মানুষ আর প্রকৃতির স্বতঃস্ফূর্ত সঙ্গম

মনে পড়ে, অনেকদিন আগে, সেই সত্তর দশকের গোড়ায়, স্কুল ডিঙিয়ে সবে আমরা কলেজে ঢুকেছি। হাতে এল বিনয় ঘোষের আনকোরা নতুন বই মেট্রোপলিটন মন ও মধ্যবিত্ত বিদ্রোহ। আলবেয়ার কামুর নাম তখন সবে কানে গেছে। কফিহাউসের টেবিলে টেবিলে তাঁকে নিয়ে তুমুল তর্ক চলে দিন থেকে রাত। কিন্তু আমি বা আমার মতো অনেক ছেলেছোকরাই তার লেখা পড়ে ফেলার সুযোগ পাইনি।বিনয় ঘোষের বইটায় দেখি, সশরীরে বিরাজ করছেন আলবেয়র কাম আর তার আউটসাইডার উপন্যাসের আলজিরিয়ান নায়ক, যে তার মায়ের মৃত্যুসংবাদ পেয়েছে টেলিগ্রাম মারফত। কবে মারা গেছেন মা? বৃদ্ধাশ্রম থেকে যে টেলিগ্রামটা পাঠানো হয়েছে সেটা দেখে সে কিছুই বুঝতে পারে না। মারা গেছেন কি আজ? না, গতকাল? ওরা জানাচ্ছে, আগামীকাল মায়ের অন্ত্যেষ্টি। অফিস থেকে ছুটি নিয়ে একবার তাহলে পৌঁছতে হয়। বসের কাছে। ছুটি নিতে গেল মরসো। কবে মারা গেলেন মা? ওপরওয়ালার নির্লিপ্ত প্রশ্নের জবাবে আরও নির্লিপ্ত মরসো বলল :‘মা মারা গেছেন আজ। কিংবা গতকালও হতে পারে। আমি ঠিক জানি না।
শিউরে উঠেছিলাম সেদিন। এমন কি হয়? হতে পারে কোনোদিন? একেবারে সাদা কাগজের রিলের মতো মন— যেখানে কোনোকিছুরই দাগ ধরে না, ছাপও পড়ে না! বিশ্বযুদ্ধের সর্বগ্রাসী আঘাতে মনুষ্যত্বের বোধটাই এমন ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল সেদিনের ইউরোপ আর তার সংলগ্ন দেশগুলোয়, যে-অভিজ্ঞতা আমাদের মতো দেশে চিন্তার অতীত। দারিদ্র্য, যন্ত্রণা, মনুষ্যত্বের অপমান এদেশে কম নেই। কিন্তু সেই যন্ত্রণা আর তার অবসাদ কখনও আমাদের এমন জায়গায় নিয়ে যায়নি যার জেরে আর একজন মরসো জন্ম নিতে পারে। আঘাত আছে, তিক্ততা আছে, লড়াই আছে। কিন্তু তার মধ্যেই আছেন একজন রবীন্দ্রনাথ, একজন বিভূতিভূষণ। আছে এদেশের অসাম্যপীড়িত সমাজ। তারই পাশে রয়েছে। আশ্চর্য এক প্রকৃতি, সমস্ত তিক্ততার বিষ যে নিঃশেষে গিলে ফেলতে পারে। গত শতাব্দীর বিশের দশকের শেষ আর তিরিশের দশকে গোড়ায় বিভূতিভূষণ যখন লিখতে শুরু করলেন, গোটা দেশ তখন আর্থিক সংকটে পুঁকছে। ভালো ভালো রেজাল্ট করা ছেলেরা চাকরি না পেয়ে বাড়িতে বসে আছে মাসের পর মাস। মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলন নানা কারণে ঝিমিয়ে পড়েছে। দুশ্চিন্তা আর উদ্বেগ ছাড়া মধ্যবিত্ত জীবনের যেন আর কিছুই নেই। কিন্তু রিক্ততাই কি সব? ব্যক্তি মানুষের দুর্ভোগ, পরস্পরের সম্পর্কে