শ্রীকৃষ্ণজী লহ প্রণাম


সঙ্ঘের প্রচারক বিদ্যুৎ দত্তের নির্দেশে সঙ্ঘের শাখা জীবন থেকে ১৯৮০ সালে বিজেপির জন্মলগ্নেই রাজনীতিতে প্রবেশ করি। কিন্তু আজও শাখার মাঠ (সঙ্ঘস্থান) নিত্য প্রতিদিনের কর্মকাণ্ডের একটি প্রধান কর্ম ও প্রেরণা হিসেবে আমার জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। সেই সঙ্ঘস্থানেই সম্ভবত ১৯৭৮ সালে কেশবরাও দীক্ষিত ও শ্রীকৃষ্ণ মােতলগজী আসেন। তখন আমি শ্যামাপ্রসাদ নগরের রায়গড় শাখার স্বয়ংসেবক, বর্তমানে বিজয়গড় শাখার। সেই জীবনে আমার প্রথম দুই মহামানবের যুগল দর্শন করার সৌভাগ্য হয়।
এরপর ১৯৮২ সালে দলের রাজ্যস্তরে কাজের সুবাদে সঙ্ঘের বৈঠকে অংশ নিতে পারার কারণে মােতলগজী ও কেশবজীর সঙ্গে বারবার দেখা হওয়ার সুযােগ হতাে।তখন রীতি ছিল সঙ্ঘের এই ধরনের বৈঠকে বিবিধ ক্ষেত্রে কার্যকর্তারা অবশ্যই হাজির থাকবেন। সেই থেকেই ধীরে ধীরে এদের কাছে আসার ও ঘনিষ্ঠ হওয়ার পরম সৌভাগ্য লাভ করেছি। কোনাে সমস্যা হলেই ২৬ নং অর্থাৎ আগের সচ্ছা। কার্যালয়, পরে কেশব ভবনে গিয়ে তাঁদের পথনির্দেশ নিয়েছি।
শ্রীকৃষ্ণজী নিজেকে এতাে গুটিয়ে রাখতেন, যার ফলে তিনি সহ প্রান্ত প্রচারক, প্রান্ত প্রচারক, পরে ক্ষেত্র প্রচারক, তারও পরে অখিল ভারতীয় প্রচারক প্রমুখ ছিলেন। কিন্তু তাঁর ব্যবহার বা কথাবার্তার মধ্যে দিয়ে তা বােঝার কোনাে উপায় ছিল না। সব সময় মনে হতাে একজন নিষ্ঠাবান, পবিত্র, অহংকার জয়ী সাধারণ স্বয়ংসেবক তিনি। বহুবার তার সঙ্গে একান্তে কথা বলার সুযােগ পেয়েছি। কোনাে অপরাধ বা ভুল
করলেও বকুনি দিতেন না, কিন্তু সাধারণ কণ্ঠস্বরে জানতে চাইতেন বিষয় সম্পর্কে। সব শােনার পর অকপটে বলতেন, এবার এই নিয়ে। আমায় কেউ কিছু বলতে এলে আমিও কথা। শুনিয়ে দেবাে। কী সরল ভাষ্য। একেক সময়। মনে হতাে নিজের জীবনের সব দুঃখ কষ্ট শ্রীকৃষ্ণজীকে সমর্পণ করে নিশ্চিন্ত হয়ে যাই। মনে হবে না কেন, তার নাম যে শ্রীকৃষ্ণ। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সত্যনিষ্ঠা, অসহায়ের প্রতি সহানুভূতি, নিঃষ্কাম কর্মই শ্রীকৃষ্ণজীকে দেবতুল্য করে তুলেছে। নাগপুরে জন্ম, সেখানে বড়াে হওয়া, অথচ পশ্চিমবঙ্গে এসে পুরােপুরি এখানকার সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাওয়া এটাতার জীবনের একটি মহান বৈশিষ্ট্য। এতাে সরলতা, সাধারণ জীবন, মিষ্ট ব্যবহার হওয়া সত্ত্বেও যে। বিষয়টি ঠিক নয় সেই বিষয়ের বিরুদ্ধে দৃঢ় কণ্ঠে বলতে কখনাে পিছপা হননি। আমি তার জীবনের অনেক ঘটনার উল্লেখ করতে পারি কিন্তু সেসব বলতে গেলে অন্য কেউ ব্যথা পাবে বা আমায় ভুল বুঝতে পারে তাই সেই সকল উল্লেখ করলাম না। তখন সুনীলপদ গােস্বামী ক্ষেত্রীয় প্রচারক, প্রায়ই তার সঙ্গে দেখা করতে যেতাম। সেখান থেকে শ্রীকৃষ্ণজীর ঘর, একবার ঢুকলে দেড় -দু’ ঘণ্টার আগে শ্রীকৃষ্ণজীর ঘর থেকে বের হওয়া যেত না। দুপুরে বিশ্রাম করার সময়ও বলতেন, “তুমি এলে ডেকে দেবে। একদিন সুনীলদার ঘর থেকে বেরিয়ে শ্রীকৃষ্ণজীর ঘরের দিকে রওনা যাচ্ছি, একজন কেউ আমায় বললেন, তিনি এখন ঘুমিয়ে আছেন, এখন যেও না। আমি বললাম, “তিনি আমায় বলে রেখেছেন, তুমি যখনই আসবে আমি ঘুমিয়ে থাকলেও ডেকে দেবে, কোনাে সংকোচ করবেনা।