প্রধানমন্ত্রীর আত্মনির্ভর ভারত গড়ার সূত্রের বিশ্লেষণ করলে উঠে আসে ভারতকে যথার্থ স্বাবলম্বী হয়ে উঠতে গেলে শিক্ষা, মানব সম্পদকে কুশলী করে তোলার ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত বিনিয়োগের সঙ্গে এ বিষয়ে গবেষণাও বাড়ানো দরকার। বিশেষ করে করোনা সংক্রমণ পরবর্তী দুনিয়ায় প্রধানমন্ত্রীর পর্যবেক্ষণ ও পরিকল্পনা সময়োপযোগী নিশ্চিৎ। অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমন এই প্রসঙ্গে চার দফায় সরকারী পরিকল্পনা ও নির্দিষ্ট ব্যয়বরাদ্দের বিশদ রূপরেখাও পেশ করেছেন। এখানে প্রধানমন্ত্রী যে বৃহত্তর অর্থে Macro অর্থনীতির ধাঁচা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রীকে সেই যাত্রাপথের উপযুক্ত তৃণমূল স্তরে micro level পরিকল্পনাগুলিকে রূপায়িত করতে হবে।।
প্রধানমন্ত্রী সাম্প্রতিক জাতির কাছে। সরাসরি সরকারি পরিকল্পনাগুলির উপস্থাপনাকে অনেকেই ১৯৯১ সালের জুলাই মাসে তৎকালীন UPA সরকারের নাটকীয় সংস্কার প্রস্তাবনার সঙ্গে তুলনা করেছেন। যে সময়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে মাত্র চারটি বিষয়ের পরিবর্তন আনা হয়েছিল। (১) লাইসেন্স পারমিট রাজ তুলে দেওয়া, (২) রাজস্ব খাতে ঘাটতি বিপুলভাবে কমিয়ে আনা, (৩) মাশুল নীতিতে বদল, (৪) টাকার বড়ো ধরনের অবমূল্যায়ন (devaluation সে সময় এক ডলারের বিনিময়ে মূল্য ভারতীয় মুদ্রায় ছিল ৮ টাকা)। সকলেই। জানেন, সে সময়ের মুমূর্য অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে এগুলি নির্ণায়ক ভূমিকা নিয়েছিল। বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারীর আক্রমণে বিশ্ব অর্থনীতির পরিপ্রেক্ষিতে করোনা পরবর্তী আন্তজার্তিক ক্ষেত্রে ভারতকেও সমগ্র দৃষ্টিভঙ্গিটি যাতে বৃহত্তর সর্বস্তরের উন্নয়নমুখী হয় সেভাবেই তৈরি করতে হবে। মানুষের যেন সরকারের দক্ষতার ওপর পূর্ণ বিশ্বাস থাকে।
এবারেও কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার চারটিই বৃহৎ রূপরেখা রয়েছে। (১) জনহিতকর প্রকল্পগুলিতে সরকারি বিনিয়োগ ও উন্নয়নমূলক খরচ বৃদ্ধি করা, (২) ব্যবসা সংক্রান্ত চলতি আইন কানুনে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন এনে দেশীয় অর্থনীতিকে বিশ্বের বাজারে আরও প্রতিযোগিতামূলক করে তোলা। (৩) অর্থনীতির বর্তমান ধাঁচায় ও পদ্ধতি এমনকি দৃষ্টিভঙ্গিতেও বদল এনে তাকে সম্পূর্ণ আত্মনির্ভর করে তোলা যাতে বিশ্ব বাজারের ওপর নির্ভরতা কমে যায়। (৪) বৃদ্ধির এই নতুন ইঞ্জিনটিতে উপযুক্ত রসদ যোগাতে লকডাউন-৪ শুরু হওয়ার সময়ের সিদ্ধান্তগুলি কেমন হবে। প্রথম তিনটির সাফল্য স্বল্পমেয়াদি স্তরে ৪নং সিদ্ধান্তের রূপায়ণ কতটা সফল হচ্ছে তার ওপরেই নির্ভর করবে। সরকারের তরফে বর্ধিত খরচ করার ফলে নিশ্চিতভাবে বাজারে জিনিসপত্রের চাহিদা বাড়বে। এবং স্বল্পমেয়াদে অবশ্যই রোজগার ও নিয়োগের সুযোগ তৈরি হবে। একই সঙ্গে কিছুটা মধ্যমেয়াদি স্তরে দেশের সামগ্রিক পরিকাঠামো ক্ষেত্রের বৃদ্ধিরও সহায়ক হবে।
