বাঙ্গালির হাত ধরে ওঠা বলিউড চিরকাল বাঙ্গালি বিদ্বেষী

ভারতে চলচ্চিত্রের সূচনা পর্বের দিকে একটু চোখ রাখা যাক। তার আগে বলে নেওয়া যাক একটু বাস্তব চিত্র। বর্তমানে বলিউড বেশ খানিকটা অন্য প্রদেশ বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ বিদ্বেষী। বলতেই পারেন, অনেকেই গিয়ে আজ রাজ করছেন, সেই অতীত থেকে যেমন করে এসেছেন। বাণিজ্যিক ছবির ক্ষেত্রে অগ্রণী পরিবার গাঙ্গুলি পরিবার। অশোক কুমার, কিশোর কুমার থেকে হৃষীকেশ মুখার্জি, শক্তি সামন্ত থেকে বসু চ্যাটার্জি, আবার সুজয় ঘোষ থেকে সুজয় সরকাররাও আছেন এই লিস্টে। বাঙ্গালি অভিনেতার নাম যদি বলা যায়, তাহলে বলা যাবে, বিশ্বজিৎ বা কাজল বা রানি বা রাখি গুলজার এরা তো আছেন। তবে বাঙ্গালিদের একটু ঘেঁষতেনা দেওয়ার বিষয়টা আসছে কোথায় ?

২৪ জুলাই, আমাদের মহানায়ক, উত্তমকুমারের চিরতরে চলে যাওয়ার দিন। এই সময়ে একটু পিছন ফিরে দেখতে ইচ্ছা করছিল, তাই এই কথাটা এল। প্রসঙ্গত, সুশান্ত সিংহ রাজপুতের ঘটনাও এই শব্দটা আসার পিছনে রয়েছে। কেননয়া এই সুশান্ত সিংহ রাজপুতের ১৪ জুন নিজেকে নিজে শেষ করে দেওয়ার পিছনে একটি শব্দ বারে বারে উঠে এসেছে, স্বজন পোষণ, আরেকটি শব্দ অলক্ষ্যে রয়ে গেছে, সেটি হলো বলিউডি নােংরা লবিবাজির রাজনীতি।

ফিরে যাওয়া যাক একটু পিছনে। এখন সামনে যখন আসছে, করণ জোহর, চোপরা পরিবারের নাম। একটা সময়ে এই নামগুলো জায়গায় ছিল কাপুর পরিবারের নাম, সাগর পরিবারের নাম। সেই সময়ে চোপরারা একটু পিছনের সারিতেই ছিল। মধ্যখানে যখন বলিউডে আন্ডার ওয়ার্ল্ডের টাকা বিনিয়োগ হতো তখন আবার দাউদ বা এরকম কোনো দুবাই ভিত্তিক ডনেদের একটা প্রভাব কাজ করত গোেটা হিন্দি ছবির জগতে।

একটু ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে ভারতে চলচ্চিত্রের সূচনা হয়েছিল এই বাঙ্গলা থেকেই। বলা যেতে পারে আমাদের টালিগঞ্জ থেকে। সেই ১৮৯০ সাল থেকে যখন কলকাতার থিয়েটারে বায়োস্কোপ দেখানো হতো। এক দশকের মধ্যেই ইন্ডাস্ট্রির বীজ বপন করেন হীরালাল সেন। তিনি রয়েল বায়োস্কোপ কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করে কলকাতার স্টার থিয়েটার, মিনার্ভাথিয়েটার, ক্লাসিক থিয়েটার ইত্যাদিতে জনপ্রিয় শো দেখাতেন। বেশ অনেকদিন পর সেই অর্থে সিনেমা শিল্পের হাল ধরেন ধীরেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলি। তিনি ইন্দো-ব্রিটিশ ফিল্ম কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন যা বাঙ্গালি মালিকানার প্রথম কোম্পানি (১৯১৮)। প্রথম বাংলা ফিচার ফিল্ম ছিল বিল্বমঙ্গল, যেটি ১৯১৯ সালে ম্যাডন থিয়েটারের ব্যানারে নির্মিত। প্রথম সবাক চলচ্চিত্র নির্মিত হয় ১৯৩০-এর শুরুর দিকে। অবশ্য এর মধ্যেই ১৯১৩ সালে প্রযোজক ও পরিচালক দাদাসাহেব ফালকের হাত ধরে যাত্রা শুরু করে বলিউড। সে বছর ৩ মে তাঁর পরিচালিত প্রথম ভারতীয় ছবি রাজা হরিশ্চন্দ্র মুক্তি পায় করোনেশন সিনেমায়। ছবিটি ছিল নির্বাক। এমনকী কাপুর পরিবারের ছবির জগতে হাতেখড়ি হয়েছিল এক কলকাতায় বাঙ্গালিদের হাত ধরেই। আর সেই অর্থে বাণিজ্যিক হিন্দি ছবির জনপ্রিয়তা সেও ওই কাপুর পরিবারের হাত ধরেই। শোনা যায় এই কাপুর পরিবার ছিল বাঙ্গলা থেকে যাওয়া অভিনেতাদের বিরোধী। অন্যদিকে, এরাই চাল করেন পরিবার ও স্বজনপোষণের বিষয়টা তবে থাক সেকথা। বাজার ধরার প্রতিযোগিতায়, হিন্দিবলয়ের প্রাধান্যের কারণে বাংলা ছায়াছবির সেই অর্থে আটকে যায় আঞ্চলিকতায়। তা সত্ত্বেও বিশ্বজনীন ক্ষেত্রে সুনাম পেতে থাকে নিজেদের কাজের মধ্যে দিয়ে।

