সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনকে কেন্দ্র করে গত কয়েকদিনে পশ্চিমবঙ্গে যে নৈরাজ্যের ঘটনা ঘটেছে, সে সম্পর্কে বেশ কিছু প্রশ্ন উঠে আসছে। এই প্রশ্নগুলি নিয়ে আলোচনা করতে বসলেই বোঝা যাবে, নাগরিকত্ব আইনের বিরোধিতা করা একটি অছিলা মাত্র। এর পিছনে রয়েছে আরও এক গভীর ষড়যন্ত্র, যে ষড়যন্ত্র পশ্চিমবঙ্গকে পশ্চিম বাংলাদেশ বানাতে চায়। নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল সংসদের উভয় কক্ষে পাশ হবার পরপরই গত ১৩ ডিসেম্বর থেকে রাজ্যের সর্বত্র হিংসার ঘটনা ঘটতে শুরু করল। সব থেকে বড়ো হিংসার ঘটনা ঘটল মুর্শিদাবাদ জেলায়। বিভিন্ন রেলস্টেশন ভাঙচুর করে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হলো। রেল লাইন এবং রেলের সিগনালিং ব্যবস্থার ক্ষতি করা হলো। এমনভাবে ক্ষতি করা হলো, যাতে চট করে রেল ব্যবস্থাকে আবার স্বাভাবিক করে তোলা না যায়। রেলস্টেশনের টিকিট কাউন্টার থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা লুট করা হলো। ১৭ কোটি টাকারও বেশি রেল সম্পত্তি ধ্বংস করা হলো। জাতীয় সড়ক অবরোধ করেও বিক্ষোভ চলল। বহু সরকারি, বেসরকারি বাস ও গাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হলো। এমনকী অ্যাম্বুলেন্সেও আগুন লাগানো হলো। বহু জায়গায় হিন্দুদের বাড়িঘর আক্রান্ত হলো, লুটপাট হলো। এই লেখা যখন লিখছি, তখনও খবর পাচ্ছি হাসনাবাদ ও বসিরহাটের বিভিন্ন অঞ্চলে হিন্দুদের ওপর হামলা হচ্ছে। হাওড়ার সাঁকরাইলে এই তাণ্ডববাজদের ছোঁড়া বোমার আঘাতে এক আই পি এস অফিসার মারাত্মক আহত হয়েছেন। গণ্ডগোল শুরু হওয়ার পর প্রথম তিনদিন পুলিশ কার্যত নিষ্ক্রিয় থেকেছে। হামলাকারীদের বিরুদ্ধে কোনোরকম ব্যবস্থাই নেয়নি তারা। তিনদিন পর সামান্য সক্রিয় হলেও যতটা সক্রিয় হওয়া প্রয়োজন ছিল, ততটা হয়নি তারা। মুখ্যমন্ত্রী শান্তি পূর্ণ গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কথা বললেও এই হামলাবাজরা মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যকে কোনো গুরুত্বই দেয়নি। বরং, মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যকে কার্যত উপেক্ষা করে তারা তাদের মতো সর্বত্র হামলা চালিয়ে গেছে। মুখ্যমন্ত্রীকেও সামান্য একটা বিবৃতি দেওয়া ছাড়া এই হামলাবাজদের বিরুদ্ধে কোনো কঠোর পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। সংসদে বিল পাশের সাতদিন পরেও রাজ্যে অশান্তির ঘটনা যে বন্ধ হয়েছে তা নয়। বরং, ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিভিন্ন জেলা থেকে প্রতিদিনই কিছু না কিছু হিংসার খবর পাওয়া গেছে।
এখন প্রশ্ন হলো, কারা এই হিংসার ঘটনা ঘটালেন? কেন ঘটালেন? এই ঘটনা ঘটানোর পিছনে কী তাদের উদ্দেশ্য? বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে এই ঘটনাগুলি দেখা গিয়েছে। বিভিন্ন কাগজে ছবিও বেরিয়েছে। তাতেই কারা হামলা। করছে, তাও পরিষ্কার দেখা গিয়েছে। ফলে, মুখ্যমন্ত্রী এবং শাসকদল যতই একে স্বতঃস্ফুর্ত গণ-আন্দোলন বলে চালাতে চান না কেন, পশ্চিমবঙ্গের মানুষ অন্তত বুঝতে পারছেন এটি স্বতঃস্ফুর্ত গণ-আন্দোলন নয়। এটি একটি বিশেষ ধর্মীয় সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর একটি অংশের সমাজবিরোধীদের কাজ। সমাজবিরোধী এই কারণেই বললাম যে, তা না হলে কেউ রেলওয়ের টিকিট কাউন্টার থেকে টাকা লুট করে নিয়ে চলে যেতে পারে না। বলা হচ্ছে, এরা নাকি সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের বিরোধিতা করছে। কেননা, এরা মনে করে এই আইনের ফলে এই দেশের মুসলমান জনগোষ্ঠীর নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হবে। অথচ, এই সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনে পরিষ্কার বলা হয়েছে, ভারতীয় ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের যে সংবিধান