শাক দিয়ে মাছ ঢাকার প্রচেষ্টা সফল হবে না

২৬ ডিসেম্বর ঢাকায় বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফকরুল ইসলাম আলমগির বলেছেন— ‘ভারতের মোদী সরকার সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন এবং জাতীয় নাগরিকপঞ্জী করে মায়ানমারের রোহিঙ্গাদের মতো তাদের দেশের মুসলমানদেরও বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য করতে চায়। তিনি আরও বলেছেন, মায়ানমার যেমন রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে নির্যাতনের মুখে রোহিঙ্গাদের রাষ্ট্রহীন করে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য করেছে, একইভাবে আমরা লক্ষ্য করছি ভারত নাগরিকত্ব আইন এবং এনআরসি জটিলতায় দেশের সংখ্যালঘু মুসলমানদের রাষ্ট্রহীন ঘোষণা করে জোর করে বাংলাদেশে পুশ ইন করার প্রক্রিয়া চালাচ্ছে।
ভারতীয় জনতা পার্টির সভাপতি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ পার্লামেন্টে তাঁর বক্তব্যের এক পর্যায়ে খালেদা জিয়া নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকারের নামোচ্চারণ করে শিষ্টাচার বহির্ভূত ভাবে সরাসরি অভিযুক্ত করে বলেন, “বাংলাদেশে বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে সেখানে ব্যাপকহারে সংখ্যালঘু নির্যাতন হয়েছে। নির্যাতনের শিকার সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায় ভারতে পালিয়ে এসেছেন। এর মাধ্যমে তিনি উদ্দেশ্যমূলক ভাবে বিএনপি-কে সাম্প্রদায়িক নিপিড়নকারী দল হিসেবে চিহ্নিত করার অপচেষ্টা চালিয়েছেন। …অমিত শাহ ভারতীয় পার্লামেন্টে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন তথ্য উপস্থাপন করেছেন। এছাড়া আরও অনেক কথাই ফকরুল সাহেব বলেছেন।
তার এই কথার প্রেক্ষিতে বলা যায় ভারত কোনোদিনই ভারতের মুসলমানকে বাংলাদেশে পাঠাতে চায়নি। বরং বাংলাদেশের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সরকারের মদতে এবং সেখানকার জঙ্গি ও মৌলবাদী সংগঠনের দৌলতে বাংলাদেশ থেকে হিন্দুদের যেমন উৎখাত করা হয়েছে তেমনি গরিব মুসলমানদেরও ভারতে ঠেলে পাঠিয়েছে ভারতে মুসলমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির লক্ষ্যে এবং অশান্তি সৃষ্টির লক্ষ্যে। এমনকী রোহিঙ্গাদের মধ্যে থেকেও প্রায় চল্লিশ হাজার রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশিরা ভারতে পাঠিয়েছে। বাংলাদেশে হিন্দুরা যদি সুরক্ষিত থেকে থাকে তাহলে ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে যে হিন্দুর সংখ্যা ছিল প্রায় ১৯ শতাংশ, তা ২০১৯ সালে প্রায় ৮ শতাংশে নেমে এসেছে কেন? যদি তারা ভারতে এসে না থাকে তাহলে ১১ শতাংশ হিন্দু গেল কোথায় ? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বারকাত সাহেব তো বলেই দিয়েছেন, আগামী ২০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশে হিন্দু বলে কেউ থাকবে না। তিনি সঠিক কথাই বলেছেন।
ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ’র মন্তব্যে মির্জা সাহেবের গোঁসা হওয়া স্বাভাবিক। কেননা সত্য বড়ো কঠিন ও নির্মম। তাই অনেকের মতোই তিনিও সত্য কথাটি হজম করতে পারছেন না। সেজন্য তিনি তার গোঁসা চেপে রাখতে পারেননি। তাই তিনি বলেছেন, বিএনপি আমলে সংখ্যালঘুরা সুরক্ষিত ছিলেন। জবাবে অমিত শাহ বলেছেন, চাইলে প্রমাণ পাঠিয়ে দিতে পারি। ফকরুলের কথা শুনে আওয়ামি লিগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন— “আমি হাসব না কাদবো ঠিক বুঝতে পারছি না। তারপর তিনি বলেন, আওয়ামি লিগ আমলে সংখ্যালঘুরা নিরাপদে থাকেন। বিদেশমন্ত্রী ড. আব্দুল মোমেন বলেছেন, বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতনের কোনও দৃষ্টান্ত নেই। এই তিনজনের কথা শুনে বাংলাদেশের হিন্দু-সহ পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুরা হাসবে না কাদবে ঠিক বুঝতে পারছে না।
মির্জা ফকরুল সাহেবকে বাংলাদেশে বিএনপি সরকারের শাসনকালের কয়েকটি ঘটনার জন্য বিদেশি এবং বাংলাদেশি সংবাদপত্রের কিছু বক্তব্য তুলে দিচ্ছি। তার আগে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টও তুলে দিলাম।
