রবীন্দ্রনাথ তৎকালীন পূর্ববঙ্গে জমিদারি তদারকিতে এসে লালন সাঁইকে আবিষ্কার করেছিলেন। আজ সেই পূর্ববঙ্গ স্বাধীন বাংলাদেশ। পাকিস্তানের দ্বিজাতি তত্ত্বকে পরাজিত করে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে এই বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়েছে। তার গান বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত। রবীন্দ্রনাথের গানের ভুবনে বাউল গানের প্রভাব এক নতুন ধারা রচনা করে। রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকলে নতুন অভিজ্ঞতা হতো, যে দেশে লালন আবিষ্কৃত হয়েছিলেন, সে দেশে লালনের উত্তরসূরিদের জগৎ ধীরে ধীরে সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। বাউলরা, লোকগানের শিল্পীরা ভালো নেই। দিনদিন তাদের উদ্বেগ-শঙ্কা বাড়ছে। তাদের মধ্যে অস্তিত্ব সংকট প্রকট হচ্ছে।
ইসলাম রক্ষার নামে বাংলাদেশে বাউল ও অন্যান্য লোকগানের শিল্পীদের আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা নতুন নয়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, সম্প্রতি শরিয়ত সরকার বয়াতি নামে এক বাউল কবিগানের আসরে ইসলামের ‘উদার দিক তুলে ধরতে গিয়ে কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন। তার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলায় বলা হয়েছে, এই বয়াতি ঢাকার ধামরাইয়ে এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, গান-বাজনা হারাম বলে ইসলাম ধর্মে কোনো উল্লেখ নেই। কেউ প্রমাণ দিতে পারলে তিনি গান ছেড়ে দেবেন।
বয়াতির সেই বক্তব্য ইউটিউবে প্রচারিত হয়। আর ইউটিউবে সেই বক্তব্য দেখে ফরিদুল ইসলাম নামে এক কট্টর মুসলমান ইসলামের নবী ও ধর্ম নিয়ে কটুক্তি করেছেন শরিয়ত বয়াতি, এই অভিযোগ এনে মামলা ঠুকে দেন। বলা হয়, ইসলামের অবমাননা হয়েছে। বয়াতির বিরুদ্ধে ইসলাম অবমাননার অভিযোগে বিক্ষোভও হয়। এর পরই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। টাঙ্গাইলের মির্জাপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সাইদুর রহমানের বক্তব্য, বয়াতি আল্লাহ, নবী, রাসুল নিয়ে বক্তব্য দিয়েছেন। এর বিরুদ্ধে বিভিন্ন ইসলামি সংগঠন ও আলেম সমাজবিক্ষোভ করেছেন, বয়াতিকে গ্রেপ্তারের জন্যে আলটিমেটাম দিয়েছেন। মামলাও হয়েছে। সেজন্যে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অভিযুক্ত হয়েছেন।
এই ঘটনায় লোকজ শিল্পীরা বিক্ষুব্ধ। তারা বলছেন, যুগ যুগ ধরে লোকজ শিল্পীরা গানের ভাব বা কথা ব্যাখ্যা করার পর গান পরিবেশন করেন। একে কেন্দ্র করে এমন গ্রেপ্তারের ঘটনা বাউল ধারার বিরুদ্ধে একটা বড়ো আঘাত। লোকজ গানের বিশিষ্ট শিল্পী কৃষ্ণকলি ইসলাম বলেন, কবিগানের লড়াই এটাতো চিরন্তন শরিয়ত ও মারফতির লড়াই। এই লড়াই বুদ্ধির চর্চার মাধ্যমে হতো। কিন্তু এবার যা হলো, তাতে প্রমাণ হলো যে, আমাদের দেশে বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা বার বার আহত হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, এই বাউল শিল্পী ইসলামে গানকে নিষিদ্ধ করা হয়নি, সেটা তুলে ধরেছেন। কারণ সমাজে এক ধরনের অপব্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে। বয়াতি এই অবব্যাখ্যার বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন, এই ঘটনা সংগীত জগতের ওপর আঘাত। এই বয়াতির বক্তব্য, ইসলামে সংগীত নিষিদ্ধ নয়। আমাদের সমাজে কট্টর ইসলামপন্থীরা ইসলামের বিকৃত ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। বয়াতি তারই জবাব দিয়েছেন। তিনি ইসলামকে উদার দৃষ্টিতে দেখেছেন। কিন্তু ইসলামপন্থীরা আজ অসহিষ্ণুতার এতো উচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছেন যে, তা মানতে নারাজ। সরকার এই গ্রেপ্তারের মাধ্যমে ইসলামপন্থীদের সঙ্গে এক কাতারে দাঁড়ালেন।
সমাজে এই বার্তা গেল, কেউ গান গাইতে পারবে না, স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করতে পারবে না। বাউল-বয়াতিরা কি সামনে এগুতে সাহস পাবেন? বাংলা অ্যাকাডেমির লোকসংগীত গবেষক সাইমন জাকারিয়া বলেছেন, গ্রামের মানুষ থানায় গিয়ে একজন শিল্পীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করবে, এটা খুব স্বাভাবিক বিষয় নয়। এর সঙ্গে অন্য বিষয় জড়িত। বাংলাদেশে এমন অসহিষ্ণুতা আগে কখনো দেখা যায়নি। সাইমন জাকারিয়া আরও বলেন, বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে একটি ধর্মীয় গোষ্ঠী ব্যাপকভাবে পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে, আমাদের শিক্ষা ও প্রশাসনে ওরা প্রাধান্য পাচ্ছে। আমাদের মনস্তাত্ত্বিক জগতে একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করছি। এটা সংগীত জগতে অসুস্থ মানসিকতার লক্ষণ।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নেত্রকোনায়। হেফাজতে ঈমান নামে এক উগ্র ইসলামি সংগঠনের দাবির মুখে লালন অনুসারীদের একটি অনুষ্ঠানে প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথা সম্মর করিয়ে দেওয়া হয়। বলা হয়, এটা বর্তমান সরকারের আমলেই হয়েছে। এটা লালনের গানের এক বাৎসরিক অনুষ্ঠান ছিল। হেফাজতে ঈমান নেতারা হুমকি দিয়ে বলেছিলেন, লালনের গান ইসলাম-বিরোধী। এই গানকে বাংলাদেশের মাটি থেকে উৎখাত করতে হবে। এর আগে মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, রাজবাড়ি ও নাটোরে লালনভক্তদের সাধুসঙ্গে হামলা করা হয়েছে। বাউলরা নানা জায়গায় আক্রান্ত হচ্ছে। বাউলরা অভিযোগ করেছেন, তাদের ওপর হামলা হলে প্রশাসন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করে না। বাউল নেতা পাগলা বাবলু বলেছেন, কষ্টটা হচ্ছে, যেখানে লালন সাঁই বলেছেন, মানুষ ভজলে সোনার মানুষ পাবি, আমাদের ইসলাম-বিরোধী বলা হচ্ছে। আমরা মানুষকে বড়ো করে দেখি এটা আমাদের ঘোরতর অপরাধ। কষ্ট শুধু আমাদের মধ্যে নয়, সমগ্র দেশে লোকশিল্পীদের মধ্যে কালো মেঘের ছায়া পড়েছে।
ঢাকা থেকে বিশেষ প্রতিনিধি