নীতিগত সংস্কার যেমন জমি, শ্রম ও অন্যান্য ক্ষেত্রে আইনে অর্থনৈতিক উন্নয়নমুখী উপযুক্ত পরিবর্তন এনে সেগুলিকে লাগু করতে পারলে সেগুলিও মধ্যমেয়াদি উপকারে আসবে। কিন্তু এগুলির প্রণয়ন ও যথোপযুক্ত প্রয়োগ পর্যন্ত বিনিয়োগকারীরা কিন্তু সন্তর্পণে নজর রাখবে কী কেন্দ্র কী রাজ্য উভয় ক্ষেত্রে সরকার তথা সরকারগুলি কতটা আন্তরিক ও কর্মদক্ষ। অর্থমন্ত্রী যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ও ধাপে নির্দিষ্ট পরিকল্পনাগুলির কথা আশাভরে ঘোষণা করেছেন তা কত দ্রুত ও নিপুণভাবে যথাযথ ক্ষেত্রগুলিতে সফলভাবে রূপায়িত হয় সে বিষয়টা বিনিয়োগকারীরা বিপুল আগ্রহে লক্ষ্য করবে। এক্ষেত্রে বিনিয়োগকারী, উপভোক্তা ও অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত অন্যান্য মানুষজন সরকারের রাজনৈতিক দায়বদ্ধতার ওপর আস্থা রাখার সঙ্গে কাজ করতে পারার প্রশাসনিক দক্ষতাকেও যদি আস্থাবান হয় সেক্ষেত্রে সরকার অবশ্যই সাফল্য পাবে।
২০১৪ সালে সরকারে আসার পর প্রধানমন্ত্রী তার প্রতিশ্রুতি মতো উন্নয়নের কাজে হাত দিয়েছিলেন। এরপর নানা সমস্যায় ৬ বছর কেটে গেলেও এখনই সামগ্রিক উন্নয়নকেই যদি তিনি প্রাথমিক লক্ষ্য হিসেবে স্থির রাখতে পারেন এবং অন্য কিছু কিছু বিষয়কে কম গুরুত্ব দেন সেক্ষেত্রে তিনি এখনও ভারতকে সত্যিই সম্পূর্ণ আত্মনির্ভর শুধু নয় পুরোপুরি আত্মবিশ্বাসী এক জাতিতে পরিবর্তন করার ক্ষমতা ধরেন।
প্রত্যেক রাজনৈতিক দলই কিন্তু দেশ আত্মনির্ভর হয়ে উঠুক একথা বরাবরই বলেন। বাস্তবে এই নির্ভরতার তত্ত্বটি এক একটি দলের কাছে এক একটি সময়ে ভিন্ন ভিন্ন অবতারে প্রকটিত হয়। মোদী তার আত্মনির্ভরতার দর্শনের ব্যাখ্যায় বলেছেন আত্মনির্ভরতার অর্থ নিঃসঙ্গ হয়ে পড়া নয়। নয় নির্দিষ্ট কোনো নিজস্ব খাঁচার মধ্যে আবদ্ধ থাকা। আদতে দেশবাসীরমনে আত্মনির্ভরতার বাস্তব রূপায়ণ বাড়তি আত্মবিশ্বাস জুগিয়ে তাদের উদ্বুদ্ধ করে তুলবে। এরই পরিণতিতে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পেয়ে অন্যান্য দেশ-নির্ভরতা কমে আসবে।
ল্যাটিন আমেরিকার বিশ্বের জাতিগুলির এই আত্মনির্ভরতার তত্ত্বের ওপর গবেষণা Branical Thcotonio Dos Santos যিনি অন্যতম গুরু হিসেবে বন্দিত, তিনি বলছেন উন্নতিশীল দেশগুলির পরনির্ভরতা নির্ধারিত হয় অন্য একটি দেশের অর্থনীতির উন্নয়ন ও বৃদ্ধির ওপর ভিত্তি করে। গত শতাব্দীর ৭০ দশকে প্রচারিত তাঁর তত্ত্ব অনুযায়ী কোনো দেশের অর্থনৈতিক প্রগতির ধারা কখনই অন্য কোনো দেশের অর্থনীতির দ্বারা পরিচালিত বা তার ওপর নির্ভরশীল হবে না। তাহলে ভারতবর্ষ এখন কী ধরনের নির্ভরতা কমিয়ে এনে আত্মনির্ভর হবে? আর আমাদের অর্থনীতি কোন দেশীয় অর্থনীতির ওপর সর্বাপেক্ষা বেশি নির্ভর?
