বাঙ্গালির সাংস্কৃতিক বিকাশের ঐতিহ্য ও ইতিহাস সহস্রাব্দপ্রাচীন। সেই ঐতিহ্য এবং ইতিহাসের শরিক বাংলাভাষী সকল মানুষ যারা তাদের সংস্কৃতি ও জীবনদর্শনে তাকে রক্ষা করতে চায়। তবে সাংস্কৃতিক বিকাশের পাশাপাশি সমাজবিন্যাস এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিকাশের দিকটিকেও অবহেলা করা যায় না। বরং এগুলিকে বেশি গুরুত্ব দিতে হয়। ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায় মনে করতেন ‘সমাজ বিন্যাসের ইতিহাসই প্রকৃত জনসাধারণের ইতিহাস। জাতিসত্তা, ভাবাবেগ প্রভৃতি সবকিছুই সমাজ ও রাজনীতির বিকাশের সঙ্গে সম্পর্কিত। সমাজবিন্যাস ও রাজনৈতিক বিকাশের ইতিহাসের পথ ধরে প্রাচীন বঙ্গদেশ মুঘল আমলে ‘সুবা বাঙ্গলা’ নামে পরিচিতি লাভ করে। ব্রিটিশ আমলে হয় বেঙ্গল বা বাঙ্গলানামে একটি প্রদেশ। ১৯৪৭ সালের ২০শে জুন সেই বেঙ্গল থেকে জন্ম নেয় ওয়েষ্টবেঙ্গল বা পশ্চিমবঙ্গ । ১৯৪৭ সালের এই দিনই বঙ্গীয় প্রাদেশিক আইনসভা ভেঙে তৈরি হয়। পশ্চিমবঙ্গ আইনসভা। পশ্চিমবঙ্গ আইনসভার সদস্যগণ ৫৮-২১ ভোটে বঙ্গভাগের পক্ষে ও পাকিস্তানে যোগদানের বিপক্ষে ভোট দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ গঠন সুনিশ্চিত করেন। সৃষ্টি হলো পশ্চিমবঙ্গ, হলো ভারতের একটি অঙ্গরাজ্য। নিশ্চিত ধ্বংসের হাত থেকে বেঁচে গেল হিন্দু বাঙ্গালি জনগোষ্ঠী, বেঁচে গেল এথনিক ক্লিনজিং-এর হাত থেকে।
কিন্তু এটা দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে, পশ্চিমবঙ্গ গঠনের এইইতিহাসেিক বহুদিন ধরে তেমন গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করা হয়নি, স্মরণ করা হয়নি যাঁর দূরদর্শিতা এবং হার-না-মানা লড়াইয়ের জন্য পশ্চিমবঙ্গ গঠন সম্ভব হলো সেই শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে বরং একশ্রেণীর বাম-উদারবাদী ইতিহাসলেখক এবং একই মতাবলম্বী রাজনীতি ব্যবসায়ী এখনো শ্যামাপ্রসাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন যে শ্যামাপ্রসাদই বাঙ্গলাভাগের জন্য দায়ী। এই ভাবনাচিন্তার প্রতিফলন ঘটে বাম-উদারবাদী গোষ্ঠীর কিছু লেখকের লেখা গ্রন্থে যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো তপন রায়চৌধুরীর ‘বাঙালনামা’, জয়া চ্যাটার্জির Bengal Divided : Hindu Communalison and Partition, 1932-1947, সুনীতি কুমার ঘোষের ‘বাংলা বিভাজনের অর্থনীতি রাজনীতি প্রভৃতি। তালিকা আরও বাড়তে পারে। এদের কেউ কেউ মনে করেন বাঙ্গলার রাজনীতির সাম্প্রদায়িকরণ হয়েছে শ্যামাপ্রসাদের কারণে। আর শ্যামাপ্রসাদ এবং তার সহযোগীদের প্রচেষ্টায় যদি বাঙ্গলাভাগ না হতো অর্থাৎ শরৎ বসু-কিরণশংকর রায়ের প্রস্তাব অনুযায়ী বাঙ্গলা যদি স্বাধীন সার্বভৌম হতো তবে বিশ্বব্যবস্থায় বাঙ্গলা নাকি অনেক গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় থাকতে পারতো।
