পঁচিশ বছর পূর্বে আমি কলকাতায় এসেছিলাম তখন আমার বয়স দশ-এগারো হবে। আমাদের বাড়ির কাছে একটামুদিখানা ছিল। সেই মুদিখানায় একটি বৃদ্ধ গদিতে বসে বিপুলাকার একটি বই নিয়ে সাপ খেলানো সুরে কী পড়ত। বৃদ্ধের মাথায় ছিল মস্ত এক টাক, চারিপাশে তার ধবধবে সাদা চুল, নাকের উপর মস্ত এক চাদির চশমা, গম্ভীর গুল্ফ ছেয়ে শূন্য মুখ। বেশ বিজ্ঞ লোকের মতো চেহারা। একটি মাঝারি বয়সের লোক এক-একবার বৃদ্ধের কাছে এসে পাঠ শুনত, আবার খদ্দের এলে, গিয়ে তাদের দেখাশুনা করত। আমারই বয়সি একটা ছেলে খালি গায়ে বুড়োর কাছে সর্বদা বসে থাকত। আর তার পাশে থাকত দুটি মেয়ে। বিশেষ আগ্রহের সঙ্গে তারা সেই পাঠ শুনত। তাদের মুখের ভাব দেখে মনে হতো বিষয়টি তারা বিশেষ ভাবেই উপভোগ করছে।
বুড়ো কী পড়ছে জানবার জন্য আমার বিশেষ কৌতুহল হলো। বাসা থেকে বেরিয়ে মুদিখানার সামনে এসে দাঁড়িয়ে আমি শুনতে লাগলুম। রামচন্দ্র কী করে, ক’টি সেনার সাহায্যে সমুদ্রের উপর সেতু বেঁধে লঙ্কাদ্বীপে পৌঁছেছিলেন, তাই ছিল পাঠের বিষয়। সেই অপূর্ব ক্রিয়াকণ্ডের কথা শুনে ছেলে-মেয়েদের মুখ আনন্দ, আগ্রহ আর উৎসাহে উজ্জ্বল হয়ে উঠত। আমি যখন সেই বর্ণনা শুনতে শুনতে তন্ময় হয়ে যেতুম তখন কেউ আমায় ডেকে নিয়ে যেত। সেতু বাঁধা হচ্ছিল, আমি তখন জেনেছিলুম। রামচন্দ্র সেতু পার হয়েছিলেন কিনা, আর পার হয়েই-বা কী করেছিলেন তা তখন জানতে পারিনি।
দু’চার দিন পরে আমি দেশে ফিরে গেলুম। তারপর কোথা থেকে যে কোথায় গেলুম ঠিকানা নেই। পরিবর্তনের কত স্রোত আমার জীবনের উপর দিয়ে গেল, সেই বৃদ্ধ আর তার সন্তানসন্ততির নিরীহ শান্ত জীবনের ছবিটি মনের কোন গুপ্ত কোণে হারিয়ে গেল। তাদের অস্তিত্বের কথা আমি ভুলে গেলুম। এমন কত শত জিনিস আমরা ভুলে যাচ্ছি।। এই সেদিন দৈবক্রমে বেড়াতে বেড়াতে আবার সেই পথ দিয়ে যাচ্ছিলুম, ঘরবাড়ি সব বদলে গিয়েছে। আগে যেখানে ঘর ছিল, এখন সেখানে বড়ো বড়ো ম্যানশন মাথা তুপলে দাঁড়িয়েছে। আগে দু’চারটে রিকশা আর ঘোড়ার গাড়িই সে পথ দিয়ে যেত, এখন বড়ো বড়ো মোটর অনবরত যাওয়া আসা করছে। আগে মিট মিট করে গ্যাসের বাতি জ্বলত। এখন ইলেকট্রিকের আলো স্থাটিকে দিনের মতো উজ্জ্বল করে রেখেছে। আমি কালের অবশ্যম্ভাবী পরিবর্তনের কথা ভবাছি, এমন সময় হঠাৎ আমার চোখ পড়ল সেই পুরানো মুদিখানাটির উপর। সেখানে বিশেষ কোনো পরিবর্তন হয়নি। জিনিসপত্র আগের মতো সাজানো রয়েছে। চাল থেকে এখনো কেরোসিনের একটি বাতি ঝুলছে। বোধ হয় সেই পঁচিশ বছরের আগের সেই বাতিটি।
