বাংলাদেশকে নিয়ে পাকিস্তানের খেলাটা ভয়ংকর ও বিপজ্জনক

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের টেলিফোন দুনিয়াজোড়া খবরের শিরােনাম হয়ে গেছে। ন’মাসের মধ্যে এটা দ্বিতীয় টেলিফোন ইমরান খানের।ন’মাস আগে টেলিফোন করার পর সংবাদপত্রে ছােট্ট খবর হয়, আলােচনা হয়নি। কিন্তু এবারের টেলিফোন নিয়ে বিস্তর আলােচনা হচ্ছে দেশ ও বিদেশের গণমাধ্যমে। কারণ সময়টা ভিন্ন। আলােচনার ধরনটাও ভিন্ন।

উহান থেকে করােনা ভাইরাস সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ার পর সংক্রমণ ও মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হওয়ায় আন্তর্জাতিকভাবে চীনকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানাে, চীন থেকে বড়াে বড়ো প্রতিষ্ঠানগুলির বিনিয়ােগ প্রত্যাহার, বিভিন্ন দেশে পণ্যের বাজার সংকুচিত হওয়ার প্রক্রিয়ার সূচনা ও দুনিয়াজোড়া ঘৃণার মধ্যে লাদাখে ভারতের ভূখণ্ড দখল করে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়া, নেপাল, ভুটান ও শ্রীলঙ্কাকে ভারতের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে প্ররােচিত করার মধ্যে ইমরান খানের টেলিফোন এল। পাকিস্তান তাে জন্ম থেকেই ভারতের সঙ্গে বৈরী আচরণ করে চলেছে। পাকিস্তানের মাটি থেকে চলছে ভারতের ওপর জঙ্গি হামলা। সাম্প্রতিক সময়ে জম্মু ও কাশ্মীরের সাংবিধানিক মর্যাদা পরিবর্তনের পর পাকিস্তান আরও বেপরােয়া হয়ে উঠেছে। পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা ভূখণ্ড ছেড়ে দিয়ে চীনের আস্থা অর্জন করেছে। নেপালের কমিউনিস্ট সরকার চীনের প্রতি অনুগত্য প্রমাণ করতে ভারতীয় ভূখণ্ডকে নিজের দাবি করে সংবিধান সংশােধন করেছে, রাম ও অযােধ্যা নিয়ে বিতর্কিত দাবি করে ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। অন্যদিকে দক্ষিণ চীন সাগর চীনের আধিপত্য হুমকির মুখে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইউরােপ থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে এশিয়ায় নিয়ে আসছে।

এই প্রেক্ষাপটে ইমরান খানের ফোন এবং ১৫ মিনিটের (পাকিস্তানি সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে ২০ মিনিট বলা হয়েছে) আলােচনার বিষয়বস্তুর একাংশ স্বাভাবিকভাবে নানা আলােচনার জন্ম দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রেস সেক্রেটারি এহসানুল করিম স্বাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানাে হয়, গত ২২ জুলাই বেলা ১টায় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান বাংলাদশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে টেলিফোন করেন। দুই নেতার ফোনালাপ ১৫ মিনিট স্থায়ী হয়। কুশলাদি বিনিময়ের পর ইমরান খান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে বাংলাদেশে কোভিড-১৯ মহামারী পরিস্থিতি ও সঙ্কট মােকাবিলায় সরকারের নেওয়া উদ্যোগ সম্পর্কে জানতে চান। জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সরকার করােনা ভাইরাস সংক্রমণ মেকাবিলায় এবং চিকিৎসার ক্ষেত্রে যেসব উদ্যোগ নিয়েছে, তা বিস্তারিত তুলে ধরেন। এছাড়া বন্যা পরিস্থিতি নিয়েও দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী আলাপ করেন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান নিজে থেকেই বন্যা মােকাবিলায় বাংলাদেশের প্রস্তুতি ও উদ্যোগ প্রসঙ্গে জানতে চান। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে চলমান বন্যার সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করেন এবং এটি মােকাবিলায় সরকারের পদক্ষেপের কথাও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করেন।

