অখণ্ড ভারতের স্মরণ মনন আজ বড়াে প্রয়ােজন

তাধীনতা দিবসে সবাই শুভেচ্ছা পাঠায়, ‘হ্যাপি ইন্ডিপেন্ডেন্স ডে’। সেটা নিয়ে আমি একটা দ্বন্দ্বে ভুগি, বুঝতে পারি না কী করব। এটা ঠিক, ওইদিন বহু শতাব্দী পর আমার দেশ স্বাধীন হয়েছিল। আনন্দ হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু ওইদিন তাে আরও কিছু হয়েছিল। সেগুলাের জন্যও কি ‘হ্যাপি’ হব? ওইদিন আমার ভারত মায়ের অঙ্গচ্ছেদ হয়েছিল। রক্তে লাল হয়েছিল ব্রহ্মপুত্র, গঙ্গা, পদ্মা, সিন্ধু। আমার প্রাণের যশােহর, বিক্রমপুর, চট্টগ্রাম, লাহাের, তক্ষশীলায় আমার প্রবেশ নিষিদ্ধ হয়েছিল। লক্ষ নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে কেনা ওই দিনটাতে মিষ্টি খেয়ে ঘুড়ি ওড়াতে কোথাও যেন বাধাে-বাধাে ঠেকে। ছিন্নমূল উদ্বাস্তু আমার পূর্বপুরুষদের যন্ত্রণা ভুলতে পারি না। যারা দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছে, যাদের দেশ ভুলে গেছে, তাদের কথা বারবার মনে পড়ে। মিষ্টি গলা দিয়ে নামে না। সেটা কি আমার দোষ?

আরেকটা প্রশ্ন মনে জাগে। ভারতের ইতিহাস তাে দুশাে বছরের নয়, লক্ষ বছরের ইতিহাস। এই লক্ষ বছরে কতগুলাে স্বাধীনতা দিবস এসেছে রাষ্ট্রের জীবনে? রাজা সুহেলদেব যেদিন তুর্কিদের তাড়িয়েছিলেন, সেটাও তাে স্বাধীনতা দিবস ছিল, তাই না? সম্রাট স্কন্দগুপ্ত যেদিন হুণদের তাড়িয়েছিলেন? শিবাজী যেদিন স্বরাজ্য ঘােষণা করেছিলেন? হরিহর বুক যেদিন স্বাধীন বিজয়নগরের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন? লাচিৎ বরফকুন যেদিন সরাইঘাটে মােগলদের জলসমাধি দিয়েছিলেন? মার্তণ্ড বর্মা যেদিন কোলাচলে ডাচ আর্মাডার মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়েছিলেন? নেতাজী যেদিন আন্দামান নিকোবরে স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করেছিলেন? মৈরাংয়ে তেরঙ্গা উড়িয়েছিলেন? সেই স্বাধীনতা দিবসগুলে কেন উদ্যাপন হয় না?

স্বাধীনতা কোনাে একটা পাথরে খােদাই করা শব্দ তাে নয়। আজ আমরা স্বাধীন, আগামীকাল আবার পরাধীন হয়ে যেতে পারি। যদি আমরা প্রস্তুত না হই, সতর্ক না হই, যদি আমরা ইতিহাস ভুলে যাই।

সবার পছন্দের সুন্দর সুন্দর কথা বলে রাজনীতি হয় না। রাজনীতির জন্য প্রয়ােজন, অপ্রিয় হলেও সত্য কথা বলা। সেই অপ্রিয় সত্যের পক্ষে কিছু লােক দাঁড়িয়ে পড়বে, কিছু লােক বিপক্ষে। এই দুই পক্ষের বৈচারিক সংঘাতের মধ্য দিয়ে ভবিষ্যতের রাজনীতি নির্ধারিত হবে। দেশহিতকারী সঠিক বিতর্ক সৃষ্টি এবং সেই বিতর্ককে উদ্দেশ্য সাধনের যন্ত্ররণপে ব্যবহার করা হলাে সফল রাজনীতিকের বৈশিষ্ট্য। এই ক্ষমতাটা আমাদের দিলীপদার বিলক্ষণ রয়েছে। এবারের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে ভারতীয় জনতা পার্টির পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘােষের একটি ফেসবুক পােস্ট এরকমই একটি বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। দিলীপদা লিখেছেন, “আজকের এই পুণ্য প্রভাতে আমাদের সংকল্প হােক অখণ্ড ভারতের পুনর্নির্মাণ। বন্দে মাতরম্।। ভারতমাতার জয় হােক। অখণ্ড ভারতের পূজারি ঋষি অরবিন্দের জন্মজয়ন্তীতে জানাই অন্তরের শ্রদ্ধার্ঘ্য ও প্রণাম।”

প্রথমেই বলি, সাবাশ দিলীপদা। অন্তত একজন রাজনৈতিক নেতা তাে আছে আজ এদেশে, যিনি অখণ্ড ভারতের মানচিত্রটা ভুলে যাননি। ঋষি অরবিন্দের উপাস্য দেবীকে ভুলে যাননি।

