ভারতীয় শিক্ষা পরম্পরা বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীনতম এবং শ্রেষ্ঠতম। ভারতের গুরুকুল, আশ্রম, বিদ্যাপীঠ এবং ছােটো ছােটো বিদ্যালয়েই জীবনের সর্বতােমুখী বিকাশ হতাে এবং ব্যক্তির তথা রাষ্ট্রের জীবন সুখ, সমৃদ্ধি, সংস্কার এবং জ্ঞানের দ্বারা পরিপূর্ণ হতাে। সমগ্র বিশ্বও এতে লাভান্বিত হতাে। কিন্তু বণিকরূপে আমাদের দেশে এসে আমাদের শিক্ষার বাণিজিকীকরণ করে তার মূলে কুঠারাঘাত করেছে ইংরেজরা। মেকলে প্রবর্তিত এই ইংরেজ শিক্ষাব্যবস্থার দুপ্রভাবে আজও ভারত জর্জরিত। আজ ভারতে ভালাে শিক্ষাব্যবস্থার চর্চা সর্বত্রই হয় কিন্তু ভারতীয় শিক্ষার চর্চা তেমন কোথাও হয় না। পাশ্চাত্য আজ নিজের দৃষ্টিকে বৈশ্বিক বা গ্লোবাল বলতে শুরু করেছে। এরই প্রভাবে আজও আমরা পাশ্চাত্য দৃষ্টিভঙ্গিকে বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি’ বলছি। কিন্তু বৈশ্বিকতা ভারতবর্ষের মূলভূত আত্মা, যা ‘চিরপুরাতন কিন্তু নিত্য নতুন। পাশ্চাত্য দৃষ্টিভঙ্গির আবরণ উন্মােচন করে যদি আমরা ভারতীয় শিক্ষার পূর্ণ স্বরূপকে বুঝতে পারি এবং সমাজ ও রাষ্ট্রজীবনে এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব সম্পর্কে নিবিড়ভাবে উপলব্ধি করতে পারি তাহলে ভারতীয় পদ্ধতিতে ভারতকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থার পূর্ণ স্বরূপ আমাদের সামনে উদ্ভাসিত হবে।
আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণে সক্ষম হবাে। এর ফলে সমাজহবে স্বনির্ভর, দেশ হবে সমৃদ্ধ, সমাজ মানসিকতা হবে বলিষ্ঠ। আর এই ভারতীয় শিক্ষার পূর্ণ স্বরূপ, তার বিকাশ ও পুনঃপ্রতিষ্ঠা— এই বিষয় নিয়ে নিরন্তর সাধনায় ব্রতী রয়েছেন গুজরাটনিবাসী শ্ৰীমতী ইন্দুমতী কাঠদরে।তিনি গুজরাটের বীসনগরের সিনিয়র কলেজের প্রাক্তন অধ্যাপিকা। তিনি বিদ্যাভারতীর অখিল ভারতীয় মহামন্ত্রী এবং অখিল ভারতীয় বিদ্যুৎ পরিষদের সংযােজক হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। এছাড়াও তিনি প্রজ্ঞাপ্রবাহের কেন্দ্রীয় প্রকোষ্ঠের সদস্যা। ইনি ‘গুরুগৌরব পুরস্কার’, ‘শিক্ষাভূষণ পুরস্কার ছাড়াও বহু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। বর্তমানে ইনিপুনরুত্থান বিদ্যাপীঠ’-এর কুলপতি হিসেবে ক্রিয়ারত রয়েছেন। পুনরুত্থান বিদ্যাপীঠ শিক্ষার ভারতীয়করণ করার কাজ করে চলেছে এবং এই নিরিখে ভারতীয় শিক্ষা বিষয়ক অধ্যয়ন, অনুসন্ধান, সাহিত্য নির্মাণ, আলােচনা প্রভৃতি করে থাকে। শ্রীমতী কাটদরে ভারতীয় শিক্ষা নিয়ে গবেষণা