এক্ষেত্রে তালিকার সবচেয়ে প্রথম সারিতে থাকবে তেল রপ্তানিকারক দেশের অর্থনীতি। তেল ও গ্যাসই আমাদের আমদানির সবচেয়ে সর্ববৃহৎ অংশ। শক্তি ক্ষেত্রে (উল্লেখিত ক্ষেত্র) আমরা অন্য যে কোনো নতুন উৎসেরই সন্ধান করি না কেন, তা আমাদের আমদানিই করতে হবে অর্থাৎ অদূর ভবিষ্যতেও আমদানি নির্ভরতা থাকছেই। কিন্তু সৌভাগ্যজনকভাবে বিশ্ব তেলের বাজারে কম দাম আগামী বেশ কিছু সময় ভারতকে প্রয়োজনীয় সুবিধে করে দেবে। তেল ও গ্যাসের বাজার বিক্রেতার বদলে থাকবে ক্রেতার আধিপত্যে।
আমাদের দ্বিতীয় নির্ভরতা রয়েছে বাইরে থেকে টাকা পাঠানোর ওপর (foreign remittance)। এইডলারে পরিবর্তিত অর্থ আমাদের দেশে ঢোকে বিশেষ করে উপসাগরীয় অঞ্চল ও মার্কিন মুলুক থেকে। এর একটা অংশ আমাদের মুলধনী বাজারেও যায়। এখন আত্মনির্ভর হয়ে উঠতে গেলে এই FDI (Foreign direct investment) কে কি আমরা এড়িয়ে যাব? তৃতীয় নির্ভরতা রয়েছে চিরকালীন প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত সরঞ্জাম ক্রয়। এক্ষেত্রে রাশিয়া, আমেরিকা, ইজরায়েল ও ফ্রান্স আমাদের বড়ো নির্ভরতা অর্থাৎ রপ্তানিকারক। চতুর্থত, বিদ্যুতিন সরঞ্জাম, ওষুধপত্র এই দুটি ক্ষেত্রে আমরা চীনের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল। এই ধরনের নির্ভরতাগুলি এড়ানোর সরাসরি উত্তর অবশ্য সরকারি ঘোষিত সম্ভাব্য নীতিগুলির মধ্যে নেই। তবে প্রধানমন্ত্রীর জরুরিভিত্তিতে নজর নিশ্চয় আছে চীন নির্ভরতা পরিহার করার ওপর।।
ডেন জিয়াও পিঙের নেতৃত্বে চীন দীর্ঘদিন আগেই একটা বিষয় প্রতিষ্ঠিত করেছে, একটা বিরাট অর্থনীতি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে আত্মনির্ভর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সারা বিশ্বের সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে অংশগ্রহণ করলে কোনো হেরফের হয় না, বরং সমৃদ্ধি বাড়ে।
প্রমাণিত হয়েছে, অর্থনীতিকে উন্নতির ধাপে পৌঁছে দিতে পারলে আমদানি-রপ্তানি একই সঙ্গে বাড়তে থাকলে কোনো পরনির্ভরতা তৈরি হয় না। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, চীন যখন অস্ট্রেলিয়াকে সদর্পে বলেছিল তারা সে দেশ থেকে গোরুর মাংস ওমদ আমদানি করবেন, তখন তারা সরাসরি আমদানি ক্ষেত্রে তাদের শক্তি প্রদর্শনই করেছিল। অর্থাৎ যদি কোনো অর্থনীতি মনে। করে তারা নির্দিষ্ট কোনো আমদানি পণ্য ছাড়াই চালাবে বা দেশের অভ্যন্তরে তার বিকল্প তৈরি করে নেবে সেক্ষেত্রে তাদের কোনো বড়ো ক্ষতি হবে না, উলটো দিকে অত্যধিক রপ্তানি নির্ভরতা বৃহৎ অর্থনীতিকেও টালমাটাল করে দিতে পারে। চীনের আমেরিকার বাজারে বিপুল রপ্তানি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বাণিজ্যযুদ্ধের হুমকির মুখে পড়ে ত্রাহি ত্রাহি করছে। ভারতের কিন্তু নির্দিষ্ট কোনো একটি দেশের ওপর পূর্ণ রপ্তানি নির্ভরতা কখনই নেই। বহুজাতিক কোম্পানিগুলি যারা চীন ছেড়ে আসতে চায় মোদী সরকার তাদের ভারতে জায়গা দিতে উন্মুখ। এতে ভারতের অর্থনীতি অনেকটাই রপ্তানি নির্ভর হয়ে পড়তে পারে। কেননা বহুজাতিক সংস্থাগুলি সারা বিশ্বে মাল বিক্রি করে। অবশ্য চীন থেকে আমদানি কমিয়ে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’র লক্ষ্যে এর বড়ো ভূমিকা থাকবে। তবে আত্মনির্ভর ও একইসঙ্গে আত্মবিশ্বাসী ভারত গড়তে আগে বলা শিক্ষা ক্ষেত্রে, মানব সম্পদ উন্নয়ন ও তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধির সঙ্গে গবেষণার ওপর জোর দেওয়া জরুরি। ভারতের বিশাল মানব মূলধনের সদর্থক ব্যবহার সরকারের উদ্দেশ্য সফল করার হাতিয়ার হতে পারে।
সঞ্জয় বারু
(লেখক নীতি বিশ্লেষক এবং ভারত সরকারের পূর্বতন মিডিয়া উপদেষ্টা)