ভারত তথা হিন্দুবিরােধী এক সন্ত্রাসী শক্তির নাম কমিউনিজম


দীর্ঘ সময়ে রাজনৈতিক অপশাসনের ফলে পশ্চিমবঙ্গর মানুষের মনে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মিথ্যা মােহ রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়েছিল। পৃথিবীর বুকে সব থেকে বেশি গণহত্যাকারী শাসকদেরকে সাম্যবাদের জনক হিসেবে মানুষের সামনে সুপরিকল্পিত মিথ্যাচারের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার ফায়দা তুলে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালানাে হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ ভােটাধিকারের মাধ্যমে এই একনায়কতান্ত্রিক শাসকদের রাজনৈতিক ভাবে প্রায় শেষ করে দিয়েছে কিন্তু এর পরেও তারা তাদের কৃতকর্মের জন্য অনুশােচনা তাে দূরের কথা, উলটে সেই একইভাবে তারা আজও মানুষের সামনে সমানভাবে মিথ্যা কথা বলে চলেছে। কোনাে তথ্যের উপর ভিত্তি করে নয়, শুধুমাত্র মিথ্যাকথা এবং ব্যক্তি আক্রমণের উপর ভিত্তি করে বারংবার তারা আমাদের সংস্কৃতির ওপর আঘাত হানছে। শুধুমাত্র হিন্দুধর্ম নয়, আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নিয়েও তারা ক্রমাগত ভুল তথ্য পরিবেশন করে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করতে চাইছে। লক্ষ্য তাদের একটা, বাঙ্গালি। হিন্দুর অস্তিত্বকে শেষ করে দেওয়া। তাই ধর্ম ও সংস্কৃতি নিয়ে কিছু সত্যি কথা মানুষের সামনে উপস্থাপন করা আজকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
বৈদিক সভ্যতা ও সাম্যবাদ : বৈদিক সভ্যতার মূল মন্ত্রই ছিল ‘বসুধৈব কুটুম্বক অর্থাৎ সমগ্র বিশ্ব একটি পরিবার। জীবনের সর্বক্ষেত্রে সমান অধিকারের কথাও ঋকবেদে বর্ণনা করা হয়েছে (RV:X.191.2)। জন্মের ভিত্তিতে জাতিভেদ বা লিঙ্গের ভিত্তিতে বৈষম্য ভেদের বিরুদ্ধেই ঋকবেদে লেখা রয়েছে। (RV:X.191.3)। এই তথ্য ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন তাঁর বইতে উল্লেখ করে গেছেন (Indian Philosophy)।
জাতিভেদ প্রথা আমাদের হিন্দু সমাজে এলাে কীভাবে? হিন্দুধর্মই যে এই জাতিভেদ প্রথার জন্ম দিয়েছে সে নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছিলেন স্বয়ং ড. বাবাসাহেব আম্বেদকর সামাজিক এই বৈষম্য মুছে ফেলার জন্য কংগ্রেস পার্টির রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছিল না বলেও তিনি মত প্রকাশ করেছেন। অন্যদিকে আমাদের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর মতে বহিরাগত শাসকরা ভারতবর্ষে আসার পরেই আমাজের সমাজে এই ভেদাভেদ শুরু হয় (The Discovery of India)।
