জ্ঞানের অর্থ জানা। কিন্তু শুধু এটুকুতেই এর অর্থ বােঝানাে যায় না। বাস্তবে জ্ঞানকে অধ্যাত্মের আলােকেই জানতে হয়। জ্ঞান হচ্ছে ব্রহ্মের স্বরূপ— ‘সত্যম্ জ্ঞানমনন্তম্ ব্রহ্ম। ব্রহ্ম সত্যস্বরূপ, জ্ঞানস্বরূপ এবং অনন্ত। এর অর্থ হচ্ছে জ্ঞান অর্থাৎ ব্রহ্মজ্ঞান।।
ব্রহ্ম কী? ব্রহ্ম হচ্ছে তত্ত্ব যা এই সৃষ্টির নিমিত্ত কারণ তথা উপাদান কারণ। নিমিত্ত কারণ হচ্ছে সেই যা সৃষ্টির উৎপত্তিতে কর্তা অথবা স্রষ্টার ভূমিকা পালন করে। ব্রহ্ম সৃষ্টির সৃজনকর্তা। উপাদান কারণ হচ্ছে সেই যার দ্বারা সৃষ্টির সৃজন হয়ে থাকে। ব্রহ্ম থেকেই সৃষ্টির সৃজন হয়ে থাকে। অর্থাৎ সৃষ্টি হচ্ছে ব্রহ্মস্বরূপ। ব্রহ্মকেই আত্মা বা আত্মতত্ত্ব বলা হয়ে থাকে। এক অর্থে । একে পরব্রহ্ম বা পরমাত্মা বলা হয়ে থাকে। সৃষ্টি পরমাত্মার বিশ্বরূপ। তাই পরমাত্মার তথা সৃষ্টির স্বরূপ জানাই হচ্ছে জ্ঞান।
ব্রহ্মের স্বরূপ জানার অর্থ হলাে নিজের স্বরূপকে জানা, কারণ আমরা ব্রহ্ম। ব্রহ্ম নিজে থেকে যে সৃষ্টির সৃজন করেছেন সেই সৃষ্টির আমরাও অঙ্গ। একারণে আমাদের সত্য স্বরূপ ব্রহ্মাই। এই তথ্যের জ্ঞান ব্রহ্মজ্ঞান এবং এটাই হচ্ছে জ্ঞানের পরমার্থ।
যেমন কিনা পরমাত্মার ব্যক্তরূপ সৃষ্টি, সেই প্রকার ব্রহ্মজ্ঞানের ব্যক্তরূপ হচ্ছে সৃষ্টির জ্ঞান।
এই প্রকার জ্ঞানের দুটি দিক আছে—এক হচ্ছে ব্রহ্মজ্ঞান ও অপরটি হলাে সৃষ্টিজ্ঞান। এটি লৌকিক জ্ঞানও বটে। প্রচলিত অর্থে শিক্ষার ক্ষেত্র হচ্ছে লৌকিক জ্ঞান।
পরমাত্মা যখন সৃষ্টিরূপে ব্যক্ত হয়ে থাকে তখন বিবিধ রূপ ধারণ করে থাকে। ঠিক সেই প্রকার জ্ঞানও বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন রূপ পরিগ্রহ করে। কর্মেন্দ্রিয় থেকে যে জ্ঞান হয়ে থাকে তা হলাে কুশলতা। এজন্যই জ্ঞানের একটা স্বরূপ হচ্ছে কুশলতা।
জ্ঞানেন্দ্রিয় থেকে যে জ্ঞান হয় তা হলাে সংবেদন। এজন্যই জ্ঞানের একটা স্বরূপ হলাে সংবেদন। সংবেদনকে অনুভবও বলা হয়ে থাকে।
মন ভাবনা করে থাকে। চিন্তন, মনন, কল্পনা ভাবনার ক্ষেত্র। এজন্যই মনের স্তরে জ্ঞান হল ভাবনা।
বুদ্ধি বিবেক তৈরি করে। বিবেকের অর্থ হচ্ছে যথার্থ জ্ঞান। যথার্থ জ্ঞানের অর্থ হচ্ছে যে যেমন আছে সেই স্বরূপের জ্ঞান। ব্যবহারিক ক্ষেত্রে ঠিক-বেঠিক অথবা উচিত-অনুচিতের জ্ঞানকে বিবেক বলা হয়ে থাকে। পদার্থের ক্ষেত্রে তার গুণাবলীর জ্ঞানকে বিবেক বলা হয়ে থাকে। একে বিজ্ঞানও বলা হয়ে থাকে। এটা হচ্ছে পদার্থবিজ্ঞান বা ভৌত বিজ্ঞান। বিজ্ঞানের এই ক্ষেত্র অনেক বড়।।
