সোশ্যাল মিডিয়াতে বারে বারেই নেটিজেনরা বলছেন, এই রাজাকে উলঙ্গ বলার ক্ষমতা কারোর নেই। কেউ যদি সামান্যভাবে বলেও ফেলেন, তাহলে তার যে কী অবস্থা হতে পারে সেটা এই ন’বছরে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন আপামর পশ্চিমবঙ্গবাসী। মাননীয়াকে কিছুই বলা যাবে না। তার পার্ষদদের দোষ বা ত্রুটিও ধরা যাবেনা। সমালোচনাও করা তো দূরের কথা ! মাননীয়ার অনুপ্রেরণাই আমাদের রাজ্যের কাছে সব। তিনিই প্রথম কথা, তিনিই শেষ কথা, এই সত্যটি জানেন তাঁর দলে ওপরতলা থেকে নীচতলা। তার একটা ভালো গুণ আছে, তিনি সব জানেন। জ্ঞান থেকে বিজ্ঞান, চিকিৎসা থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং বিদ্যাও তার করায়ত্ত। তার কাছে খাপ খুলতে যাওয়ার ক্ষমতা স্বয়ং ঈশ্বরের পিতারও নেই। তিনি অবলীলায় যে কোনো কথা বলতেও পারেন। দুর্জনেরা বলেন, তিনি নাকি ৮০ শতাংশ মিথ্যা, ১৫ শতাংশ সত্য-মিথ্যার মিশেল। আর ৫ শতংশ সত্য। মানুষ তাঁকে। খুব বিশ্বাস করেন। এমনটাই ধারণা তার। তাই তিনি এই ধারায় চলতে পারেন। এটাও বলেন, তার বিরোধীরা। কিন্তু করোনা বা সম্প্রতি আমফান সুপার সাইক্লোন! তিনি। সমানে বলে চলেছি লেন পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য তার সরকার সম্পূর্ণভাবে প্রস্তুত। তিনি জানতেনই না যে, তার নেতৃত্ব যে পরিকাঠামোর ওপর দাঁড়িয়ে, সেটা কতটা ফঁপা। এই দুটি ক্ষেত্রেই বেআব্রু হয়ে পড়লেন তিনি ও তার নেতৃত্ব।
লেখার শুরু করেছিলাম রাজাকে উলঙ্গ বলবে কে? কার ঘাড়ে কটা মাথা আছে। মিডিয়ার কথাই বলছি। স্তাবক মিডিয়া এখন ব্যস্ত রাজা কতটা ভেঙে পড়েছেন সেটা বোঝাতে। নিঃসন্দেহে আমফান যে ক্ষতি আমাদের দক্ষিণবঙ্গের করে গেল, সেই ক্ষত যে এই শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়ংকর, সে কথা অতি নাবালকও স্বীকার করবে। দেশের প্রধানমন্ত্রী ছুটে এলেন, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন। পাশের রাজ্য ওড়িশাও এগিয়ে এসেছে। সবাই মিলে আমাদের রাজ্যকে আবার নতুন করে গড়ে তোলার কাজে হাত লাগিয়েছে। কিন্তু সেই আবার ফিরে আসতে হয়, রাজা তোমার কাপড় কই? এই কথাটি বলবে কে? সমালোচনা করতে গিয়ে একটি বৈদ্যুতিন সংবাদ মাধ্যমের কী হাল হয়েছে তা সবাই জানে। তাই মিডিয়া চুপ। ফনির মোকাবিলা করেছে। ওড়িশা, এই আমফানেরও করল। কিন্তু তাদের ক্ষতি এক লহমায় সামলে নিয়েছে তারা। স্বাভাবিক ছন্দে ফিরে এসেছে জীবন। সে করোনা বা আমফান যাই বলা হোক না কেন। এর পিছনে রয়েছে রাজ্যের প্রশাসক ও তার নেতৃত্বের সুন্দর সমন্বয়ের একটি পরিকল্পনার বাস্তবায়ন। আমাদের রাজ্যে এই বিষয়টি স্বপ্নেও ভাবা যায় না। মাননীয়ার অনুপ্রেরণা না থাকলে, সে পরিকল্পনা আদতেই স্বীকৃতি পাবে না।