সত্যিটা হলো কেবল বাঙ্গলা নয়, শ্যামাপ্রসাদ প্রবলভাবে চেষ্টা চালিয়েছিলেন যাতে ভারতভাগ আটকানো যায়। যখন ভারতভাগ প্রায় অনিবার্য হয়ে উঠলো তখন বাঙ্গলার হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলিকে ভারতের সঙ্গে যুক্ত করার দাবি তুলেছিলেন এবং তার ও তৎকালীন বাঙ্গলার জাগ্রত মনীষার এক বড় অংশের ঐকান্তিক প্রচেষ্ঠা এবং জনগণের দাবিতে সৃষ্টি হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ও বাস্তববাদী রাজনীতিক শ্যামাপ্রসাদ বুঝেছিলেন তথাকথিত স্বাধীন, সার্বভৌম বাঙ্গলা আসলে পাকিস্তানের অংশ হবে এবং হিন্দু বাঙ্গালিকে নিশ্চিত ধ্বংসের পথে নিয়ে যাবে। শ্যামাপ্রসাদ তাই বাঙ্গলা নয়, আসলে পাকিস্তানকেই ভাগ করেছিলেন। অখণ্ড বঙ্গের কৃষি, শিল্প এবং খনিজ সম্পদে বলীয়ান এক শক্তিশালী পাকিস্তানের যে স্বপ্ন জিন্না দেখেছিলেন তা বাস্তবে সত্যি হতে দেননি শ্যামাপ্রসাদ। প্রবন্ধের পরবর্তী অংশে সেই সত্যিটাকেই খুঁজে বের করার চেষ্টা করবো।
বর্ণান্ধ বাম-উদারবাদী ইতিহাস লেখকগণ বাঙ্গলায় সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রাবল্যের জন্য শ্যামাপ্রসাদ, হিন্দু মহাসভা কিংবা সামগ্রিকভাবে হিন্দু জনগোষ্ঠীকে যতই দায়ী করুন, বাস্তব সত্য হলো সাম্প্রদায়িকতার চারাগাছটি রোপণ করা হয়েছিল ১৯০৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর ঢাকা শহরে। ওইদিন প্রতিষ্ঠিত হয় মুসলিম লিগ। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে আলিগড় আন্দোলনের মধ্য দিয়ে পৃথক মুসলিম জাতিসত্তার সে ভাবনাকে লালন পালন করা শুরু হয় তার সাংগঠনিক প্রকাশ ঘটেছিল মুসলিম লিগ প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে। লিগের ভেতরে এবং বাইরে অখণ্ড ভারতীয় জাতিসত্তার বদলে মুসলমানদের পৃথক জাতিসত্তার ভাবনাকে শক্তিশালী করা হতে থাকে। তার রাজনৈতিক জীবনের প্রথম পর্যায়ে উদারপন্থী জিন্নাও ধর্মের ভিত্তিকে জাতিসত্তা নির্ধারণের ভাবনাকে সমর্থন করেননি। কিন্তু ১৯১৯-২০ সালে কংগ্রেস ত্যাগ করার পর জিন্নাও ৩০-এর দশক থেকে পৃথক মুসলিম জাতিসত্তার ভাবনাকে মুসলমান জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার এবং জনপ্রিয় করার কাজ শুরু করেন। ১৯৩০ সালে মুসলিম লিগের এলাহাবাদ সম্মেলনে স্যার আল্লামা মহম্মদ ইকবালের সভাপতির ভাষণে পৃথক মুসলিম জাতিসত্তাকে একটি দার্শনিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা পরিলক্ষিত হয়। পৃথক জাতিসত্তার ভাবনা পৃথক দেশের রূপ পায় ১৯৪০ সালে মুসলিম লিগের