বিজ্ঞান মুখ্যত সমস্ত পদার্থের প্রক্রিয়াসমূহের জ্ঞান। লবণ জলে গুলে যায় কিন্তু বালি গুলে যায় না। এই গােলা না গােলার প্রক্রিয়ার জ্ঞানই বিজ্ঞান। জল ওপর থেকে নীচের দিকে প্রবাহিত হয়—এই গুণধর্মের নামই বিজ্ঞান। পঞ্চভূতাত্মক পদার্থসমূহের আচরণ করার প্রক্রিয়ার জ্ঞান হচ্ছে ভৌতবিজ্ঞান। তেমনিভাবে মনের আচরণের বিষয়ে জানা হচ্ছে মনােবিজ্ঞান। আত্মার আচরণকে জানা হচ্ছে আত্মবিজ্ঞান।
বিজ্ঞান হচ্ছে বুদ্ধির ক্ষেত্র। অহংকারের স্তরে জ্ঞানের স্বরূপ হচ্ছে কর্তাভাব। তাই অহংভাবও জ্ঞানেরই স্বরূপ। মনের মধ্যে থাকা সংস্কারও জ্ঞানেরই এক স্বরূপ।
এসব কিছু জ্ঞানের বিভিন্ন স্বরূপ হওয়া সত্ত্বেও জ্ঞান মূলরূপে হচ্ছে ব্রহ্মজ্ঞান। এটা মন ইন্দ্রিয় মন বুদ্ধি ইত্যাদি থেকে সৃষ্ট জ্ঞানের চেয়ে বড়। এটা হচ্ছে অনুভুতির ক্ষেত্র। অনুভূতির স্তরের জ্ঞান হচ্ছে শুদ্ধ জ্ঞান। আর সব হচ্ছে জ্ঞানের বিভিন্ন স্বরূপ। ভৌতিক জগতে বুদ্ধির স্তরের জ্ঞান হচ্ছে শ্রেষ্ঠ স্বরূপের জ্ঞান।
বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন স্বরূপের জ্ঞান লাভ করবার জন্য সেই কারণগুলাের অভ্যাস করতে হয় এবং অভ্যাস দ্বারাই নিজেকে সক্ষম করে তুলতে হয়। জ্ঞানের সঠিক স্বরূপ জানবার পর জ্ঞানার্জন কীভাবে করতে হয়। এটা জানা যায়। লৌকিক জ্ঞান লাভ করবার সব যাত্রাপথ ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করবার দিকে উন্মুখ হলেই সঠিক হয়। ব্রহ্মজ্ঞান পর্যন্ত পৌছানােই সমস্ত লৌকিক জ্ঞানের মুখ্য উদ্দেশ্য।
২. ধর্ম
এই সৃষ্টিতে অসংখ্য পদার্থ রয়েছে। এসব পদার্থই গতিশীল। সকলের ভিন্ন ভিন্ন গতি ও অভিমুখ রয়েছে। পদার্থগুলির চরিত্রও ভিন্ন ভিন্ন। এদের ব্যবহারও ভিন্ন। তথাপি এরা। একে অপরের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় না। পরস্পর বিরােধী স্বভাবের পদার্থ সমূহেরও সহবাস সম্ভব হয়ে থাকে। আমরা দেখতে পাই যে এদের অস্তিত্ব সৃষ্টিতে চলতেই থাকে। এর অর্থ হলাে সৃষ্টিতে কোনাে না কোনাে মহতী শক্তি আছে যা সকল পদার্থকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। সৃষ্টির নিয়ন্ত্রণকারী এই শক্তি সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গেই উৎপন্ন হয়েছে। এই ব্যবস্থা বা শক্তির নাম হলাে ধর্ম। একেনিয়মও বলা হয়ে থাকে। এটা বিশ্বজনীন নিয়ম। এটাই ধর্মের। মূলস্বরূপ। এই ব্যবস্থাই সৃষ্টিকে ধারণ করে থাকে। এজন্যই ধর্মের পরিভাষা হল ‘ধারণাধর্মমিত্যাহুঃ—ধারণ করে থাকে। বলেই একে ধর্ম বলে। এই মূল ধর্মের ভিত্তির ওপর ধর্ম’ শব্দের অনেক ব্যাখ্যা হয়ে থাকে। পদার্থসমূহের স্বভাব বা আচরণকে গুণধর্ম বলা হয়। আগুন উষ্ণ। তাই উষ্ণতা হচ্ছে আগুনের গুণধর্ম। জলের গুণধর্ম হচ্ছে শীতলতা।