অন্যদিকে পাকিস্তানের সরকারি বার্তা সংস্থা অ্যাসােসিয়েট প্রেস অব পাকিস্তান (এপিপি) সে দেশের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়কে উদ্ধৃত করে বলেছে, পারস্পরিক বিশ্বাস, সম্মান এবং সার্বভৌম সমতার ভিত্তিতে বাংলাদেশের সঙ্গে ভ্রাতৃত্বমূলক সম্পর্ক গভীর করতে পাকিস্তান প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ইমরান খান ‘ভারত অধিকৃত জম্মু-কাশ্মীরের প্রসঙ্গ গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করেন এবং পাকিস্তানের দৃষ্টিভঙ্গিও তুলে ধরেন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী একটি শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধিশালী অঞ্চল গড়ে তুলতে জম্মু ও কাশ্মীর সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের ওপর গুরত্ব আরােপ করেন। সার্কের প্রতি পাকিস্তানের সমর্থনের কথা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান পাকিস্তান ও বাংলাদেশ যৌথভাবে আঞ্চলিক সহযােগিতা সৃষ্টিকরে টেকসই শান্তি ও উন্নয়নের জন্য কাজ করে যাওয়ার ওপর গুরুত্ব আরােপ করেন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে সুবিধামতাে সময়ে পাকিস্তান সফরের আমন্ত্রণ জানান।

এক দেশের প্রধানমন্ত্রী অন্য দেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছে টেলিফোন করতেই পারেন। মহামারী কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগে দুঃখদুর্দশার খোঁজখবর নেওয়া অত্যন্ত স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু দেশ-বিদেশে এই টেলিফোন নিয়ে আলােচনার কারণ পাকিস্তানের বিবৃতিতে এমন কিছু বিষয় আছে যা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সেক্রেটারি উল্লেখ করেননি। হয়তাে বিব্রতকর বলে উল্লেখ করেননি। পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী মানবিক দিক ছাড়াও কিছু রাজনৈতিক বিষয়ও টেনে এনেছেন। মানবিক বিষয়টি ছিল গৌণ, জম্মু-কাশ্মীর, সার্ক ও দু’দেশের আঞ্চলিক সহযােগিতার বিষয়ই মূখ্য। যার কোনােটিই বাংলাদেশের বক্তব্যে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।

পাকিস্তানের অন্যতম দীর্ঘ দৈনিক দি নেশন তাদের এক মন্তব্য প্রতিবেদনে ইমরান খান এবং শেখ হাসিনার টেলিফোন আলাপকে ‘ডন অব এ নিউ এরা অর্থাৎ পাকিস্তান-বাংলাদেশ সম্পর্কে নতুন দিগন্তের সূচনা হিসেবে বর্ণনা করেছে। প্রভাবশালী এই পত্রিকাটি বলছে, বাংলাদেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার জন্য পাকিস্তানের এখন সম্ভাব্য সবকিছু করা উচিত। পাকিস্তানের মূলধারার গণমাধ্যমে দুই প্রধানমন্ত্রীর এই ফোনালাপকে ইতিবাচক অগ্রগতি হিসেবে দেখা হয়েছে। বিবিসির মতে, স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে যে, পাকিস্তান বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রতিবাদে ২০১৬ সালে তাদের পার্লামেন্টে নিন্দাপ্রস্তাব পর্যন্ত পাশ করেছে, তারা কেন বাংলাদেশের নৈকট্যের জন্য এখন উদগ্রীব?