লাহোর অধিবেশনে। ১৯৪০ সালের ২৪শে মার্চ, মুসলিম লিগ মুসলমান জনগোষ্ঠীর জন্য পৃথক দেশের দাবি তুলে এক প্রস্তাব গ্রহণ করে। এই প্রস্তাবে ভারতের উত্তর-পশ্চিম এবং পূর্বাংশে সেখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম প্রধান অঞ্চলগুলির ভৌগলিক সীমা চিহ্নিত করে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠনের দাবি তোলা হয়।
লাহোর প্রস্তাবের প্রভাব ভারতীয় রাজনীতিতে কী হতে চলেছে তা অনুমান করতে পেরেছিলেন বাস্তববাদী রাজনীতিবিদ। শ্যামাপ্রসাদ। বিশেষত এই দাবিকে সামনে রেখে বাঙ্গলার রাজনীতিতে কী কাণ্ড ঘটাতে পারে মুসলিম লিগ, সে ব্যাপারেও শ্যামাপ্রসাদের মনে গভীর উদ্বেগ ছিল। তার চিন্তা এবং উদ্বেগের বহিঃপ্রকাশ দেখা যায় লাহোর প্রস্তাবের ঠিক ১৩ দিন পরে সুরমা ভ্যালি এবং শিলং হিল ডিস্ট্রিক্ট হিন্দু কনফারেন্সে প্রদত্ত ভাষণে। ১৯৪০ সালের ৬-৭ এপ্রিল অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনে শ্যামাপ্রসাদ বলেন, “আমাদের সামনে বিপদ এখন অনেক। শেষতম বিপদটি হলো । পাকিস্তানের দাবিতে আন্দোলন যাকে কিছুতেই এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। যারা হিন্দুস্থানকে ভালোবাসে তাদের সকলের কাজ হলো এই অযৌক্তিক দাবিকে অঙ্কুরেই বিসর্জন করা।”
ভারতে কংগ্রেস রাজনীতির চরিত্র সম্পর্কে শ্যামাপ্রসাদ সম্যকরূপে অবহিত ছিলেন। মুসলিম লিগের এই দাবির মোকাবিলা কংগ্রেস কতখানি করতে পারবে সে ব্যানারে তার সন্দেহ ছিল। ওই অধিবেশনেই কংগ্রেসকে সতর্ক করে শ্যামাপ্রসাদ বলেছিলেন, “বিভিন্ন সম্প্রদায়কে নিজের ছত্রছায়ায় এনে ঐক্যবদ্ধ ভারতীয় জাতি গঠনের যে নীতি কংগ্রেস গ্রহণ করেছিল তা এমন কোনো সাফল্যের মুখ দেখেনি যে আমাদের হৃদয় আনন্দ এবং আশাবাদে পূর্ণ হবে। বরং সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা এটাই প্রমাণ করে যে আমরা অন্যান্য সম্প্রদায়কে তুষ্ট রাখতে হিন্দুদের অধিকার ও স্বার্থকে যতই জলাঞ্জলি দিই না কেন, যতই আমরা তাদের ব্ল্যাঙ্ক চেক দেওয়ার নীতি গ্রহণ করি না কেন, অন্য পক্ষের প্রতিক্রিয়াকে যদি শত্রুতাপূর্ণ নাও বলি তা বড়োই ধীরগতির কিংবা একেবারে স্তব্ধ।”
তৎকালীন জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে মুসলিম লিগের দাবি পর্যালোচনা করে শ্যামাপ্রসাদ বুঝেছিলেন যে, লিগ এই অস্থির পরিস্থিতির সুযোগে তাদের পৃথক রাষ্ট্রের দাবি আদায় করে নিতে চাইছে। আর এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে মুসলিম লিগ ভারতীয় মুসলমানদের সবচেয়ে শক্তিশালী সংগঠন। লিগের ভারতভাগের দাবি প্রতিহত করতে শ্যামাপ্রসাদ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল নিলেন। প্রথমত, ভারতভাগ প্রতিরোধ করতে সমস্ত শক্তি নিয়ে রুখে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি বুঝেছিলেন হিন্দু সমাজই কেবল সংগঠিতভাবে ভারতভাগ রুখে দিতে পারে।। ১৯৪০ সালের ১৪ এপ্রিল নবম বিহার প্রাদেশিক হিন্দু সম্মেলনে শ্যামাপ্রসাদ বলেন, “এদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দেওয়া মুসলমানদের সংখ্যা খুব বেশি নয়। আমরা হিন্দুরা স্বাধীনতার লক্ষ্য অর্জনে মুসলমানদের সঙ্গে ঐক্যের স্বার্থে আমাদের অনেক ন্যায্য স্বার্থ বিসর্জন দিয়েছি। কিন্তু তাদের সমর্থন লাভ করতে আমাদের আগ্রহকে আমাদের দুর্বলতা এবং অসহায়তা বলে ভুল ভাবা হয়েছে।” শ্যামাপ্রসাদের নীতি ছিল হিন্দুরা আর কোনভাবে নিজেদের স্বার্থ বিসর্জন দেবেনা। মুসলমানদের সমর্থন লাভের আশা ত্যাগ করে এবার নিজেদের হাতে হাত মেলাতে হবে। একই সঙ্গে পৃথক পাকিস্তানের জন্য মুসলিম লিগের দাবির বিরোধিতা করতে হবে কারণ এই দাবি মেনে নিলে গোটা হিন্দু সমাজ খণ্ড খণ্ড হয়ে যাবে।
এটা তখনই সম্ভব হবে যদি হিন্দু সমাজ সমস্ত বিভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ হয়। এটাই ছিল শ্যামাপ্রসাদের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ নীতি। এর প্রতিফলন দেখা যায় ওই সম্মেলনে শ্যামাপ্রসাদের বক্তৃতায়। তিনি বলেছিলেন, “ইসলামে ঐক্য এবং সমতার নীতি আছে যা হিন্দু ধর্মে নেই। জাতি, বর্ণ, ধর্মের পার্থক্য একজন হিন্দুকে অপর হিন্দুর প্রতি সহানুভূতিপ্রবণ হতে বাধা দেয়। অন্যদিকে একজন মুসলমান অন্য মুসলমানের প্রতি তাঁর টান অনুভব করে। যদি সে মুসলমান ভারতের অন্য কোনো অংশে কিংবা পৃথিবীর যে কোনো অংশে বাস করে তবু এই টান বজায় থাকে। এই নীতির আরও প্রকাশ ঘটে ১৯৪০ সালের ৭ ডিসেম্বর মহাকোশল প্রাদেশিক হিন্দু সভার সম্মেলনে শ্যামাপ্রসাদ প্রদত্ত ভাষণে। এই ভাষণে তিনি বলেন যে, হিন্দুদের মধ্যে। ঐক্যবোধ জাগ্রত করতে গেলে তাদের মধ্যে পার্থক্যগুলিকে দূর করতে হবে। “রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ঐক্য কখনোই অর্জন করা সম্ভব হবে না যদি না আমরা আমাদের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক কর্মসূচিগুলিকে এমনভাবে প্রস্তুত করতে পারি ও এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি যাতে হিন্দুদের সমস্ত অংশের স্বেচ্ছাকৃত সহযোগিতা নিশ্চিত হয়।” শ্যামাপ্রসাদের তৃতীয় নীতিটির মধ্যে তার রাজনৈতিক বাস্তববাদের পরিচয় পাওয়া যায়। মুসলমানদের প্রগতিশীল অংশকে কাছে টানার জন্য ১৯৪১ সালের ১২ ডিসেম্বর ফজলুল হককে প্রধানমন্ত্রী করে যে প্রগ্রেসিভ কোয়ালিশন সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল শ্যামাপ্রসাদ সেই মন্ত্রীসভায় যোগ দিয়ে। অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। শ্যামাপ্রসাদের মূল লক্ষ্যই ছিল তীব্র হিন্দু বিরোধী এবং আগ্রাসী রাজনীতির ধারক ও বাহক। মুসলিম লিগকে রাজনীতির ক্ষমতাবৃত্ত থেকে দূরে রাখা। কৃষক প্রজা পার্টির নেতা ফজলুল হক ছিলেন তুলনামূলকভাবে উদারপন্থী। মুসলমান। তিনি দ্বিজাতিতত্ত্বও মানতেন না। শ্যামাপ্রসাদ মনে করতেন বাঙ্গলার রাজনীতির ভরকেন্দ্র থেকে মুসলিম লিগকে দূরে রাখার সুবর্ণ সুযোগ এসেছিল ১৯৩৭ সালে বাঙ্গলার প্রাদেশিক আইনসভা নির্বাচনের পর। এই নির্বাচনের পর ফজলুল হককে প্রধানমন্ত্রী করে যদি হক-কংগ্রেস কোয়ালিশন মন্ত্রীসভা তৈরি হতো তবে বাঙ্গলার রাজনীতিতে মুসলিম লিগের গুরুত্ব অবশ্যই কমে যেত। কিন্তু কংগ্রেসের দোদুল্যমান্যতা এবং অন্তঃকলহের কারণে তা সম্ভব হয়নি। ফলে ফজলুল হক মুসলিম লিগের সঙ্গে কোয়ালিশন করে মন্ত্রীসভা গঠন করেন। ফজলুল হক দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে বাঙ্গলাভাগের বিরোধী ছিলেন। বাঙ্গলার রাজনীতির এই বাস্তবতা কংগ্রেস যদি বুঝতো তবে আজ হয়তো অন্য পরিস্থিতি থাকতো।
লাহোর প্রস্তাবের কী ভয়ংকর প্রভাব ভারতীয় রাজনীতিতে পড়তে চলেছে কংগ্রেস তা সঠিক অনুধাবন করতে পারেনি। যদি পারতো তবে সর্বশক্তি এর বিরোধিতা করতে পাশে থাকতো। কিন্তু লাহোর প্রস্তাব পাশ হওয়ার পরহরিজন পত্রিকার এক নিবন্ধে গান্ধীর গলায় স্পষ্টতই অসহায়তার সুর দেখা গেল। গান্ধী লিখলেন, “দেশকে টুকরো টুকরো করার সিদ্ধান্তের আমি শরিক হতে পারি না। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে হিন্দু ও মুসলমানরা যে এক জাতি হিসেবে বাস করেছে তা এর ফলে এক লহমায় নষ্ট হয়ে যাবে।” কিন্তু একই সঙ্গে তিনি এটাও বললেন, “আমরা এখন একটি যৌথ পরিবার। কেউ একজন পৃথক হতে চাইতেন পারে….. ভারতের মুসলমানরা যদি দেশভাগের দাবি নিয়ে জোর করতে থাকে অহিংসার পূজারি হিসেবে, আমি জোর করে তা আটকাতে পরি না।” এদিকে ১৯৪০-৪১ সালে পূর্ববঙ্গের বেশ কিছু অঞ্চলে হিন্দুদের উপর আক্রমণ শুরু হলো। নোয়াখালি, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ প্রভৃতি অঞ্চলে এই দাঙ্গার ভয়াবহতা ছিল সবচেয়ে বেশি। বাঙ্গলার প্রাদেশিক সরকারে একটি বড়ো অংশই ছিল মুসলিম লিগ। ফলে এই দাঙ্গাগুলোতে সরকার প্রায় নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে। ইতিমধ্যেই দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে আরও জটিল। করে তোলে। একটি হলো ক্রিপস মিশনের প্রস্তাব এবং হলো চক্রবর্তী রাজাগোপলাচারি প্রদত্ত রাজাজী ফরমুলা। দুটিতেই প্রকারান্তরে ভারতভাগ মেনে নেওয়া হলো। ক্রিপস প্রস্তাবের সবচেয়ে বিপজ্জনক দিক ছিল যদি কোনো প্রদেশ বা একাধিক প্রদেশ নতুন। সংবিধান অনুযায়ী ভারতীয় ইউনিয়নে থাকতে রাজি না হয় তবে তারা নিজেদের গণপরিষদ গঠন করে সংবিধান রচনা করবে। আর ১৯৪২ সালের ২৩ এপ্রিল মাদ্রাজ প্রাদেশিক আইনসভায় রাজাজী যে প্রস্তাব পেশ করেছিলেন তার মূল ভাবনা ছিল বিশ্বসুদ্ধ পেয়ে ভারতের উত্তর পশ্চিম এবং পূর্বের মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলিকে চিহ্নিত করে গণভোটের ব্যবস্থা করা। এই গণভোটেই ঠিক হবে এই অঞ্চলগুলো ভারতে থাকবে না ভারতের বাইরে গিয়ে পাকিস্তান গঠন করবে।
বাঙ্গলার হিন্দু জনগোষ্ঠীর মধ্যে ক্রিপস প্রস্তাব এবং রাজাজী ফরমুলা বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টিকরে।শ্যামাপ্রসাদের নেতৃত্বে হিন্দু মহাসভা বাঙ্গলায় বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে হিন্দু জনগোষ্ঠীর মধ্যে। এই সময় ব্রিটিশ সরকারের গোপন রিপোর্ট বলে বাঙ্গলায় কংগ্রেস দল ক্রমেই জনপ্রিয় হারাচ্ছে এবং শ্যামাপ্রসাদের কারণে জনসমর্থন বাড়িয়ে চলেছে হিন্দু মহাসভা। ১৯৪৩ সালে শ্যামাপ্রসাদ দিল্লিতে জিন্নার সঙ্গে দেখা করলেন। কিন্তু ক্রিপস প্রস্তাবের পর জিন্না তখন পাকিস্তান সৃষ্টির ব্যাপারে অনেকটাই নিশ্চিত। শ্যামাপ্রসাদ তার ডাইরিতে লিখেছেন, “আমি জিন্নার কাছে পাকিস্তান ধারণা অযৌক্তিকতা সম্পর্কে অনেক যুক্তি তুলে ধরেছি। কিন্তু তাকে প্রভাবিত করতে পারিনি। সেই সময় বিভিন্ন সভায় মুসলিম। লিগের দাবির কাছে কংগ্রেসের অসহায় অত্মসমপর্ণকে তীব্র সমালোচনায় বিদ্ধ করেন।
১৯৪৬ সালের প্রথমদিকে ভারতের প্রাদেশিক আইনসভাগুলির নির্বাচনের ফলাফল শ্যামাপ্রসাদের ভাবনায় পরিবর্তন আনে। এই নির্বাচনে মুসলিম লিগ লড়েছিল পাকিস্তানের দাবিকে সামনে রেখে আর হিন্দু মহসভার দাবি ছিল অখণ্ড ভারত। এই নির্বাচনে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলিতে লিগ বিপুল ভোট পেয়ে জয়ী হয়। সার্বিকভাবে কংগ্রেসও ভালো ফল করে।কিন্তু হিন্দু মহাসভা নির্বাচনে ভালো ফল করেনি। ইতিমধ্যে পুনা প্রস্তাবে কংগ্রেসও ভারত ভাগের দাবি মেনে নেয়। ১৯৪৬-এর ক্যাবিনেট মিশনও তার ভারতভাগে সম্মতি নেয়। শ্যামাপ্রসাদের সামনে তখন সবচেয়ে বড়ো চিন্তার বিষয় ছিল বাঙ্গালি হিন্দুর ভবিষ্যৎ। বাঙ্গলায় লিগের নেতৃত্বাধীন প্রাদেশিক সরকারের প্রত্যক্ষ মদতে ১৯৪৬-এর ১৬ আগস্ট হয় ‘গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’। হিন্দু বিরোধী দাঙ্গার বীভৎস রূপ দেখা গেল ঢাকা, নোয়াখালি, চট্টগ্রাম প্রভৃতি অঞ্চলে। গণপরিষদ গঠন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কার্যকারিতা প্রভৃতি বিষয়ে যখন কংগ্রেস ও লিগের মধ্যে তীব্র মতবিরোধ চলছে তখন ব্রিটিশ প্রধামন্ত্রী