প্রাণীসমূহের স্বভাবকে ধর্ম বলা হয়। সিংহ ঘাস খায় না, এটা সিংহের ধর্ম। গােরু ঘাস খায় আবার মাংস খায় না, এটা গােরুর ধর্ম। এই ধর্ম বিশ্বনিয়মেরই একটি দিক। এই প্রকৃতিধর্মের অনুসরণ করেই মানুষও নিজের জীবনের জন্য ব্যবস্থার সৃষ্টি করেছে। এই। ব্যবস্থাকেও ধর্ম বলা হয়ে থাকে। অর্থাৎ সমাজকে ধারণ করবার জন্য যেসব অর্থব্যবস্থা, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা ইত্যাদি হয়ে থাকে তা হচ্ছে ব্যবস্থাধর্ম। এই ধর্মের পালন করাই হচ্ছে নীতি। এই নীতিকেও ধর্ম বলা হয়ে থাকে।।
ব্যক্তির সমাজ জীবনে বিভিন্ন ভূমিকা হয়ে থাকে। কোনাে ব্যক্তি যখন অধ্যয়ন কর্মে লিপ্ত থাকে তখন সে শিক্ষক। ঘরে থাকলে সে পিতা বা পুত্র হয়ে থাকে। বাজারে থাকলে। সে গ্রাহক বা ব্যবসায়ী হয়ে থাকে। এই সব কর্তব্যসমূহকেও ধর্ম বলা হয়। উদাহরণস্বরূপ—পুত্রধর্ম, পিতৃধর্ম, শিক্ষকধর্ম ইত্যাদি।
মানুষের পঞ্চভূতাত্মক জগতের প্রতি, প্রাণী সমূহের প্রতি, বনস্পতি জগতের প্রতি যে কর্তব্য আছে তাকেও ধর্ম বলা হয়ে থাকে।
মানুষের ইষ্টদেবতা, গ্রামদেবতা, কুলদেবতা, রাষ্ট্রদেবতা থাকেন। এসব ধর্মের অনেক প্রকারের আচার হয়ে থাকে। এইসব আচারকে ভিত্তি করে অনেক প্রকার সম্প্রদায় হয়ে থাকে। এই সম্প্রদায়গুলােকেও ধর্ম বলা হয়। সৃষ্টিকে ধারণের জন্য মানুষকে নিজের। মধ্যে অনেক গুণ বিকশিত করবার প্রয়ােজন হয়। একে সগুণ বলে। এই সগুণও হচ্ছে। ধর্মের অঙ্গ। এইজন্য বলা হয়েছে —“ধৃতিমা দমােহস্তেয়ম শৌচমিন্দ্রিয় নিগ্রহঃ। ধীর্বিদ্যা সত্যমক্রোধাে দশক
ধর্ম লক্ষণম্।। (মনুস্মৃতি অধ্যায় ৬)।
এসব আয়ামের মধ্যে ধর্ম ধারণ করার কাজ করে। এসব ধর্মের পালন দ্বারা ব্যক্তির তথা সমষ্টির অভ্যুদয় নিঃশ্রেয় প্রাপ্ত হয়ে থাকে। অভ্যুদয়ের অর্থ হচ্ছে সর্বপ্রকারের ভৌতিক সমৃদ্ধি এবং নিঃশ্রেয়সের অর্থ হচ্ছে পারমার্থিক কল্যাণ।
৩. বৈশ্বিকতা
বৈশ্বিকতা হচ্ছে বর্তমান সময়ের একটি লােকপ্রিয় দৃষ্টিভঙ্গি। সবার সবকিছু বিশ্বমানের চাই। বিশ্বজনীন মাপদণ্ডকে শ্রেষ্ঠ মাপদণ্ড বলে মান্য করা হয়। লােকে বলে থাকে যে, সঞ্চার মাধ্যমের প্রতাপে বিশ্বের যে কোনাে কোণায় কখন কী হচ্ছে তা দেখতে পারি তা জানতে পারি ও তার সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে পারি। দ্রুতগতিসম্পন্ন যানের কারণে আমরা বিশ্বের যে কোনাে প্রান্তে চব্বিশ ঘণ্টর মধ্যে পৌঁছে