ঠীগত ভাবে স্থানীয় রাজবংশী হিন্দু ও স্থানীয় মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ নিকট সম্বন্ধে আবদ্ধ। আসলে স্থানীয় মুসলমান (দেশি মুসলমান) শ্ৰেণী ধর্মান্তরিত রাজবংশী সমাজেরই মানুষ। ফলে দেশীয় ভাবাবেগ উভয়ের মধ্যেই বিদ্যমান। সেজন্য উভয়ের কাছেই পূর্ববঙ্গীয় উদ্বাস্তু হিন্দু ভিন্ন প্রজাতির বলে প্রতীয়মান হয়। এই ভাবাবেগকে কাজে লাগিয়ে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরোধিতা করে রাজনৈতিক ফয়দা তোলার কাজটি করে যাচ্ছে তৃণমূল কংগ্রেস।
কিন্তু সময়ের স্রোতে মানুষ ভেসে চলে। আর্থ সামাজিক ও রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতায় বিশাল জনগোষ্ঠী একসঙ্গে একই লক্ষ্যে এগুতে থাকে। ফলস্বরূপ আঞ্চলিক ভাবাবেগ বা খণ্ড জাতীয়তার আবেগ অনেকটাই স্তিমিত হয়ে পড়ে।
আঞ্চলিক স্তরে ক্ষুদ্র ও খণ্ড জাতীয়তার পরিসর বৃদ্ধি ঘটিয়ে বৃহত্তর জাতীয়তার স্রোতে সাধারণ মানুষকে মিলিয়ে দিতে যে রাষ্ট্রীয় ভাবনার প্রচার ও প্রসারের প্রয়োজন। হয় তা করে দেখিয়েছে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ এবং তার সহমর্মী রাষ্ট্রবাদী সংগঠনগুলো। মূলত এই সংগঠনগুলির লাগাতার প্রচার ও সাংগঠনিক কাজকর্মের ফলে এই ভূভাগের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের সাধারণ মানুষ সর্বভারতীয় আঙ্গিকের সঙ্গে নিজেদের মেলাতে পেরেছে।
এখন উত্তরবঙ্গের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী ও স্থানীয় জনজাতি সম্প্রদায়ের মানুষ রাজনৈতিক দল হিসেবে বিজেপির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। যার সুফল গত লোকসভা নির্বাচনে। (২০১৯) দল পেয়েছে। উত্তরবঙ্গের ৮টি লোকসভা আসনের মধ্যে ৭টিতেই বিজেপি। জয়লাভ করেছে।
এই প্রেক্ষাপটে বলা যায়, আঞ্চলিক ভাবাবেগ পুষ্ট ছোটো ছোটো দল বা গোষ্ঠীগুলোর নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন বিরোধী প্রচার ও মিছিল সত্ত্বেও এবং রাজনৈতিক ভাবে কোণঠাসা ও দিশাহীন মুখ্যমন্ত্রীর বিভ্রান্তিমূলক অপপ্রচার সত্ত্বেও সাধারণ রাজবংশী ও জনজাতি মানুষ এই আইনকে স্বাগত জানাচ্ছে। গত ৩০ ডিসেম্বর কোচবিহার শহরে ঐতিহাসিক অভিনন্দন মহামিছিল তার সাক্ষ্য বহন করছে।
ইন্দ্রমোহন রাভা
2020-01-14