একটি বইয়ের ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দুঃখ করে বলেছেন, “এতকাল আমাদের দেশের যে-কেহ অক্ষর মাত্র পড়িতে জানিত, কৃত্তিবাসের রামায়ণ এবং কাশীরাম দাসের মহাভারত না পড়িয়া ছাড়িত না। যাহার অক্ষরবােধ ছিল না, সে অন্যের মুখ হইতে শুনিত। এই রামায়ণ, মহাভারত আমাদের সমস্ত জাতির মনের খাদ্য ছিল; এই দুই মহাগ্রন্থই আমাদের মনুষ্যত্বকে দুর্গতি হইতে রক্ষা করিয়া আসিয়াছে। আজকাল আমরা যাহাকে শিক্ষিত সম্প্রদায় বলি, সেই সমাজে এই দুই গ্রন্থ এখন আর কেহ পড়ে না।” রামায়ণ মহাভারত না পড়ার হতাশা অন্য একটি চিঠিতেও তিনি লিখে গিয়েছেন, “কৃত্তিবাসের রামায়ণ যদি বাঙ্গালি ছেলে-মেয়েরা না পড়ে তবে তার চেয়ে শােচনীয় আশঙ্কা আমাদের পক্ষে আর কিছু হতে পারে না।”
দেশীয় পুরাণের প্রতি রবীন্দ্রনাথের সদর্থক। আসক্তি ছিল। আর ছিল বলেই রবীন্দ্রনাথ বুঝেছিলেন শিশুপাঠ্যে শিশুকে সবসময় তার ঐতিহ্যের মধ্যে ঘােরাফেরা করতে দিতে হবে। ঐতিহ্যের শিক্ষার মধ্যেই শিশুকে সবচাইতে ভালােভাবে শিক্ষিত করা সম্ভব। শিশুকে যথােপযুক্ত নাগরিক হয়ে উঠতে সহায়তা করে দেশ ও তার ঐতিহ্য। ঐতিহ্যের প্রতি টান, ঐতিহ্য-বিষয়ক জ্ঞান একেবারে ছােটোবেলা থেকেই আসা দরকার। রবীন্দ্র-মানসে ঐতিহ্য তাই লেপটে আছে, ঢুকে আছে সহজপাঠে, শিশু কাব্যগ্রন্থের পরতে পরতে। একইভাবে রবীন্দ্র সাহিত্যে অন্বিত রামায়ণের অমােচ্য কলম, যাকে বিচ্ছিন্ন করা যাবে না কোনােদিনও।“তােরা যে যা বলিস ভাই/আমার সােনার হরিণ চাই।”“রাম’ বলতেই ভারতীয় শিশুর কাছে এক অমােচ্য চিত্র ফুটে ওঠে। মিথােম্যানিয়ার জন্যই সহজপাঠ বইটি আজ সেকুলার, বিধর্মী আর বামেদের কাছে এতটা ব্রাত্য !
মহাভারতের ঐতিহাসিকতা নিয়ে বিপুল গবেষণা করেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
তার ‘কৃষ্ণচরিত্র’-তে এই বিষয়ে বিস্তারিত আলােচনা আছে। ভারতীয় মহাকাব্য যে ভারতের ইতিহাস, তা বলার ক্ষেত্রে স্পষ্টবাদী ছিলেন রবীন্দ্রনাথও। “রামায়ণ-মহাভারতকে কেবলমাত্র মহাকাব্য বলিলে চলিবে না, তাহা ইতিহাসও বটে। ঘটনাবলীর ইতিহাস নহে; কারণ সেরূপইতিহাস সময় বিশেষকে অবলম্বন করিয়া থাকে, রামায়ণ-মহাভারত ভারতবর্ষের চিরকালের ইতিহাস।” কথায় বলে, “যাহা নাই
মহাভারতে তাহা নাই ভারতে৷ এত বিচিত্র ও বিপুল বিষয়ের অবতারণা মহাভারতে আছে। যে তার অধিক বিষয় ভারতবর্ষের মতাে বিরাট দেশেও অসম্ভব। মহাভারতের কাহিনির মধ্যে চিরকালীন ভারতীয় সমাজের চিত্রটি যেন আবিষ্কৃত হয়ে গেছে। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “ইহা কোনাে ব্যক্তিবিশেষের রচিত ইতিহাস নহে, ইহা একটি জাতির স্বরচিত স্বাভাবিক ইতিবৃত্ত।”রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীরও একই কথা, “মহাভারতের বর্ণিত ইতিহাস মানব সমাজের বিপ্লবের ইতিহাস।” শ্রীঅরবিন্দের মতে, এক সাংস্কৃতিক বিপ্লবের কাহিনি।।
রাম বাঙ্গালির দেবতা নয়, এটা বাম-কংগ্রেস-নকশাল প্রায়ই বলে থাকে। কাছে। গেলে শােনা যায়, রাম উত্তর ভারতের। গুটকাখােদের দেবতা। কিন্তু কৃত্তিবাসী রামায়ণ যদি মেলে ধরা হয়, তারা প্রবল অস্বস্তির সম্মুখীন হন। বাম আমলে কৃত্তিবাসী পাণ্ডুলিপি আবিষ্কার হলে হয়তাে বিনষ্ট হবার সমূহ সম্ভাবনা থাকতাে। নেহাত ১৮০২-০৩ সালে শ্রীরামপুর মিশন প্রেস পাঁচ খণ্ডে ‘কৃত্তিবাসী রামায়ণ’ প্রকাশ করে ফেলেছিল তাই রক্ষে!