যেতে পারি। যে কোনাে জিনিস যে কোনাে জায়গায় পাঠাতে চাইলে বা কোনাে জিনিস আনাতে চাইলে তা সম্ভবপর হয়ে গেছে। বিশ্ব এখন টিভির পর্দায় আর টিভি এখন বৈঠকখানায় কিংবা শয়নকক্ষে ঢুকে পড়েছে। এটা কেবলমাত্র জানবার বিষয় নয়। একদেশ এখন অন্য দেশের এত কাছাকাছি এসে গেছে যে তারা একে অপরের দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে পারে
। বিশ্ব এখন একটা গ্রামের রূপ নিয়েছে। একারণে এখন বিশ্ব সংস্কৃতির কথাই বলা দরকার। এখন দেশ নয়, বিশ্ব নাগরিকতার কথাই বলা দরকার।
এখন দেশের কথা বলা সংকীর্ণতার পরিচয় দেয়। শিক্ষার প্রাক-প্রাথমিক থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত বিশ্বমানের সংস্থান খুলে গেছে। বহুজাতিক সংস্থাসমূহ ব্যবস্থা করতে শুরু করেছে। ভৌতিক পদার্থ থেকে নিয়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্য পর্যন্ত বিষয়গুলাের জন্য বিশ্বস্তরের মাপদণ্ড স্থাপিত হয়ে গেছে। মানুষ চাকুরি ও ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য এক দেশে থেকে অন্য দেশে সহজেই যাতায়াত করছে। এখন বিশ্বভাষা, বিশ্ব সংস্কৃতি, বিশ্ব। নাগরিকতার কথা বলা হচ্ছে।
ভারতে বিশ্বায়নের আকর্ষণ একটু বেশি মাত্রাতেই দেখা যায়। ভাষা থেকে শুরু করে
সম্পূর্ণ জীবনশৈলীতে অভারতীয়তার ছাপ দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। একারণে এ বিষয়ে একটু স্পষ্টীকরণ প্রয়ােজন।
এই বিশ্বায়নের মূল কোথায় তা জানা খুব দরকার। পাঁচশাে বছর আগে ইয়ােরােপীয় দেশগুলাে বিশ্বযাত্রা শুরু করে। বিশ্বের পূর্বাঞ্চলীয় দেশগুলাের সমৃদ্ধির প্রতি তাদের আকর্ষণ ছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীতে য়ুরােপে তথাকথিত শিল্পবিপ্লব হয়েছিল। এতে বিভিন্ন যন্ত্রের আবিষ্কার হলাে; বড়ো বড়ো কারখানায় বিপুল পরিমাণে উৎপাদন হতে শুরু করল। এসব উৎপাদনের জন্য ওই দেশগুলাের বাজারের প্রয়ােজন হয়ে পড়ল। তারও আগে য়ুরােপীয় আমেরিকায় নিজেদের উপনিবেশ স্থাপিত করল। অষ্টাদশ শতাব্দীতে আমেরিকা স্বাধীন দেশে পরিণত হলাে। এরপর আফ্রিকা ও এশিয়ার দেশগুলােতে বাজার স্থাপন করার কাজ আরও দ্রুতগতি লাভ করল। সপ্তদশ শতাব্দীতে ভারতে ব্রিটিশ রাজ স্থাপিত হতে শুরু করে। ব্রিটিশদের মুখ্য উদ্দেশ্যই ছিল ভারতের সমৃদ্ধি লুণ্ঠন করা। একারণে ভারতে লুট ও অত্যাচার চলেছিল।
