আবার এসো

ছোটোবেলায় পুজো আসছে টের পাওয়া যেত ক্লাবের মাঠেম্যারাপের জন্য বাঁশ পড়লে। দু এক দিনের মধ্যে শুরু হত দেড়-দু’হাত গভীর গর্ত খুঁড়ে দড়ি দিয়ে মেপে খুঁটি পোঁতা। আড়াআড়ি বাঁশ বাঁধা। ত্রিপলের ছাউনি। ভিতরে রঙিন কাপড়ের আস্তরণ। দুর্গা মায়ের সপরিবারে অধিষ্ঠানের মণ্ডপ।
প্রতিমা আসতো চতুর্থী বা পঞ্চমীর মধ্যরাত্রে। ওই সময় আগমনীর আগমনের প্রত্যক্ষদর্শী হওয়া সম্ভব হতো না। তাই সাধারণত ষষ্ঠীর সকালে মাতৃমুখ দর্শন হতো।
ষষ্ঠীর সন্ধ্যা থেকে বিজয়া দশমীর দুপুর থেকে রাত অবধি চলতো উৎসবের ঘনঘটা। নতুন জামা, প্যান্ট, জুতো। প্রায় সব বাড়িতেই তৈরি হতো নানা ধরনের খাবার। সে সময় হোটেল রেস্তোরাঁয় খাবার খাওয়ায়। খুব বেশি প্রবণতা ছিল না। বাড়িতেই রকমারি ভোজ্যপদ তৈরি হতো। কিন্তু আমাদের হাতে সময় খুব বেশি থাকতোনা। তাই খাবারের রকমফের নিয়ে মাথা ঘামাতাম না। এই কদিন সকালে উঠে মুখ ধুয়ে, মুখে কিছু দিয়ে সটান পুজোপ্যান্ডেলে। পাড়াতুতো অভিভাবক আমাদের কিছু কাজ করতে বললে নিজেদের ধন্য মনে করতাম।
সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী তিনদিন দুপুরে ভোগ বিতরণ হতো। পাড়াসুদ্ধ লোক সেই ভোগ পেত। কেউ কেউ বাড়ি নিয়ে যেত। আর একটা প্রথা ছিল ‘সিধে দেওয়া। ভোগের জন্য চাল, ডাল, সবজি, মশলা, তেল ইত্যাদি দেওয়া। সাধারণত অষ্টমীর দিন বেশি লোক সিধে দিত। পাড়ার মাতৃস্থানীয়রা ষষ্ঠী ও অষ্টমীর দিন নিজ নিজ সন্তান এবং পরিবারের মঙ্গল কামনায় মানত করে উপবাস করতেন। এই দুদিন প্রায় সববাড়িতে নিরামিষ আহারের আয়োজন হতো। তবে নবমীর দিন ছাগ মাংস খাবার চল ছিল ব্যাপক ভাবে। অধিকাংশ বড়োরা তিনদিন পুস্পাঞ্জলি দিতেন। আমরা অষ্টমীর পূজাতেই পুস্পাঞ্জলি দিতাম। প্রণাম মন্ত্র উচ্চারণের পর প্রণত হয়ে নিরুচ্চার কাতর অনুনয় অন্তরের অন্তস্থল থেকে বেরুত—‘মা এবারটা ভালোভাবে পাশ করিয়ে দাও, সামনেরবার ঠিক মন দিয়ে পড়াশুনা করবো। তখন পুজোর ছুটির পর স্কুল খুললে কিছুদিনের মধ্যে শুরু হতো ফাইনাল পরীক্ষা। কারণ ফেল করলে বাড়িতে দুর্গতি আর নীচের ক্লাশের ছেলেদের সঙ্গে সহাবস্থান অনিবার্য। বোধহয় ক্লাস সেভেন, এইট পর্যন্ত এটা চলেছিল। তখন দশমীর দিনই প্রতিমা বিসর্জন হতো। তাই লোকে তিনদিন সন্ধ্যারাত থেকে বিভিন্ন মণ্ডপে প্রতিমা দেখার জন্য ভিড় করতেন। এই দর্শনার্থীদের ভিড় সামাল দেবার জন্য স্বেচ্ছাসেবকের ভূমিকা পালন করে আত্মশ্লাঘা বোধ করতাম।
আমার ছোটোবেলা সময়টা ছিল বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগের দ্বিতীয় দশক। তখন এই বঙ্গের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের অন্তর্গত সবকিছুই ছিল সমৃদ্ধ, ঋদ্ধ। সংগীত, সিনেমা, সাহিত্য, নাটক সবক্ষেত্রে ছিল নিত্য নতুন। ভাবনার রূপায়ণ। পুজোর গান, পুজাসংখ্যা ইত্যাদির বাহুল্য ছিল উল্লেখযোগ্য। প্রায় সারদিন মাইকে গান বাজতো তবে পড়শীকে পীড়িত না করে। শিশু, কিশোর, বড়োদের শারদীয়া সংখ্যা প্রচুর পাওয়া যেত। প্রত্যেক বাড়িতে দু-চারটে করে পূজা সংখ্যার দেখা পাওয়াটা অবাক করা ব্যাপার ছিল না।
নবমীর রাত শেষ হলে দশমীর প্রভাত আসতো আজও যেমন আসে। মণ্ডপে পূজারি দধিকর্মার উপকরণ এসেছে কিনা খোঁজ নিচ্ছেন। নির্ঘণ্ট অনুসারে মায়ের বিসর্জন হবে। তার আগে দেবীকে শেষ নিবেদন এবারের মতো। পুরোহিতের কণ্ঠে ধ্বনিত হয় ব্যাকুল আর্তি—পুনরাগমনায় চ’ এক তীব্র আকুতি অনুরণিত হয় উপস্থিত সকলের হৃদয়ে মনে—মা আবার। এসো।
অভিজিৎ রায় চৌধুরী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.