অবিশ্বাসের ভারী হাওয়া, মনস্তত্ত্বের জটিল হাঁটাচলা—এসবের বাইরে কি জগৎ আর জীবনে অন্য কিছুর অস্তিত্ব নেই? ভারতবাসীর আবহমানের জীবনদৃষ্টি তো সেকথা বলে না। মানুষের সমাজের চারপাশেও যে ঘুরে বেড়ায় অন্য এক বৃহত্তর জগৎ! সে জগতের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রয়েছে সীমাহীন অরণ্য, অনাদিকালের মহাবৃক্ষ, আকাশভরা নক্ষত্রপুঞ্জ, আদিম পর্বতমালার উদার বিস্তার, আর হুরি-পরি ঘেরা অপ্রাকৃত জগতের ইশারা। আমাদের চেনা সমাজের বাইরে, গভীর সেই অরণ্যে বাস করেন হয়তো কোনও জনজাতি রাজার বংশধরেরা। আর বাস করে প্রকৃতির। সঙ্গে যুগযুগ ধরে মিশে থাকা মানুষ। আমাদের সমাজ আর সম্পর্কের চারপাশে আপনা থেকেই জেগে রয়েছে যে পৃথিবী, যে পায়ে চলা গ্রাম্য পথ, শিকড় নামা বটগাছ; পাহাড়ি শুড়িপথ বেয়ে পৌঁছতে হয় সে বনবাসী রাজ পরিবারের সমাধিভূমিতে—এই সবই আসলে আমাদের বৃহত্তর অস্তিত্বের অংশ। বিভূতিভূষণ তার দৃষ্টি আর অনুভূতির অখণ্ডতা দিয়ে বুঝতে ও বোঝাতে চেয়েছিলেন, আমার বা তোমার। বিলাস-তৃপ্তি-আক্রোশ বা দুর্ভোগের সঙ্গে এই বিশাল পৃথিবীর বাস্তবতার কোনও বিরোধ নেই। চারপাশের সবকিছু নিয়ে সবাইকে। নিয়েই জীবন এবং জগৎ। বিভূতিভূষণ যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে চেয়েছেন, পাহাড়, নদী, অরণ্য, বন্যপ্রাণীর দল, আকাশের গ্রহ-নক্ষত্র—যাদের সঙ্গে আমাদের বেঁচে থাকা লতায় পাতায় জড়িয়ে রয়েছে, দিনের পর দিন তাদের বিস্মৃত হয়ে থাকার অধিকার আমাদের নেই। কারণ এই সবকিছু নিয়েই আমাদের বিশ্বসংসার। যেন বলতে চেয়েছেন, সংসারের বাইরে যেমন কেউ নন, তেমনি জগৎকে বাদ দিয়েও কেউ বেঁচে থাকতে পারে না।
বিভূতিভূষণের এই বৃহত্তর জীবনবোধ কতখানি পরিব্যাপ্তি ছিল, লেখক-সাংবাদিক পরিমল গোস্বামী তার এক চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন। লিখেছেন; তাঁর দৃষ্টি বারবার অনাহারক্লিষ্ট মরণোন্মুখ অখ্যাত- অবজ্ঞাত গ্রাম্য লোকদের দিকে প্রসারিত হয়েছে। তাদের সেই হতাশা আর দীনতার গুহান্ধকারে, যেখানে সহজে কারোর দৃষ্টি পৌঁছয় না, সেখানে বহু যত্ন করে তিনি দৃষ্টি মেলেছেন। …গ্রামের অপরিচিতদের মধ্যে গিয়ে গিয়ে কে কী খেতে পায়, চাল কী দরে কেনে, শুধু সেই। জিজ্ঞাসা। বিভূতিবাবু এইসব গ্রাম্য নিঃস্ব। মানুষের মধ্যে, গাছপালা ঝোপঝাড়ের মধ্যে, অরণ্যের মধ্যে কাকে খুঁজে বেরিয়েছেন সমস্ত জীবন? কী খুঁজেছেন, কে তার উত্তর দেবে?
