আমার কর্মজীবনে জম্মু ও কাশ্মীরে নিযুক্ত থাকাকালীন মিডিয়ার কাছ থেকে একটা প্রশ্ন নিয়ম করে শুনতে হতো যে আফগানিস্তানে পরিস্থিতি খারাপ হলে তার কতটা প্রভাব সে রাজ্যের নিরাপত্তা পরিস্থিতির ওপর পড়ার সম্ভাবনা। আমার চিরাচরিত উত্তর ছিল আফগানিস্তানে অস্থিরতা, যুদ্ধাবস্থা চললে তার খারাপ ফল চুইয়ে চুইয়ে সীমান্তরাজ্যে আসবেই।
সদ্য আফগানিস্তানে আমেরিকা ও জঙ্গি তালিবানদের মধ্যে চুক্তি নিয়ে আমাকে সেই একই প্রশ্ন আবারও করা হয়েছে, বিশেষ করে ১৯৮৯ সালে উপত্যকায় যে চরম অস্থিরতা শুরু হয়েছিল তারই পুনরাবৃত্তি ঘটতে চলেছে কিনা? বিশেষ করে আমেরিকার নেতৃত্বের মিত্র সেনা বাহিনী যখন আফগানিস্তান থেকে উঠে যাচ্ছে। প্রশ্নটিতে যুক্তি আছে। কেননা ১৯৮৯ সালে তদানীন্তন সোভিয়েত সেনা সরে যাওয়ার পরই কাশ্মীরে অস্থিরতার সূত্রপাত হয়। না, ১৯৮৯-এর ভারত আর ২০২০-র ভারতে আকাশ পাতাল তফাত। এমন দেশ যে কোনো ধরনের বদ অ্যাডভেঞ্চারের মোকাবিলায় অনেক বেশি প্রস্তুত।
সাধারণ যে ধারণাটা বাজারে খুবই চলছে যে আফগানিস্তান থেকে বিদেশি সৈন্য হটে গেলে চুক্তি অনুযায়ী তালিবানরা ক্ষমতায় বসবে। ক্ষমতায় এলেই তখন আর যুদ্ধ চালাবার দরকার না হওয়ায় একটা বড়ো সংখ্যক তালিবান পাকিস্তানের কুখ্যাত Inter service Intelligence (ISI)এর দিকে চলে যাবে। যাদের কাজে লাগাতে পাকিস্তান সদা উন্মুখ। এই কর্মহীন জঙ্গি তালিবানি যোদ্ধাদের পাকিস্তান চাকরি দিয়ে জম্মু ও কাশ্মীরে ঢোকানোর চেষ্টা করবে ঠিক যেমন ১৯৮৯-৯০-এ করেছিল। স্বাভাবিকভাবেই বর্তমানে জম্মু ও কাশ্মীরে কড়া প্রশাসনের মাধ্যমে সন্ত্রাসবাদীর যে সংখ্যা মাত্র ২৫০-এর কাছাকাছি নেমে এসেছিল হঠাৎ তাতে বৃদ্ধি ঘটবে, চরম অস্থিরতার সময় যা ৭ হাজারকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। অর্থাৎ ৮৯-৯০-এর পুনরাবৃত্তি। এই মতের প্রবক্তারা প্রায় ধরেই নিয়েছেন যে সেই কালো দিন ফিরে এল বলে।
এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে পাকিস্তানের মনোভাবে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন ঘটেনি। জম্মু ও কাশ্মীরে অস্থিরতা ও আতঙ্কের পরিস্থিতি তৈরি করে গণহত্যা চালিয়ে একটি দীর্ঘকালীন হিংসার পরিস্থিতি তৈরির মাধ্যমে তারা বারবার ভারতকে পরীক্ষা করে। এই ভাবে ছায়াযুদ্ধের পরিস্থিতি বজায় রাখার বিকৃত মানসিকতা তারা কখনই ছাড়েনি। পাকিস্তানের মনে এখনও একটা বদ্ধমূল ধারণা আছে যে কাশ্মীরের পিরপাঞ্জাল পর্বতমালা অঞ্চল সংলগ্ন বড়ো সংখ্যার মানুষজনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কযথেষ্টদুর্বল। তাদের ভারতের বিরুদ্ধে সহজেই ব্যবহার করা যেতে পারে, শুধু কিছুটা ভারত বিরোধী সেন্টিমেন্টে সুড়সুড়ি দেওয়ার অপেক্ষা। এই সূত্রে আফগান, পাকিস্তানি ও স্থানীয় সন্ত্রাসবাদীদের একজোট করে আবার ভারত বিরোধী প্রচার চালিয়ে হিংসার মাধ্যমে ভারতের যত বেশি ক্ষতি করা যায় এই চিন্তা পাকিস্তানে সদা সক্রিয়। আর এই ভাবে কাশ্মীরিদের মধ্যে ভারত বিরোধী সন্ত্রাসবাদে মদত দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে অবশিষ্ট ভারতবাসীর মনকে বিষিয়ে তুলতে পারলে সারা ভারতের সামগ্রিক সামাজিক পরিমণ্ডলে একটা মুসলমান বিরোধী আবহ তৈরি করা সহজ হবে। ভারতে সৌহার্দ্র ও প্রীতির পরিবেশ ধ্বংস করতে সুবিধে হবে।
