ভারতবর্ষে রামচন্দ্রের বিকাশ ও নবনির্মাণ

অনেক ধ্বংস, অন্যায়, আক্রমণ, লুণ্ঠন, ধর্মান্ধতা পার হয়ে এই নির্মাণ-সূচনা একটি গণ-সংগ্রামের পরিণতি। নতন ভারতের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হলাে— এরপর তা নব নব নির্মাণের দিকে দুরন্ত গতিতে অগ্রসর হবে। একে প্রতিরােধ করার শক্তি পৃথিবীতে কোনাে লুণ্ঠনজীবী রাক্ষসের নেই।

‘রামায়ণ’ নিয়ে বহু মিথ্যা ধারণা প্রচারিত হয়েছে। বঙ্গদেশে রামায়ণ সম্পর্কে নাকি আপত্তি আছে! বাঙ্গালি কৃষ্ণোপাসক। ‘কানু ছাড়া গীত নাই’। সম্পূর্ণ ভুল কথা। মহাকবি কত্তিবাস তবে কোন দেশের কবি? শুধু কৃত্তিবাস নন, বাংলা ভাষায়। অজস্র কবি রামায়ণ অনুবাদ করেছেন। তাদের একটি অসম্পূর্ণ তালিকা দিলাম : কৃত্তিবাস (পঞ্চদশ শতাব্দী), নিত্যানন্দ, ‘অদ্ভুত রামায়ণ (সপ্তদশ শতাব্দী), শিবানন্দ সেন, ফকিররাম কবিভূষণ, ভবানীশঙ্কর, কবিচন্দ্র শঙ্কর চক্রবর্তী, জগদরাম রায় (সবাই অষ্টদশ শতাব্দী)। এই পর্যায়ে বিশিষ্ট বঙ্গীয় মহিলা কবি চন্দ্রাবতীর ‘রামায়ণ’ (অষ্টাদশ শতাব্দী)। বঙ্গদেশে সংস্কৃত ভাষায় একাধিক কবি রামায়ণ লিখেছেন। অভিকন্দ রচিত ‘রামচরিত’(৯ম শতাব্দী), সঙ্গ্যাকর নন্দীর ‘রামচরিত (১০ম শতাব্দীতে) রচিত হয়।

যাঁরা ভাবেন, রামায়ণ উত্তর ভারতীয় আধিপত্যের প্রতীক তাদের দুঃখ করার কারণ হতে পারে তথ্যাহরণ করলে। দক্ষিণ ভারতের চারটি প্রধান ভাষাতে রামায়ণ-কথা অত্যন্ত জনপ্রিয়। সেইসব ‘ভাষা রামায়ণ (অর্থাৎ Nernacnlan Ramayana) উত্তর-পূর্ব ও পশ্চিম ভারতের আগে থেকেই প্রচলিত হয়েছে। এ থেকে কী প্রমাণিত হয় ? দক্ষিণ ভারতে রামায়ণ ও তার নায়ক শ্রীরামচন্দ্র একান্ত আত্মীয়ের মতাে। দেখাই

তালিম : ‘কম্বন রামায়ণ’– দশম শতাব্দীর রামায়ণ অনুসারী কাব্য।

কন্নড় : কবি রামচন্দ্র লিখেছিলেন, ‘পম্প রামায়ণ’ (১১০০ খ্রি.), নরহরি ‘কুমাল বাল্মীকি নামে পরিচিত ছিলেন, তিনি লিখেছেন কন্নড় রামায়ণ।

তেলুগু : তেলুগু ভাষাতে ‘ভাস্কর রামায়ণ’ ত্রয়ােদশ-চতুর্দশ শতাব্দীতে রচিত হয়। এর লেখক রঙ্গনাথ। জোল্লা ছিলেন মহিলা কবি। তাঁর রামায়ণ ‘জোল্লা রামায়ণ’অষ্টাদশ শতাব্দীতে অন্ধ ও তেলেঙ্গানা প্রদেশে জনপ্রিয় হয়।

মালায়ালাম : চতুর্দশ শতাব্দীতে ‘রামচরিতম্ রচিত হয়— রামায়ণের যুদ্ধকাণ্ডের অনুবাদ হিসেবে।

কন্নোগা পানিকর লিখেছেন ‘কান্নাগা রামায়ণ’ ষােড়শ শতাব্দীতে। এঝুত্তাক্কানের ‘অধ্যাত্ম রামায়ণ’ও মালয়ালাম ভাষার অন্যতম জনপ্রিয় ষােড়শ-সপ্তদশ শতাব্দীর কবি।

