৬. অধ্যাত্ম
অধ্যাত্ম হচ্ছে ভারতের একটি বিশেষ দর্শন। সৃষ্টিরচনার মূলে রয়েছে আত্মতত্ত্ব। আত্মতত্ত্ব হচ্ছে অব্যক্ত, অপরিবর্তনীয়, বিমূর্তকল্পনা যা থেকে এই ব্যক্ত সৃষ্টিনির্মিত হয়েছে। অব্যক্ত আত্মতত্ত্বই ব্যক্ত সৃষ্টিতে রূপান্তরিত হয়েছে। আত্ম ও সৃষ্টির মাঝে কোনাে পার্থক্য নেই। অব্যক্ত আত্মতত্ত্ব থেকে ব্যক্তি সৃষ্টি কেন হলাে তার কারণ কেবল আত্মতত্ত্বের সংকল্প।
এই সৃষ্টিতে আত্মতত্ত্ব সর্বত্রই পরস্পর সম্পর্কিত রূপে রয়েছে। আর সেইজন্যই সৃষ্টির সমস্ত সম্বন্ধের সকল ব্যবহারের এবং সকল ব্যবস্থার মূল অধিষ্ঠান হচ্ছে। আত্মতত্ত্ব। আত্মতত্ত্বের অধিষ্ঠানের ওপর যা কিছু রয়েছে তা হচ্ছে আধ্যাত্মিক। এটা তার ভাবাত্মক নয়, বরং বৌদ্ধিক ব্যাখ্যা। এজন্য আধ্যাত্মিকতা গৈরিক বস্ত্র, সন্ন্যাস, মঠ, মন্দির বা সংসারত্যাগের সঙ্গে যুক্ত সংকল্পনা নয়, বরং সংসারের সব ব্যবহারের সঙ্গে যুক্ত তত্ত্ব। আজ এই বক্তব্যের মধ্যে গােলমাল দেখা দিয়েছে।
এই সংকল্পনার কারণে সৃষ্টির সমস্ত রচনায় তথাব্যবস্থায় একাত্মতার কল্পনা করা হয়েছে। যেখানে যেখানেই একাত্মতা রয়েছে সেখানে সেখানেই আধ্যাত্মিক ভিত্তি রয়েছে এমনটা আমরা বলতে পারি। ভারতে গৃহব্যবস্থা, সমাজব্যবস্থা, অর্থব্যবস্থা, শাসনব্যবস্থার মূল অথিষ্ঠান অধ্যাত্মই বটে। তাই আধ্যাত্মিক অর্থশাস্ত্র বলার ক্ষেত্রে কোনাে অস্বাভাবিকতা নেই।
ভারতের যুগ যুগের ইতিহাস প্রমাণ করছে যে এই দৃষ্টিভঙ্গি ভারতের ব্যবস্থাসমূহকে এত উত্তমরূপে প্রস্তুত। করেছে এবং আচরণসমূহকে এতটাই অর্থপূর্ণ ও মানবিকভাবে তৈরি করেছে যে সে বিশ্বের মাঝে দীর্ঘজীবী এবং সমৃদ্ধ রাষ্ট্র হয়ে উঠেছে। এই দূরদৃষ্টির জন্য ভারতের প্রত্যেকটি ব্যবস্থায় সমরসতাদৃষ্টহয়, কারণ সর্বত্র আত্মতত্ত্ব ব্যাপ্ত হওয়ার দরুণ সৃষ্টির সমস্ত পদার্থ একে অপরের সঙ্গে যুক্ত এবং একে অপরের দ্বারা প্রভাবিত এমনটাই প্রতীত হয়। সামগ্রিকতায় বিচার করার কারণে এবং তার ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থাবলী প্রস্তুত করবার জন্য ন্যূনতম জটিলতার সৃষ্টিহয় এটাই ব্যবহারের নিয়ম।