করেছেন। ভারতীয় সংস্কার, সমাজপদ্ধতি, জীবনযাপনশৈলী নিয়ে বহু গ্রন্থ প্রণয়ন করেছেন এবং সম্পাদনার কাজ করে চলেছেন। ভারতীয় শিক্ষা নিয়ে তার আকরগ্রন্থ‘ভারতীয় শিক্ষা গ্রন্থমালা’ ৫টি খণ্ডে ইতিমধ্যেই হিন্দিতে প্রকাশিত হয়েছে। এগুলি হলাে—(১) ভারতীয় শিক্ষা : ‘সংকল্পনা ও স্বরূপ, (২) শিক্ষা বা সমগ্র বিকাশ প্রতিমান’, (৩) ভারতীয় শিক্ষা বা ব্যবহারিক আয়াস’, (৪) পশ্চিমিকরণ সে ভারতীয় শিক্ষা কী মুক্তি’ এবং (৫)‘বৈশ্বিক সংকটো কা নিবারণ ভারতীয় শিক্ষা। ভারতীয় মূল্যবােধের উপর আধারিত জাতীয় শিক্ষানীতি (National Education Policy) ও পাঠ্যক্রম (Curriculum) কী হওয়া উচিত তার সুস্পষ্ট রূপরেখা এই গ্রন্থগুলিতে তুলে ধরা হয়েছে। শ্রীমতী কাটদরের ‘ভারতীয় শিক্ষা গ্রন্থমালা বাংলা ভাষায় ‘স্বস্তিকার এই সংখ্যা থেকে ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হচ্ছে।
স্ব: স:
এই বিশ্বে অনেক রাষ্ট্র আছে এবং প্রত্যেক রাষ্ট্রেরই নিজ নিজ স্বভাব রয়েছে। রাষ্ট্রের স্বভাব অনুযায়ী তার স্বধর্ম রচিত হয়। স্বভাব ও স্বধর্ম অনুযায়ী প্রত্যেক রাষ্ট্রের জীবন ও জগৎকে দেখা নিজ নিজ দৃষ্টি রয়েছে। ওই দৃষ্টি অনুযায়ী প্রত্যেক রাষ্ট্রের জীবনশৈলী বিকশিত হয়, জনগণের মানসিকতা তৈরি হয়, ব্যবহার নিরূপিত হয়, ওই ব্যবহারের অনুরূপ ও অনুকূল ব্যবস্থাসমূহ রচিত হয় এবং জীবন চালিত হয়।
ভারতও একটি রাষ্ট্র। তার নিজস্ব জীবনদৃষ্টি আছে। একে ভিত্তি করেই তার জীবনশৈলী বিকশিত হয়েছে। সেই অনুসারে তার জীবন যুগ যুগ ধরে আসছে।
রাষ্ট্রের শিক্ষা এই জীবনদৃষ্টি অনুসারেই হয়ে থাকে। এরূপ হওয়ার কারণে শিক্ষা জীবনদৃষ্টিকে পুষ্টও করে থাকে। এজন্য শিক্ষার বিচার করার সময় জীবনদৃষ্টিরও বিচার করা আবশ্যক।
ভারতীয় জীবনদৃষ্টির প্রধান বিষয়গুলাে এরকম :
জীবন এক অখণ্ড :
ভারতের দৃষ্টি সর্বদাই সমগ্রতার ওপর প্রতিষ্ঠিত। যে কোনাে ঘটনা বা স্থিতির বিষয়ে খণ্ড খণ্ড করে বিচার না করাই ভারতের স্বভাব। জীবনকেও ভারত এক ও অখণ্ড মনে করে। ভারত জন্মান্তরবাদে বিশ্বাসী। জন্মের সঙ্গে জীবনের আরম্ভ হয় না, মৃত্যুর সঙ্গে এর অন্তও হয় না। একের পর অন্য জন্মের জীবন অখণ্ডভাবে চলতে থাকে। এক জন্ম ও অপর জন্মের জীবন পৃথক হয় না। অনেক জন্মে ওটা একই থাকে। কেবল জন্ম-জমান্তরেই নয়, জগতে দৃশ্যমান অসংখ্য পদার্থেও জীবন একই থাকে। এর অর্থ হলাে এক জন্মের পরিণাম অন্য জন্মের ওপর পড়ে থাকে। আমাদের এই জন্মের জীবন পূর্ব জন্মের পরিণাম এবং এই জন্মের পরিণামস্বরূপ আগামী জন্ম