অ্যাটলি ঘোষণা করলেন যদি ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে ভারতের রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলির মধ্যে মতৈক্য না হয় তবে ব্রিটিশ সরকার ১৯৪৮ সালে জুনের মধ্যে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে। এই ঘোষণায় আরও বলা হলো ব্রিটিশ সরকার ঠিক করবে কেন্দ্রীয় সরকার কিংবা কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে সঙ্গে কিছু প্রাদেশিক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে কিনা। এই ঘোষণায় খুবই আশান্বিত হয়েছিলেন বাঙ্গলার প্রধানমন্ত্রী সুরাবর্দি। তার আশা ছিল গোটা বাঙ্গলার নিয়ন্ত্রণ তাঁর হাতেই থাকবে। অদ্ভুতভাবে স্বাধীন সার্বভৌম বাঙ্গলার দাবিকে সমর্থন করে বসলেন শরৎ বসু ও কিরণশংকর রায়। শ্যামাপ্রসাদ বুঝেছিলেন সুরাবর্দির স্বাধীন সার্বভৌম বাঙ্গলার স্বপ্ন যদি সফল হয় তবে হিন্দু সমাজের পক্ষে তা ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনবে। বাঙ্গলার লিগ সরকারের হিন্দুবিরোধী কার্যকলাপের স্মৃতি তখনো সবার মনে টাটকা। বিশেষত ১৯৪৬-এর ১৬-ই আগস্টের গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং সুরাবর্দি এবং তাঁর দল মুসলিম লিগের প্রকৃত স্বরূপ উন্মোচিত করেছিল। অখণ্ড বঙ্গপ্রদেশে হিন্দু জনসংখ্যা ছিল ৪৫ শতাংশ। ফলে বাঙ্গলার রাজনীতিতে হিন্দুরা কখনোই নিয়ন্ত্রক শক্তিতে পরিণত হতে পারবে না। শ্যামাপ্রসাদ বলেছিলেন, “ধর্মের ভিত্তিতে বঙ্গভাগ জাতীয়তাবাদের মূল নীতির বিরোধী। হিন্দুরা ভারতবর্ষ বা তার কোনো অংশকে ভাগ করতে চায় না। কিন্তু তারা (হিন্দুরা) যদি দেখে গোটা বঙ্গপ্রদেশ একদল উন্মত্ত সাম্প্রদায়িক মানুষের হাতে চলে গেছে এবং ৪৫ শতাংশ মানুষ ক্রীতদাসে পরিণত হতে চলেছে, কারণ তারা একটি বিশেষ ধর্মের মানুষ, তাহলে নিজেদের জন্য ভূখণ্ড দাবি করা অপরাধ নয়। সে ভূখণ্ডে তারা বসবাস করবে স্বাধীন ভাবে, যেখানে তাদের ঐতিহ্য অনুযায়ী নিজেদের সংস্কৃতি, সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবন পরিচালনা করতে পারবে।
শ্যামাপ্রসাদ এটা ভালোই জানতেন সুরাবর্দি যতই স্বাধীন সার্বভৌম বাঙ্গলায় হিন্দু মুসলমানের স্বাধীন ও মুক্ত জীবনের স্বপ্ন দেখান, তিনি আসলে জিন্নার হাতের পুতুল। ১৯৪৭-এর ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবস উপলক্ষ্যে সুরাবর্দি বলেছিলেন, “খুব তাড়াতাড়ি পাকিস্তান দিনের আলো দেখবে এবং পরের বছর পাকিস্তান দিবস পালনের কোনো প্রয়োজন হবে না। এর প্রমাণ মেলে প্রাদেশিক মুসলিম লিগের তৎকালীন সভাপতি আক্ৰম খানের কথাতেও। তিনি বলেছিলেন, “পাকিস্তানের বাইরে পৃথক স্বাধীন বাঙ্গলার প্রশ্নই আসে না….