বর্তমান বৌদ্ধিক বিমের পরিণামস্বরপ আমরা ভৌতিক ও আধ্যাত্মিক এমন দুটো বিভক্ত করে থাকি। এবং প্রত্যেকটি অবস্থানকে দুটো ভাগে বিভক্ত করে দেখে থাকি। আমাদের বুদ্ধির সীমাবদ্ধতা এখানেই যে আমরা যা ভৌতিক নয় তা হচ্ছে আধ্যাত্মিক কিন্তু যা আধ্যাত্মিক তা ভৌতিক নয় এমনটা মনে করি। বাস্তবে ভৌতিক ও আধ্যাত্মিক এমন দুটো বিভাগই নেই। ভৌতিকের ভিত্তি হচ্ছে আধ্যাত্মিক। এজন্যই বিচার্য হয় আধ্যাত্মিক , নয়তাে অনাধ্যাত্মিক। আধ্যাত্মিক অথবা ভৌতিক হয় না। কারণ স্পষ্ট। আধ্যাত্মিকের ব্যক্ত রূপই হচ্ছে ভৌতিক। এজন্যই যেভাবে আধ্যাত্মিক অর্থশাস্ত্র হয় সেভাবেই আধ্যত্মিক ভৌতবিজ্ঞানও সম্ভব।
ভারত ও পশ্চিমের মধ্যে পার্থক্য এটাই যে পশ্চিম অনাধ্যাত্মিক ভৌতিক, অপরদিকে ভারত হচ্ছে আধ্যাত্মিক ভৌতিক। আধ্যাত্মিক ভৌতিক হবার কারণে ভারতে সমৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সংস্কৃতিও বিকশিত হয়ে থাকে যখন কিনা পশ্চিমে সংস্কৃতি ছাড়াই সমৃদ্ধি সম্ভব হয়ে থাকে। সমৃদ্ধি ও সংস্কৃতিকে একই সঙ্গে প্রাপ্ত করবার জন্য আধ্যাত্মিকতার সমপর্যায়ে দাঁড়াবার মতাে তাদের কোনাে দূরদৃষ্টি বা দর্শন নেই।
ভারতের বৌদ্ধিক জগতের জন্য এই আধ্যাত্মিক ও ভৌতিকের সমন্বয় স্থাপন। করাই হচ্ছে বড়াে চ্যালেঞ্জ। কয়েক প্রজন্ম। ধরে বৌদ্ধিক ক্ষেত্র এবং তার মূলে থাকা শিক্ষাক্ষেত্র উলটো অভিমুখে চলেছে, সেজন্য এটা কঠিন তাে বটেই কিন্তু অনিবার্যরূপে করণীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
৭. সংস্কৃতি
সংস্কৃতির অর্থ হচ্ছে জীবনশৈলী। সংস্কৃতি শব্দের সম্বন্ধ ধর্মের সঙ্গে রয়েছে। ধর্ম হচ্ছে বিশ্বনিয়ম। ধর্ম হচ্ছে একটা সার্বভৌম ব্যবস্থা। সংস্কৃতি হচ্ছে তার অনুসরণে কৃত কর্ম। সংস্কৃতি ধর্মের একটি প্রণালী বা পদ্ধতি। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম আচরণ করে করে সকল অধিবাসীর যা রীতিতে পরিণত হয়েছে সেটাই হচ্ছে সংস্কৃতি। ভারতের অধিবাসীদের যে জীবনরীতি সেটাই হচ্ছে ভারতীয় সংস্কৃতি।।
আজ ধর্মের দিকে সংস্কৃতির মনােযােগ নেই এবং শুধু রীতিসমূহকে সংস্কৃতি বলা হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ রঙ্গমঞ্চে যে নাটক, নাচ, গান ইত্যাদি হয় তাকে সাংস্কৃতিক কার্যক্রম বলা হয়ে থাকে। বিদেশে দেশের সাংস্কৃতিক দল গেলে তাতে গায়ক ও নর্তক থাকে। বেশভূষা, খাবারদাবার, অলংকারের প্রদর্শন ইত্যাদিকে সাংস্কৃতিক প্রদর্শন বলা হয়ে থাকে। এসব কিছু সংস্কৃতির অঙ্গ হলেও শুধু এটাই সংস্কৃতি নয়।।