এইসব অখ্যাত অবজ্ঞাত গ্রাম্য মানুষ আর জনপদকে প্রকৃতির সীমাহীনতার পটভূমিতে ফেলে যখন তিনি নতুন ধরনের। এক্সপেরি মেন্টে ঢুকে পড়েন, সেই পরীক্ষানিরীক্ষার ফল একেবারে অন্যরকম হতে বাধ্য। বিভূতিভূষণের প্রকৃতি, মানুষের পাশাপাশিই থাকে। কিন্তু মানবজীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, জীবন-মত্যু কিংবা । জয়-পরাজয়ের সঙ্গে তাদের সরাসরি কোনও সম্পর্ক নেই। এই প্রকৃতি আবহমানের। যার মধ্যে দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে অতীত থেকে বর্তমান হয়ে ভবিষ্যতের দিকে বয়ে চলে আবহমানের মনুষ্যজীবন।
দুই
আজ থেকে বছর তিনেক আগে, ২০১৬ সালে, কলকাতার সত্যজিৎ রে সোসাইটি এবং আন্তর্জাতিক প্রকাশক হার্পার কলিনসের সৌজন্যে একটি আশ্চর্য বই বিভূতিভূষণ ও সত্যজিৎ অনুরাগীদের হাতে এসে পৌঁছয়। বইটার নাম— ‘দ্য পথের পাঁচালী স্কেচবুক। পথের পাঁচালী নামে কোনও সিনেমা কোনোদিন করে ওঠা যাবে এমন কল্পনাও যখন সত্যজিৎ করে উঠতে পারেননি, সেই সময়ে দোকান থেকে ড্রইং খাতা কিনে আপনমনে তিনি সে ছবির স্কেচ করে যেতেন। বিভূতিভূষণের উপন্যাসে পরস্পর জড়িয়ে থাকা প্রকৃতি আর মানুষ দুরন্ত সুষমায় ফ্রেমের পর ফ্রেমহয়ে ফুটে উঠছিল সেই ড্রইং খাতায়। পরপর দেখলে আমাদের মনে হতে পারে যেন সিনেমাটাই দেখছি। এই স্কেচবুক সত্যজিৎ পরবর্তীকালে প্যারিসের ‘সিনেমাথেক ফ্রাসোয়া’কে দান করে দেন। বহুকাল পর, সত্যজিতের মৃত্যুরও বেশ কয়েক বছর বাদে, দ্য ক্রাইটেরিয়ন কালেকশনের উদ্যোগে স্কেচবইয়ের এক ফ্যাক্সিমিলি সংস্করণ সত্যজিৎ-পুত্র সন্দীপ রায় ও তার সহযোগীরা হাতে পান। তার ওপর ভিত্তি করেই মুদ্রিত হয়েছে এই বই। এক সকালে চা খেতে খেতে স্কেচগুলো খুঁটিয়ে দেখছিলাম। আর আমার চোখের সামনে থেকে দীর্ঘদিনের এক অপপ্রচারের মেঘ ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছিল। সত্যজিৎ সমালোচকদের একটা গোষ্ঠী অনেক বছর ধরে নাগাড়ে রটিয়ে আসছিলেন যে, সিনেমার পথের পাঁচালী বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালী নয়। পাহাড়, নদী, দূরের রেলগাড়ি, শাপলা ফুল, পদ্ম, কচুরিপানা, অরণ্যের মহাবৃক্ষের দল বিভূতিভূষণের গল্প-উপন্যাসকে যেভাবে লতায়-পাতায় জড়িয়ে রেখেছে, সত্যজিৎ নাকি তাকে অনেকখানি পাশ কাটিয়ে গিয়েছেন। তাঁর সিনেমায় গ্রামের দরিদ্র মানুষ, তাদের বিবর্ণ জীবন, শোক-দুঃখ-মৃত্যু, দারিদ্রের দাঁত-নখ বের করা বাস্তব ছবিই শুধু ফুটে উঠেছে। পথের পাঁচালীকে যেজন্য নাকি বলা হয় দরিদ্র ভারতবর্ষের বিশ্বস্ত ডকুমেন্টেশন। সত্যি কি তাই?তরুণ সত্যজিতের আঁকা এই স্কেচবুকের পাতায় পাতায় ছড়িয়ে আছে পদ্মফুল, পাখির ডাক, পুকুরে সাঁতরে চলাহাঁসের পাল, পেয়ারা গাছে দুর্গার ঢিল ছোঁড়া, চড়কের ঢাক, অন্ধকার দাওয়ায় বসে ইন্দির ঠাকরণের কাছে অপু-দুর্গার গল্প শোনার দৃশ্য। আছে মেঘ, আছে মাথায় ছেয়ে থাকা বট-অশ্বত্থ, আছে পুকুরের জলে বড়ো বড়ো বৃষ্টির ফোঁটার গীতিকাব্যের সুষমা। তাহলেও সিনেমা তৈরির অনেক আগে থেকেই যে বিভূতিভূষণের নিস্পৃহ পরিপূর্ণতা নিজের মধ্যে আত্মস্থ করে নিচ্ছিলেন সত্যজিৎ। সমালোচনা কি তবে করতে হবে বলেই করা?