পােস্ট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কিছু লােক বিরােধিতায় মেতে উঠেছে, ততােধিক লােক সমর্থনে। এটাই এখন দরকার। রামনাম ভক্তিতে করক বা ঘৃণায়, দুটোতেই রামনামের মনন হয়। অখণ্ড ভারতের মনন আজ বড়ো প্রয়ােজন। অখণ্ড ভারত আমাদের খণ্ডিত হওয়ার ইতিহাস মনে করিয়ে দেয়। সে ইতিহাস ভুলে গেলে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঠেকাবাে কী করে? তাছাড়া, অখণ্ড ভারতের ধ্যান তাে সৃষ্টিছাড়া কোনাে আকাশকুসুম কল্পনা নয়। বহু মনীষী জীবনের শেষদিন পর্যন্ত বিশ্বাস রেখেছিলেন, অখণ্ড ভারত বাস্তবে রূপ নেবে। স্বাতন্ত্র্যবীর সাভারকর বলেছিলেন, ভারতের ইতিহাসে বহু শকস্থান হূণস্থান তৈরি হয়েছে, তারা বিলুপ্তও হয়েছে। পাকিস্তানেরও সেটাই ভবিতব্য। তিনি কি ভুল ছিলেন ? পণ্ডিচেরী অরবিন্দ আশ্রমে আজও অখণ্ড ভারতের মানচিত্র পূজিত হয়। তার সামনে অনুষ্ঠান হয়, ফ্ল্যাগ মার্চ হয়। খণ্ডিত নয়, অখণ্ড ভারতের মানচিত্র। ঋষি অরবিন্দ সেই মানচিত্রকেই তাে তার আরাধ্যা দেবী মেনেছিলেন! দেবীর রূপ কি আমাদের সুবিধেমতাে খণ্ডিত হতে পারে?

কিন্তু সত্যিই কী অখণ্ড ভারতের পুনর্নির্মাণ সম্ভব? অটক থেকে কটক এক রাজশক্তি, এক শাসন? একাগ্রতা, ধ্যেয়নিষ্ঠা ও নিরন্তর প্রচেষ্টা থাকলে কোনাে কিছুই অসম্ভব নয়। নিরন্তর কার্যকরী আঘাতে কঠিন পাথরও একদিন ভেঙে চুরমার হয়। একটা কথা সত্যি, এটা গায়ের জোরে হবে না। তাছাড়া, শুধু ওই মাটি নয়, ওই মাটির পথভােলা মানুষগুলােকেও তাে আমাদের চাই। তাদের বাদ দিয়ে দেশ গড়ার কাজ সম্পূর্ণ হবে কী করে? তাহলে কীভাবে এই একীকরণ হতে পারে?

প্রথমে তাে আমাদের মধ্যে একীকরণের ইচ্ছেটা চাই, স্বপ্নটা চাই। স্বাধীনতার সময় নেপাল ও বালুচিস্তান ভারতে যােগ দিতে চেয়েছিল। চাচা নেহরু রাজি হননি। কী মনে হয়, চাচার জায়গায় ঋষি অরবিন্দ থাকলে রাজি হতেন না? সমস্যাটা ছিল, অখণ্ড ভারত নিয়ে চাচার কোনাে স্বপ্ন ছিল না। তাই, অখণ্ড ভারতের স্বপ্ন দেখা ছাড়লে চলবে না। সুযােগ ঠিক এসে যাবে। সাফল্য যে পথে চলে, সবাই সেই পথে চলে। এককালে তুর্কিরা সফল ছিল। আজ তারা ব্যর্থ। আজ যদি ভারত সাফল্যের প্রতীক হয়ে ওঠে, সবাই ভারতকেই অনুসরণ করবে। ভারতে যােগ দিতে আগ্রহী হবে। পূর্বপুরুষদের পরম্পরার দান মাথা পেতে। নিতে এগিয়ে আসবে তারা, দলে দলে। আমাদের ধমনীতে একই রক্ত বইছে, সেই রক্তের টান তুর্কিনাচে ভুলে থাকা কিছুদিন সম্ভব, চিরদিন নয়। কোভিড পরবর্তী বিশ্ব এক নতুন বিশ্ব হবে। নতুন পরিস্থিতি, নতুন

প্রযুক্তি, নতুন সুযােগ। কে ভেবেছিল, আরব আমিরাতের সঙ্গে ইজরায়েলের বন্ধুত্ব হবে? তুর্কির সঙ্গে ঝগড়া বাধবে গ্রিসের? চীনতুর্কি-পাকিস্তান-ইরান, এক নতুন অক্ষ নির্মাণ হচ্ছে। এদিকে খনিজ তেলের লাভের গুড় তলানিতে এসে ঠেকেছে, অন্যদিকে আরব-তুর্কি সংঘর্ষের আশঙ্কায় কাঁপছে মধ্যপ্রাচ্য। এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে ফাপরে পড়বে ওয়াহাবি-সালফিরা, লাভ হবে ভারতের।