অন্ন, গােরু, তুলসী, জল ইত্যাদিকে পবিত্র জ্ঞানে যে ব্যবহারের নিয়ম বা রীতি নির্মিত হয় সেটা হচ্ছে সংস্কৃতি। আমরা খাবার খেতে বসলে তখন যদি কেউ আসে তাকেও খাবার জন্য বসানাে এটা আমাদের সংস্কৃতি। পূর্বসূচনা ছাড়া কেউ এলে তাকে খাবার জন্য জিজ্ঞেস করবার আবশ্যকতা নেই এবং আগন্তুকও এমনটা আশাও করে না, এটা হচ্ছে পশ্চিমের সংস্কৃতি।
কেবল কলাকৌশলই সংস্কৃতি নয়, বরং অধিবাসীদের জীবনদর্শন যে পদ্ধতিতে, যে রূপে কলাকৌশলের মাধ্যমে ফুটে ওঠে সেটা হচ্ছে সংস্কৃতি। উদাহরণ : সংস্কৃতে মহাকাব্য ও মহানাটক কখনও দুঃখান্ত হয় না, কেননা জীবনের বিধায়ক দৃষ্টিকোণ কাব্যে প্রস্ফুটিত হওয়া দরকার এমনটাই সর্বৰ্মন্যতা রয়েছে। যতাে ধর্মস্ততাে জয়ঃ— এই সূত্র সকল কলাকৃতিতে প্রস্ফুটিত হওয়া দরকার বলে মনে করা হয়। ‘কলার জন্য কলা’—এই সূত্র ভারতীয় সাহিত্যে মান্য নয়। সাহিত্যের প্রয়ােজন জীবনধর্মী হওয়া দরকার।
ইতিহাস কেন পড়া দরকার? আজকের মতাে শুধু রাজনৈতিক ইতিহাস পাঠের আবশ্যকতা মানা হয় না। সাংস্কৃতিক ইতিহাস পাঠই আবশ্যক বলে মনে করা হয় কেননা ইতিহাস থেকে ধর্ম, অর্থ, কাম, মােক্ষ ইত্যাদির জন্য কেমন ব্যবহার করা দরকার আর কেমনটা নয় তার প্রেরণা ও উপদেশ পাওয়া যায়। সাংস্কৃতিক ভূগােল তাকে বলে যেখানে ভূমির সঙ্গে ভাবাত্মক সম্বন্ধ জুড়ে থাকে। সাংস্কৃতিক সমাজশাস্ত্র তাকে বলে যাতে ধর্মরক্ষার জন্য তার অনুসরণ হয়ে থাকে। সাংস্কৃতিক ধর্মশাস্ত্র তাকে বলে যেখানে ধর্মের অবিরােধী অর্থার্জন হয়ে থাকে। তাৎপর্য হচ্ছে, এই যে সংস্কৃতি কেবল কলাই নয়, বরং তা হচ্ছে জীবনশৈলী।
‘মাতৃ দেবাে ভব, পিতৃ দেবাে ভব, অতিথি দেবাে ভব, আচার্য দেবাে ভব’— এটাই ভারতীয় সংস্কৃতির আচার। যুদ্ধ করবার সময়ও ধর্মকে ছাড়া যাবে না – এটাই ভারতের রীতি। ভূত মাত্রেরই কল্যাণ চাওয়া ভারতীয় সংস্কৃতির রীতি। ভােজ্যকে ব্রহ্মরূপে গণ্য করে তা জঠরাগ্নিতে আহুতি দেওয়া রূপে গ্রহণ করা হচ্ছে ভারতীয় সংস্কৃতির রীতি।
ধর্ম ও সংস্কৃতি একই সঙ্গে প্রযুক্ত