সুতরাং দশম থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যে দক্ষিণ ভারতের সমস্ত ভাষায় রামায়ণ-কথা আদৃত ছিল। দক্ষিণ ভারতের রাক্ষস সভ্যতা ধ্বংস করতে শ্রীরামচন্দ্র অভিযান করেছেন— এই মিথ্যা তর্ক বহু পরবর্তী সময়ের। এর সঙ্গে দ্রাবিড়-মনের, সংস্কৃতির সম্পর্ক নেই।

উত্তর ভারতে রামায়ণ-কথা কীভাবে বিভিন্ন ভাষায় রচিত, অনুদিত নব নব রূপ পরিগ্রহ করেছে তা বলার আগে পূর্ব ও পশ্চিম ভারতের কথা লিখছি।

অসমীয়া : শঙ্করদেব ষােড়শ শতাব্দীতে ‘সপ্তকাণ্ড রামায়ণ’ অনুবাদ করেছিলেন। তিনি ‘রাম বিজয়’ নাটকও লিখেছিলেন। শঙ্করদেবের শিষ্য মাধবদেবও রামায়ণের অংশবিশেষ ষােড়শ শতাব্দীতে রচনা করেন। এর আগে চতুর্দশ শতাব্দীতে মাধবকলী রামায়ণ’ অনুবাদ করেছিলেন। একই শতাব্দীতে দুর্গাবর লিখেছিলেন গীতি রামায়ণ।

উড়িয়া : বলরাম দাস লিখেছিলেন ‘জগমােহন রামায়ণ’। ষােড়শ শতাব্দীর বিশিষ্ট বৈষ্ণব কবি বলরাম দাসের এই কাব্য ‘দণ্ডী রামায়ণ’ নামেও পরিচিত। সরলা দাসের ‘রামায়ণ’দপ্তদশ শতাব্দীতে জনপ্রিয় হয়।

মৈথিলি : চঙ্গুয়া রচিত মৈথিলী ‘রামায়ণ’ ষােড়শ শতাব্দীর শেষ দিকে রচিত হয়।

নেপালি : নেপালি ভাষা রামায়ণের রচয়িতা ভানুভক্ত। তার রামায়ণ ঊনবিংশ শতাব্দীতে রচিত।

পশ্চিম ভারতের দুটি বড়াে ভাষাগােষ্ঠী যথাক্রমে মারাঠী ও গুজরাটি। এই দুই ভাষার রামায়ণ সম্পর্কে প্রাপ্ত তথ্য উপস্থাপন করছি—

মারাঠি : সন্ত কবি একনাথ ষােড়শ শতাব্দীতে লেখেন ‘ভাষাৰ্থ রামায়ণ। এটি একাধিক প্রচলিত রামায়ণ-কথার বিপুল কাব্য। বাল্মীকি রামায়ণ, অধ্যাত্ম রামায়ণ ও আনন্দ রামায়ণ— একত্র করেছেন সন্তকবি একনাথ। সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে (১৬০৮ খ্রি.) রামদাস অনুবাদ করেছেন রামায়ণ।

সপ্তদশ শতাব্দীতে ‘রাম বিজয়’ লিখেছেন শ্রীধর। শ্রীধরের ‘রাম বিজয়’ মহারাষ্ট্রে অত্যন্ত জনপ্রিয়। শ্রীধর মহাভারতের অনুবাদও করেন। এই দুটি গ্রন্থ মহারাষ্ট্রের হিন্দু গৃহস্থের বাড়িতে রক্ষিত থাকে।

গুজরাটি : প্রেমানন্দ সপ্তদশ শতাব্দীতে আর গিরধর অষ্টাদশ শতাব্দীতে রামায়ণ অনুবাদ করেন গুজরাটিতে। গিরধরের রামায়ণের জনপ্রিয়তা অত্যন্ত বেশি।

উত্তর ভারতে কাশ্মীরি ভাষায় রামায়ণ অনুবাদ হয় অষ্টাদশ শতাব্দীতে। করেছিলেন দিবাকর প্রকাশ ভট্ট। এই ‘রামায়ণ’ হর-পার্বতীর কথােপকথনছলে রচিত হয়। সেদিক থেকে এই রামায়ণ আগম শাস্ত্রের অন্তর্গত। আগম হলাে মুণ্ডমাল শব্দ।‘আ’-শিবের মুখ থেকে ‘আ’ গত; গ-পার্বতীর কানে ‘গ’-ত; ‘ম’-বিষ্ণুর সম্মত। এই তিন শব্দ মিলিয়ে ‘আগম’ শব্দ নিষ্পন্ন।