হতে যাচ্ছে। এর মধ্যে কর্ম, কর্মফল ও ভাগ্যের কর্মসিদ্ধান্ত তৈরি হয়। এই সিদ্ধান্ত বলছে যে, আমরা যে কর্ম করি তার ফল ভােগ করতেই হয়। কিছু কর্মের ফল তাৎক্ষণিক তাে কিছু কর্মের ফল কিছু সময় পরে ভােগ করতে হয়। যতক্ষণ তা ভােগ না করা হচ্ছে ততক্ষণ তা সংস্কাররূপে সঞ্চিত থাকে আর চিত্তে সংগৃহীত হতে থাকে। এই জন্মে ভােগ না করলে আগামী জন্মে তা ভােগ করতে হয়। কর্মফল ভােগ করতে করতে নতুন কর্ম তৈরি হতে থাকে। কর্মের ভিত্তিতে পুনর্জন্ম হয়ে থাকে। কর্মের ভিত্তির ওপর জীবনভর কেমন ভােগ হবে তা নিশ্চিত হয়। কর্মসিদ্ধান্তের সঙ্গেই শ্রীমদ্ভগবদগীতা দ্বারা প্রতিপাদিত নিষ্কাম কর্ম, কর্মফলের অপেক্ষা ছেড়ে দিয়ে মুক্তির সিদ্ধান্তও বােঝা যায়। জীবনের গতিবিধিসমূহকে বােঝাবার এই জন্ম হচ্ছে পুনর্জন্মের সিদ্ধান্ত যা ভারতীয় জীবনদৃষ্টির এক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত।।
এই জগৎ অসংখ্য পদার্থ ও জীবের সঙ্গে যুক্ত। এসব কিছু নিজের মূল রূপে এক, কেননা তা একই আত্মতত্ত্বের বিস্তার। যেমন গম দ্বারা প্রস্তুত সব পদার্থেই মূল তত্ত্ব গম, যেমন সােনা দ্বারা প্রস্তুত সব অলংকারের মধ্যে মূল বস্তু সােনা একই থাকে, ঠিক সেভাবেই জগতে দৃশ্যমান অসংখ্য পদার্থে মূলতত্ত্ব একই থাকে। একথা বুঝেই ভারতীয় জীবনব্যবস্থা রচিত হয়েছে।
জগৎ পরমাত্মার বিশ্বরূপ :
ভারতীয় চিন্তাধারায় জীবনের মূল । তত্ত্বকে অনেক নামে বলা হয়েছে। কোথাও ব্রহ্ম, কোথাও পরব্রহ্ম, কোথাও আত্মা, কোথাও পরমাত্মা, কোথাও ঈশ্বব, কোথাও পরমেশ্বর, কোথাও পরম চৈতন্য, কোথাও জগৎনিয়ন্তা, আবার কোথাও সােজাসুজি ভগবান বলা হয়েছে। যার যেমন মতি তেমনই নাম ওই মূল তত্ত্বকে মনীষীগণ দিয়েছেন। এ বিষয়ে ঋগ্বেদে বলা হয়েছে, ‘এক সৎ বিপ্রাঃ বহুধা বদন্তি’ অর্থাৎ সত্য এক, মনীষীগণ একেই ভিন্ন নাম দিয়ে থাকেন। এই মূল তত্ত্ব অব্যক্ত, অচিন্ত্য, অকল্প, অদৃশ্য, অস্পৃশ্য, অজর, অমর হয়ে থাকে। এই জগৎ অথবা সৃষ্টি সেই অব্যক্ত তত্ত্বেরই ব্যক্ত রূপ। ব্যক্ত রূপ বিবিধতা দ্বারা যুক্ত। এখানে রূপ, রস, স্পর্শ, গন্ধ ইত্যাদির অপরিমিত বিবিধতা রয়েছে। সৃষ্টির প্রত্যেক পদার্থ অন্য পদার্থ থেকে কোনাে না কোনাে রূপে ভিন্ন। কিন্তু দৃশ্যমান ভিন্নতার মধ্যে মূল
তত্ত্বের একত্ব রয়েছে। মূল একত্ব ও দৃশ্যমান ভিন্নতা হচ্ছে একই তত্ত্বের দুই রূপ। এই আধারভূত ধারণার ওপর ভিত্তি করে ভারতীয় জীবনব্যবস্থা তৈরি হয়েছে।