আমফান আসবে, এমনটা আভাস ছিল পনেরো দিন আগে থেকেই। সেটা যে কলকাতা বা দক্ষিণবঙ্গমুখী সেটাও আভাষ দিয়েছিল আবহাওয়া দপ্তর। সেই অনুযায়ী আমাদের রাজ্যের বিপর্যয় মোকাবিলা করার। জন্য প্রত্যেকটি জরুরি পরিষেবা বিভাগ সেই মতো পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছে, সেটা তিন দিন আগে থেকেই গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বলছিলেন কলকাতা পুরসভার মেয়র থেকে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং। কিন্তু বাস্তবে সেই প্রস্তুতি যে শুধুই ফাঁকা বুলি, সেটা প্রমাণ হয়ে গেল আমফানের তাণ্ডবের পর। দেখা গেল, না আছে পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য দক্ষ কর্মীর দল, না আছে পরিস্থিতির পর জনসাধারণকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে দেবার মতো কোনো পরিকল্পনা। প্রমাণ হয়ে। গেল আমাদের রাজ্যে জররি বা আপকালীন পরিস্থিতি সামাল দেবার মতো কোনো কিছুই নেই। কলকাতা পুরসভার প্রাক্তন মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় প্রকাশ্যেই সমালোচনা করে একেবারে উলঙ্গ করে দিয়েছেন বর্তমান পুরমন্ত্রী ও কলকাতা পুরসভার সদ্য প্রাক্তন হয়ে যাওয়া মেয়র ও বর্তমান প্রশাসক ফিরহাদ হাকিমকে। এই পরিস্থিতির ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতির কথা বলতে গিয়ে আরেক প্রাক্তন মেয়র সুব্রত মুখার্জিও একটু ঘুরিয়ে প্রশাসনের সমালোচনা করতে ছাড়েননি। দুর্জনেরা বলছেন, হয়তো রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বা পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ভেবেছিলেন, ঝড়টা আমাদের রাজ্যকে পাশ কাটিয়ে বাংলাদেশে প্রতিবারের মতো আছড়ে পড়বে। কিন্তু ওরা হয়তো ইচ্ছাকৃতভাবে ভুলে গেছেন, এখনকার অত্যাধুনিক প্রযুক্তি আবহাওয়ার ক্ষেত্রে সম্ভাব্য ৯৯ শতাংশ মিলিয়ে দিচ্ছে। তা সত্ত্বেও কেন এত গাছাড়া ভাব দেখাল রাজ্যের প্রশাসন। সেটা নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে। সব মহলে। এই পরিস্থিতি সামাল দিতে অনেক আগে থেকেই কেন্দ্র সরকারের তরফে রাজ্যকে সাবধান করা হয়েছিল। তা সত্ত্বেও কেন ডাকতে হলো সেনাবাহিনীকে? যদি ডাকতেই হতো, তাহলে একটু আগে কেন ডাকা হলো না? ঝড় থেমে যাওয়ার পরেও বেশ কয়েক দিন কেন অসহায় মানুষকে ধ্বংসস্তুপের মাঝে বিদ্যুৎহীন, জলহীন, যোগাযোগ মাধ্যমহীন হয়ে কাটাতে হলো? এসব তো দেখার দায়িত্ব রাজ্য সরকারের। ভারতের অন্যতম প্রধান শহরের অবস্থা যদি এই হয়, তাহলে গ্রাম থেকে গ্রামাঞ্চলের অবস্থা যে কি ভয়ানক, সেটা সহজেই অনুমেয়। মাননীয়া প্রেস কনফারেন্সে এই পরিস্থিতির সামাল দেবার ক্ষেত্রে লেজেগোবরে হয়ে বলেছেন, তার মাথা কেটে নিতে। বালখিল্যের মতো এই উক্তি। তিনি নিজেকেই নিজে উলঙ্গ প্রমাণ করে দিলেন। অন্যেরা আর বলবে কী!