হিন্দি ভাষায় ১৫৭৫-১৫৭৭ খ্রিস্টাব্দে তুলসীদাস ‘রামচরিত মানস’রচনা করেন। এই রচনাভারতের শুধু নয়—পৃথিবীর যেখানেই হিন্দিভাষীরা ছড়িয়ে পড়েছেন, সেখানেই তুলসীদাসের রামায়ণ ও ‘হনুমান চল্লিশা’ জনপ্রিয়।

আরও বহু ভাষায় রামায়ণ কথা অনুদিত হয়েছে। সেসবই প্রমাণ করছে ভারতবর্ষে শ্রীরামচন্দ্রের প্রভাব যুগে যুগে পড়েছে। এই প্রভাবের তুলনা পৃথিবীর অন্য কোনাে সাহিত্যকর্মের নেই। রামকে ঘিরে ভারতবর্ষ জাতীয় জীবনের আদর্শ হিসেবে যা কিছু সত্য,সুন্দর ও মঙ্গল— তা ঘনীভূত হয়েছে।

রামকথার সঙ্গে বেদের দূরত প্রতিধ্বনি পাওয়া গেছে। ঋগ্বেদের বৃত্রাসুরের সঙ্গে ইন্দ্রের দ্বন্দ্ব রামকথায় রাবণের বিরুদ্ধে শ্রীরামচন্দ্রের সংগ্রামের মিল পাওয়া যায়। বৃত্র কৃষিকর্মের জন্য প্রয়ােজনীয় জলস্রোতকে অবরুদ্ধ করেন। সীতা পৃথিবী দুহিতা, পৃথিবীতেই ফিরে যাচ্ছেন। শস্য-সম্পদ হিসেবে এই রূপক রামায়ণে বিধৃত হয়েছে। রাক্ষসরাজ রাবণও এই শস্য সম্পদকে অবরুদ্ধ করছেন। ঋগ্বেদের কাহিনিতে আছে, অবরুদ্ধ গােসম্পদ রক্ষা করেছেন কুকুরী সরমা। রামায়ণে সীতাকে আগলে রেখেছেন সরমা। সুতরাং রামকথাকে যাঁরা বিদেশি কাহিনি বলে মনে করেন তারা ভারতীয় সংস্কৃতিকে ঠিকমতাে বােঝেন না।

ক্রমে রাম-কথা থেকে সাংস্কৃতিক উপকরণের উপর গঙ্গা গােদাবরীর পলি পড়েছে। ভারতের সবখানে ছড়িয়ে পড়েছে শ্রীরামসীতা- লক্ষ্মণ-হনুমানের পদচ্ছাপ। রামায়ণ শব্দটি এসেছে রামের অয়ন বা পর্যটন থেকে। এই পর্যটনে অহল্যাভূমি পত্র-পুষ্পে ফলেশস্যে প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। এক পর্যায়ে রাম-বলরাম একাকার হয়েছেন। রাম ধনুর্ধর, বলরাম হলধর, সীতা কৃষিক্ষেত্রে হলকর্ষণের চিহ্ন, লক্ষ্মণ কৃষিসম্পদ। রাজা জনকও কৃষিকর্ম করতেন। এইসব রূপকের আবরণ থেকে ক্রমে চরিত্রায়ণের স্তরে বিকশিত হলাে রাম-কথা।

দেশ জাতি ক্রমে রাম-কথাকে অবলম্বন করে বিকশিত হতে থাকল। রামের মতাে সন্তান, অগ্রজ, স্বামী, প্রেমিক, বন্ধু, সেনাপতি আর কে? বনবাসী রামচন্দ্র স্ত্রী-সম্মানের জন্য অযােধ্যায় ফিরে যাননি—ভরতের সাহায্য নেওয়া তার পণ রক্ষার পিতৃসত্য পালনে অন্তরায় ছিল। এই ভাবে এক মহৎ ব্যক্তিত্ব—- Person নয়, Personality রামচন্দ্রকে ঘিরে সন্নিবেশিত হয়েছে। দেশের মানুষ যা চায় রামচন্দ্র তারই সুষমামণ্ডিত রূপায়ণ হলাে।রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, রামায়ণ ঘরের কথাকে বড়াে করে ধরেছে। মহাভারতে পারিবারিক দ্বন্দ্বের কুটিল জটিল পর্ব ও পর্বান্তর, রামায়ণে পারিবারিক সংহতির শান্ত রূপায়ণ। ফলে যা ছিল আরণ্যক-সমাজ ভেঙে গ্রাম্যজীবন প্রতিষ্ঠার গল্প তাই হয়েছে নীতিসম্মত পরিবার, একান্নবর্তী বর্ধিষ্ণু জীবনের আকাঙ্ক্ষা ও পরিণতির জীবন মহাকাব্য।।

