ফেসবুকের সঙ্গে বিজেপি-আরএসএসের আঁতাত নিয়ে এখন সােশ্যালমিডিয়া সরগরম। সিপিএম তাে ১ সেপ্টেম্বর ফেসবুক বয়কটের ডাক অবধি দিয়ে দিয়েছে। এবং এখনও পর্যন্ত ফেসবুকেই তার জোরদার প্রচার চলছে। আশা করা যায়, ১ সেপ্টেম্বরও ফেসবুক জুড়ে বামপন্থীদের। ফেসবুক বয়কটের ডাক উপচে পড়বে! মজা থাক, আসল কথায় ফেরা যাক। সম্প্রতি ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’ নামে এক মার্কিন সংবাদপত্র এক প্রতিবেদনে প্রকাশ করেছে যাতে দেখানাে হয়েছে, ফেসবুকের ভারতীয় প্রধান আঁখি দাস ফেসবুকের যে কর্মীরা ফেসবুক পােস্টে নজরদারি চালান, সেইসব কর্মীদের কাছে প্রয়ােজনীয় নির্দেশিকা পাঠিয়ে বলেছেন এক বিজেপি নেতার একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ‘বিদ্বেষমূলক’ পােস্ট ফেসবুক থেকে না সরাতে। ফেসবুকের কমিউনিটি গাইডলাইন অনুযায়ী, কোনাে বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে যে কোনাে বিদ্বেষমূলক প্রচার হতে দেখলে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ অবিলম্বে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেবে। প্রয়ােজনে পােস্ট ডিলিট করে দিতে পারে। আঁখি দাস পােস্ট ডিলিট না করার পেছনে যুক্তি দিয়েছিলেন এতে নাকি ফেসবুকের বাণিজ্যিক স্বার্থ ক্ষুন্ন হবে।
প্রথমেই বলে রাখা ভালাে, যা ঘটেছে তার জন্য আন্তর্জাতিক আইন আছে, ভারতের তথ্যপ্রযুক্তি আইনও যথেষ্ট কড়া। দেশের আইনমন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ সে কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। রাহুল গান্ধী স্বভাবসিদ্ধ ঢঙে বিজেপি-আরএসএসের সঙ্গে ফেসবুকের আঁতাত ও তার ফলে মিথ্যে খবর রটানাে, ঘৃণা ইত্যাদি প্রচার করা নিয়ে বস্তাপচা অভিযােগ করলে রাহুলকে মনে করিয়ে দিয়েছেন নির্বাচনের আগে ভারতীয় নাগরিকদের ব্যক্তিগত তথ্য চুরির ঘটনায় কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা ও ফেসবুকের ঘটনায় রাহুল গান্ধীর হাতেনাতে ধরা পড়ার কথা। এই ধরনের রাজনৈতিক চাপানউতাের চলতেই থাকবে, সেটা অস্বাভাবিক নয়। দেশের নিরাপত্তার মতাে অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও যখন রাজনীতির অঙ্গীভূত হয়, তখন এতাে অতি স্বাভাবিক ঘটনা। সিপিএম ১ সেপ্টেম্বর ফেসবুক বয়কটের ডাক দিয়েছে, তাতেও আমাদের বলার কিছু থাকতে পারে না। গণতান্ত্রিক দেশে এই অধিকারটুকু সবার থাকা উচিত। কিন্তু আমরা একটা সাম্প্রতিক প্রবণতার দিকে একটু খেয়াল করার চেষ্টা করবাে, তাতে করে এই বিষয়টা বােঝার একটু সুবিধে হবে।