পশ্চিমের চিন্তাভাবনা অর্থনিষ্ঠ ছিল। আজও তাই আছে। একারণে পশ্চিমকে এখন সমগ্র বিশ্বে আর্থিক সাম্রাজ্য বিস্তার করতে হচ্ছে। আর এই উদ্দেশ্যেই বিশ্বায়নের পরিকল্পনা হয়ে চলেছে। বহুজাতিক সংস্থাগুলাে, আন্তর্জাতিক মুদ্রাভাণ্ডার, বিশ্বব্যাঙ্ক ইত্যাদি হচ্ছে এই পরিকল্পনার উপকরণ। বিজ্ঞাপন, প্রতিশ্রুতি, বিশ্ব বাণিজ্য সংগঠন ইত্যাদি হচ্ছে এর মাধ্যম।
ভারতে বিশ্বায়নের খুব আকর্ষণ আছে। কিন্তু আজ যে বিশ্বায়নের প্রচার চলছে তা হচ্ছে আর্থিক, অপর দিকে ভারতের বিশ্বায়ন হচ্ছে সাংস্কৃতিক। এই পার্থক্য আমাদের বােঝা দরকার। ভারতও প্রাচীনকাল থেকে অবিরাম বিশ্বভ্রমণ করেছে। ভারত নিজের সঙ্গে জ্ঞান ও কারিগরি বিদ্যা ও কলা নিয়ে গেছে। বিশ্বের দেশগুলােকে তারা কলা কৌশলের বিদ্যা শিখিয়েছে। বিশ্বের প্রত্যেক দেশে আজও ভারতীয় সংস্কৃতির চিহ্ন পাওয়া যায়। যেখানে যেখানে পশ্চিমের লােকেরা গিয়েছে সেখানে সেখানে নিজের সঙ্গে গােলামি, অত্যাচার, ধর্মান্তরণ ও লুটের বিভীষিকা নিয়ে গিয়েছে।
কিন্তু ভারত যেখানেই গিয়েছে সে নিজের সঙ্গে জ্ঞান সংস্কার ও বিদ্যা নিয়ে গিয়েছে। ভারতের বিশ্বায়নের সূত্র হলাে—কৃন্তো বিশ্বমাৰ্য, অর্থাৎ বিশ্বকে আর্যে পরিণত করা। আর্য অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ করে তােলা। ‘উদারচরিতানাং তু বসুধৈব কুটুম্বক’ যার হৃদয় উদার, সমগ্র বিশ্বই তার আত্মীয়। বসুন্ধরায় কেবল মানুষেরইনয়, চরাচর সৃষ্টির সমাবেশ হয়ে থাকে। সর্বে ভবন্তু সুখিনঃ, সর্বেসন্তু নিরাময়াঃ। অর্থাৎ সবাই সুখী হােক সবাই নিরাময় হােক। এইসবের মধ্যে কেবল ভারতীয়ই নয় বিশ্ব চরাচর সৃষ্টির সাথে পুরাে বিশ্ব রয়েছে। এর তাৎপর্য হলাে এই যে, ভারতের চিন্তাধারায় সর্বদাই বিশ্বায়ন রয়েছে। ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি অর্থনিষ্ঠনয়, বরং ধর্মনিষ্ঠ, আর তাই ভারতের বিশ্বায়নও হচ্ছে সংস্কৃতিক।
আজ অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁচেছে যে ভারত আর্থিক বিশ্বায়নে ফেঁসে গিয়েছে। পশ্চিমের এই আর্থিক বিশ্বায়ন বিশ্বকে নিজের বাজারে পরিণত করতে চাইছে। কিন্তু যারা অর্থনিষ্ঠ তৈরি করে তারা অনাত্মীয় ব্যবহার করে থাকে। ভারতের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরা বলেছেন যে, ‘অর্থাতুরাণাংন গুরুর্ন বন্ধুঃ—যে অর্থের পেছনে ছােটে তার না থাকে গুরু না থাকে বন্ধু। এমন অনাত্মীয় সম্বন্ধের মাধ্যমে প্রতিযােগিতা, হিংসা, সংঘর্ষ ও বিনাশই ছড়াতে পারে। পশ্চিমি দেশসমূহের অর্থনিষ্ঠা তাদেরও বিনাশের দিকে নিয়ে চলেছে। আমরাও যদি তাদেরই অনুসরণ করি তাহলে আমাদের পরিণতিও বিনাশই হবে।