হওয়ার সংজ্ঞার অর্থ এই যে সংস্কৃতি ধর্মকে অনুসরণ করে থাকে। সংস্কৃতিতে আনন্দের ভাবও জড়িয়ে থাকে। জীবনে যখন। আনন্দের অনুভব হয় তখন তা নৃত্য, সংগীত, কাব্য ইত্যাদির মাধ্যমে অভিব্যক্ত হয়। সৌন্দর্যের অনুভূতি বস্ত্রালংকার, শিল্পস্থাপত্যের মধ্যে দিয়ে অভিব্যক্ত হয়। এজন্য সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তিতে রস আছে, আনন্দ আছে, সৌন্দর্য আছে। জীবনে সত্য এবং ধর্মের অভিব্যক্তিকেও সুন্দর করে তােলা হচ্ছে ভারতীয় সংস্কৃতি।
৮. সংস্কৃতি ও সভ্যতার সম্বন্ধ
নেপােলিয়ন ১৫৩ সেমির একজন খাটো মানুষ ছিল। একবার তিনি নিজের থেকে উঁচু স্থানে থাকা কোনাে বস্তুকে তিনি দেখলেন এবং তার প্রতি দৃষ্টিকে স্থির করলেন। অভিপ্রায় বুঝে তার পেছনে দাঁড়ানাে সহকারী হৃষ্টপুষ্ট একজন সৈনিক তৎক্ষণাৎ ওই জিনিসটিকে এনে তার কাছে। দিল এবং মশকরা করে বলল, আপনার চেয়ে আমি উঁচু। সঙ্গে সঙ্গে বন্দুকের গুলির মতাে উত্তর বেরিয়ে এল, “লম্বা বলাে, উঁচু বােলাে না। সংস্কৃতি ও সভ্যতা বিবেচনা করবার সময় এই ছােট্ট প্রসঙ্গের কথাটা মনে পড়ে যায়। তাৎপর্য হচ্ছে যে, সংস্কৃতি হচ্ছে উঁচু এবং সভ্যতা হচ্ছে দীর্ঘ।
আদি শংকরাচার্যের নির্বাণাষ্টকে বিরুদ্ধ ভাবাপন্ন একটি শব্দ হয়েছে‘নিরাকার রূপ। নিরাকারের রূপ কী করে হতে পারে? কিন্তু নিরাকারিতাই যার আকার তা অন্য শব্দ দ্বারা কী করে বলা যায়? সংস্কৃতিও এই শ্রেণীতে এসে থাকে। এটা নিরাকাররূপী। অতএব সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে দেখা এবং পরীক্ষা করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। কিন্তু সভ্যতা তার পরিচায়ক ছােটো বড়াে বস্তুরূপে দৃষ্টিগত হয়ে থাকে।
এটাও মানুষের প্রকৃতি। সাধারণ মানুষের সূক্ষ্মদৃষ্টি হওয়া কঠিন। আবার স্থূলদৃষ্টি হওয়া সহজ। এজন্য সংস্কৃতির ওপরে মাপদণ্ড কম মনে হয়। অপরদিকে সভ্যতার ওপর অধিক মনে হয়।
রামেশ্বরম, চিদম্বরম, শ্রীরঙ্গম, মাদুরাইয়ের মতাে প্রাচীন মন্দিরগুলাের কথা ভাবুন। সর্বত্রই ওখানকার গগনচুম্বী গােপুর, স্বর্ণমণ্ডিত চূড়া, সহস্ৰস্তম্ভ মণ্ডপ ইত্যাদির চাকচিক্য বর্ণিত হয়ে থাকে। কিন্তু মন্দিরের মূর্তির বর্ণনা অল্পই পওয়া যায়। অথচ ওই ছােট্ট মূর্তিকে ছাড়া মন্দিরের কল্পনা করা সম্ভব নয়। কিন্তু এর কথাই বিস্মৃত হয়ে থাকে আর চূড়ার বর্ণনা থেকে যায়। বাস্তবে সংস্কৃতির স্থান হলাে মূর্তির মতাে, মূর্তি ও সভ্যতার স্থান হচ্ছে। শিখরের। যেমন মূর্তি ছাড়া মন্দির চূড়া চিন্তাও করা যায় না, ঠিক তেমনই সংস্কৃতি ছাড়া সভ্যতা অসম্ভব। সংস্কৃতিহীন সভ্যতাকে অসভ্যতা বলতে হবে। এটা। মানুষকে বিকৃত অভিমুখে চালিত করবে এবং তাকে নিঃশেষ করবে।।