আধুনিক গবেষকদের মত অনুযায়ী, T.H. Griffith 978 H.H. Wilson 43 দুইজন বিখ্যাত অনুবাদক ঋকবেদের অনুবাদ করার সময় মূল সংস্কৃত শ্লোক ভুল ভাবে অনুবাদ করেন। সেই থেকেই একদল সুবিধাবাদী মানুষ সমাজে এই ভেদাভেদ প্রকটভাবে অপপ্রয়ােগ করতে শুরু করেন। এই বৈষম্য যখন সমাজের চরম পর্যায়ে পৌঁছে ছিল তখন তা থেকে মুক্তির জন্য ভক্তি আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু। যাকে শ্রীকৃষ্ণের অবতাররূপে হিন্দু ধর্মাবলম্বী বিশ্বাস করে থাকেন। কিন্তু কমিউনিস্টরা এই সমস্ত তথ্য সুপরিকল্পিত ভাবে বিকৃত করে। শ্রীচৈতন্যের ৩৩৩ বছর পরে জন্ম নেওয়া কালৰ্মার্কসকে তারা সাম্যবাদের জনক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চায়।
হিন্দু সহনশীলতা এবং বৈদেশিক শক্তির আক্রমণ :ভারতবর্ষ এবং হিন্দু হলাে একই হৃদপিণ্ডের দুইটি ভিন্ন প্রকোষ্ঠের মতাে অর্থাৎ একটি ছাড়া অন্যটির অস্তিত্ব কল্পনা করা সম্ভব নয়। স্বামী বিবেকানন্দের দর্শন অনুযায়ী পাশ্চাত্যের ধর্মপুস্তক শ্বাসগ্রহণের মতাে অর্থাৎ বাইরে থেকে ভিতরে আসছে কিন্তু আমাদের ধর্মপুস্তকগুলি আগের মতাে অর্থাৎ ভেতর থেকে বাইরে আসছে। মুসলমান আক্রমণ তরঙ্গ ভারতবর্ষে আসবার আগে ধর্মের জন্য রক্তক্ষয় কী তা এদেশের মানুষ প্রত্যক্ষ করেনি। ইসলাম এদেশে আসার পর কয়েকশাে বছর ধরে ‘আল্লা-হাে-আকবর’ ধ্বনিতে ভারতের আকাশ মুখরিত হয়েছিল। শুধু তাই নয়, এমন একজন হিন্দু ছিল না যে প্রতি মুহূর্তে নিজের বিনাশ আশঙ্কা না করে থাকতে পেরেছে বলেও তিনি মত প্রকাশ করেছেন (হিন্দুধর্ম, স্বামী বিবেকানন্দ, উদ্বোধন কার্যালয়)। কিন্তু এইসব অত্যাচার সহ্য করার পরেও আমাদের বিনাশ ঘটেনি। তার কারণ হিসেবে স্বামীজী বলেছেন, “জাতির বিশ্বাসের জীবন কোনাে নির্দিষ্ট ভাবের মধ্যে থাকে, সেখানেই সেই জাতির জাতীয়ত্ব, যতদিন না তাতে আঘাত লাগে ততদিন সেই জাতির মৃত্যু নাই। এই ধর্ম আমাদের জাতির জীবনীশক্তি, আর যতদিন আধ্যাত্মিকতা অব্যাহত থাকবে ততদিন জগতের কোনাে শক্তি এই জাতিকে ধ্বংস করিতে পারিবে না।”
স্বামীজীর বক্তব্যের তাৎপর্য আজকের দিনেও একই রকম প্রাসঙ্গিক। দেশ বিভাজনের সময় ভারতবর্ষ ভেঙ্গে নতুন করে তৈরি হওয়া পাকিস্তান এই দুই দেশই তাদের দেশের সংখ্যালঘুদের সমান অধিকারের প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তবে সেই প্রতিশ্রুতি শুধুমাত্র রক্ষা করেছে ভারত। তাই বর্তমান পাকিস্তানে হিন্দুদের প্রায় কোনাে অস্তিত্বই নেই এবং বাংলাদেশে হিন্দু সংখ্যা ক্রমাগতভাবে কমতে কমতে ৩০ থেকে ৮ শতাংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের দিকে তাকালেই বােঝা যায় কীভাবে একের পর এক দেশ মুসলমান অধ্যুষিত দেশে পরিণত হয়েছে অল্প সময়ের ব্যবধানে।
কিন্তু কমিউনিস্টরা সুপরিকল্পিতভাবে তাদের পছন্দমতাে লােকদের শিক্ষা, অর্থ ও বিনােদনের জগতে শীর্ষস্থানে বসিয়ে, ভারতের ইতিহাসকে বিকৃত করে, স্বামীজীকে হিন্দুধর্মের সমালােচক হিসেবে মানুষের সামনে উপস্থাপনা করে, আমাদের জীবনীশক্তির উপর আঘাত হেনে ভারতকে ধ্বংস করার চেষ্টা চালিয়েছিল।
স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং মনীষীদের সম্পর্কে মিথ্যাচার : রবীন্দ্রনাথ থেকে স্বামীজী বা নেতাজী থেকে শ্যামাপ্রসাদ কেউই বাদ যাননি বামেদের মিথ্যাচারের