ফিরে আসি লবিবাজির কথায়। উদাহরণ হিসাবে মহানায়ক উত্তমকুমারের কথাই আসা যাক। অনেকেই সেই সময়ে বলিউডে কাজ করে ফেলেছেন। তবে লবিতে পড়তে পারেননি বলে কল্কে পাননি। মূলত অনেকেই বলেন সেই সময়ে কাপুরদের প্রভাবে বাঙ্গালিদের জায়গা সংকুচিত হয়ে গিয়েছিল। এমনকী মহানায়ক যখন প্রযোজক হিসাবে এলেন, তার প্রযোজনার জন্য টাকা জোগাড় করতে পারেননি এই লবির জন্য। এমনকী তাঁর রাস্তায় থাকার মতো অবস্থা হয়েছিল। ছিল না খাবার টাকাও। সেই কথা তিনি ব্যক্তিগত চিঠিতে স্ত্রী গৌরীদেবীকেও জানিয়েছিলেন। এমনকী এও বলেছিলেন, খাবার টাকা জোগাড় করার জন্য তিনি অনেকের কাছে কাজের কথাও বলেছেন। কিন্তু কাজ পাননি। কেন পাননি? তাঁর কি অভিনয়যোগ্যতা ছিল না? সে প্রশ্ন তোলা থাক। যখন বাঙ্গলায় মহানায়কের স্বর্ণযুগ, সেই সময়ে যদি লক্ষ্য করা যায় মুম্বাইয়ের একমাত্র শক্তি সামন্ত তাকে নিয়ে দ্বিভাষিক ছবি করেছেন। বলিউডে তাঁর ঝুলিতে সেই অর্থে তিনটি ছবিতে অভিনয় ‘দেশপ্রেমী’, ‘ছোটিসি মুলাকাত’, আর ‘মেরা করম মেরা ধরম। বুঝুন, একজন মহানায়ককে কেমন মানসিক যন্ত্রণার শিকার হতে হয়েছিল। সেই সময়ের একটি সূত্র মারফত সেই লবির একটি ছবি পাওয়া যায়। সঞ্জিবকুমার লবি, চোপরা লবি, কাপুর লবি, আর রাজনৈতিক দিক দিয়ে কংগ্রেস ও দক্ষিণ ভারতীয় লবি। তবে সবছেয়ে বড়ো লবি ছিল, প্রবাসী বাঙ্গালি অভিনেতা লবি। এরা এদের জায়গা যাতে নষ্ট না হয়, সে কারণে সেদিনও বাঙ্গালিদের বলিউডে ঢুকতে বাধা দিয়েছিল। পরবর্তীকালে অবশ্য সেই ধারায় চলে এসেছে সলমন খান লবি, আমীর খান লবি, করণ জোহর লবি সমেত একাধিক লবি। তাই শাহুরুখ খানরা কাজ পায় না সেরকম। এই লেখায় নায়িকাদের কথা বাদ রাখলাম। অন্য কোনো সময় বলা যাবে। এত গেল বলিউডের কথা। টলিউডেও আছে এরকম লবি। তবে সেটা রাজনৈতিক লবি। সেটাও বলা যাবে আরেকটি লেখায়।

সুষমা শ্রীবাস্তব

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.