প্রথমেই একটা বিষয়ে খোলাখুলি নিন্দা করা যাক। জে এন ইউ-তে সম্প্রতি যে হামলা হয়েছে তা অত্যন্ত নিন্দনীয় ঘটনা, কোনোমতেই সমর্থন যোগ্য নয়। ঘটনার অব্যবহিত পরেই জেএনইউ-এর প্রাক্তনী তথা কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন এবং কেন্দ্রীয় বিদেশমন্ত্রী এস জয়ঙ্কর এর নিন্দা করে বিবৃতি দেন। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের নির্দেশে তড়িঘড়ি একটি তদন্ত কমিটিও গঠন হয়। ফলত জেএনইউ কাণ্ডে কেন্দ্রীয় সরকারের ভূমিকা অত্যন্ত ইতিবাচক। তবে সংবাদমাধ্যমের একটি বড়ো অংশ এই হামলার ঘটনাটিকে যথাসম্ভব বিকৃত করছে। একতরফা ভাবে শুধুমাত্র এস এফ আই-এর ওপর হামলা হয়নি, জাতীয়তাবাদী ছাত্র সংগঠন এবিভিপি-র অন্তত পনেরো জন কার্যকর্তা গুরুতর জখম হয়ে চিকিৎসাধীন বলে সূত্রের খবর।
যে ভিডিয়ো ফুটেজ প্রকাশ্যে এসেছে, তাতে দেখা যায় জেএনইউ ছাত্র-সংসদের সভানেত্রী ঐশী ঘোষের সঙ্গে মুখে কালো কাপড় বাঁধা কয়েকজন দুষ্কৃতী ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অভিযোগ গত ৫ জানুয়ারি সকালে এরাই সর্বপ্রথম এবিভিপি। সমর্থকদের ওপর হামলা চালায়। আরেকটি সূত্রের মতে, যেহেতু ওইদিন ছিল পরীক্ষার সেমিস্টারের রেজিস্ট্রেশনের শেষ দিন, উপস্থিত পরীক্ষার্থীদের বিঘ্ন ঘটাতে নকশালি ছাত্রদের একটা বড়ো অংশ সক্রিয় ছিল। তারাই অন্য বামপন্থী ছাত্র সংগঠনের কর্মীদের ওপর রাতে চড়াও হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারও এই হামলার পেছনে বামপন্থীদের গোষ্ঠীকোন্দলকেই দায়ী করেছেন।
যাঁরাই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে গুন্ডাগিরি করে থাকুন না কেন, বিষয়টির কড়া নিন্দা ও পদক্ষেপহওয়া প্রয়োজন। তবে বাস্তব খুব নিষ্ঠুর। এই পরিপ্রেক্ষিতে কতগুলি কথা বলতেই হয়। সমস্ত বিরোধী দল এবং
ফেসবুকের মাধ্যমে প্রচার হতে শুরু হলো ‘গেরুয়াবাহিনী’-র তাণ্ডবে জেএনইউ রক্তাক্ত ইত্যাদি। সংবাদমাধ্যমের একটা বড়ো অংশ এই সুরেই পরেরদিন খবর করলো, টিভি চ্যানেলগুলোও শুধুমাত্র বিরোধীদের বক্তব্যগুলিই ‘হাইলাইট করতে শুরু করলো। সত্য-মিথ্যা জানার প্রয়োজন ছিল না, শুধুমাত্র নির্দিষ্ট একটি মতাদর্শ কিংবা কায়েমি স্বার্থ এই ধরনের প্রচারে অক্সিজেন জুগিয়েছে। এবং এর ফলে দেশজুড়ে শুরু হয়েছে বিপজ্জনক এক প্রবণতা।
এই আধুনিক যুগে দাঁড়িয়েও প্রকাশ্যে সামাজিক বয়কটের ডাক দেওয়া যেতে পারে, কাকে? না যে দল মাত্র কয়েকমাস আগে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ভারতের ক্ষমতায় এসেছে, সেই দলকে। তাদের কর্মী-সমর্থকদের প্রকাশ্যে দেখলেই মারার হুমকি দেওয়া হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। নির্বিচারে। এই অভাবনীয় ঘটনার প্রত্যক্ষ নজির জেএনইউ-এর হামলার ঘটনা। এই প্রেক্ষিতে বিশ্বামিত্রের একটি বিনম্র নিবেদন রয়েছে, হামলার কড়া নিন্দা করেও— জেএনইউয়ে হামলা কাণ্ডের অব্যবহিত আগেই যাদবপুরের একটি ঘটনা সামনে এসেছে। শ্লীলতাহানি, মেয়েদের অসম্মান, সংগঠনের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রহীনতা ইত্যাদি গুরুতর অভিযোগে এসএফআই-এর ৩২ জন তাবড় নেতা-নেত্রীর পদত্যাগ। বামপন্থী ছাত্র সংগঠন মানেই পড়াশুনোয় তুখোড়, সামাজিক ন্যায়ে অনবদ্য ভূমিকা পালনকারী, সর্বোপরি বিপ্লবী। তাদের অতি সুবোধ বালক প্রমাণের যে অপচেষ্টা হচ্ছে, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় সর্বজনসমক্ষে এদের প্রকৃত চেহারাটা দেখিয়ে দিয়েছিল। নাগরিকত্ব আইন, এনপিআর-বিরোধিতা ক্রমে বুমেরাং হচ্ছে এটাও বোঝা যাচ্ছিল। বুঝবেন কী করে?
মুসলমান জাতিসত্তাকে এতদিন যারা সর্বাগ্রাধিকার দিয়েছিল, সেই জামিয়া মিলিয়া ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রীরা জাতীয় পতাকা হাতে জাতীয় সংগীত গাইছে, এমন ভিডিয়ো ভাইরাল হলো। ভারত তেরে টুকরে হোঙ্গে’ ছিল যাদের এতকালের স্লোগান, তারাই এখন দেশপ্রেমী হলো কোনো মন্ত্রবলে?
এই ভেকের প্রয়োজনীয়তাটা বুঝতে হবে। সাধারণ মানুষ যে আর বামপন্থীদের বিশ্বাস করে না, বিগত নির্বাচনগুলো তার প্রমাণ দিয়েছে। শুধু জেএনইউ, যাদবপুরের মতো হাতে গোনা কিছু প্রতিষ্ঠান তাও কেবল কলা-বিভাগে এদের অস্তিত্ব রয়েছে, অন্যান্যদের ‘অশিক্ষিত’ বলার মধ্যে যে আত্মগরিমা ছিল, তা এদের আরও একঘরে করে দিয়েছে। ফলে সাধারণের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে সহানুভূতিটুকুই ভরসা। জেএনইউ তারই আভাস দিল। সঙ্গে বামপন্থীদের যেটা চিরকালীন বৈশিষ্ট্য, মানুষে মানুষে ঘৃণা, বিদ্বেষ তৈরি করে পরিস্থিতির ফয়দা লোটা—এবারও সোশ্যাল মিডিয়ায় তার প্রমাণ পাওয়া গেল। দোর্দণ্ড প্রতাপ বামআমলেই স্লোগান উঠেছিল ‘ছাত্রদের ছাত্রপ্রেম, এরই নাম সিপিএম। আজ অবলুপ্তির যুগেও একই পন্থা? প্রশ্নগুলি সহজ, উত্তরও তো জানা।
2020-01-14