স্বীকৃত অধিকার দেওয়া আছে, তা এই আইনে কোনো অবস্থাতেই ক্ষুন্ন হবে না। অর্থাৎ, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান থেকে আসা হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, খ্রিস্টান, পার্সিদের নাগরিকত্ব দিলেও তা এদের অধিকার ক্ষুন্ন করে দেওয়া হবে না। তাহলে এদের বিক্ষোভ কেন ? এবার একটু ভাবলেই বুঝতে পারবেন, সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে এই বিক্ষোভ আসলে পুরোপুরিই একটি অছিলা। এই হাঙ্গামাবাজির মূল লক্ষ্য সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন বাতিল করানো নয়, বরং মূল লক্ষ্য আরও অন্য কিছু, আরও গোপনীয় এবং গভীর কিছু। একটু লক্ষ্য করলেই দেখবেন যেভাবে, যে কায়দায় রেল যোগাযোগ বিনষ্ট করে, জাতীয় সড়ক অবরুদ্ধ করে বিক্ষোভ দেখানো হয়েছে, তাতে মুর্শিদাবাদ থেকে উত্তরবঙ্গ পর্যন্ত এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলের সঙ্গে দক্ষিণবঙ্গের যোগাযোগ। বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছিল। উত্তরবঙ্গের সঙ্গে দক্ষিণবঙ্গের, বিশেষত মুর্শিদাবাদ জেলার সঙ্গে রাজ্যের অন্যান্য অংশের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে ফেলাটা কিন্তু তাৎক্ষণিক স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভ নয়। এটি একটি বড়োসড়ো পরিকল্পনার মহড়া মাত্র। স্বাধীনতার লগ্নে মুর্শিদাবাদ জেলা ৪৮ ঘণ্টার জন্য পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্গত হলেও, পরবর্তীকালে এই জেলাকে বৃহত্তর বাঙ্গলার অংশ করার জন্য পশ্চিমবঙ্গ থেকে বিচ্ছিন্ন করার চক্রান্ত থামেনি। সে চক্রান্ত এখনো চলছে। মুর্শিদাবাদ জেলাতেই স্বাধীন মোগলস্তান গড়ার লক্ষ্যে লিফলেট ছড়িয়েছে ইসলামিক মৌলবাদীরা। মুর্শিদাবাদ জেলাতেই সব। থেকে বেশি বেআইনি মাদ্রাসা চলছে। মুর্শিদাবাদ জেলার সীমান্ত সংলগ্ন গ্রামগুলি দিনদিন হিন্দুশূন্য হয়ে পড়ছে। কাজেই নাগরিকত্ব আইনকে হাতিয়ার করে মুর্শিদাবাদ জেলাকে বিচ্ছিন্ন করে। দেওয়ার একটি মহড়া যদি সেরে ফেলা যায়- তাহলে তাতে কাদের সুবিধা সকলেই বুঝতে পারবেন। আর মুর্শিদাবাদের পাশাপাশি সমগ্র উত্তরবঙ্গকেও যদি বিচ্ছিন্ন করে রাখা যায়, তাহলে মালদা থেকে কোচবিহার অনেকগুলি জেলাতেই আগুন জ্বালিয়ে একটি গৃহযুদ্ধ বাধিয়ে দেওয়া যাবে। যেরকম গৃহযুদ্ধ ১৯৪৬ সালে বাধিয়ে মহম্মদ আলি জিন্নাহ পাকিস্তান আদায় করে নিয়ে গিয়েছিলেন। আরও একটু গভীরে গিয়ে ভাবলে বুঝবেন, পরিকল্পনাটি সেই একই। ১৯৪৬ সালের মতোই ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা। ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট কলকাতায় হিন্দুদের উপর আক্রমণ, যেটি গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংস হিসাবেই ইতিহাসের পাতায় রয়ে গিয়েছে, তা শুরু হয়েছিল এক শুক্রবার, জুম্মার আজানের পরই। ১৩ ডিসেম্বর, ২০১৯ যেদিন থেকে নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের নামে জেলায় জেলায় তাণ্ডব শুরু হলো, সেদিনটিও ছিল শুক্রবার। সেদিনও মসজিদগুলি থেকে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের বিরোধিতা করে জুম্মার আজানের পর বার্তা দেওয়া হয়েছিল। সাদৃশ্য আরও রয়েছে। ১৯৪৬ সালের আগস্টে যখন মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র আবাসভূমির দাবিতে কলকাতা শহরে মুসলিম লিগ বাহিনী অবাধ লুটপাট, খুনজখম, নারী ধর্ষণ করছে, সেই সময় অবিভক্ত বাঙ্গলার প্রধানমন্ত্রী জিন্নাহ ঘনিষ্ঠ সৈয়দ সোহরাওয়ার্দি তার পুলিশকে সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় করে রেখেছিলেন। এবারও কিন্তু পুলিশকে নিষ্ক্রিয় করে রাখল রাজ্য সরকার। ২০১৯-এর ১৩ ডিসেম্বর থেকে সংগঠিতভাবে জেলায় জেলায় যে হাঙ্গামা হলো, তা পুরোপুরিই একটি বৃহৎ পরিকল্পনার অঙ্গ। পরিকল্পনাটি হচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গকে আর একবার ভাগ কর। ১৯৪৬ সালে গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংসের পর তখনকার বড়লাট মাউন্টব্যাটেন মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীকে বলেছিলেন, ‘জিন্নাহ শুধু মহড়া হিসাবে কলকাতায় ৫০০০ মানুষকে খুন করিয়েছেন। কাজেই তাকে পাকিস্তান না দিলে তিনি কী করবেন বুঝে নিন।