রাজনীতিতে স্থায়ী শত্রু বা বন্ধু বলে কিছু নেই, কথাটা সত্যি। কিন্তু বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্কের কথা এলে ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানে নির্যাতন-শােষণের দুই দশক এবং একাত্তরের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ, ত্রিশ লক্ষ বাঙ্গালিকে হত্যা ও চার লক্ষেরও বেশি মা-বােনকে নির্বিচারে ধর্ষণ, বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে স্বাধীন বাংলাদেশকে মাথা তুলে দাঁড়াতে না দেওয়ার ষড়যন্ত্র এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর উল্লাস ও হত্যাকাণ্ডের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের অবৈধ সরকারকে স্বীকৃতি দান, একাত্তরের ঘাতক-দালালদের বিচার নিয়ে আপত্তিকর, অনৈতিক ও নােংরা আচরণ—এই বিষয়গুলিকে সামনে রাখতেই হবে। পাকিস্তান বাংলাদেশে গণহত্যা, নারী নির্যাতন ও ধ্বংসযজ্ঞ চালানাের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করেনি। ১৯৪৭ সালে সিমলায় শেখ মুজিবুর রহমান, ইন্দিরা গান্ধী ও জুলফিকার আলি ভুট্টোর মধ্যে স্বাক্ষরিত ত্রিপক্ষীয় চুক্তিতে প্রতিশ্রুত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেনি এবং সম্পদ ভাগাভাগির বিষয়টি ফয়সালা করেনি। তারপরও বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের দ্রুত উন্নতি চায় পাকিস্তান।

পাকিস্তানে সামরিক সমর্থন ছাড়া কেউ ক্ষমতায় যেতে পারে না, ক্ষমতায় থাকতেও পারে না। গণতন্ত্র সেখানে মুখােশ মাত্র। আপাতত ইমরান খান তাদের প্রতিনিধি, যদিও কোনাে কারণে এই সম্পর্কে সাম্প্রতিক সময়ে চিড় ধরেছে বলে গণমাধ্যমে খবর এসেছে। সেই প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে টেলিফোনে আলােচনায় সার্ক ও আঞ্চলিক সহযােগিতা বাড়ানাের কথা উল্লেখ করেছেন। করােনা পরিস্থিতি জানতে চেয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছে। অথচ মাত্র কয়েক মাস আগে করােনা সংক্রমণের গােড়ার দিকে একটি সুন্দর ও মানবিক উদ্যোগেও পাকিস্তানের পাকিস্তানি চরিত্র’ অত্যন্ত জঘন্যভাবে প্রকাশ পায়। ‘প্রতিবেশী প্রথমে’ নীতির অংশ হিসেবে এবং কোভিড-১৯-এর বিস্তার রােধ করার জন্য একটি সমন্বিত আঞ্চলিক উদ্যোগ নিতে গত ১৫ মার্চভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মােদীর উদ্যোগে সার্ক নেতৃবৃন্দের একটি ভিডিয়াে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে সার্ক দেশগুলির সরকার প্রধানগণ যােগ দিলেও পাকিস্তানের পক্ষ থেকে যােগ দেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। অর্থাৎ গােড়াতেই এই মানবিক উদ্যোগটিকে ভালাে দৃষ্টিতে দেখেনি পাকিস্তান, যেহেতু উদ্যোগটি ভারতের প্রধানমন্ত্রীর এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা-সহ অন্যান্য সার্ক নেতৃবৃন্দ তাৎক্ষণিকভাবে সাড়া দিয়েছেন। প্রাণঘাতী একটি ভয়ংকর রােগের বিরুদ্ধে লড়াইয়েও পাকিস্তান রাজনীতি নিয়ে আসে এবং হীনমন্যতার পরিচয় দেয়।ভিডিয়াে সম্মেলনেও ‘নেতিবাচক পরিচয় রাখে পাকিস্তান। সম্মেলন যখন সুন্দর ও কার্যকর পদক্ষেপের দিকে এগুচ্ছ। দ্বিতীয় পর্যায়ে বক্তব্য রাখতে গিয়ে পাকিস্তানের স্বাস্থ্যমন্ত্রী তখনই কাশ্মীর প্রসঙ্গটি নিয়ে আসেন। তাও আবার নাটকীয়ভাবে। দৃশ্যটি সবারই চোখে পড়েছে অত্যন্ত কটুভাবে। দ্বিতীয় পর্যায়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন বক্তব্য রাখছিলেন, এমন সময় দেখা যায় পাকিস্তানের স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বাঁ দিক থেকে এক ব্যক্তি এলেন, মন্ত্রীর সামনে থেকে একটি কাগজ উঠিয়ে নিয়ে চলে গেলেন। নিমেষেই ডানদিক থেকে একটি কাগজ এসে যায় মন্ত্রীর সামনে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী ফ্যালফ্যাল করে তাকালেন। এরপর তার বক্তব্যে ঢুকে গেল কাশ্মীর। টেলিভিশনের পর্দায় সবাই দেখলেন। এমন অশােভন ও অনৈতিক কাজ পাকিস্তানের পক্ষেই সম্ভব। সার্ক সনদে কোনাে দ্বিপক্ষীয় সমস্যা উত্থাপনের কোনাে সুযােগ নেই। আর কোভিড-১৯-এর সমূহ বিপদ মােকাবিলা নিয়ে যেখানে বৈঠক সেখানে এই ঘটনাটি সার্ক নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার ইতিবাচক পরিচয় বহন করে না। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী সেই ইমরান খান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আলােচনায় সার্ক ও আঞ্চলিক সহযােগিতার কথা তুললেন, তার মধ্যে স্বাভাবিকভাবে ‘কোনাে কিছুর ছায়া দেখতে পাওয়া যায়।