২০০৩ সালের ৫ নভেম্বর দিল্লিতে সব রাজ্যের পুলিশের ডিজি-দের ৩৮তম সম্মেলনে বাংলাদেশ সম্পর্কে আইবি-র পেশ করা রিপোর্টের আলোচনা করেছিলেন ডিজি-রা। আইবি-র রিপোর্টে বলা হয়েছিল ২০০১ সালে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে বাংলাদেশ ভারতের নিরাপত্তার পক্ষে বিপদস্বরূপ হয়ে উঠেছে। বিপদের কারণগুলি হলো— (১) বাংলাদেশে বিশাল সংখ্যক পাকিস্তানি গোয়েন্দার উপস্থিতি। (২) সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলির উত্থান এবং (৩) জঙ্গি গোষ্ঠীগুলির বাংলাদেশে ঘাঁটি গাড়া।
এবারে দেখা যাক, বিদেশি সংবাদপত্র এবং বাংলাদেশের সংবাদপত্রের বিবৃতি। (১) আমেরিকার বিখ্যাত ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল লিখেছিল, ‘বাংলাদেশে এক বিপ্লব চলছে যার মোকাবিলা করা না হলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ও অন্যান্য জায়গায় বিপদ দেখা দেবে।
(২) নিউইয়র্ক পোস্ট লিখেছিল– ‘বাংলাদেশের জনসংখ্যার ৮৩ শতাংশ মুসলমান। সেখানে চেষ্টা চলছে শরিয়ত ভিত্তিক সংবিধান-সহ ইসলামিক রিপাবলিক অব বাংলাদেশ গড়ে তোলার। লক্ষ্য একটাই, বাংলাদেশের ইসলামিকরণ ঘটানো।
(৩) দ্য হেরাল্ড পত্রিকায় সিআইএ-র মতে, আলকায়েদার শতশত যোদ্ধা আফগানিস্তান থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে এসে সেখান থেকে অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে পড়ছে।
(৪) আমেরিকার টাইম পত্রিকা। লিখেছিল— এক বিরাট আলকায়েদা দল ঢাকায় এসেছে। আমেরিকার সন্ত্রাসবাদ বিরোধী যুদ্ধে বাংলাদেশ এক নতুন। বিপজ্জনক ফ্রন্ট হয়ে উঠতে পারে।
এছাড়া বাংলাদেশের সংবাদপত্রগুলিতে লেখা হয়েছিল– ‘সেখানকার হিন্দুরাই জঙ্গিদের প্রথম টার্গেট। বিভিন্ন সংবাদপত্র হিন্দুদের খুন, জখম, ধর্ষণ ও ভিটেছাড়া করার অজস্র খবর ছাপিয়েছিল। শত শত হিন্দু পুরুষ ও নারী বর্বরতার স্বীকার হলেও খালেদা সরকার থেকেছে নীরব ও নিষ্ক্রিয়। বরং সরকারের শরিক দলগুলি রাস্তায় মিছিল করে স্লোগান দিয়েছিল একটা দুটো হিন্দু ধরো, সকাল বিকাল নাস্তা করো। এত কিছু দেখে ও জেনেও খালেদা সরকার ওইসব জঙ্গিদের বা শরিকদলের নেতাদের বিরদ্ধে কখনও কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। মির্জা সাহেব কি এই ঘটনাগুলি অস্বীকার করেন?
তবে শেখ হাসিনা সরকারের আমলে যে হিন্দুরা সুখে আছেন সেটাও বলা যাবে না। কেননা বাংলাদেশের মুসলমানদের কিছু কিছু লোক হিন্দু মেয়ে-বউদের ধর্মান্তরিত করা এবং ধর্ষণ করা শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে। সেখানকার হিন্দু মহাজোটের নেত্রী প্রিয়া সাহা স্বয়ং আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের হস্তক্ষেপ চেয়েছেন। বাংলাদেশের হিন্দুদের ওপর মুসলমানদের দ্বারা নির্যাতন বন্ধের জন্য। ফকরুল সাহেব নিশ্চয় জানেন যে তার দেশের সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র সিনহা কর্মরত থাকাকালীন তাকে গৃহবন্দি করে রেখে সরকারি আধিকারিকদের দিয়ে মানসিক নির্যাতন ও শেষে সেনাবাহিনীর সদস্যদের দিয়ে লাথি মেরে দেশ থেকে বিতাড়নের কথা। কী অপরাধ ছিল বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার? তাঁর অপরাধ ছিল, তিনি আরও ছয়জন বিচারপতিকে নিয়ে গঠিত সাত সদস্যের ডিভিশন বেঞ্চ গঠন করে, সরকারের বিরুদ্ধে হাইকোর্টের দেওয়া এক মামলার রায় বহাল রেখেছিলেন। কই, সেই বেঞ্চের অন্য ছয় বিচারপতির বিরুদ্ধে তো সরকার কোনো পদক্ষেপ নেয়নি? পদক্ষেপ নেয়নি তার কারণ তাঁরা ছিলেন মুসলমান সম্প্রদায়ের। আর সুরেন্দ্র কুমার সিনহার অপরাধ ছিল— তিনি হিন্দু। তাই তো? বাংলাদেশের কোনও সরকারই হিন্দুদের ভালো চোখে দেখে না। কেউ আঠারো, কেউ কুড়ি।
ভারতে নাগরিকত্ব আইন, এন আর সি ইত্যাদি ভারতের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। এদেশের যে কোনো রাজনৈতিক দলের তাকেই সমর্থন করতে পারে আবার কেউ বিরোধিতাও করতে পারে। এটাই ভারতীয় গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি। ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে সমালোচনা করার অধিকার অন্যদেশের নেই। সুতরাং কোনো দেশের বিরোধী দলের প্রথম শ্রেণীর নেতা হয়ে। পররাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে সমালোচনা করা মানায় না। বাংলাদেশের শাক দিয়ে মাছ ঢাকার প্রচেষ্টা সফল হবে না।
মণীন্দ্রনাথ সাহা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.