আপনাদের স্মরণে থাকতে পারে একের পর এক বিধানসভায় বিজেপি যখন সাফল্য পাচ্ছিল, তার ওপরে ২০১৯-এর লােকসভায় বিজেপির বিপুল ভােটে জয়, তখন রাহুল গান্ধী ও তার সহযােগী বামপন্থী-সহ অন্য বিরােধী দলগুলি একযােগে চিলচিৎকার জুড়েছিল। ইভিএম নাকি হ্যাক হচ্ছে। ফল ঘােষণার দিন তাে অনেক পরের কথা, তার আগে ভােটের দিনই নানান, যাকে ফেসবুক মিম বলে, তাতে পড়ছিল। মিম অনেকটা ব্যঙ্গচিত্রের মতাে, তবে কার্টুনের সঙ্গে সাধারণ তফাত হলাে এতে বাস্তবের কোনাে মিল থাকে না। অনেকটা কাল্পনিক ব্যঙ্গচিত্র বলা যেতে পারে। তবে এসব ক্ষেত্রে কাল্পনিক ব্যাপারটা সবসময়। বিশুদ্ধ নির্দোষ থাকে না। মূলত মিথ্যা খবরের ওপর ভিত্তি করে বিদ্বেষ ছড়ানােরও চেষ্টা হয় কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে। ভােটের দিন বামপন্থীরা উদ্যোগী হয়ে যে মিমগুলাে শেয়ার করতেন তাতে গ্রাফিক্সের মাধ্যমে। দেখানাে হতাে আপনি যেখানেই বােতাম টিপুন না কেন, ভােট পড়ছে। কিন্তু বিজেপি প্রার্থীর অনুকূলেই। বামপন্থীরা এমন অভিযােগ সংসদীয় ক্ষেত্রেও করেছে। কিন্তু নির্বাচন কমিশন আনুষ্ঠানিক ভাবে চ্যালেঞ্জ করলে কমিউনিস্ট দলগুলাে পালানাের পথ পায়নি। সােশ্যাল মিডিয়ায় নির্বাচন কমিশনের বালাই নেই, যা খুশি লিখে পার পাওয়া যায়। তখন কিন্তু ফেসবুক কর্তৃপক্ষ কোনাে ব্যবস্থা নেয়নি। কমিউনিটি গাইডলাইন। বাকস্বাধীনতার ধুয়াে তুলে অভিযােগ পার করে দেওয়া হয়েছে। তখন কিন্তু ফেসবুক-বিজেপি আঁতাত ছিল না।
মজার ব্যাপার হলাে, বিজেপি যখন সাম্প্রতিক বিধানসভা নির্বাচগুলিতে আর সাফল্যের মুখ দেখছে না, তখন কিন্তু আর ইভিএম কারচুপির প্রসঙ্গ উঠছে না— সংসদীয় ক্ষেত্রে তাে বটেই, এমনকী ফেসবুক বিপ্লবীরা বিষয়টিকে হিমঘরে পাঠিয়ে দিয়েছে।
আরও একটা বিষয় খেয়াল করলে লক্ষ্য করবেন, বিজেপির আইটি সেলের প্রতি এদের খুব রাগ। নরেন্দ্র মােদী যেমন ভারতকে ডিজিটালি স্বনির্ভর করে তুলতে চেয়েছিলেন, মূলত তার দেখানাে পথেই হেঁটে অমিত শাহ বিজেপি পার্টিকে আধুনিক করে তুলতে চাইছিলেন। তাই বিজেপির আইটি সেলের অবতারণা। রাহুল, বামপন্থী-সহবিরােধীদের ধারণা হলাে বিজেপির জয়ের মূল স্থপতি হলাে এই আইটি সেল। আইটি সেলের কর্মকর্তারাও তাদের এই ক্ষমতা সম্বন্ধে বােধহয় অবগত নন। ফেসবুক বিপ্লবী বামপন্থীরা নিজেদের এই আইটি সেলের প্রতিদ্বন্দ্বী খাড়া করতে গিয়েই যত বিপত্তি ঘটিয়েছেন। বিষয়টি একটু খােলসা করি।
অতি সম্প্রতি করােনামহামারীর কালে, আপনারা জানেন প্রধানমন্ত্রী কিছু কর্মসুচি নিয়েছিলেন তার মধ্যে অন্যতম ছিল কাঁসর বাজানাে, প্রদীপ প্রজ্বলন করা—এগুলাের মূল উদ্দেশ্য ছিল কিন্তু করােনার বিরুদ্ধে দেশ ঐক্যবদ্ধভাবে লড়ছে, তা বিশ্বের দরবারে তুলে ধরা। প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান সারাদেশের মানুষ সাড়া দিয়েছিলেন, কিন্তু বামপন্থীরা পুরাে