কবীর দাস, মীরা-সুরদাস, সর্বোপরি তুলসীদাস। এঁদের দোঁহায় ভজনে চৌপাঈতে রাম হলেন ব্রহ্মের প্রতিরূপ। রামনাম করলেই কোটি পাপ থেকে মুক্তির ভাবনা ভারতীয় জীবন-রসায়ণে নতুন অমৃত কণা। কৃত্তিবাসের ‘রামপাঁচালী’তে পেলাম সুবাহুর পালা— তরণী সেন বধের পালা। সুবাহু রামভক্ত। রাক্ষসকুলে জন্ম হলেও তার ভক্তিতে রামচন্দ্র কৃপা প্রদান করছেন, এমন ভাব পরিকল্পনা ‘রামভক্তিবাদ’ প্রতিষ্ঠার ইঙ্গিত বহন করে। তরণী সেন রামের সঙ্গে যুদ্ধ করতে গেছেন সারা শরীরে, রথে, রথের চুড়ায় ‘রাম নাম’ লিখে। মৃত্যুর পরও ‘তরণী সেনের মুণ্ড রাম নাম বলে।

বৌদ্ধ ভাষ্যে রাম-রাবণ যুদ্ধ প্রসঙ্গ অনুপস্থিত। কারও কারও মতে অহিংসা-প্রিয় বৌদ্ধরা এই অংশ পরিহার করেছেন। হিন্দু ভারত কিন্তু মনে করে ঈশ্বর অবতীর্ণ হন ধর্ম রক্ষা ও অধর্ম দূর করার জন্য। ধর্ম রক্ষার জন্য অস্ত্রধারণ অনিবার্য। অধর্মের বিনাশ করতে শ্রীরামচন্দ্র পরাঙ্খ নন। ফলে রামচন্দ্র শুধু ভক্তি নয় শক্তিরও প্রতীক।

মহাকাল অনির্দিষ্ট গতিশীল তরঙ্গ ভঙ্গ ভারতবর্ষকে বিশ্ব সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলছে। আজ আমরা দেখছি রামচন্দ্রকে অবলম্বন করে এই নতুন ভারতের নবজন্ম হচ্ছে। ১৫২৮-২৯খ্রিস্টাব্দে রামের জন্মভূমিতে গড়ে উঠেছিল বাবরের আদেশে সেনাপতি মীর বাঁকির তৈরি ধাঁচাটি। এই মহাকালের মহাবৃত্তে একটি বিন্দুর মতাে অকিঞ্চিৎকর, তুচ্ছ। ভারত ইতিহাসে ভিক্ষুক বেশী লুটেরারা যত চেষ্টাই করুক বারংবার ভেঙে ফেলা ‘সােমনাথ মন্দিরের মতাে সে আবার উঠে আসবে। আসবেই। শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস বলেছিলেন হুমাে পাখির কথা। মাটিতে পড়তে পড়তে যাদের ডিম ফোটে, ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে আবার সূর্যের দিকে উড়ে যায়। সােমনাথ মন্দির উঠে দাঁড়িয়ে প্রমাণ করেছে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি ভস্মাচ্ছাদিত সাধনক্ষেত্র থেকে পুনরুজ্জীবিত হয়। এটাই ভারতের ভবিষ্যৎ।

একই কথা রামজন্মভূমিতে শ্রীরামের ভব্য মন্দির গড়ে ওঠার ইতিহাসে। অনেক ধ্বংস, অন্যায়, আক্রমণ, লুণ্ঠন, ধর্মান্ধতা পার হয়ে এই নির্মাণ-সূচনা একটি গণ-সংগ্রামের পরিণতি। ধ্বংসকে সৃষ্টিতে পরিণত করার অমৃত আমাদের পূর্বপুরুষদের সঞ্চিত ধন। রামচন্দ্র তাকে রক্ষা করেন তিনি ভারতের আত্মমর্যাদার প্রকৃত ধারক। নতুন ভারতের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হলাে— এরপর তা নব নব নির্মাণের দিকে দুরন্ত গতিতে অগ্রসর হবে। একে প্রতিরােধ করার শক্তি পৃথিবীতে কোনাে লুণ্ঠনজীবী রাক্ষসের নেই।

ড. অচিন্ত্য বিশ্বাস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.