নাগরিক সংশোধনী আইন এবং বুদ্ধিজীবী সমাজ

নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরোধিতায় মুসলমান সম্প্রদায়ের একটা বিরাট অংশ যে হিংস্রতায় পশ্চিবঙ্গের বিভিন্ন অংশে সপ্তাহ খানেক ধরে রাস্তায় বাসের পর বাস, মোটর সাইকেল এবং ট্রেন জ্বালিয়ে, স্টেশন ভাঙচুর ও অগ্নি সংযোগ করে, তার সঙ্গে রেলের টাকা লুট করে বাধাহীন ভাবে তাণ্ডব চালাল তা দেখে ভয়ে শিউরে উঠতে হয়। ভয় হয় আবার দেশান্তরি হয়ে উদ্বাস্তু হতে হবে না তো! কারণ উত্তরাধিকার সূত্রে আমি যে একজন উদ্বাস্তু। এ কোন বাঙ্গলা আমরা দেখছি। আরও শিউরে উঠেছি দাঙ্গাকারীদের বয়স দেখে। এদের মধ্যে যুবক থেকে শুরু করে বেশ কিছু মধ্যবয়স্ক এবং প্রৌঢ়কে যেমন দেখেছি তেমনি দেখেছি সাত আট বছরের শিশুদের। ভাবলে অবাক হতে হয়, সাত আট বছরের শিশুরাও আজ পশ্চিবঙ্গের নির্দ্বিধায় দাঙ্গায় মেতে উঠেছে।
নাগরিক সংশোধনী আইনের প্রতিবাদে জেহাদি মসলমানদের তাণ্ডব ও সন্ত্রাসের পরিপ্রেক্ষিতে বাঙ্গলার বিদ্বজ্জন ও সুশীল সমাজের কাছে কিছু প্রশ্ন রাখতে চাই। বিদ্বজ্জনেরা বেশ কিছুদিন ধরেই নাগরিক আইনের বিরুদ্ধে যে উচ্চতায় বিরোধিতা করে চলেছেন তার বিন্দুমাত্র বিরোধিতা ও প্রতিবাদ আপনারা এই জেহাদি তাণ্ডবের বিরুদ্ধে করলেন না কেন? কিসের এতো ভয় আপনাদের? তবে কি আপনারা আন্দোলনের নামে এই তাণ্ডব ও বর্বরতাকে সমর্থন করেন? এটাকে কী আপনারা গণতান্ত্রিক আন্দোলন বলে মনে করেন? যে ভাবে কলকাতার পথে স্কুল ফেরত শিশুরা ভয়ার্ত মুখে স্কুল বাসের মধ্য আটকে ছিল। তাদের ভয়ার্ত মুখগুলো কী আপনাদের চোখে পড়েনি? ওইসব শিশুদের বাবা-মায়ের মনের অবস্থা কী আপনারা অনুভব করতে পারেন না? পারেন, নিশ্চয়ই পারেন। আসলে রাজনৈতিক তাবেদারির দায়বদ্ধতায় আপনাদের অনুভবগুলির মৃত্যু হয়েছে। আপনারা জড় পদার্থের আকার নিয়েছেন। রোজনিয়ম করে টেলিভিশনের পর্দায় শান্তির আবেদন না করে তাণ্ডবকারীদের এলাকায় তাণ্ডবকারীদের মধ্যে গিয়ে কেন শান্তির আবেদন করলেন না। শুধু কলকাতায় পদযাত্রা না করে কেন যাচ্ছেন না তাণ্ডববিধ্বস্ত এলাকায়। জানি ওই সব অঞ্চলে যেতে আপনাদের ভয় হয়। কারণ আট থেকে আশির ওইসব দাঙ্গাকারীদের আপনারা জানেন, চেনেন, তাদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে আপনারা ভালোই অবগত, আর সেই কারণেই কালিয়াচক থেকে ধুলাগড়, বসিরহাট থেকে ক্যানিংয়ে হিন্দুদের উপর আক্রমণ হলে। আপনারা শুধু স্থবির হয়ে থেকেছেন। ঘরের মধ্যে থাকাই শ্রেয় মনে করেছেন। স্বার্থের ভয়ে অসাম্প্রদায়িক তকমা রক্ষায় ক্রমাগত মুসলমান তোষণকরে সত্যি বলার অভ্যাসটাই আজ আপনারা হারিয়ে ফেলেছেন।
নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনে পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তানের অত্যাচারিত সংখ্যালঘুদের ভারতবর্ষে আশ্রয় দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। আমার প্রশ্ন, ভারতে আশ্রয় না পেলে তারা কোথায় আশ্রয় পাবে? অবিভক্ত ভারতের তারাও তো বাসিন্দা। দেশ ভাগে ওই মানুষগুলির তো কোনো ভূমিকা ছিল না। ধর্মের ভিত্তিতে দেশ ভাগ না হলে তাদের। জীবনের কি এই করুণ পরিণতি হতো? স্বাধীনতার বলি অত্যাচারিত মানুষদের প্রতি আমাদের কী কোনো দায়বদ্ধতা নেই ? আমাদের ক্ষমতাললুপ নেতারা সেদিন ধর্মান্ধ মুসলমানদের অন্যায় ও আগ্রাসী দাবির কাছে মাথা বিকিয়ে দেশভাগ মেনে নিয়ে লক্ষ লক্ষ অসহায় মানুষকে বিপন্ন করে যে পাপ করেছে। তার প্রায়শ্চিত্ত তো আমাদেরকেই করতে হবে। এবং তা করতে হবে ওই তিন দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ভারতে আশ্রয় দিয়ে, আপন করে কাছে টেনে নিয়ে। পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তানে সংখ্যালঘুরা যে চরম অত্যাচারের শিকার তা কী বুদ্ধিজীবীরা অস্বীকার করতে পারেন? ওই সব দেশের সংখ্যালঘু অত্যাচারের বিরুদ্ধে কোনোদিন একটি বারের জন্য পথে নেমেছেন? একটিও শব্দ উচ্চারণ করেছেন? করেননি। ওসব অন্য দেশের ব্যাপার বলে দায় এড়িয়ে গেছেন। বাংলাদেশের প্রিয়া সাহার আর্তনাদ আপনাদের কানে কী পৌঁছয় না? বাংলাদেশ, পাকিস্তানে হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান-সহ অন্য সংখ্যালঘু মহিলাদের যে ভাবে অপহরণ ও ধর্মান্তরিত করে বলপূর্বক যে মুসলমান যুবকেরা বিয়ে করে চলেছে সেই সংবাদ তো সংবাদমাধ্যমে মাঝে মাঝেই শিরোনাম হয়ে ওঠে।
বুদ্ধিজীবীদের অনেকেরই পশ্চিমবঙ্গের পূর্বপুরুষেরা স্বাধীনতার সময় এবং তার পরে পূর্বপাকিস্তান থেকে উৎখাত হয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে এদেশে পালিয়ে এসেছিলেন। সুতরাং মুসলমানদের প্রধান দেশে সংখ্যালঘুদের অবস্থা ও পরিণতি আপনারা অনেকের থেকে ভালো জানেন। প্যালেস্টানীয়দের জন্য, রোহিঙ্গা মুসলানদের জন্য আপনাদের অন্তর কাঁদবে। কিন্তু পাশের দেশের হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানদের উপর নির্যাতনের বিরদ্ধে আপনারা বোবার মতো নীরব থেকেছেন। এ দ্বিচারিতা কেন? কেন রাজনৈকি দলের আজ্ঞাবহ দাসে পরিণত হয়ে নাগরিক সংশোধনী আইনের অপব্যাখ্যা করে মানুষকে বিভ্রান্ত করে সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টিতে সাহায্য করছেন? মিথ্যাচার থেকে বিরত থাকুন। দয়া করে শরণার্থীদের অবস্থা একটু মানবিক দৃষ্টি দিয়ে দেখুন।
বিদ্বজ্জন যারা বলছেন, এই বিলে কেন মুসলমানদের স্থান দেওয়া হয়নি। তাদের বলতে চাই, যারা ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ করেছে শুধুমাত্র হিন্দুদের থেকে আলাদা থাকার জন্য। তাদের তো আর নতুন করে এ দেশে নাগরিকত্ব দেওয়ার প্রশ্ন নেই। তারা তো ওই দেশগুলিতে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়। তারা হলো অত্যাচারী। ওইসব দেশের অত্যাচারী সংখ্যাগুরু মুসলমানদের স্থান ভারতে হতে পারে না। যারা সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় অস্তিত্বকে মানতে চায় না, স্বীকার করে না। ভারতবর্ষ। কখনও সেই অত্যাচারীদের আশ্রয় নিতে পারে না, ভারতবর্ষ আশ্রয় দেবে কেবল অত্যাচারিতকে এবং পীড়িতকে; অত্যাচারীকে নয়।
শ্রীরাধা কৃষ্ণত্রয়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.