এ এক অসম্ভব সম্ভবের কালখণ্ড। কে ভেবেছিল রামমন্দির নির্মাণ এই চোখে এই দেহে দেখে যেতে পারব? ভারতের ঘটনাবলী বিশ্ব জুড়ে বিভিন্ন প্রাচীন সভ্যতার উত্তরাধিকারীদের মধ্যে নব জোয়ার আনবে। পিছু হটা শেষ, এগিয়ে চলা শুরু। এই সময় লক্ষ স্থির রাখতে হবে। সুযােগ ঠিকই এসে যাবে।।

অখণ্ড ভারত ছিল অর্থনৈতিকভাবে সফল একটা মডেল। এই মডেলে অন্তর্ভুক্ত। হলে সবারই লাভ। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ব্যবসা হয় দুটি প্রণালী দিয়ে ভারতের পূর্বে মলাক্কা প্রণালী ও ভারতের পশ্চিমে হরমুজ প্রণালী। ভারত খণ্ডিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা এই দুই প্রণালী থেকে দূরে সরে এসেছি। অখণ্ড ভারত এই সমস্যার নিরসন।

করবে। একদিকে মধ্য এশিয়া, ইউরােপ ও আফ্রিকা, অন্যদিকে প্রশান্ত মহাসাগরের । সঙ্গে বাধাহীনভাবে ব্যবসা চালানাে সহজ হবে। মধ্যযুগে ভারতের, বিশেষত বঙ্গদেশের পতনের মূল কারণ ছিল ভারত মহাসাগরের সর্বত্র ভারতীয় নৌসেনার প্রভুত্ব প্রয়ােজন, ভারতের সার্বভৌমত্ব প্রয়ােজন। যাতে আমাদের বাণিজ্যপােতগুলাে নির্দ্বিধায় কারাের চোখ রাঙানি ছাড়াই মহাসাগর পাড়ি দিতে পারে। শক্তিশালী স্বয়ংসম্পূর্ণ ভারতের এই শক্তিটুকু দরকার।

পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানির একীকরণ। কীভাবে হয়েছিল? দুই পক্ষের মধ্যে বিভেদ ছিল মতাদর্শের। যেদিন পূর্ব জার্মানি কমিউনিজম ত্যাগ করল, সেদিনই পূর্ব জার্মানি পশ্চিম জার্মানিতে বিলীন হলাে। মিলনের সেই মডেল তাে উদাহরণ স্বরূপ । আমাদের সামনেই রয়েছে। ভারত ও পাকিস্তান দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভাগ হয়েছিল, সেই মতাদর্শটা ধ্বংস হলেই কার্যসিদ্ধি হবে। সমস্যাটা ধর্মীয় নয়, সমস্যাটা সাংস্কৃতিক। সমস্যাটা আইডেন্টিটির। ইন্দোনেশিয়া কিন্তু তার আইডেন্টিটি বদলায়নি। কারেন্সি নােটে তারা গণেশের ছবি ছাপায়, এয়ারলাইন্সের নাম রাখে গরুড়’। শুনেছি দেশ স্বাধীন হতে তারা নিজেদের দেশের নাম ‘ইন্ডিয়া’ রাখতে চেয়েছিল। ভারত ততদিনে নামটা নিয়ে নেওয়ায় তারা নাম রাখে ‘ইন্দেনেশিয়া। আজও নাকি সে দেশের রাষ্ট্রপতির কাজের ঘরের দেওয়ালে ভারতীয় মাজাপাহিত সাম্রাজ্যের মানচিত্র টাঙানাে রয়েছে। পাকিস্তান-বাংলাদেশে এই বােধদয়, এই চেতনা প্রয়ােজন।

আমার স্থির বিশ্বাস, অখণ্ড ভারত একদিন না একদিন বাস্তবে রূপ নেবেই।

জানি না, সেই দিনটা এই চোখে এই দেহে দেখে যেতে পারব কিনা। তবে স্বপ্ন দেখা ছাড়তে আমি রাজি নই।।

তাই, স্বাধীনতা দিবস আমার কাছে। ‘অখণ্ড ভারত দিবস। এই দিনটা যত না আনন্দের, তারচেয়ে বেশি বিষাদের। ধ্যেয়নিষ্ঠার, প্রতিজ্ঞার প্রস্তুতির। আরেকটা পরাধীনতা যেন আর না আসে। পার্টিশনের, গণহত্যার কালাে দিনগুলাে যেন আর ফিরে না আসে। যতদিন না ভারতমাতার গৌরবময়ী অখণ্ড রূপ আবার জগৎসভায় বিশ্বগুরুর আসনে বসছে, পনেরােই আগস্ট মিষ্টি খেয়ে আনন্দ করার সুযােগ আমাদের নেই।

প্রবাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.