আমি কিন্তু স্তম্ভিত হয়ে গেলুম ভিতরকার দৃশ্য দেখে। পঁচিশ বছর আগে যে বৃদ্ধকে দেখেছিলুম, ঠিক তারই মতো একটি বৃদ্ধ গদির উপর বসে মোটা একটা বই নিয়ে সাপ খেলানো সুরে কী পড়ছিল। পঁচিশ বছর আগের সেই মধ্য বয়স্ক লোকটির মতো একটি মধ্য বয়স্ক লোক। এক-একবার এসে সেই পাঠ শুনছিল আর আবশ্যক মতো খদ্দেরদের দেখাশুনা করছিল। সেই আগের ছেলেটি মতো একটি ছেলে খালি গায়ে বুড়োরমুখের দিকে চেয়ে। বসে ছিল। তার পাশে বসে ছিল সেই আগের মেয়েদের মতো দেখতে দুটি মেয়ে।
আমি আর থাকতে পারলুম না, সোজা বৃদ্ধের কাছে গিয়ে বললুম, “মশাই মাপ। করেন, পঁচিশ বছর পূর্বে আমি এই ছেলেদের সামনে আপনাকে এই বই পড়তে দেখেছি। এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে এরা কি আর বড়েনি, আর আপনার মধ্যেও কি কোনো পরিবর্তন হয়নি? রামচন্দ্র কি এখনও সেতুবন্ধনের কাজে ব্যস্ত আছেন?”
বৃদ্ধ তার চোখ দুটি তুলে আমার দিকে একবার চাইলেন। তার গম্ভীর দৃষ্টিতে আমার আপাদমস্তক একবার ভালো করে দেখে নিয়ে তারপর বিস্ময়ের সুরে বললেন, “ পঁচিশ বছর আগে আপনি এখান দিয়ে গিয়েছিলেন?” আমি বললুম, আজ্ঞে হ্যা।। বৃদ্ধ বললে, “তাহলে আপনি আমার স্বর্গীয় পিতামশায়কে এই রামায়ণ পড়তে দেখেছেন। আমার ছেলে-মেয়েরা তার কাছে বসে পাঠ শুনত। ছেলেটি এখন ওই বড়ো হয়েছে। ওর বয়স আপনার মতোই হবে। মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে। ভগবানের ইচ্ছায় তারা স্বামী-পুত্র নিয়ে ঘর করছে। কন্যাদুটি আমার নাতনি, ওই ছেলের সন্তান।”
বৃদ্ধের হাতের বইটির দিকে ইঙ্গিত করে বললুম, “ এ বইটি কবেকার।”স্মিত হাস্যে বৃদ্ধ বললে, এ হচ্ছে কৃত্তিবাসের রামায়ণ। আমার ঠাকুরদা বটতলায় এটি কিনেছিলেন। সে অনেকদিনের কথা, আমার তখন জন্ম হয়নি।”
বৃদ্ধকে অভিবাদন করে দোকান ত্যাগ করলুম। আমি দিব্যচক্ষু পেয়েছি, প্রকৃত ভারতবর্ষের নিখুঁত একটা ছবি আমার চোখের সামনে ফুটে উঠল—সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে, তার পরিবর্তন হয়নি।
এস. ওয়াজেদ আলী
(লেখকের ‘দাশুকের দরবার’গ্রন্থ থেকে রচনাটি গৃহীত)