মাত্র মাসখানেক আগে আল কায়েদা প্রধান ওসামা বিন লাদেনকে ‘শহিদ’ বলে উল্লেখ করেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নিরাপদ আশ্রয়ে অ্যাবােটাবাদে গ্যারিসন টাউনে থাকা ওসামা ২০১১ সালে মার্কিন নেভি সিলের আকস্মিক এক অভিযানে নিহত হন। ইমরান খান ওসামাকে প্রয়াত মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটনের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। বােঝা যাচ্ছে সেনাবাহিনীর সর্বাত্মক আস্থা লাভে চেষ্টার কোনাে খামতি নেই ইমরান খানের। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নাকানিচুবানি খাওয়ার পর লাদেনকে গােপনে আশ্রয় দিয়ে। মার্কিন বাহিনীর হাতে দ্বিতীয়বার মানসম্মান খােয়ায়। একাত্তরে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ কমান্ডের অধিনায়ক লে. জেনারেল জগজিৎ সিংহ অরােরার কাছে প্রায় ৯০ হাজার সৈন্য নিয়ে আত্মসমর্পণ করেছিলেন পরাজিত পাকিস্তানি বাহিনীর অধিনায়ক লে. জেনারেল আমির আলি খান নিয়াজি, তারই যােগ্য ভাতিজা ইমরান খান নিয়াজি।।

তবে এবারে পাকিস্তানের খেলাটা বেশ বিপজ্জনক ও ভয়ংকর বলে মনে হচ্ছে। চীন সাম্রাজ্যবাদের নতুন মােড়ল হওয়ার যে স্বপ্ন দেখছে, গােটা এশিয়া জুড়ে দাপাদাপির চেষ্টা তারই ইঙ্গিতবহ। পাকিস্তান তাদের পুরনাে বন্ধু, পাকিস্তানে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধিকারের লড়াই ‘ভােটের আগে ভাত চাই’ স্লোগান তুলে রুখে দেওয়ার ষড়যন্ত্র হয়েছিল। আইয়ুব খান-ইয়াহিয়া খানকে রক্ষার এই প্রেসক্রিপশন এসেছিল চীন থেকে, কিন্তু ষড়যন্ত্র সফল হয়নি। বাঙ্গালির মুক্তিযুদ্ধ রুখতে ৩০ লক্ষ মানুষকে হত্যা করা হয় চীনের অস্ত্রে, মদতে। শেষ পর্যন্ত কিন্তু অখণ্ড পাকিস্তান রক্ষা পায়নি।