মৌলিক বিরোধ আসলে কোথাও নেই। বিভূতিভূষণের পৃথিবীকেই অসীম মমতায় নতুনভাবে নির্মাণ করে দর্শকদের উপহার দিয়েছেন সত্যজিৎ রায়। আর সেই অনবদ্য সৃষ্টির মাধ্যম হিসেবে কাজে লাগানো হয়েছে। অন্য একটি উপাদানকে— ক্যামেরা। বিভূতিভূষণের অশনি সংকেত মানুষের তৈরি দুর্ভিক্ষের কাহিনি। সেই দুর্ভিক্ষের সঙ্গে প্রকৃতির তো কোনও লড়াই নেই। সত্যজিতের অশনি সংকেতের প্রকৃতিও তাই আগের মতো সুন্দর। মানুষের চক্রান্ত, শয়তানি, নীচতার কোনও ছাপই সেই লিরিক্যাল সৌন্দর্যকে বিচলিত করতে পারে না। সৌন্দর্য সৃষ্টির পদ্ধতিটুকু শুধু আলাদা হয়ে যায় ক্যামেরার ক্লোজ, মিড লং, আর লং শটের জাদুতে। ইন্দির ঠাকরুণের মৃত্যুর মুহূর্তে বাঁশঝাড়ে বাতাসের শোঁ-শোঁ শব্দে।
মনে করুন আরণ্যকের সেই সরস্বতী কুণ্ডীর কথা। সেই যেখানে হুরি-পরিরা সরোবরের জলে নামে। বন কেটে বসত গড়ার কাজে লেখককে মাঝে মাঝেই জরিপের ক্যাম্পে রাত্রিযাপন করতে হয়। সেদিন সঙ্গে ছিল আমিন রঘুবর প্রসাদ। তার কাছে সরস্বতী কুণ্ডীর কথা তুলতেই রঘুবীর বলল : “হুজুর ও মায়ার কুণ্ডী, ওখানে রাতে হুরি-পরিরা নামে; জ্যোৎস্না রাতে তারা কাপড় খুলে রাখে ডাঙায় ওইসব পাথরের ওপর রেখে জলে নামে। সে সময়ে যে তাদের দেখতে পায়, তাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে জলে নামিয়ে ডুবিয়ে মারে। জ্যোৎস্নার মধ্যে দেখা যায়, মাঝে মাঝে পরিদের মুখ জলের উপরে পদ্মফুলের মতো জেগে আছে।…”
অরণ্য নিশ্চিহ্ন করে জনপদ তৈরির দায়িত্ব নিয়ে লবটুলিয়া-বইহারে এসেছিলেন লেখক। কাজ শেষ করে বছর পাঁচেক পরে ফিরে গেলেন শহরে। কিন্তু মাঝের এই সময়টায় পাহাড়, জঙ্গল, আদিম কৌম সমাজ, অরণ্যের প্রাণী আর অরণ্যচারী মানুষ এমনভাবে তাকে বদলে দিয়ে গেল, যে অভিজ্ঞতার কোনও তুলনা সারাজীবনে আর কখনও তিনি পাবেন না।
অভিজিত দাশগুপ্ত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.