তিনি সম্ভবত অসন্তুষ্ট হয়ে বললেন, বারবার তােমার এতাে কী কাজ? এতােবার আসার কী দরকার? অবশেষে ভয়ে ভয়ে ঘরে ঢুকে ঘুম ভাঙিয়ে শ্রীকৃষ্ণজীকে বললাম, আমি এলে কী আপনি অখুশী হন?’ স্বাভাবিক উত্তর, কেন! আমি সব খুলে বললাম। আমার সব অনুরােধ উপেক্ষা করে যিনি আমাকে নিষেধ করেছিলেন তাকে আমার সামনেই ডেকে যা বলা প্রয়ােজন তা সহজভাবে বলে দিলেন। জীবনে বহু প্রচারকের আশীর্বাদ পাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে, তাঁদের মধ্যে শ্রীকৃষ্ণজী অবশ্যই অন্যতম।
সেই দিনটির কথা আজও আমার মনে পড়ে, যেদিন পাকাপাকিভাবে কলকাতা ছেড়ে তিনি নাগপুর ফিরে যাচ্ছেন। কেশব ভবনে বিদায় সমারােহের ব্যবস্থা হয়েছে। সকলেরই ভারাক্রান্ত হৃদয়ের সুস্পষ্ট লক্ষণ মুখমণ্ডলে ফুটে উঠেছে। এতােদিনের কর্মস্থান, এতাে মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালােবাসার মায়া কাটিয়ে জন্মস্থানে ফিরে যাওয়ার এক বিন্দু আনন্দের রেখা তাঁর চোখ-মুখে দেখতে পাইনি। তিনি নাগপুরে জন্মালেও তিনি আমাদের, তিনি পশ্চিমবঙ্গের। পরের দিন দেখা করে বললাম, ‘তাহলে চলেই যাচ্ছেন! নাগপুর গিয়ে আমাদের ভুলে যাবেন। তিনি বললেন, “দেখ রাহুল, আমার সারা দেহের রক্তে নাগপুর আছে। কিন্তু হৃদয়ে শুধু বাঙ্গলা।’তিনি আবার বাঙ্গলায় কয়েক দিনের জন্য আসবেন বলেছিলেন, শুনেছি এসেও ছিলেন, কিন্তু খবর না পাওয়ার কারণে দেখা করতে পারিনি।
তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, নাগপুরে গিয়ে কী বাড়ি ফিরে যাবেন?তার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে জবাব —ভাই-বােনেরা চাইছে বাকি জীবনটা পরিবারে কাটাই। তাই বাড়িতে কয়েকটা দিন কাটিয়ে নাগপুর নিবাসে ফিরে যাব। সেখানেই থাকব। নাগপুরে থাকতে থাকতে অন্তত সাতবার আমার সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছে। তার ছােটোবেলার বন্ধু, স্কুলের সহপাঠী, প্রচারক দেবদাস আপ্তেজীর ফোনে শেষবার লকডাউনের ১০ দিন আগে কথা হয়। আমি শ্রীকৃষ্ণজীকে বললাম, আমি নাগপুরে কখনও যাইনি। এবার লকডাউন উঠে গেলে নাগপুর গিয়ে আপনার সঙ্গে দেখা করে আসবাে। কিন্তু তখন ভাবিনি শ্রীকৃষ্ণজী ইহলােকের মায়া এতাে তাড়াতাড়ি শেষ করে পরলােকে যাত্রা করবেন। আজ তিনি নেই একথা সত্য কিন্তু তাঁর কর্মের মধ্যেই তিনি আমাদের মধ্যে বেঁচে আছেন। বেঁচে থাকবেন। আমাদের জন্য রেখে গেলেন। তাঁর কৃতি ও আশীর্বাদ। তাই তাঁর প্রতি রইল অগাধ শ্রদ্ধা, “হে শ্রীকৃষ্ণ লহ প্রণাম।
রাহুল সিন্‌হা
(লেখক ভারতীয় জনতা পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যকর্তা)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.