এই সৃষ্টির সমস্ত পদার্থ একাত্ম সম্বন্ধ দ্বারা একে অপরের সঙ্গে যুক্ত। একাত্মতার ব্যবহারিক রূপ হলাে চক্রীয়তা তথা পরস্পর-পরিপূরকতা সমস্ত পদার্থ গতিশীল ও পরিবর্তনশীল। পদার্থসমূহের গতি বৃত্তাকার। এসব কিছু যেখান থেকে আসে আবার সেখানেই ফিরে যায়। এভাবে একটি বৃত্ত পূর্ণ করার পর অন্য বৃত্ত আরম্ভ হয়ে থাকে। সকল পদার্থ যা থেকে তৈরি হয়েছে। পুনরায় তাতে বিলীন হয়ে যায়। গতিশীলতা ও পরিবর্তনশীলতার সঙ্গেই পরম্পরাবলম্বন তথা পরস্পর পূরকতাও সৃষ্টিতে দেখা যায়। এই সব তত্ত্বের কারণে সব এক অপরের পােষক হয়ে থাকে। সব একে অপরের সহায়ক এবং একে অপরের ওপর আধারিত—এই তত্ত্বকে মনে রেখে ভারতের জীবনব্যবস্থা গড়ে উঠেছে।
সৃষ্টিতে দৃশ্যমান অথবা অদৃশ্য অস্তিত্বধারী সকল পদার্থের স্বতন্ত্র সত্তা আছে। এর কোনাে না কোনাে প্রয়ােজন আছে। এই তত্ত্বকে স্বীকার করে ভারতের জীবনশৈলীর বিকাশ হয়েছে। তার স্বতন্ত্র সত্তাকে স্বীকার করা, তার সমাদর করা এবং ওই স্বাতন্ত্রকে রক্ষা করা মানুষের কর্তব্য বলে বর্ণনা করা হয়েছে। মূল অব্যক্ত তত্ত্বের ভাবাত্মক রূপ হচ্ছে প্রেম, সৌন্দর্য, জ্ঞান ও আনন্দ। যেভাবে আত্মতত্ত্ব সৃষ্টির বিবিধতা রূপে ব্যক্ত হয়েছে ঠিক সেই প্রকারেই এসব তত্ত্বও সৃষ্টিতে বিবিধ রূপ ধারণ করে ব্যক্ত হয়েছে। এসব তত্ত্বকে মূল তত্ত্ব মনে করে ভারতীয় জীবনব্যবস্থা রচিত হয়েছে। জগতে যত সম্বন্ধ আছে তার আধারভূত হচ্ছে প্রেম, যত সৃজন ও নির্মাণ আছে তার আধারভূত হচ্ছে সৌন্দর্য, যত রকমের কাজ আছে তার পরিণাম হচ্ছে আনন্দ এবং যতরকম অনুভব আছে তার আধারভূত তত্ত্ব হচ্ছে জ্ঞান। সর্বত্র এই তত্ত্ব সমূহের অনুভব করাই হচ্ছে জীবনকে জানা।
এর উদাহরণ আমাদের সর্বত্রই চোখে পড়ে। কলা, কাব্য সাহিত্যের সৃজনে আনন্দ তাে আসেই কিন্তু প্রাত্যহিক পরিচ্ছন্নতা, মাটির পাত্র তৈরি করা, রুগ্নের পরিচর্যা করা, কাপড় সেলাই করা ইত্যাদির মধ্যেও সেই আনন্দের অনুভূতি থাকে। রাজা-প্রজার, মালিক-কর্মচারীর, শিক্ষক – বিদ্যার্থীর সম্বন্ধের মধ্যে আত্মীয়তা রয়েছে। আত্মীয়তাই প্রেম। প্রেমের কারণে সৃষ্টিতে সৌন্দর্য দেখা যায়। আত্মীয়তার মাধ্যমে বিবিধ স্বরূপের ভেতরে একত্বের বােধ রয়েছে—এটিই জ্ঞান।
এটিই হলাে আধ্যাত্মিক জীবনদৃষ্টি। আত্মতত্ত্বকে অধিষ্ঠানরূপে স্বীকার করে যা স্থিত রয়েছে সেটাই আধ্যাত্মিক। ভারতের পরিচিতিও বিশ্বে আধ্যাত্মিক দেশরূপে রয়েছে।
সমগ্র জীবনদৃষ্টি :