যারা বলেন রাম বাঙ্গালির দেবতা নন, তারা কী জানেন রবীন্দ্রনাথ কী বলেছেন?“বাঙ্গলাদেশে যে এক সময়ে সমস্ত জনসাধারণকে একটা ভক্তির প্লাবনে প্লাবিত করিয়া তুলিতেছিল; সে ভক্তিধারার অভিষেকে উচ্চ-নীচ, জ্ঞানী, মূর্খ, ধনী, দরিদ্র সকলেই এই আনন্দের মহাযজ্ঞে সম্মিলিত হইয়াছিল—বাঙ্গলা রামায়ণ, বিশেষভাবে, বাঙ্গলাদেশের সেই ভক্তিযুগের সৃষ্টি। বাঙ্গলাদেশে সেই যে এক সময়ে একটি নবােৎসাহের নব-বসন্ত আসিয়াছিল, সেই উৎসবকালের কাব্যগুলি বাঙ্গালির ছেলে যদি শ্রদ্ধাপূর্বক পাঠ করে, তবে দেশের যথার্থ ইতিহাসকে সজীবভাবে উপলব্ধি করিতে পারিবে।”
তা কবে থেকে বাঙ্গালি রামনামে জারিত? কৃত্তিবাসের শ্রীরামপাঁচালীর স্বাদ বাঙ্গালি পেয়েছে অন্তত ছ’শাে বছর আগে। অনুমান করা যায় তার আগে থেকেই বাঙ্গলার প্রবুদ্ধ মহলে সংস্কৃত বাল্মীকি রামায়ণের চর্চা ছিল এবং লােককথায় তার অবিসংবাদিত বিস্তারও ছিল। লােকায়ত-মানসে এমন শক্ত ভিত্তি না থাকলে কৃত্তিবাস এমন জনপ্রিয় ও লােকপ্রিয় রামায়ণ কাব্য লিখতে প্রেরণা পেতেন না। আশ্চর্যের বিষয় হলাে, রামায়ণ বিরােধিতা করতে গিয়ে হিন্দু বিরােধী ভ্রান্ত সেকুলারি সমাজ শ্রীরামকে অবাঙ্গালির দেবতা বলে দেগে দিয়েছেন। মনে রাখতে হবে, তুলসীদাসী রামচরিতমানস লেখা হয়েছে কৃত্তিবাসী রামায়ণের অনেক পরে। সম্ভবত রামজন্মভূমি-বাবরি ধাঁচা বির্তকে বাঙ্গালিকে শামিল করানাের ‘সেকুলারি-চালাকি’ ছিল ‘অসত্য কথা বলা ইতিহাসবেত্তা’-দের।
শ্রীরামকৃষ্ণের কুলদেবতা শ্রীরামচন্দ্র, স্বামী বিবেকানন্দের রাম-উপাসনা, রানি রাসমণির রঘুবীর সাধনাকে বাঙ্গালি ভুলে গেছে। বাঙ্গালি কীভাবে ভুলে যায় বঙ্গভূমির ঘরে ঘরে জপিত মহামন্ত্র “হরে রাম হরে রাম / রাম রাম হরে হরে হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে। হরে”।
কৃত্তিবাসী রামায়ণ নিয়ে বামপন্থীদের যথেষ্ট অস্বাচ্ছন্দ্য বােধ কাজ করে, তার একটি ছােট পরিচয় তুলে ধরা যাক। মহাশ্বেতা দেবী কোনাে এক জায়গায় উল্লেখ করেছেন, “কৃত্তিবাসের রামায়ণে আলাদা করে কোনাে অন্ত্যজ ভাবনা থাকতে পারে না। তিনি সংস্কৃত রামায়ণ অসামান্য ভাষায় ও ছন্দে বাংলায় লিখেছিলেন মাত্র।” (দেবী মহাশ্বেতা ১৩৯৫ কৃত্তিবাসের রামায়ণে অন্ত্যজ ভাবনা, কবি কৃত্তিবাস সংকলন গ্রন্থ, ফলিয়া-বয়রা, নদীয়া, পৃষ্ঠা ১৫১)। কিন্তু সত্যিই কী তাই?
