ভ্লাদিমির লেনিনের একটি কথাকে তুলে ধরে বিভিন্ন ধরনের পােস্টার ও প্রচার আজকাল প্রায়শই দেখা যাচ্ছে। প্রচার চলছে, ‘মার্কসবাদ সর্বশক্তিমান, কারণ ইহা সত্য। হয়তাে বিশ্বের নানা স্থানে মার্কসবাদের চূড়ান্ত বিপর্যয়ের সম্মুখে দাঁড়িয়ে আপন তত্ত্বের মাহাত্ম পুনঃপ্রতিষ্ঠার তাড়না থেকে তা করা হয়। মার্কসবাদকে এইভাবে সর্বশক্তিমান হিসেবে। ব্যাপক প্রচার করার বাকখিল্য সুলভ প্রচেষ্টার মধ্যে পরােক্ষভাবে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ মুহম্মদুর রসুলুল্লাহ’– এই আদর্শটিই পরিস্ফুট হয়। অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনাে উপাস্য নেই। অথচ কার্ল মার্কস নিজে কখনও তত্ত্বকে সর্বশক্তিমান হিসেবে দাবি বা প্রচার করেছেন বলে জানা নেই।
বিজ্ঞানে চরম সত্য বলে কিছু নেই। একটি বিশেষ সময়ে তখনকার তথ্য, জ্ঞান অনুযায়ী এবং যুক্তির সহায়তায় সেই সময়ে কোনাে তত্ত্বকে সত্য বলে আংশিকভাবে স্বীকার করার অর্থ এটা কখনােই হতে পারে না যে অন্ধ ও দ্বিধাহীন ভাবে তাকে অপরিবর্তিত অবস্থায় আজও বয়ে চলতে হবে। ফলত, নতুনত্বের কোনােরূপ দিশা ছাড়াই নিজেদের আঁকড়ে রাখা কীট দংশিত তত্ত্বকে সর্বশক্তিমান হিসেবে গণ্য করার ফলেই প্রকৃতির অমােঘ নিয়মেই বামপন্থীরা মৌলবাদী চরিত্র অর্জন করেছে। সমাজের সমস্ত সমস্যার সমাধান একটি আদ্যন্ত জড়বাদী দর্শন করে ফেলতে সক্ষম, এই অবাঞ্ছিত ভাবনা বাস্তবতা থেকে শতসহস্র যােজন দূরে। একাত্ম মানবদর্শন ছাড়া কেবলমাত্র যান্ত্রিক বাস্তবতায় সমগ্রতা প্রতিফলিত হয় না। নানাবিধ পরস্পর বিরােধী সামাজিক-সাংস্কৃতিক-ধর্মীয়-অর্থনৈতিক ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতে সভ্যতার ক্রমবিকাশ ঘটতে থাকে। শুধুমাত্র অর্থনৈতিক উপাদানের উপর অত্যধিক অসম গুরুত্ব আরােপ করে মার্কসবাদ বাস্তবিকই যান্ত্রিকতায় পর্যবসিত হয়েছে। শুধু এবং একমাত্র শ্রেণী সংঘর্ষের মধ্য দিয়েই সমাজের রূপান্তর ঘটে বা এককথায় জড়বাদই সভ্যতার প্রাণশক্তি, এরূপ তত্ত্ব বাস্তব থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ারই নামান্তর। কেবলমাত্র মার্কসীয় সরলরেখাকার দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির মাধ্যমে সমাজ বিবর্তনের এই তত্ত্ব অসম্বন্ধ প্রলাপ ব্যতীত আর কিছুই নয়। জড়বাদের প্রতি এই দ্বিধাহীন বিশ্বাস ও প্রশ্নহীন আনুগত্যই ধীরে ধীরে ভােগবাদ, ক্রমশ তা বৈষম্যবাদ ও শােষণবাদের জন্ম দেয় এবং পরিশেষে তা নির্লজ্জ সাম্রাজ্যবাদ বাবিস্তারবাদের দিকে অগ্রসর হয়। বর্তমান বৈশ্বিক রাজনীতিতে এরই প্রতিফলন দেখা দিচ্ছে। নিজেদের আঁকড়ে রাখা তত্ত্বকে সর্বশক্তিমান গণ্য করে, তার প্রতি চূড়ান্ত বশ্যতা, পরমত অসহিষ্ণুতা, হিংস্রতা, সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্বজুড়ে একের পর এক বামপন্থী মৌলবাদী চরিত্র সৃষ্টি করে চলেছে।
এই রাজনৈতিক মৌলবাদীদের মানসিকতা, আচার-আচরণের মধ্যে। ইসলামি মৌলবাদীদের সাধারণ লক্ষণগুলাে পরিলক্ষিত হয়। এরা ধর্মের স্থানে নিজের দলীয় রাজনীতিকে বসায়, ধর্মগ্রন্থের জায়গায় বসায় রাজনৈতিক দলিলপত্রকে। এদের দলীয় রাজনীতিকে যে বা যারা বিরােধিতা বা সমালােচনা করে, তাদের সঙ্গে খােলা মনে বিতর্কে না গিয়ে উগ্র ও হিংস্রভাবে বিরােধিতা করে। এরা রাজনৈতিক উদারতা থেকে সহস্র যােজন দূরে থাকে এবং ভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রতি ন্যূনতম সম্ভম বােধ হারিয়ে ফেলে। দলীয় রাজনীতির প্রতি শৃঙ্খলা ও কেন্দ্রিকতার নামে দল ও নেতৃত্বের প্রতি