আজ ২০১৯ সালে জিন্নাহর মতোই কেউ মহড়া হিসেবে সর্বত্র সন্ত্রাস ছড়িয়ে দিয়ে হিন্দু জনগোষ্ঠীকে সন্ত্রস্ত করে তুলতে চাইছে কিনা সেটাও ভাবতে হবে।
এ তো গেল একটি দিক। এই ঘটনাবলীর আর একটি দিকও রয়েছে। সেটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিক। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সংবিধানগতভাবে শপথ নিয়েছেন যে, তিনি সততার সঙ্গে রাজধর্ম পালন করবেন। অর্থাৎ রাজ্যের জনগণকে প্ররোচিত করার মতো কোনো কাজ করবেন না। কোনো বিষয়ে রাজ্যের জনগণকে তিনি বিভ্রান্তও করবেন না। কিন্তু এই সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তিনি এই দুটি কাজই করেছেন। এই আইনটি যখন বিল আকারে ছিল, তখন থেকেই তিনি ক্রমাগত মিথ্যা প্রচার করছেন, বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন। এখন তিনি বলছেন, এই আইন তিনি এই রাজ্যে কার্যকর করতে দেবেন না। এবং এ মর্মে সরকারিভাবে বিজ্ঞাপনও দিচ্ছেন তিনি। কিন্তু একাজও তিনি করতে পারেন না। তার এই কাজও সংবিধান বিরোধী। দেশের কোনো আইন নিজ রাজ্যে চালু করব না— এরকম কথা কোনো রাজ্য সরকার বলতে পারে না। মুখ্যমন্ত্রী তো পারবেনই না। তবু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তা করছেন।তিনি যা করতে পারেন, তাহলো এই আইনের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হতে পারেন, সংবিধানের ব্যাখ্যা চাইতে পারেন। এর বেশি আর কিছুই তার করার নেই। এক্ষেত্রেও আইন চালু করতে দেব না বলে জনগণকে ভুল বোঝাচ্ছেন, বিভ্রান্ত করছেন। নাগরিকত্ব আইনে যখন বলা হয়েছে এই আইনে মুসলমানদের স্বার্থ ক্ষুন্ন হবে না, তার পরেও এর বিরোধিতায় চড়ামাত্রায় বিবৃতি দিয়ে পদযাত্রা করে আরও বেশি প্ররোচনা জোগানোর কাজ করছেন তিনি। সারা রাজ্যে যে হাঙ্গামা ছড়িয়েছে এর দায় তিনিও অস্বীকার করতে পারেন না। তার এই ধরনের মন্তব্য এবং আচরণ এই হামলাবাজদের আরও উৎসাহী করেছে। হামলাবাজদের দমন করতে তার কঠোর ভূমিকা একদিনের জন্যও দেখা যায়নি। অথচ এই আইনের সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্ট কেন্দ্র সরকারের কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছে। কেন্দ্রও বিভিন্ন সংবাদপত্রে এই আইনে প্রকৃত কী বলা আছে– তা নিয়ে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। এমন একটি পরিপ্রেক্ষিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উচিত ছিল আর প্ররোচনামূলক কথাবার্তা না বলে সুপ্রিম কোর্টের বক্তব্য শোনার জন্য অপেক্ষা করা। সেটি মুখ্যমন্ত্রী সুলভ কাজ হতো। তা না করে, তিনি প্রতিটি দিন যা করে যাচ্ছেন, তা নিতান্তই অপরিণামদর্শী এক আত্মদর্পী মানুষের আচরণ।
সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের ফলে পাকিস্তান, বাংলাদেশ, আফগানিস্তান থেকে আসা যে হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, শিখ, পার্সি মানুষরা নাগরিকত্ব পাবেন—তাহলে তাদের পাশেকি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নেই? সেটা তো পরিষ্কার করে তাকেই বলতে হবে। আসলে তোষণের রাজনীতি করতে গিয়ে যে বাঘটির পিঠে তিনি চেপে বসেছেন, তার হাত থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিস্তার নেই। সেটা মমতাও জানেন। নীচে নামলেই বাঘ তাকে খেয়ে ফেলবে। আর তাই সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের বিরোধিতা তাঁকে করতেই হবে।
রন্তিদেব সেনগুপ্ত
2019-12-27