১.শ্রীরামের সঙ্গে চণ্ডাল গুহকের মিতালি কবি কৃত্তিবাস যে ভাষায় বলেছেন, তার পর মহাশ্বেতা দেবীর উচিত হয়নি কৃত্তিবাসে অন্ত্যজ ভাবনা অনুপস্থিত। কৃত্তিবাস লিখেছেন, “চণ্ডাল বলিয়া যদি ঘৃণা কর মনে পতিত পাবন নাম তবে কি কারণে।”মনে রাখার মতাে বিষয় এই, কৃত্তিবাস যখন এমন কথা লিখছেন, তখনও আবির্ভূত হননি সাম্যবাদী ভক্তি আন্দোলনের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ শ্রীচৈতন্য। এমন মানুষের সাহিত্যকীর্তি নিয়ে মহাশ্বেতা দেবীর ‘সাড়েছয়ানা’ টাইপের মন্তব্য আমাদের ব্যথিত করে।
২. সুগ্রীবের সঙ্গে শ্রীরামচন্দ্রের সখ্য, বানরকুলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা কীসের ঈঙ্গিতবাহী?
৩. অন্ত্যজ শবরীর হাত থেকে শ্রীরামচন্দ্র ফল গ্রহণ করছেন, সেই জায়গাতেও কৃত্তিবাস মুনশিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন।
রামায়ণের শিকড় যে কতটা মজবুত তার প্রমাণ ছড়িয়ে আছে নানান বনবাসী কৌমগােষ্ঠীর পুরাণ কথাতেও। একটি বিরহড় লােককথা, ‘রাম-সীতা-হনুমান’ গল্প; সেখানে শােনান হয়েছে তেঁতুল আর খেজুর পাতার অভিযােজনের গল্প। রাম-লক্ষ্মণ-সীতা বনে চলে গেল। সেখানে তারা ‘উথলু’বিরহড়দের মতাে যাযাবরের জীবন কাটাতে লাগল। থাকত পাতার ছাওয়া কুঁড়েঘরে। একবার একটা মস্ত বড় তেঁতুল গাছের তলায় ঘর তৈরি করল তারা। সেই সময় তেঁতুল গাছের পাতা ছিল মস্ত বড়াে বড়াে; ভেতর দিয়ে রােদ ঢুকতে পারত না। রাম ভাইকে বলল, আমরা বনবাসে এসেছি, এখানে কষ্টে থাকতে হবে, আরাম করা চলবে না। কিন্তু এই গাছের ছায়ায় আমরা সুখে আছি, আমাদের গায়ে রােদ বৃষ্টি লাগছে না। এটা তাে ঠিক নয়। তুমি তির মেরে পাতাগুলােকে চিরে দাও। লক্ষণ তির মেরে তেঁতুল পাতাগুলােকে চিরে ফালাফালা করে দিল। একটা পাতা চিরে অনেক ছােটো ছােটো পাতা হয়ে গেল। সেই পাতার মধ্যে দিয়ে বৃষ্টির জল আর রােদের তাপ তাদের দেহে লাগল। সেইদিন থেকেই তেঁতুল পাতা এত ছােটো হয়ে গেল। আবার চলেছে তিনজন বপনথ দিয়ে। এবার তারা ঘর তৈরি করল খেজুর গাছের নীচে৷ সেইকালে খেজুর পাতা ছিল খুব লম্বা আর চওড়া। বৃষ্টির জল আটকে দিত সেই পাতা। রাম আবার ভাইকে তির ছুঁড়তে বলল। লক্ষ্মণ তির মেরে খেজুর পাতাকে সরু সরু করে দিল। সেইদিন থেকে খেজুর পাতা সরু সরু হয়ে গেল। এই গল্পটি বনবাসী সমাজে প্রচলিত অনেকানেক গল্পের মতােই, যা প্রমাণ করে রামায়ণ ও মহাভারতের কাহিনি বনবাসী কৌমসমাজেরও উত্তরাধিকার।