পশ্চিমের বিশ্বায়ন ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থাকেও গ্রাস করে ফেলেছে। পশ্চিমি সভ্যতা শিক্ষাকে একটি শিল্পে পরিণত করে তার একটি বাজার তৈরি করে ফেলেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ও একটি কারখানায় পরিণত হয়েছে। আমরা সকলে শিক্ষার বাজারে শামিল হয়েছি। বিশ্বায়নের ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়েছি। শিক্ষাই আমাদের অস্বাভাবিক এই বশ্যতার হাত থেকে রক্ষা করতে পারে। এটা বিচার করে বিশ্বায়ন ও শিক্ষা এই দুইয়ের সম্বন্ধে পুনর্বিচারের প্রয়ােজন হয়ে পড়েছে। বিশ্বকেও বাঁচাতে হলে ভারতীয় সাংস্কৃতিক
বিশ্বায়নেরই প্রয়ােজন পড়বে।
৪. রাষ্ট্র
রাষ্ট্র হচ্ছে একটি সাংস্কৃতিক পরিকল্পনা। আমরা পশ্চিমি বিচার প্রণালীর প্রভাবে পড়ে রাষ্ট্রকেই দেশ বলে থাকি এবং তাকে রাজনৈতিক ও ভৌগােলিক একক রূপেই দেখে থাকি। রাষ্ট্রমূলত জীবন দর্শনকেই বলা হয়ে থাকে। জীবনদর্শন একজন নাগরিকেরই হয়ে থাকে। জগতে ভিন্ন ভিন্ন নাগরিক বা অধিবাসীর ভিন্ন ভিন্ন জীবনদর্শন রয়েছে। জীবন ও জগৎকে বােঝার বৈশিষ্টকে ওই অধিবাসীদের জীবনদর্শন বলা হয়ে থাকে। কখনও কখনও লােকে বলে থাকে সৃষ্টি তাে একই আছে যেমনকার তেমন, একে বুঝবার পদ্ধতি ভিন্ন ভিন্ন কী করে হতে পারে ? সেইভাবেই জীবনও যেমনকার তেমনই রয়েছে, জনগণ তা ভিন্ন কীভাবে দেখতে পায়?তর্কের দৃষ্টিতে প্রশ্ন যদিও-বা ঠিক কিন্তু বাস্তবিকতার দৃষ্টিতে জনসাধারণের দর্শন ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে এটা সত্যি। উদাহরণস্বরূপ, ভারতের অধিবাসীগণ জন্ম জন্মান্তরকে স্বীকার করে এবং অনেক জন্মের মাঝে জীবন একই হয়ে থাকে এই তথ্যে বিশ্বাস করে। যখন কিনা য়ুরােপের খ্রিস্টানরা জন্মান্তরে বিশ্বাস করে না। চরাচর সৃষ্টিতে একটি মূলগত ঐক্য রয়েছে—ভারতীয়রা এমনটা মানে, যখন কিনা য়ুরােপীয়রা ভিন্নতায় বিশ্বাস করে থাকে। অর্থাৎ জনগণের জীবন ও জগৎকে বােঝার দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। এই ভিন্নতায় রাষ্ট্র একে অপরের থেকে পৃথক হয়ে থাকে।
ভৌগােলিক দৃষ্টিতে যা কিছু একে অপরের থেকে পৃথক তাকে মহাদ্বীপ তথা দেশ বলা হয়ে থাকে। সমুদ্রসমূহের কারণে যে ভূভাগ একে অপরের থেকে পৃথক হয় তাকে মহাদ্বীপ, আর পর্বত দ্বারা যারা বিভক্ত হয় তাদের দেশ বলে। উদাহরণ স্বরূপ, অস্ট্রেলিয়া হলাে একটি মহাদেশ, অপর দিকে ভারত হচ্ছে একটি দেশ। এটা তার। ভৌগােলিক পরিচয়। ভারত হলাে একটি সার্বভৌম গণতান্ত্রিক দেশ। এটা তার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয়। এই পরিচয় তাকে রাষ্ট্রে পরিণত করে। রাষ্ট্রের রূপে এটা হচ্ছে একটা ভূসাংস্কৃতিক সত্তা।