বিষয়টি হাস্যকর খাড়া করার প্রচেষ্টায় সােশ্যাল মিডিয়া জুড়ে এক ধর্মীয় প্রচারের (পড়ুন হিন্দুধর্মের) পরাকাষ্ঠা হিসেবে প্রচার করে গিয়েছিল, তখন কিন্তু তাদের মনে হয়নি ফেসবুক আদতে বিজেপি-আরএসএসের দালাল। ২০১৮ সাল থেকে একের পর এক বিজেপির বরিষ্ঠ নেতৃবৃন্দ দীর্ঘ রােগভােগের কারণে প্রয়াত হন। তাঁদের মধ্যে যেমন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী সর্বজনশ্রদ্ধেয় অটলবিহারী বাজপেয়ী , অরুণ জেটলি, সুষমা স্বরাজ প্রমুখ ছিলেন, যারা চিরদিন সংসদীয় রাজনীতিতে বামপন্থী তাে বটেই বিরােধীদের সঙ্গেও সুসম্পর্ক রক্ষা করে এসেছেন, তাদের মৃত্যুতেও যে চূড়ান্ত নােংরামি, অশ্লীলতা আমরা ফেসবুকে দেখেছিলাম, তার বিন্দুমাত্র প্রতিবাদও কিন্তু সংসদীয় বামেদের পাওয়া যায়নি। সাম্প্রতিক করেনায় বিজেপি নেতারা করােনা আক্রান্ত হলে যেভাবে ফেসবুকে তাদের হেনস্তার শিকার হতে হয়েছিল, তখন ফেসবুককে বিজেপি-আরএসএসের দালাল বলে তাে কারাে মনে হয়নি। বরং বাকস্বাধীনতার অজুহাতে এই ধরনের অসভ্যতা সামাজিক স্বীকৃতি পেয়ে গিয়েছিল।
৩৪ বছরের বামশাসনে হিন্দু-নিধন যজ্ঞ বা হিন্দুদের হেনস্থা কম কিছু হয়নি। তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর বামপন্থীদের এই নীতিই অনুসরণ করছে। রাজ্যের মানুষ কিছুই জানতে পারেননি, কারণ মূলধারার সংবাদপত্র এ ব্যাপারে নিশ্রুপ। পরিস্থিতিটা খানিক পাল্টালাে ফেসবুক সক্রিয় হবার পর। ফেসবুকে এই ধরনের সাম্প্রতিকালে হিন্দুরা আক্রান্ত হলে উঠে আসতে দ্বিধা করছিল না। আর এতেই গাত্রদাহ হলাে বামপন্থীদের। তারা প্রতিযােগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতা বলে নতুন শব্দবন্ধনীও আবিষ্কার করে ফেললেন দোষীদের আড়াল করতে। কমিউনিটি গাইডলাইন অনুযায়ী, ফেসবুকে কোনও ঘটনা সত্য না মিথ্যা তা নির্ধারণ করার চল রয়েছে, সংসদীয় গণতন্ত্রে বামপন্থা আজ গােটা ভারতবর্ষে ১ শতাংশ নেমে গেলেও ফেসবুকে তারা এখনও যথেষ্ট সক্রিয়। তাই কমিউনিটি গাইডলাইন মেনে সংখাধিক্যের সুযােগের জোরে বামপন্থীরা এতদিন হয়কে নয় করেছে, কোথাও যেন সেই একাধিপত্যে এবার ঘা পড়েছে। তাই এবার নতুন খেলা নিয়ে তারা আসরে নেমেছে। ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের সেই প্রতিবেদন তাদের সামনে সুযােগ তৈরি করে দিয়েছে মাত্র। তাই আসল ঘটনাকে বিকৃত করার উদাহরণ নেহাত কম নেই। প্রকৃত ঘটনা সামনে আসুক এটা সবাই চাইবেন। কিন্তু দেখতে হবে গােয়েবলসীয় প্রচারের আড়ালে যেন বারবার বলা একটা মিথ্যে সত্য না হয়ে যায়। সুতরাং যাঁরা ফেসবুক বয়কটের যেমন ডাক দিয়েছেন সেই আহ্বান অব্যাহত থাক, কিন্তু প্রকৃত সত্যটা এবার বুঝে নেওয়া দরকার।
অভিমন্যু গুহ
2020-08-31