আমরা একটি পৃথক ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চাই যার মধ্যে থাকবে সমস্ত মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল।” কুশলী রাজনীতিবিদ জিন্নার স্বপ্ন ছিল গোটা বাঙ্গলা ও অসমকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করা। আসামের চা-শিল্প, বাংলার পূর্ববঙ্গের কৃষি উৎপাদন আর পশ্চিমাংশের শিল্প ও খনিজ দ্রব্য পাকিস্তানের অর্থনীতিকে শক্ত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠা করবে। ভারতের প্রাচীনতম বন্দর কলকাতার উপর নির্ভরশীল নেপাল, ভুটান কিংবা সিকিম পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণেই থাকবে। এইভাবে পাকিস্তান হয়ে উঠবে দক্ষিণ-দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এক প্রবল পরাক্রমশালী দেশ। জিন্নার স্বপ্ন সত্যি হলে পাকিস্তান সত্যিই এক পরাক্রমশালী দেশে পরিণত হতো। কিন্তু তা হতে দেননি শ্যামাপ্রসাদ, তার সহযোগী ছিলেন বাঙ্গলার জাগ্রত মনীষা এবং হিন্দু জনগোষ্ঠী। ১৯৪৭ সালের ৪-৬ এপ্রিল হিন্দু মহাসভার তারকেশ্বর সম্মেলনে বাঙ্গলার হিন্দু অধ্যুষিত অঞ্চলগুলিকে ভারতের সঙ্গে যুক্ত করার জোরালো দাবি তোলান হলো। সেই সময় বিখ্যাত ইংরেজি দৈনিক অমৃত বাজার পত্রিকা বঙ্গ ভাগ নিয়ে যে জনমত সমীক্ষা চালিয়েছিল তাকে ৯৮.৩ শতাংশ পাঠকই বঙ্গভাগের পক্ষে রায় দেন। শ্যামাপ্রসাদ ঝড়ের বেগে গোটা বঙ্গ চষে বেড়ালেন বঙ্গভাগের দাবি নিয়ে। সর্বত্রই হিন্দু সমাজের ব্যাপক সাড়া পেলেন। বঙ্গভাগের দাবি তুললেন স্যার যদুনাথ সরকার, বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা, শিশির মিত্র, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, রমেশচন্দ্র মজুমদার প্রমুখ বাঙ্গলার বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীগণ। শেষ পর্যন্ত কংগ্রেস পঞ্জাব ও বঙ্গভাগের দাবি সমর্থন করলো। ব্রিটিশ সরকারও এই দাবি মানলো। জিন্না রাজি হলেন পোকায় খাওয়া খাওয়া পাকিস্তান মেনে নিতে।
সুতরাং শ্যামাপ্রসাদ বাঙ্গলাভাগ করেছিলেন এই বক্তব্য ইতিহাসের অপব্যাখ্যা। শ্যামাপ্রসাদ পাকিস্তান ভাগ করেছিলেন। প্রকৃত রাষ্ট্রনায়ক যিনি, তিনি অনেক দূরের সম্ভাবনা বুঝতে পারেন। চল্লিশের দশকে বঙ্গ তথা ভারতের রাজনীতির গতিপ্রকৃতি এবং প্রবণতাগুলিকে বিশ্লেষণ করে শ্যামাপ্রসাদ সেই অনুযায়ী তার ভূমিকা পালন করেছিলেন। শ্যামাপ্রসাদ তাই একজন সত্যিকারের রাষ্ট্রনায়ক।
বিমল শংকর নন্দ
তথ্যসূত্র ঃ ১) নীহাররঞ্জন রায়-বাঙালির ইতিহাস-আদি পর্ব।
২) দীনেশচন্দ্র সেন—শ্যামাপ্রসাদ, বঙ্গবিভাগ ও পশ্চিমবঙ্গ
5) Nabkumar Adak-Shyamaprasad Mukherjee : A Study of His Role in Bengal Politics (1929-1953)