এর অর্থ হচ্ছে ভারতের ভূভাগ, ভারতের অধিবাসী এবং ওই অধিবাসীদের জীবনদর্শন মিলে রাষ্ট্র নির্মাণ হয়ে থাকে। এতে ভূভাগ কম-বেশি হয়ে থাকে। ভারতের ভূভাগ একসময় ইরান ও ইরাক পর্যন্ত ছিল। আজ তা জম্মু কাশ্মীর ও পাঞ্জাব পর্যন্ত রয়েছে। একটা সময় ছিল যখন ভারতে মুসলমান ও খ্রিস্টান সম্প্রদায় ছিল না, কিন্তু আজ আছে। এতে ভারতের রাষ্ট্রীয়তাতে কোনাে পার্থক্য বা ভেদাভেদ নেই। যতদিন জীবনদর্শন লুপ্ত না হচ্ছে ততদিন তা বজায় থাকে। যখন জীবনদর্শন ও তার অনুসরণে নির্মিত সংস্কৃতি বদলে যায় তখন ভূভাগ থাকলেও রাষ্ট্র থাকে না। উদাহরণস্বরূপ, বর্তমান ইজরায়েল ১৯৪৮ সালে পৃথিবার মানচিত্রে ভূভাগ রূপে আত্মপ্রকাশ করে। এর আগে দু’হাজার বছর পর্যন্ত তাদের অধিবাসী ও জীবনদর্শন ছিল কিন্তু ভূভাগ ছিল না। তাদের রাষ্ট্র ছিল কিন্তু দেশ ছিল না। আজ গ্রিস তথা রােমের ভূভাগ রূপে আছে। কিন্তু প্রাচীনকালে যে রাষ্ট্র ছিল। তা এখন আর নেই।
প্রত্যেক রাষ্ট্রের নিজস্ব একটা স্বভাব থাকে যা জন্ম থেকেই প্রাপ্ত হয়। এই স্বভাবই তার পরিচয় হয়ে থাকে। আমাদের জটিলতা হচ্ছে ,এই যে আমরা রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সত্তাকে একই ভেবে থাকি। আমাদের রাজনৈতিক সত্তাই জানা আছে, সাংস্কৃতিকনয়। কিন্তু যুগে যুগে যা টিকে থাকে তা হচ্ছে সাংস্কৃতিক সত্তা। রাজনৈতিক বা ভৌগােলিক নয়। ভারতকে একটি রাষ্ট্ররূপে রক্ষা করাই এখনকার অধিবাসীদের সর্বাধিক গুরত্বপূর্ণ। রাষ্ট্র হচ্ছে এমন একটা ভৌগােলিক সীমা যেখানে অধিবাসীদের তার জন্য মাতৃ স্নেহ থাকবে। এটাই হচ্ছে। অধিবাসীদের মাতৃভূমি। এটাও সাংস্কৃতিক পরিচয়ই বটে।
৫. বৈজ্ঞানিকতা বিশ্বায়নের মতােই বুদ্ধিজীবীদের জন্য বৈজ্ঞানিকতা হচ্ছে একটি লােভনীয় পরিকল্পনা। সবকিছুই বৈজ্ঞানিক হওয়া চাই। যা কিছু প্রক্রিয়া, পদ্ধতি, পদার্থ, বৈজ্ঞানিক নয়, তা পরিত্যাজ্য। বুদ্ধিজীবীদের অনুসরণ করে সাধারণ মানুষও বৈজ্ঞানিকতার অজুহাত দিয়ে থাকে।
কিন্তু এই বৈজ্ঞানিকতা কী? আজ যাকে বিজ্ঞান বলা হচ্ছে তা হচ্ছে ভৌত বিজ্ঞান। ভৌতবিজ্ঞানের পরীক্ষাগারে যা পরীক্ষা করা হয় তাই হচ্ছে বৈজ্ঞানিক। এই ফলাফলে যদি আমাদের উৎসব, বিধিবিধান, রীতিনীতি, অনুষ্ঠান প্রমাণিত না হয় তবে তা অবৈজ্ঞানিক। তাই পরিত্যাজ্য। তা অন্ধবিশ্বাস বলে প্রতিপাদিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, আমাদের পারস্পরিক যজ্ঞগুলােতে ঘিয়ের