বর্তমান আফগানিস্তান এখন একটি অত্যন্ত সংবেদনশীল অবস্থার মধ্যে দিয়ে চলেছে। এই পরিস্থিতিতে ভারত যদি এটা ধরে নেয় যে আফগানিস্তানের জাতীয় সেনাবাহিনী ও তালিবানি জঙ্গিরামিলে মিশে একটি সম্মিলিত শক্তি তৈরি করবে ও শান্তির বাতাবরণ তৈরি হবে তাহলে সেটা ভুল। ওইতালিবানদের মধ্যে থেকে আইএসআই-এ যোগ দিয়ে জম্মু ও কাশ্মীরে আগুন জ্বালানোর ভাড়াটে খুনি হিসেবে কাজ করার লোকের অভাব হবে না। এত কিছু সত্ত্বেও পাকিস্তানের চরম কট্টরপন্থী সামরিক শাসক ও ভারত বিদ্বেষীরা এটা নিজেদের মধ্যে মানতে বাধ্য হয়েছে যে ২০২০-র ভারতের কাশ্মীর পরিস্থিতির কোনো সাযুজ্য ১৯৮৯-এর সঙ্গে নেই। সেই কালপর্বে ভারতীয় সেনা শ্রীলঙ্কা থেকে সুদূর পঞ্জাব ও উত্তর-পূর্ব ভারতের বিস্তীর্ণ এলাকায় নানা সমস্যা ঠেকাতে সদা ব্যতিব্যস্ত ছিল। সেখানে ঢিলেমি দেওয়ার কোনো প্রশ্ন ছিল না। কাশ্মীর উপত্যকায় মাত্র ১ ডিভিসন সেনা মজুত ছিল যাদের সঙ্গে কয়েকটি অন্য ক্যাডারের আধা সামরিক বাহিনী সঙ্গী হিসেবে হাজিরা দিত। ১৯৯৯ সালে কার্গিল যুদ্ধে মার খাওয়ার পর ভারতের সদা পাহারা দেওয়ার লাইন অব কন্ট্রোল অনেক ছোটো হয়ে এসেছে। সে সময়। সন্ত্রাসবাদীদের মোকাবিলায় কোনো কাউন্টার ইনসারজেনসি বাহিনী গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। জম্মু-কাশ্মীর পুলিশের অভিজ্ঞতাও ছিল কম। বিগত ৩০ বছর ধরে নানান ছায়াযুদ্ধের অভিজ্ঞতা অর্জন করে জম্মু-কাশ্মীর পুলিশ আজ পূর্ণ আত্মবিশ্বাসী। দু’টি বিশাল সংখ্যার পদাতিক বাহিনী ও কয়েকটি স্বতন্ত্র সক্ষম ব্রিগেড নিয়ন্ত্রণরেখার সামনে অপ্রতিরোধ্য দুর্জয় প্রতিরক্ষায় মোতায়ন রয়েছে।
এদের ঠিক পেছনেই সদা জাগ্রত রাষ্ট্রীয় রাইফেল (RR) যা ভারতের উৎকৃষ্টতম সেনাবাহিনী তৈরি করার যে পরীক্ষামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল তার সফলতম উদাহরণ হিসেবে দণ্ডায়মান। সমগ্র RR-এর দুই তৃতীয়াংশ উপত্যকা পাহারা দিচ্ছে। এদের প্রশিক্ষণের মূল অভিমুখই হলো— (১) সদা সর্বদা দায়িত্বে নিযুক্ত থাকা, (২) স্থানীয় মানুষের সঙ্গে মিশে তাদের বিশ্বাস অর্জন করা, (৩) উপত্যকায় শান্তি ও সুস্থিরতা কোনো ভাবেই বিঘ্নিত না হতে দেওয়া।
এর সঙ্গে সোনায় সোহগা হিসেবে রয়েছে। CRPF যারা সর্বাধিক আত্মবিশ্বাসী ও RR বাহিনীর সঙ্গে সম্পূর্ণ সঙ্ঘবদ্ধ হিসেবে কাজ করে চলেছে। এই পটভূমিতে পাকিস্তান চারটি কৌশল প্রয়োগ করে পরিস্থিতি উত্তেজক করে তোলার চেষ্ট করতে পারে। (১)নাগাড়ে লোক। ঢোকানো, (২) সন্ত্রাসী কার্যকলাপ, (৩) গণ বিক্ষোভের আয়োজন, (৪) প্রচার মাধ্যম ও মসজিদের মৌলানাদের মাধ্যমে লোক ক্ষেপিয়ে পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ করে তোলা।