শিকার হতে। কমিউনিস্ট পার্টি ১৯৪২-৪৩-এ সুভাষচন্দ্র বসুর সৃষ্ট ফরােয়ার্ড ব্লককে ঘর শত্রুর আখ্যা দিয়েছিল এবং তাদের মুখপত্র পিপলস ওয়ারে নেতাজীকে নিয়ে কুরুচিপূর্ণ কার্টুন প্রকাশ করেছিল। অবশ্য এসব তথ্য বর্তমান প্রজন্মের ফেসবুকীয় কমরেডদের জানার আগ্রহ নেই। পশ্চিমবঙ্গের বুকে জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দল বিজেপির উত্থান যত দ্রুত গতিতে এগােচ্ছে ঠিক একই গতিতে শ্যামাপ্রসাদের প্রতি আক্রমণ ও মিথ্যাচার বাড়িয়ে চলেছে কমিউনিস্টরা। শ্যামাপ্রসাদ সম্পর্কে তাদের প্রত্যেকটি অভিযােগকে যুক্তি এবং উপযুক্ত প্রমাণ-সহ খণ্ডন করেছেন পিনাকী পাল ও কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় রবীন্দ্রনাথ-নেতাজী-স্বামীজীর পর মিথ্য বাম কুৎসার লক্ষ্য শ্যামাপ্রসাদ’ এই লেখনীর মাধ্যমে। তাই সেই বিষয়ে আলােচনা না করে শুধু মাত্র কয়েকটি তথ্য তুলে ধরতে চাই। এক, বীর সাভারকারের ব্রিটিশ সরকারকে মুচলেকা দেওয়ার কথা বারবার মানুষের সামনে তুলে এনে মানুষকে বিভ্রান্ত করেছেন বামপন্থীরা, কিন্তু ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সর্বপ্রথম জেনারেল সেক্রেটারি পি সি যােশী ব্রিটিশ সরকারকে যে মুচলেকা দিয়েছিলেন সেই ব্যাপারে আমাদের অনেকেরই জানা নেই। দুই, দেশনায়ক নেতাজীর দেশ স্বাধীন করার উদ্দেশ্যে হিটলারের সঙ্গে হাত মেলানাের রণনীতিকে সমালােচনা করতে কমিউনিস্টরা পিছপা হন না। কিন্তু ১৯৩৯ সালের ২৩ আগস্ট কমিউনিস্টদের পিতৃতুল্য গণহত্যাকারী স্ট্যালিন যখন হিটলারের সঙ্গে সন্ধি স্বাক্ষরিত করে সেই নিয়ে কিন্তু ভারতীয় কমিউনিস্টরা কোনাে শব্দ ব্যয় করেননি। তিন, ১৯০০ সালের পর থেকে সশস্ত্র বিপ্লবের পথ বেছে নিয়ে যে সমস্ত স্বাধীনতা সংগ্রামী জীবন বলিদান দিয়েছিলেন তাঁদেরকে বর্তমান কমিউনিস্টরা অতি নির্লজ্জের মতাে কমরেড’ বলে সম্বােধন করেন। উদাহরণস্বরূপ ভগৎ সিংহ যিনি জীবনে কোনােদিনও কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য পদ গ্রহণ করেননি। কিন্তু তারপরও বিকৃত মানসিকতার পরিচয় দিয়ে চলেছে
কমিউনিস্টরা। চার, ১৯৪২-এর ভারত ছাড়াে আন্দোলনের সময় তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টি এবং মুসলিম লিগের কোনাে নেতাকে গেপ্তার করা হয়নি। এরপরেও নির্লজ্জ কমিউনিস্টরা স্বাধীনতা সংগ্রামে তাদের দেশপ্রেম কতটা ছিল তা দেখানাের চেষ্টা করে চলেছে।
কিন্তু প্রশ্ন হলাে, কমিউনিস্টদের এহেন আচরণের কারণ কী? কারণটা হলাে, যে সভ্যতা গােটা বিশ্বকে নগর পরিকল্পনা শিখিয়েছিল। যে সভ্যতা গােটা বিশ্বকে শূন্যের ব্যবহার শিখিয়েছিল। যে সভ্যতা অজন্তার গুহাচিত্র এবং ইলােরার কৈলাস মন্দির ইত্যাদি গােটা বিশ্বকে উপহার দিয়েছিল সেই বৈদিক সভ্যতাকে কমিউনিজমের জন্মদাতা কালমার্কস অর্ধসভ্য ও অর্ধবর্বর বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, ব্রিটিশরা ভারতবর্ষে এসে নাকি আমাদেরকে সভ্য করেছিল এবং আমাদের দেশে বিপ্লব এনেছিলেন বলেও তিনি মত প্রকাশ করেছিলেন। তাই অত্যন্ত প্রাসঙ্গিকভাবেই