সভ্যতার বিকাশ কীভাবে হয় ? সভ্যতার বীজ হলে সংস্কৃতি। সাধারণত মানুষ সংস্কৃতির প্রেরণায় ঊর্ধ্বে যেতে চায়, নীচে পড়তে চায় না। উঁচুতে ওঠার কাজ হলাে পাহাড়ে ওঠার কাজ। নিজেকে সামলে সাবধানতার সঙ্গে একটু একটু করে ওপরে উঠতে হবে। এজন্য মানুষ সতর্কতার। সঙ্গে নিজের কাছে যেটুকু প্রয়ােজনীয় সামগ্রী রয়েছে তার দ্বারা সুবিধাজনক ব্যবস্থা করে থাকে। ধীরে ধীরে সে পাথরের ওপর লাগায়। অনুরূপভাবে সংস্কৃতির মূল্য ধরে উৎকৃষ্টতার দিকে যাবার জন্য মানুষ নানা প্রকারের প্রয়াস করে থাকে। তা থেকেই সভ্যতা জন্ম নিয়ে থাকে।
সংস্কৃতি যা হচ্ছে নিরাকাররূপী, তাকে তুলে ধরতে কোনাে মাধ্যম চাই, যেমন বিদ্যুৎকে উপস্থাপনা করতে ও প্রয়ােজক তৈরি করবার জন্য অন্যান্য মাধ্যমের প্রয়ােজন পড়ে থাকে। ওই মাধ্যম দু’ প্রকারের হয়ে থাকে — গুণাত্মক ও রূপাত্মক। আচার অনুষ্ঠান, ঐতিহ্য,
পরম্পরা, রীতিনীতি, শিক্ষা ইত্যাদি হচ্ছে। গুণাত্মক মাধ্যম। এর কোনাে স্থলরূপ নেই, তথাপি তা হচ্ছে প্রভাবশালী মাধ্যম। একে ব্যবহারেআনবার জন্য প্রাণময় মাধ্যম হচ্ছে। আচার্য, দার্শনিক, মহাপুরুষ, নেতাগণ, চরিত্রবান সজ্জনগণ প্রভৃতি এবং বস্তুনির্মাণ, বস্তুসংগ্রহ ইত্যাদি হচ্ছে অন্য প্রকারের মাধ্যম। কর্মেন্দ্রিয় হচ্ছে বিজ্ঞান, শিল্পশাস্ত্র, বাস্তুকলা, হস্তশিল্প, সৃষ্টিশীলতা ইত্যাদি।
উপযুক্ত মাধ্যমগুলাের দ্বারা তার কর্মশীল সহায়ক সমূহের সহযােগে যখন সংস্কৃতি অধিকাংশ উন্মােচিত হয়ে যায় তখন ওই বিশেষ অবস্থাকে বলে শুচিতা। শুচিতা সাংস্কৃতিক মূল্যগুলাের মধ্যে একটি। এটি মানুষের অনিবার্য গুণ। তার জন্য নিজের আবাসস্থল স্বচ্ছ থাকা আবশ্যক। তার জন্য মানুষের আগেকার। দিনগুলােতে ঘােড়ার মতাে পশুর লেজ দিয়ে ঝাঁট দিয়ে থাকতে পারে। অথবা জঙ্গলের গাছের ছাল অথবা পুরাতন ছেড়া কাপড় দিয়ে মুছে দিয়ে থাকতে পারে। ধীরে ধীরে সে কেবল ওই কাজের জন্য একটি মাধ্যমের আবিষ্কার করল এবং পরিষ্কার করবার জন্য বঁটা নামের একটা মাধ্যম আবির্ভূত হলাে। জঙ্গলে ও নিজের গ্রামে উপলব্ধ জিনিস দ্বারা মানুষ বঁটা বানানাে শুরু করল।শুচিতাকে টিকিয়ে রাখবার জন্য এক বিশেষ মাধ্যম মানুষের জীবনে প্রবেশ করল। বিদ্যুৎ এল, বিজ্ঞান সামনে এগিয়ে চলল এবং ঝাঁটার বদলে এল ডাস্টার। ঘােড়ার লেজ থেকে ডাস্টার পর্যন্ত যাত্রা সভ্যতার হয়েছে। এই সভ্যতার প্রাণরূপী। সাংস্কৃতিক মূল্য শুচিতা যা কখনও বদলায়নি, স্থির রয়েছে।