এবারও উদ্বেগটা একই কারণে। বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি সাধনে পাকিস্তানের চেষ্টা হতেই পারে।কিন্তু উদ্বেগটা হচ্ছে, তার পেছনে যে ছায়াটা দাঁড়িয়ে আছে এবং মাথার ওপরে হাত রেখেছে তাকে নিয়ে। এই শক্তিটার আধিপত্যবাদী থাবা এখন গােটা বিশ্বকে দাপিয়ে বেড়াতে চায়, তাদের হাতেও একাত্তরে ৩০ লক্ষ বাঙ্গালি হত্যার রক্ত লেগে আছে, লক্ষ লক্ষ নারী নির্যাতনের আর্তনাদ এখনাে কান পাতলে শােনা যায়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়া পর্যন্ত স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি। জাতিসঙ্ঘাে দীর্ঘদিন আটকে রাখা হয়েছিল বাংলাদেশের সদস্যপদ। এসব হয়তাে ইতিহাস, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবােধের সঙ্গে হাঁটতে গেলে ইতিহাসের পাতা ওলটাতেই হয়। এতাে তাড়াতাড়ি ভুলে যাওয়া আত্মঘাতী হতে পারে। কারণ পাকিস্তানকে চেনা, পেছনের ছায়াটাও বড্ড চেনা।

উদ্বেগ আরও আছে। কয়েকদিন আগে বাংলাদেশের একটি সংবাদপত্রে এক বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দায়িত্বপালনরত উপদেষ্টাদের মধ্যে পাকিস্তানের প্রতি সহানুভূতিশীল উপদেষ্টার সংখ্যা বেড়েছে, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষাকারী উপদেষ্টারা গুরুত্ব হারিয়েছেন এবং দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষমতার বলয়ে জোরালােভাবে উপস্থিত হয়েছে চীন। চীন-পাকিস্তানের যৌথ প্রয়াসে বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে সম্পর্কে নতুন সমীকরণ এনেছে। বলে বিশ্লেষকদের ধারণা। যে কারণে বিভিন্ন ইস্যুতে বাংলাদেশ- ভারতের মধ্যে সম্পর্কের টানাপােড়েন তৈরি হয়েছে। যদিও দু’দেশ প্রকাশ্যে এখনাে এ বিষয়ে কিছু বলতে রাজি নয়।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২০১৯ সালে বাংলাদেশের নতুন মন্ত্রীসভা গঠিত হওয়ার পর থেকে ভারতীয় প্রকল্পগুলাের কার্যক্রম পিছিয়ে পড়েছে। অন্যদিকে চীনের প্রকল্পগুলির ব্যাপারে উৎসাহ দেখা গেছে দৃষ্টিকটু পর্যায়ে। ভারতের উদ্বেগ সত্ত্বেও সীমান্তবর্তী সিলেট বিমানবন্দর সম্প্রসারণের প্রকল্প চীনা কোম্পানিকেই দেওয়া হয়েছে। করােনা মােকাবিলায় ভারত সরকার বিভিন্ন সামগ্রী দিলেও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে একটি ধন্যবাদ চিঠিও পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে চীনের একটি ডাক্তারের প্রতিনিধি। দলকে অভ্যর্থনা জানানাের জন্য বিমানবন্দরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মােমেনের উপস্থিতি ও বিদায় জানানাের সময় স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের সংবর্ধনা নিয়ে নানা বিশ্লেষণ চলছে নয়াদিল্লির সাউথ ব্লকে। এর মধ্যে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের এই নতুন। মেরুকরণ বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে ভিন্ন বিশ্লেষণ দাবি করছে। গত পহেলা জুলাই এই করােনা পরিস্থিতির মধ্যে বাংলাদেশে নিযুক্ত পাকিস্তানের হাইকমিশনার ইমরান আহমেদ সিদ্দিকী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মােমেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। এই সাক্ষাতের খবর বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কোনাে মিডিয়ায় প্রচার না করলেও খবরটি প্রচারের জন্য পাকিস্তান হাইকমিশনের বিশেষ প্রচেষ্টা ছিল লক্ষণীয়।