পাকিস্তানের জানা উচিত ২০০৪-এর পর থেকে এলওসি অঞ্চলে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে ব্যাপক কাটাতারের বেড়া দেওয়া সমেত সর্বাধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে নজরদারি ব্যবস্থা বিপুল বাড়ানো হয়েছে। এই ব্যবস্থার ফুল হাতেনাতে পাওয়া গেছে। অবশ্য অতি দুর্গম অঞ্চল দিয়ে সীমানা ভেদ করে প্রবেশের কিছু প্রচেষ্টা এখনও রয়েছে। অনুপ্রবেশকারী সন্ত্রাসবাদীদের কাজের সাফল্য অনেকটাই নির্ভর করে উপত্যকায় বসবসকারীদের যোগসাজসের ওপর। একই সঙ্গে তাদের হাতে বেআইনি অর্থ কতটা মজুত করা হচ্ছে সেটাও একটা বড়ো ফ্যাক্টর। ভারতের নিরাপত্তার আঁটোসাটো বাঁধুনি এই ধরনের কুমতলবের নিয়ন্ত্রণে উল্লেখযোগ্য সাফল্য পেয়েছে। একই সঙ্গে এদের কাজকর্ম কত দূর এগোচ্ছে বা আদৌ এগোচ্ছে কিনা তার ২৪x৭-এর সতর্ক প্রহরা জারি রয়েছে। প্রয়োজনে প্রত্যাঘাতের সর্বাধুনিক সামরিক কৌশল তৈরি থাকছে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে স্থানীয় সন্ত্রাসবাদীদের দলে টানা বা আফগানিস্তান থেকে আমদানি করা বিদেশি সন্ত্রাসবাদী বাহিনী তৈরি করে নতুন করে বড়োসড়ো জেহাদি উন্মাদনা তৈরি করা অতটা সহজ নয়। ৯০-এর দশকের অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায় এখন ওই ধরনের সন্ত্রাসের পুনরাবৃত্তির সম্ভবনা সীমিত, কেননা এই স্থানীয় অঞ্চলের সঙ্গে অপরিচিত বিদেশি জেহাদিদের মোকবিলা করতে হবে অনেক উন্নত সর্বাধুনিক প্রায়োগিক দক্ষতাসম্পন্ন ভারতীয় সেনা ও বিভিন্ন প্রতিরোধ বাহিনীর। কিন্তু হিংসার পরিমাণ সীমিত হলেও এর ফলে সামগ্রিক বাতাবরণের যে ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা তাতে সদ্য চালু হওয়া উন্নয়ন প্রক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ কারণে দ্রুত নানা প্রকল্পে যুবকদের টেনে। আনতে পারলে সন্ত্রাসবাদীদের দলে আসার লোক থাকবে না। তারা ব্যর্থ হবেই। নিরাপত্তা বাহিনী তাদের কর্তব্যে সজাগ থাকবেই, কিন্তু অসামরিক ক্ষেত্রে সরকারের বহুমুখী যোগদান। যে কোনো মূল্যে প্রয়োজন। সাফল্যের পথ সামরিক অসমরিক দুটির সংমিশ্রণেই তৈরি হবে।
এই কারণে কাশ্মীরে আরও স্থিরতা ও শান্তির পরিবেশ ফিরুক এমন অপেক্ষায় না থেকে এখনই সমাজের নীচু স্তর থেকে সাধারণ কাশ্মীরিদের আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তুলতে হবে। মানুষের মধ্যে কাজ করা একই সঙ্গে টাকার জোগান বন্ধ করে দেওয়া– এই দুটিই সরকারের প্রধান অস্ত্র হওয়া উচিত। বাকি সব ঠিকই আছে। আলোচনার বিষয়বস্তু ও পরিণতি অনেকটাই, অনেক কিছু ফ্যাক্টর-এর স্থির থাকা ধরে নিয়ে তাই কিছুটা অনুমাননির্ভর বলা যেতে পারে। তাই নেতাদের ছাড়া পাওয়া, বিধিনিষেধে শিথিলতার পর পরিস্থিতির অবনতি হলেও হতে পারে ধরে নিয়ে প্রস্তুত থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ।
সৈয়দ আটা হাসনান
(লেখক কাশ্মীরে নিযুক্ত পূর্বতন লেফট্যান্যান্ট জেনারেল)