নেতাজী তার নিজের লেখা ‘The Indian Struggle’ বইতে লিখে গেছেন যে, ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধ ভারতবর্ষের মানুষকে ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত করার জন্য। যেহেতু ভারতীয় কমিউনিস্টদের সঙ্গে জাতীয়তাবােধের কোনাে সম্পর্ক নেই, তাই তাদের মতাদর্শ কখনােই ভারতবর্ষে স্থাপন করা যাবে না। কিন্তু তারপরেও আপাদমস্তক বৈদিক সংস্কৃতির বিরােধী এবং গােটা বিশ্বের বুকে প্রায় ১২ কোটি গণহত্যাকারী (Death by Government by R. J. Rummel) লেনিন-স্ট্যালিন-মাও – পল পটদের উত্তরাধিকারী কমিউনিস্টরা এখনাে ভারতবর্ষকে টুকরাে টুকরাে করার স্বপ্ন দেখছে। নিজের সঙ্গে মতবিরােধ হলে কীভাবে মানুষ খুন করতেন তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ নিজের ডায়েরিতে লিখে রাখা চে গুয়েভারা (History Collection)-কে বিপ্লবের অনুপ্রেরণা হিসেবে তুলে ধরেছে ভারতের কমিউনিস্টরা।
আজকে পশ্চিমবঙ্গের নির্লজ্জ কমিউনিস্ট নেতারা শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির
বিরুদ্ধে মিথ্যা কথা রটানাের আগে নিজেরা জবাব দিক কেন তাদের অধিকাংশ নেতাকে পূর্ব পাকিস্তান বা বর্তমান বাংলাদেশ থেকে ভিটেমাটি ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে আসতে হয়েছিল? স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্ক-এর বিশিষ্ট অধ্যাপক ডক্টর সব্যসাচী ঘােষ দস্তিদার তাঁর লেখা ‘Mukti : Free to be born Agsin : Partitions of Indian Subcontinent, Islamism, Hinduism, Leftism and Liberation of the Faithful’বইতে সঠিকভাবেই বলেছেন। যে, পশ্চিমবঙ্গের কমিউনিস্ট নেতাদের কাছে‘হিন্দুমুসলমান ভাই ভাই, কিন্তু তাদের সঙ্গে বাস নাই।।
পশ্চিমবঙ্গের বাঙ্গালি হিন্দুর এই সংকটকালে, এই সর্বগ্রাসী, ধ্বংসাত্মক ও গণহত্যাকারী বিকৃত মানসিকতার কবল থেকে আগামী প্রজন্মকে বাঁচানাের জন্য শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সমস্ত মানুষকে এগিয়ে। আসতে হবে। ঠিক যেমনটি স্বামীজী বলেছিলেন—“Again the force to raise them must come from inside. i.e. from the orthodox Hindus’। আমাদের মানবতার আদর্শ হােক শ্রীচৈতন্য বা স্বামীজী। আমাদের বিপ্লবের আদর্শ হােক ক্ষুদিরাম বা ভগৎ সিংহ বা নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু এবং আমাদের প্রতিরােধের আদর্শ হােক ঋষি অরবিন্দ শ্যামাপ্রসাদ। স্বামীজীর বাণী আমাদের পাথেয় হওয়া উচিত – “তােমাদের ভিতর যাহা আছে নিজের শক্তি বলে তাহা প্রকাশ করাে কিন্তু অনুকরণ করিও না অথচ অপরের যা ভালাে তা গ্রহণ করাে। আমাদিগকে অপরের নিকট শিখিতে হইবে, অপরের নিকট শিক্ষা করিতে গিয়া তার সম্পূর্ণ অনুসরণ করিয়া নিজের স্বাতন্ত্র্য হারাইও না। এই ভারতের জাতীয় জীবন হইতে একেবারে বিচ্ছিন্ন হইয়া যাইও ।
রুদ্র প্রসন্ন ব্যানার্জি
(লেখক গবেষক, অ্যালবার্টা বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.