প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, ‘২০১৮-১৯ পর্যন্ত বাংলাদেশে পাকিস্তানের কোনাে হাইকমিশনার পর্যন্ত ছিল না। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তৎকালীন পাকিস্তানি হাইকমিশনার রফিকুজ্জামান সিদ্দিকী দায়িত্ব পালন শেষে চলে যাওয়ার পর মার্চ মাসে ঢাকায় নতুন হাইকমিশনার হিসেবে সাকলাইন সাঈদের নাম ঘােষণা করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হাইকমিশনার হিসেবে পাকিস্তানি এই কূটনীতিকের নিয়ােগে অনুমােদন দেয়নি। দীর্ঘ দু’বছর হাইকমিশনার ছাড়া অবস্থায় ছিল ঢাকাস্থ পাকিস্তানের হাইকমিশন। দু’দেশের সম্পর্ক এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে দুই দেশ একে অপরকে ভিসা দেওয়াও বন্ধ করে দেয়। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে পাকিস্তান নতুন করেইমরান আহমেদ সিদ্দিকীকে বাংলাদেশে হাইকমিশনার হিসেবে নিয়ােগ করে। সরকারের ভিতরে থাকা পাকিস্তানি লবির জোর তৎপরতায় দ্রুত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতি পাওয়া যায় এবং জানুয়ারিতে তিনি ঢাকায় এসে পৌঁছান। গত ১৯ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের কাছে তিনি তার পরিচয়পত্র পেশ করেন। অন্যদিকে সম্পর্ক উন্নয়নের প্রচেষ্টায় সরকারের বিভিন্ন মহলের সঙ্গে পাকিস্তানি হাইকমিশনারের তৎপরতা ছিল লক্ষণীয়। এরই অংশ হিসেবে। গত পহেলা জুলাই বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর পাকিস্তানের হাইকমিশনার ইমরান আহমেদ সিদ্দিকীর মন্তব্য ছিল। গুরুত্বপূর্ণ।

তুরস্কের বার্তা সংস্থা আনাদুলুকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ ইতিহাস, ধর্ম ও সংস্কৃতির বন্ধনে একসঙ্গে আবদ্ধ। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে এই আকস্মিক সাক্ষাৎকারটির পেছনে সরকারের ভেতরের লবিটি জোরালাে ভূমিকা পালন করেছে বলে জানা যায়। এই লবির তৎপরতায় গত জানুয়ারিতে নিরাপত্তার কারণে বিশ্বের সব দেশের বয়কট সত্ত্বেও বাংলাদেশের ক্রিকেট দল অদ্ভুত ৩ দফা সফরসূচি তৈরি করে। জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে একটি টি-টোয়েন্টি সিরিজ খেলিয়ে আনতেও তারা সক্ষম হয়, যদিও কোনাে কোনাে খেলােয়াড় নিরাপত্তার কারণ উল্লেখ করে পাকিস্তান সফরে যেতে রাজি হয়নি এবং করােনার কারণে বাকি দুটি সফর আর অনুষ্ঠিত হয়নি।

কিন্তু বাংলাদেশ- পাকিস্তানের সুসম্পর্ক তৈরির চেষ্টায় ওই পাকিস্তানি গােষ্ঠীর সক্রিয়তা ও নানা উদ্যোগ অব্যাহত রয়েছে।

ঢাকা থেকে বিশেষ প্রতিনিধি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.