প্রশ্নহীন বিশ্বাস ও সীমাহীন আনুগত্য প্রকাশ করতে থাকে। এমনকী দলের অভ্যন্তরে যেই কেউ কিছু প্রশ্ন তােলে বা সমালােচনা করে, তাকেই শ্রেণীশত্রু, প্রতিক্রিয়াশীল, পার্টি বিরােধী বলে দাগিয়ে দেওয়া হয়। বিকৃত আদর্শ চাপিয়ে দেওয়ার রাজনীতির স্বার্থে হিংস্র শ্বাপদের ন্যায় আচরণ, খুন-জখম, সামাজিক বয়কটে শামিল হওয়া প্রকট হতে থাকে। ক্রমশ এরা সমাজকে মেকি শ্রেণীশত্রুতার নামে আড়াআড়ি দুই ভাগে ভাগ করে নেয়। হয় আপনি এদের দর্শনে বিশ্বাসী, না হয় আপনি প্রতিক্রিয়াশীল, চক্রান্তকারী বর্বর, যার সঙ্গে অত্যাশ্চর্যভাবে মৌলবাদী ইসলামি জিহাদিদের বিস্ময়কর মিল হয় আপনি মুসলমান, না হয় কাফের।
যে কাফের শব্দটি আজকাল আমরা শতসহস্রবার শুনি, কোরানেই তার অর্থ পরিষ্কার করে বলা আছে (৫/৪৪)। এর অর্থ, যে কোরান মানে না অর্থাৎ অমুসলমান। বিশ্বজুড়ে সন্ত্রাসের আঁতুড়ঘরগুলিতে উগ্র জিহাদি মৌলবাদীরা শুধুমাত্র তাদের ধর্মগ্রন্থে বিশ্বাস না রাখার কারণে এই কাফেরদের নির্বিচারে হত্যা করতে, গর্দানে আঘাত করতে বলে। সন্ত্রাসী আঁতুড়ঘরগুলিতে এই ধর্মান্ধ জিহাদিরা কচি কচি শিশু মনকে, বিশ্ব সৌভ্রাতৃত্বকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্য নিয়ে, ক্রমাগত হিংসার বিষবাষ্পতে আর্দ্র করে তুলতে থাকে, যেখানে শেখানাে হয় তােমাদের ও আমাদের মধ্যে চিরশত্রুতা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি হবে যদি না তােমরা এক আল্লাহতে বিশ্বাস স্থাপন কর। তােমরা তাদের (কাফেরদের) সঙ্গে যুদ্ধ করতে থাকো যতক্ষণ ধর্মদ্রোহিতা (ইসলাম বিরােধিতা) দূর হয় এবং আল্লাহর দ্বীন (ইসলাম) প্রতিষ্ঠিত না হয়। সেখানে অবিশ্বাসী (কাফের)-দের প্রতি কঠোর এবং নিজেদের মধ্যে পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে শেখানাে হয়, যা মানব সভ্যতার ভ্রাতৃত্ববােধের মূলেই কুঠারাঘাত করে। জেহাদের নামে বিশ্বজুড়ে নিজ ধর্মবিশ্বাসকে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার তাড়নায় উগ্র মৌলবাদীরা
যে দোষে দুষ্ট, ঠিক সেই একই কায়দায় বামপন্থী মৌলবাদীরাও সমাজে ভ্রান্ত জড়বাদী দর্শন প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে মেকি শ্রেণীশত্রুতার নামে সৌভ্রাতৃত্ববােধকে ধর্ষণ করে মানুষে মানুষে বিভেদ তৈরি করতে সদা উদগ্রীব। হয় আপনি তাদের রাজনৈতিক দলিলগুলিকে দ্বিধাহীন আনুগত্যের জপমালা করে তুলুন, না হয় আপনি চূড়ান্ত প্রতিক্রিয়াশীল, চক্রান্তকারী, কুচক্রী হিসেবে বিবেচিত হউন এবং আপনার ধ্বংসই হউক— এটিই মৌলবাদী বামেদের চরম মােক্ষ।
দেশমাতৃকাকে মাতৃরূপে স্বীকার করতে অস্বীকৃত হওয়া ইসলামি মৌলবাদী জিহাদি শক্তি এবং আদ্যন্ত জাতীয়তাবিরােধী মৌলবাদী বামেদের এই মিল হয়তাে বা অবিশ্বাস্য এবং কাকতালীয়, এর কোনােটাই নয়। নিজ সুপ্রাচীন সমৃদ্ধিশালী ঐতিহ্যের প্রতি চরমভাবে অনুসন্ধিৎসু বর্তমান ভারতের নব প্রজন্মই না হােক এর যৌক্তিক বিচার করুক। প্রকৃতপক্ষে, একাত্মবাদী ভারতীয় সংস্কৃতিতে আপাত প্রভেদের মধ্যেই তার অন্তর্নিবিষ্ট ঐক্য বিদ্যমান। বহুমাত্রিক প্রভেদের মধ্যে বিরাজিত এই ঐক্যের সুরকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করার নােংরা ষড়যন্ত্রে একইসঙ্গে মেতে ওঠা বিজাতীয় বামপন্থী মৌলবাদ এবং বিশ্ব সৌভ্রাতৃত্বের শত্রু–উগ্র ইসলামি জিহাদি মৌলবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরােধের শক্ত দেওয়াল তুলে ধরা আজ আশু কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ড. তরুণ মজুমদার
2020-08-31