বামপন্থী নানান ন্যারেশনে রামচরিত্রকে ছােটো করে দেখানাে হয়েছে। সমকালকে বিচার না করে তার চরিত্রের মধ্যে তুলে ধরা হয়েছে নানান অসঙ্গতি। অথচ রবীন্দ্রনাথ দেবর্ষি নারদকে দিয়ে বলাচ্ছেন রামচরিত্রের অপূর্বর্তা, অমৃতভাষণ— ..“কহাে মােরে, বীর্য কার ক্ষমারে করে না অতিক্রম, কাহার চরিত ঘেরি সুকঠিন ধর্মের নিয়ম ধরেছে সুন্দর কান্তি মাণিক্যের অঙ্গদের মতাে, মহৈশ্বর্যে আছে ন, মহাদৈন্যে কে হয়নি নত, সম্পদে কে থাকে ভয়ে, বিপদে কে একান্ত নির্ভীক, কে পেয়েছে সব চেয়ে, কে দিয়েছে তাহার অধিক, কে লয়েছে নিজ শিরে রাজভালে মুকুটের সম সবিনয়ে সগৌরবে ধরা মাঝে দুঃখ মহত্তম। কহাে মােরে সর্বদর্শী হে দেবর্ষি তার পুণ্য নাম।” নারদ কহিলা ধীরে, “অযােধ্যার রঘুপতি রাম।।” (কবিতা—ভাষা ও ছন্দ)
আমরা দেখি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর যে ঈশ্বর মানতেন না, তা প্রমাণ করতে বামপন্থীরা খুবই যত্নবান ছিলেন। অথচ ১৮৬০ সালে বিদ্যাসাগরই লিখেছিলেন “মহাভারত’—উপক্রমণিকা ভাগ এবং রামায়ণের উত্তরকান্ড অবলম্বনে ‘সীতার বনবাস’। সত্যজিৎ রায়ের পিতামহ উপেন্দ্রকিশাের রায়চৌধুরী ছেলেদের রামায়ণ ও মহাভারত লিখে মহাকাব্য পড়ার একটি কৈশাের জীবন তৈরি করে দিয়েছিলেন। ভবিষ্যপুরাণে আছে, রামায়ণ মহাভারতাদি ইতিহাস ও অষ্টাদশ পুরাণ ইত্যাদি শাস্ত্র অধ্যয়ন করলে সংসার জয় হয়, অর্থাৎ জীব জন্মমৃত্যুপরম্পরারূপ সংসারশৃঙ্খলা হইতে মুক্ত হয়।
অষ্টাদশ পুরাণানি রামস্য চরিতং তথা। কার্ফং বেদং পঞ্চমঞ্চ যন্মহাভারতং বিদুঃ।। তথৈব শিবধর্মাশ্চ বিষ্ণুধর্মাশ্চ শাশ্বতাঃ।। জয়েতি নাম তেষাষ্ণ প্রবদন্তি মনীষিণঃ।। সংসারজয়নং গ্রন্থং জয়নামানমীরয়েৎ।।
শ্রীকৃষ্ণ প্রদত্ত গীতােপদেশ বা শ্রীমদ্ভগবত গীতা মহাভারতেরই এক অঙ্গ। শ্রীকৃষ্ণের বাঙ্য়ী মূর্তি। বলা হয় গীতার মধ্য দিয়ে শ্রীকৃষ্ণ সত্যযুগ আগমনের উপযােগী গুহ্য জ্ঞান ও কর্মপ্রণালী রেখে গেছেন। শ্রীঅরবিন্দ লিখছেন, “গীতা অক্ষয় মণির আকর। যুগে যুগে আকরস্থ মণি যদি সংগ্রহ করা যায়, তথাপি ভবিষ্যৎবংশধরগণ সর্বদা নুতন নুতন অমূল্য মণিমাণিক্য লাভ করিয়া হৃষ্ট ও বিস্মিত হইবেন।”
মহাভারত হিন্দুধর্মাবলম্বীদের কাছে এক পবিত্র ধর্মগ্রন্থ। যে উদ্দেশে মহাভারত রচিত হয়েছিল, তার পরিসমাপ্তি গীতার মধ্যে। “আতস কাচের এক পিঠে যেমন ব্যাপ্ত সূর্যালােক এবং আর এক পিঠে যেমন তাহারই সংহত দীপ্তিরশ্মি, মহাভারতেও তেমনই একদিকে ব্যাপক জনশ্রুতিরাশি আর একদিকে তাহারই সমস্তটির একটি সংহত জ্যোতি—সেই জ্যোতিটিই ভগবদ্গীতা”—এটাই ছিল রবীন্দ্রনাথের বিশ্বাস। আর তাতে পরিষ্কার মতামত হলাে, মহাভারতের