শূচিতা নিয়েই এগােনাে যাক। ব্যক্তিগত জীবনে শুচিতার জন্য প্রয়ােজন স্নান। পশু-পাখিও স্নান করে থাকে। কিন্তু মানুষ স্নানকে একটা বিশেষ স্থান দিয়েছে। এবং নিয়মিত স্নান তার জীবন পদ্ধতির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল। প্রারম্ভিক দিনগুলােতে তারাও পশুদের মতাে যেখানে পৌঁছেছে সেখানে স্নান করে
থাকতে পারে। যখন যখন মনে হয়েছে। তখন তখন করে থাকতে পারে। স্নানের সময়ের নিয়মিততা নাও থাকতে পারে। জীবন সুব্যবস্থিত করার অন্তঃপ্রেরণা থেকে ধীরে ধীরে সে ব্যবস্থা করল। তারা নদীর ধারে আসতে আরম্ভ করল। ধীরে ধীরে তারা ব্যবস্থায় সংশােধন এনে ঘাট বানালাে, ঘাটে সিড়ি তৈরি করল। এর নিতান্ত প্রয়ােজনীয়তার কথা মেনে নিয়ে লােকোপকারের কারণে লােকপ্রিয় উদার মনােভাবাপন্ন মানুষ নিজের আবাস থেকে বহুদূরে হলেও দীর্ঘকায় ঘাট তৈরি করল। বাস্তুকলার বিকাশ হতে হতে তারা স্নান করবার আলাদা ব্যবস্থা বাড়ির পাশে বানালাে। পুকুরের সৃষ্টি হলাে, কূপের সৃষ্টি হলাে। বিজ্ঞান এগিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ ঘরে স্নান করবার জন্য বাড়ির ভেতরে নলবাহিত জল আসতে শুরু করল। এখন গঙ্গা থেকে শত মাইল দূরের শহরে মানুষ নিজের শয়নকক্ষের সঙ্গে সংলগ্ন স্নানাগারে গঙ্গা জলে স্নান করে থাকে। এখানে। অপরিবর্তিত মূল্য হচ্ছে শুচিতা। তার জন্য যে ব্যবস্থা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বানানাে হলাে তা পরিবর্তিত হতে থাকল। এই পরিবর্তনের কারণ অনুসন্ধান ও আবিষ্কার মূলত মানুষের কল্পনাপ্রসূত। এজন্য নতুন। নতুন নির্মাণ হতে লাগল। নতুন নতুন ব্যবস্থা আসতে থাকল, তাসমাজব্যাপী হতে থাকল। সাধারণ মানুষ তাতে অধিক সুবিধা অনুভব করতে লাগলাে। ওই মানগােষ্ঠীর প্রয়াসের পরিণতি দৃষ্টিগােচর হলাে। এই প্রক্রিয়াকে সভ্যতা বলে।।