এই জীবনদৃষ্টি ব্যবহারিক দিক থেকে বিভিন্ন রূপ ধারণ করে। এই দৃষ্টির ওপর প্রতিষ্ঠিত জীবনব্যবস্থা গৃহসংস্থাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে। গৃহসংস্থার আধারই হচ্ছে। একাত্মতা। গৃহে প্রতিষ্ঠিত একাত্মতার বিস্তার ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’ পর্যন্ত হয়ে থাকে। সবাইকে নিজের ভাবা, কেননা সবাই এক, এটি ব্যবহার সম্বন্ধে মূলসূত্র হয়ে ওঠে। বেদে বলা হয়েছে— ‘সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম’ অর্থাৎ এ সবই হলাে বাস্তবে ব্রহ্ম। এই বেদবাক্য আমাদের সর্বত্রই প্রতীত হয়। এই সৃষ্টিতে যেমন জ্ঞান আছে, তেমনি অজ্ঞানও আছে। সত্য যেমন আছে, তেমনি অসত্যও আছে। জড় যেমন আছে, তেমনি চৈতন্য আছে। ভালাে যেমন আছে, তেমনি খারাপও আছে। ইষ্ট যেমন আছে তেমনি অনিষ্টও আছে। আলাে যেমন আছে তেমনি অন্ধকারও আছে। অর্থাৎ সৃষ্টির অব্যক্ত রূপ একই ব্যক্ত রূপ দ্বন্দ্বাত্মক। এই দুই পক্ষ সর্বদা একে অপরের সঙ্গে থাকে। এই দুইয়ের মধ্যে একটিও পূর্ণরূপে নষ্ট হয় না। সময়ে এই দুইয়ের মধ্যে একটি প্রভাবী থাকে, কিন্তু সম্পূর্ণরূপে নষ্ট হয় না। এই তত্ত্বকে স্বীকার করেই জীবনের সকল ব্যবস্থা রচিত হয়েছে।
তথাপি জ্ঞান, সত্য, ধার্মিকতাকেই ব্যবহারিক দৃষ্টিকোণ থেকে আদর্শ মানা হয়েছে। কেউ কাউকে অসত্য বা দুর্জনতার ব্যবহার করতে প্রােৎসাহিত করবেনা। সবাই ভালাে হতেই চাইবে। এরকম হওয়ার জন্য ঋষিগণ তপস্যা, দান, যজ্ঞ, সাধনা, জ্ঞান প্রাপ্তির সর্বদা উপদেশ দিয়ে থাকেন।
সমাজজীবনকে আধ্যাত্মিক অধিষ্ঠান দেবার জন্য যােগসূত্র অহিংসা, সত্য, অস্তেয়, ব্রহ্মচর্য ও অপরিগ্রহ— এই পাঁট সার্বভৌম মহাব্রতগুলাে পালন করবার উপদেশ দিয়ে থাকে। অর্থাৎ ভারতীয় জীবনদৃষ্টিতে অধ্যাত্ম ও ভৌতিকতা একে অপরের থেকে পৃথক নয়। আধ্যাত্মিকতা সকল ভৌতিক রচনাতেই অনুস্ত থাকে। তত্ত্ব ও ব্যবহারের একাত্মতা এই জীবনদৃষ্টির বিশিষ্ট লক্ষণ। এই জন্যই সমাজ জীবনের জন্য সমৃদ্ধি ও সংস্কৃতি, অভ্যুদয় ও নিঃশ্রেয়স সঙ্গে সঙ্গেই থাকে।
খণ্ডিত ভাবে নয়, বরং সমগ্রতার মধ্য দিয়েই জীবনকে দেখবার কারণে এখানে সংঘর্ষ নেই। বরং সমন্বয় আছে। এখানে ব্যক্তিকেন্দ্রিক নয়, বরং পরমেষ্টি কেন্দ্রিক চিন্তাধারা রয়েছে। এই জন্যই একের বিরুদ্ধে অন্য কেউ এমন ধারণা তৈরি হয় না। একজন পারে তাে অন্যজন পাবে না এমন ব্যবস্থা নেই। সবাই নিজের আবশ্যকতা অনুযায়ী পাবে এমন শ্রদ্ধা আছে। যাদের তিনি জন্ম দিয়েছেন তাদের সবারই আবশ্যকতার পূর্তি প্রকৃতি করে থাকে। এমন ধারণা অনুসরণেই যে কোনাে মানুষ অথবা প্রাণী অথবা পদার্থের আবশ্যকতার পূর্তি করবার কাজ মানুষও নিজের ধর্মরূপে গ্রহণ করেছে।