সঙ্গে লােকশ্রুতি জনশ্রুতির এক অনন্য আধার। গীতার বাণী সত্যযুগের মহালয়া, আগমনীবার্তা। সত্যের আগমনে গীতাধর্মের বিশ্বব্যাপী প্রচার অবশ্যম্ভাবী। কী সেই প্রচার? গীতার বক্তা শ্রীকৃষ্ণ; তিনি কর্মবীর, মহাযােগী, মহাসংসারী, সাম্রাজ্যস্থাপক, রাজনীতিবিদ ও যােদ্ধা, ক্ষত্রিয়দেহে ব্রহ্মজ্ঞানী হিসাবে দর্শিত। শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং ভগবান; মানবদেহে মানুষের শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক ধর্ম গ্রহণ করে সেই অনুযায়ী লীলা করেছেন। শ্রীকৃষ্ণ-সখা মহাবীর অর্জুন গীতারূপ জ্ঞানের পাত্র, তিনি শ্রীকৃষ্ণের ভাই, প্রিয় সখা, পরম হিতৈষী বন্ধু এবং ভগ্নীপতি। ভগবান তাকেই গীতার পরম রহস্যের অমৃতবাণী শােনার জন্য বরণ করে নিয়েছেন। সখা ও সহায় যিনি, তারই কাছ থেকে জ্ঞানলাভ করে মানবজাতিকে তুলে দিচ্ছেন অর্জুন। গীতার অবস্থা’ কুরুক্ষেত্র হলেও, মঞ্চ সৈন্যদ্বয়ের মধ্যস্থল হলেও, দেখা যাচ্ছে সেখানেই এর দীপ্তকথাচারণা। ভগবান কী, জগৎ কী, সংসার কী, ধর্মপথ কী, গীতায় তার সকল প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাচ্ছে। সন্ন্যাসশিক্ষা নয়, কর্মশিক্ষাই গীতার মূল উদ্দেশ্য।
ভারতীয় সাহিত্যিকদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ রামায়ণের প্রধান পৃষ্ঠপােষক বললেও বােধহয় ভুল হবে না। তিনি রামায়ণের সেরা ভাষ্যকার, কারণ তিনি রামায়ণের কাহিনিতে জারিত হয়েছিলেন। আর তা আত্তীকরণ করে তা সুপাচ্য সাহিত্য-ব্যঞ্জন রূপে পরিবেশন করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের বহু সাহিত্য-কর্ম তার প্রমাণ। রবীন্দ্রনাথের অধ্যয়ন নিয়ে যারা গবেষণা করেছেন তাদের লেখা থেকে জানা যায়, সবচাইতে বেশি দাগানাে বই যা তিনি পড়েছিলেন এবং বিশ্বভারতী রবীন্দ্রভবনে আজও সংরক্ষিত আছে, তাহলাে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশিত এবং নলিনীকান্ত ভট্টশালী সম্পাদিত (১৩৪৩) ‘কৃত্তিবাস রামায়ণ’। রামায়ণ সম্পর্কে কবির এতটা আগ্রহ, এটা শুরু হয়েছিল কবির জীবনের প্রথম পর্যায় থেকেই। কৃত্তিবাসী রামায়ণ তার জীবনকে একরকম আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। তাঁর ‘জীবনস্মৃতি’ গ্রন্থে দেখতে পাই, ভৃত্যরাজকতন্ত্রে বেড়ে ওঠারবীন্দ্রনাথের অবাধ্য মনের আবহ যেন বদলে যেত রামায়ণের আবহে। পাঁচালি গায়ক কিশােরী চাটুজ্জে জোড়াসাঁকোয় আসতেন গান গাইতে। ছেলেবেলা’ (১৩৪৭) নামক আত্মনিষ্ঠ প্রবন্ধেও তিনি উল্লেখ করেছেন রামায়ণেমজে থাকার আনন্দকথা, কৃত্তিবাসী রামায়ণের বই পড়তে গিয়ে করুণ বর্ণনায় তার চোখ দিয়ে যখন টপটপ করে জল পড়ত, দিদিমা জোর করে তার হাত থেকে বইটি কেড়ে নিয়ে যেতেন।