পুরসভার একটি সুত্র মারফত বেশ কয়েকটি কথা জানা গেছে। কলকাতা পুরসভার এই পরিস্থিতি সামাল দেবার মতো কি পরিকাঠামো আছে, সেটাই জানা নেই বর্তমান প্রশাসকের। কত ম্যান পাওয়ার বা দক্ষ মানুষ কজন আছে, সেটাই জানা নেই। অন্য দিকে বিদ্যুৎ সরবরাহকারী সংস্থা সিইএসসি কি পরিকল্পনা করেছে, একদিকে যেমন সেটা জানার চেষ্টা হয়নি, অন্য দিকে সংস্থাটিও জানায়নি তাদের পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য কী কী ব্যবস্থা নিতে হবে সে কথাও। এই প্রসঙ্গে একটি বিষয়ের অবতারণা করতে হয়। শহর কলকাতার যে ক’জন মারা গেছেন, তার সিংহভাগ বিদ্যুৎ পৃষ্ট হয়ে। অন্য দিকে সেনাবাহিনী এসে গাছ কেটে যেখানে একেবারে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে রাস্তা পরিষ্কার করে দিল, সেটা কেন পুরসভার কর্মীরা পারল না? অন্যদিকে ওড়িশা থেকে অগ্নিনির্বাপন বিভাগের টিম এসেছে। তারা দক্ষতার সঙ্গে পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক করছে দ্রুততার সঙ্গে। এই দক্ষতা কি আমাদের দমকল বিভাগের কর্মীদের মধ্যে নেই? এর উত্তর সহজে যে পাওয়া যাবে , সেটা বলাই যায়।
অন্যদিকে রাজ্যের কোনো দুর্গত এলাকায় বিরোধী দলের পক্ষে রাজ্যের সাংসদ যেতে চাইলে, শত শত পুলিশ রাস্তা আটকে তাঁকে যেতে দিচ্ছে না। এতে নাকি পরিস্থিতি রাজনৈতিকভাবে উত্তপ্ত হয়ে উঠবে, সেটাকে আটকাবার জন্য? মাননীয়া এইভাবে আপনি যদি ঝড়ে বিধ্বস্ত হবার আগে ও পরে আক্রন্ত মানুষগুলির জন্য ভাবতেন, তাহলে হয়তো মানুষের কাছে ভুল বার্তা পৌঁছত না। এইশতশত পুলিশ কর্মীকে দিয়ে কেন গাছ কাটালেন না? কেন ভেঙে পড়া বাড়ি মেরামতের কাজে লাগালেন না? এই প্রশ্নের উত্তর দেবেন কি? আর আপনিই বলছেন এই পরিস্থিতিতে রাজনীতি ভুলে একসঙ্গে কাজ করতে। তাহলে আপনি এভাবে বিরোধীদের আটকাচ্ছেন কেন ? সেটা কি রাজনীতি নয়? এই প্রশ্নের উত্তর রাজ্যের মাননীয়া থেকে তাঁর দলের মন্ত্রী ও সান্ত্রীদের মুখে শুধু বড়ো বড়ো কথা। আর কাজের বেলায় যে অশ্বডিম্ব, সেটা প্রমাণ হয়ে গেল আরেকবার। আর প্রমাণ হয়ে গেল, আপকালীন পরিস্থিতি সামাল দেবার ক্ষেত্রে আমাদের রাজ্যে পরিকাঠামো বলে কিছুই নেই।
বিশ্বপ্রিয় দাস