অপচয় হয়। কোনাে গবিীব মানুষকে ঘি খাওয়ানাে বরং এর চেয়ে উৎকৃষ্টতর এমনটা বলা হয়ে থাকে। শিখা রাখা মুখতা অথবা অপ্রাসঙ্গিক এমন বলা হয়ে থাকে। এমন শত শত উদাহরণ আছে। এর মধ্যে অনেক অপূর্ণতা আছে এটা বােঝা দরকার। বিশ্বে। শুধুমাত্র ভৌতিক পদার্থই নেই, ভৌতিকতার উধ্বে অনেক বড়াে বিশ্ব রয়েছে। সেটা হচ্ছে। মন ও বুদ্ধির জগৎ যা ভৌতিক জগৎ থেকে সূক্ষ্ম। সূক্ষ্ম বলতে লঘু বােঝায় না। সূক্ষ্ম । বলতে অধিক ব্যাপক ও অধিক প্রভাবশালী বােঝানাে হচ্ছে। মন ও বুদ্ধির বিশ্ব ভৌতিক। বিশ্ব অপেক্ষা অধিক ব্যাপক ও অধিক প্রভাবী হয়ে থাকে। সমস্যা হচ্ছে এই যে আজকের বিজ্ঞান মন ও বুদ্ধির বিশ্বেও ভৌতিক বিশ্বের নিয়মাবলী প্রয়ােগ করে থাকে। মনােবিজ্ঞানের পরীক্ষা ভৌতিক বিজ্ঞানের ফলাফলের ওপর নির্মিত হতে তাে আমরা দেখেইছি। এটা তাে উলটো কথা। ভাবনা, ইচ্ছা, বিচার, কল্পনা, সৃজন ইত্যাদির বিশ্ব ভৌতিক বিজ্ঞানের মাপদণ্ডের থেকে অনেক ওপরে হয়ে থাকে।
একারণে আজকের বৌদ্ধিক বিশ্বের বিজ্ঞান ও বৈজ্ঞানিকতা অনেকটাই অসম্পূর্ণ। এটা কেবল অন্নময় ও প্রাণময় কোষেতেই প্রয়ােগ করা যেতে পারে। মনােময়, বিজ্ঞানময়। ও আনন্দময় কোষের ক্ষেত্রে এই ফলাফল অনেকটা খাটো হয়ে পড়ে।
ভারতেও বিজ্ঞান সভা আছে। এটা অনেক প্রতিষ্ঠিতও বটে। ভারতে বৈজ্ঞানিকতার অর্থ হচ্ছে শাস্ত্রীয়তা। শাস্ত্রসমূহের আধার অনুভূতির হয়ে থাকে। শাস্ত্র হচ্ছে আত্মনিষ্ঠ বুদ্ধির আবিষ্কার। একারণে শাস্ত্র প্রামাণ্যের প্রতিষ্ঠা রয়েছে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন— “যঃ শাস্ত্রবিধিমুৎসৃজ্য বৰ্ততে কামকারতঃ।।
স সিদ্ধিমবাপ্নোতি ন সুখ ন পরাম
গতিম্।। গীতা-১৬/২৩।
অর্থাৎ যে শাস্ত্রের নির্দেশ উপেক্ষা করে স্বৈর আচরণ করে থাকে তার সুখ সিদ্ধি কিংবা পরমগতি প্রাপ্ত হয় না।
তিনি আরও বলছেন—“তস্মাচ্ছাস্ত্রম্ প্রমাণম্ তে কার্যাকার্যব্যবস্থিতৌ। ১৬/২৪।
অর্থাৎ কী করা দরকার আর কী না করা দরকার এমন প্রশ্ন উঠলে তােমার জন্য শাস্ত্রই হচ্ছে প্রমাণ।
শাস্ত্র অর্থাৎ বিজ্ঞান। তাৎপর্য হচ্ছে এই যে, বৈজ্ঞানিকতা তাে ভারতেও প্রতিষ্ঠা রয়েছে। ওটা শুধু ভৌতবিজ্ঞানই নয়, বরং আত্মবিজ্ঞানের আলােক রচিত মন ও বুদ্ধির বিশ্বকেও ধারণ করবার বিজ্ঞানের বৈজ্ঞানিকতা। ইউরােপেও সাইন্সের অর্থ হচ্ছে শাস্ত্রীয়তা। আজ আমরা তাকে কেবল সংকুচিত করে ফেলেছি।
ভারতের বৌদ্ধিক জগতের এই দায়িত্ব হচ্ছে বৈজ্ঞানিক অন্ধ শ্রদ্ধাকে দূর করে বিজ্ঞান ও বৈজ্ঞানিকতাকে সঠিক অর্থে প্রকাশিত করা।
ইন্দুমতী কাটদরে
(ক্রমশঃ)
2020-08-31