সৃষ্টি পরমাত্মার বিশ্বরূপ এবং মানুষ তাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ অভিব্যক্তি। শ্রুতি বলছে, পরমাত্মা মানুষকে নিজের প্রতিরূপে সৃষ্টিকরেছেন। মানুষ শ্রেষ্ঠ আর সে কারণেই শেষ সৃষ্টি তার উপভােগের জন্য তৈরি হয়েছে—এটা ভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গি নয়। শ্রেষ্ঠ বলেই তার চেয়ে অপেক্ষাকৃত ছােটো ও হীন। প্রাণী ও পদার্থসমূহের রক্ষা এবং পােষণ করা তাদের কর্তব্য। জীবনের সব ব্যবহারিক ক্ষেত্রে আভিজাত্যের সঙ্গে কর্তব্য ও দায়িত্ব, ছােটোদের ক্ষেত্রে রক্ষা করবার অধিকার যুক্ত রয়েছে। সমাজের ধারণার জন্য এটি ভারসাম্য রক্ষার উত্তম ব্যবস্থা।
ভারতীয় জীবনদৃষ্টি সমগ্রতায় স্থিতিশীলতাকে দেখে থাকে। এর আরও একটা লক্ষণ এই যে, এটা বৈশ্বিক বিচারই করে থাকে। সচরাচর জগৎকে একসঙ্গে বিচার করে থাকে। এজন্যই ব্যক্তি তাে দূরের কথা রাষ্ট্রও কখনও একথা ভাবে না যে তার একারই বিকাশ হােক অথবা তার একারই সবকিছু প্রাপ্ত হােক আর অন্যদের যা হবার হােক। সর্বে ভবন্তু সুখিনঃ এমনটাই তার কামনা হয়ে থাকে। জীবনের সব ব্যবস্থাই এই ভাবনা অনুসারেই রচিত হয়ে থাকে।
সংঘর্ষ নয় সহঅস্তিত্ব :
সংঘর্ষের মূল হচ্ছে প্রতিযােগিতা। এর পরিণাম হিংসা এবং অতঃপর বিনাশ। ভারতের সামাজিক আচরণের প্রস্থানবিন্দুই হলাে অহিংসা। যার মধ্যে হিংসা ও বিনাশের স্থান নেই। এ কারণেই ভারত চিরঞ্জীবী হয়ে রয়েছে। এই জীবনদৃষ্টি অনুসারে যদি বিশ্ব চলে তবে পরিবেশ দূষণ, ধর্ষণ, পরাধীনতার মতাে মহাসংকট দূর হবে, এতে কোনাে সন্দেহ নেই। এই দৃষ্টি সহঅস্তিত্ব স্বীকার । করে। জগতে যত সম্প্রদায়, পরম্পরা, শৈলীসমূহ রয়েছে তাদের সবাইকেই ভারত সম্মান করে এবং যারা সহঅস্তিত্বকে মানে তাদের সঙ্গে সমায়ােজন করবার কলাও এর অবগত রয়েছে। সাধারণ দৃষ্টিতে আধ্যাত্মিক জীবনদৃষ্টিকে সরলতা, দারিদ্র্য, তপশ্চর্যা, সন্ন্যাস ইত্যাদির সঙ্গে যােগ করে দেখা হয়। ভৌতিকতার সঙ্গে এর বিরােধ রয়েছে এমনটা প্রতিপন্ন হয়ে থাকে। ভারতের দার্শনিক ইতিহাস এটা সিদ্ধ করেছে যে, আধ্যাত্মিক জীবনদৃষ্টি সর্বাধিক সমৃদ্ধির জনক। বর্তমানে বিকাশের যতগুলাে মানদণ্ড আছে, তার সবকটিই এর মধ্যে সমাবিষ্ট হয়ে যায়। এই দৃষ্টিভঙ্গি ভাবী প্রজন্মকে শেখানাের কাজ শিক্ষা ব্যবস্থাকেই করতে হবে। এজন্যই শিক্ষার অধিষ্ঠানও আধ্যাত্মিক হওয়া দরকার। আধ্যাত্মিক অধিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত শিক্ষাই হচ্ছে ভারতীয় শিক্ষা। (ক্রমশ)
ইন্দুমতী কাটদরে
(ভাষান্তর : সূর্য প্রকাশ গুপ্ত, প্রাক্তন অধ্যাপক)