শুচিতার সমান আরও দুটো গুণ আছে। তা হচ্ছে দয়া ও দান। ভিক্ষুককে ভিক্ষে দেওয়া, ক্ষুধার্তকে অন্ন দেওয়া, অসুস্থকে সেবা করা ইত্যাদি মানবিকতার সঙ্গে সম্পাদন করা হচ্ছে সুসংস্কৃত মানুষের কর্তব্য। ভারতের সমস্ত গৃহবাসী এই। কর্তব্যগুলােকে ব্যক্তিগতভাবে সম্পন্ন করতে থাকল। ধীরে ধীরে সে সমমানসিকতাসম্পন্ন সঙ্গীদের সাহায্যে অধিক মানুষ তাদের এই সেবার লাভ পাক এই দৃষ্টিতে উপযুক্ত ব্যবস্থা ও সংস্থাসমূহ
তৈরি করতে থাকল। তার মধ্যে সার্বজনিক কূপ, লঙ্গরখানা, চিকিৎসালয়, অনাথালয়, ধর্মশালা ইত্যাদির নির্মাণ হলাে। ভারতে প্রাচীনকাল থেকেই এটা চলে আসতে লাগল। আচার্য চাণক্যের গ্রন্থে এর স্পষ্ট উল্লেখ আছে। তেমনিভাবে এখানে আগত বিদেশি যাত্রীদের অভিজ্ঞতার বর্ণনাতেও পর্যাপ্ত মাত্রায় পাওয়া যায়। তা থেকে উপলব্ধি হয় যে, ভারতের সভ্যতা উচ্চমানের ছিল। এরকমটাই হচ্ছে বিদ্যাদান করবার গুণ। তার জন্য আদিস্থান ছিল গুরুগৃহ। ক্রমশ গুরুকুল বিকশিত হলাে। বড়াে বড়াে বিদ্যালয় নির্মিত হলাে। সমাজ থেকে প্রাপ্ত ধন থেকে শত শত আচার্যের অধ্যাপনায় সমৃদ্ধ নালন্দা, তক্ষশীলা, বিক্রমশীলা, কাঞ্চীপুরমের মতাে বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের উদয় হলাে। এর উল্লেখ করবার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বের সমস্ত ইতিহাসকার গণের মত হলাে যে, তৎকালীন ভারতীয় সভ্যতা অপ্রতিম ছিল।
দৃষ্টান্তস্বরূপ আমরা ওপরে কেবল চারটি গুণের কথা আলােচনা করেছি। এভাবেই সমস্ত গুণের বিকাশ সভ্যতার দিকে নিয়ে চলেছে। সভ্যতার এই বিকাশ সংস্কৃতিকেও বিকশিত করে থাকে। যখন দান, দয়া, শুচিতা, বিদ্যাদান প্রভৃতি গুণ ব্যক্তিগত থাকে তখন ওই ব্যক্তির দৃষ্টিকোণ পরােপকারের মাধ্যমে পুণ্যার্জন হয়ে থাকে। দানের মাধ্যমে স্বর্গলাভের উদ্দেশ্য থাকে। কিন্তু তার জন্য করা ব্যবস্থা যখন বৃহদাকার হয়, সামগ্রিক সহযােগিতার হয় তখন সহযােগীদের দৃষ্টিকোণ ব্যক্তিগত পুণ্য থেকে ওপরে উঠে ব্যক্তি নিরপেক্ষ সমষ্টিগত পুণ্যের হয়ে যায়। তখন সমষ্টির উদ্ধার হয়ে থাকে। বাস্তবে এটাই হচ্ছে সংস্কৃতি ও সভ্যতার সম্বন্ধ। সংস্কৃতির কারণে ক্রমবর্ধমান জ্ঞানের উপর নির্ভর করে সভ্যতা জনকল্যাণকারী অভিমুখে বিকশিত হয়ে যায়, আবার বিকশিত সভ্যতার জন্য চিরন্তন মূল্য দ্বারা সংস্কৃতি সার্বজনিক হয়ে যায়। (ক্রমশ)।
ইন্দুমতী কাটদরে
ভাষান্তর :সূর্য প্রকাশ গুপ্ত (অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক)
2020-09-07