‘শিক্ষার হেরফের’ প্রবন্ধে লিখেছেন, “কৃত্তিবাসের রামায়ণ ও কাশীরামদাসের মহাভারত পড়িতে বসিতাম। রামচন্দ্র ও পাণ্ডবদিগের বিপদে কত অশ্রুপাত ও সৌভাগ্যে কী নিরতিশয় আনন্দলাভ করিয়াছি তাহা আজও ভুলি নাই।”
রবীন্দ্রনাথের দু’টি গীতিনাট্য ‘বাল্মীকি প্রতিভা (১২৮৭) এবং ‘কালমৃগয়া’ (১২৮৯)-য় সংস্কৃত রামায়ণের প্রভাব রয়েছে। অহল্যার প্রতি’ (১২৯৭), ‘পতিতা’ (১৩০৪) কবিতার কাহিনি নির্মাণ হয়েছে। রামায়ণের গভীর পাঠ অনুসরণ করে। পুরস্কার’ (১৩০০) কবিতাতে ধরা পড়েছে রামায়ণের নির্যাস, চিত্র’কাব্যের ‘নগর সঙ্গীত’ কবিতাতেও রবীন্দ্রনাথকে রামায়ণ সম্পর্কিত “মিথােম্যানিয়ায় আক্রান্ত হতে দেখি। ‘শিশু’ কাব্যগ্রন্থ ও ‘সহজপাঠ’-এ তাে রবীন্দ্রনাথ শিশু মনকে রামায়ণে জারিত করে দিয়েছেন। শিক্ষার হেরফের’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলছেন, “মনে আছে আমরা বাল্যকালে কেবলমাত্র বাংলাভাষায় শিক্ষা আরম্ভ করিয়াছিলাম, বিদেশি ভাষার পীড়নমাত্র ছিল না।…. কিন্তু আজকাল আমরা জ্ঞানে আমি একটি ছেলেকেও ওই দুই গ্রন্থ পড়িতে দেখি নাই।”
শিশু কাব্যগ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ দু’ভাবে শিশুকে রামায়ণের সঙ্গে সংপৃক্ত করে দিচ্ছেন, নাম-বাচক শব্দে এবং প্রকৃতি চিত্রণে। কখনাে নাম না বলেই শিশু রামায়ণের দেশে পাড়ি দিয়েছে—“মা গাে, আমায় দেনা কেন / একটি ছােটো ভাই / দুইজনেতে মিলে আমরা / বনে চলে যাই।” এখানে নাম না করেও শিশু নিজের সঙ্গে শ্রীরামকে অভেদ কল্পনা করেছে, ছােটো ভাইটি যে সহােদর লক্ষ্মণ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রকৃতি চিত্রণে রামের বনবাস-জীবন কল্পনায় মুহূর্তেই চলে আসে—“চিত্রকুটের পাহাড়ে যাই/ এমনি বরষাতে…”। রাজপুত্রের বনবাসী হয়ে যাওয়া বাঙ্গালি তথা ভারতীয় শিশুর মানস-কল্পনায় কতটা প্রভাব এনেছিল, ‘সহজপাঠ’-এর একটি কবিতায় কবি তা এক লহমায় ধরে দিয়েছেন—“ঐখানে মা পুকুরপাড়ে / জিয়ল গাছের বেড়ার ধারে / হােথায় হব বনবাসী
কেউ কোত্থাও নেই।/ ঐখানে ঝাউতলা জুড়ে বাঁধবাে তােমার ছােট কুঁড়ে/ শুকনাে পাতা বিছিয়ে ঘরে / থাকব দুজনেই।” কি বলবেন একে, মিথােম্যানিয়া নয়? রামায়ণ ম্যানিয়া নয়! পারবেন তাে এই শিকড়কে কেটে দিতে! আমার কিন্তু একজন রবীন্দ্রনাথ আছেন। আপনার?
ড. কল্যাণ চক্রবর্তী