পশ্চিমবঙ্গের জন্ম বাঙ্গালি শুধু আত্মবিস্মৃত নয়, ইতিহাস চর্চায় উদাসীনও বটে

সময় ১৯০৫ প্রতিবাদ! প্রতিবাদ! প্রতিবাদ :

গত কয়েকশো বছরে বাঙ্গালির বুকে এত বড়ো মৃত্যুবাণ আর বাজেনি। এই মৃত্যুবাণের আর এক নাম বঙ্গভঙ্গ। বড়লাট কার্জনের তিন বছর ধরে তিল তিল করে গড়ে তোলা সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র। তার বিরুদ্ধেই প্রতিবাদ উঠেছিল।

প্রতিবাদের একই সূত্রে মিলেছিল সেদিন সমগ্র বঙ্গভূমি। মিলেছিল অভিজাত – অভাজন শ্রেণীর মানুষ। কে ছাপছে, কে ছড়াচ্ছে কেউ জানে না। কেবল হাতে হাতে ঘুরছে হাজার হাজার ইস্তেহার, হাতের মুঠোকে বজ্রমুষ্টি করে তোলার ডাক দিয়ে। বাঙ্গলার পত্রপত্রিকায় জ্বালাময় অক্ষরে লিখে চলেছে একটি জ্বলন্ত শব্দ— প্রতিবাদ।।

প্রস্তাব বঙ্গভঙ্গ :

ইংরেজ একটা জিনিস হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিল যে, ভারতবর্ষের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রধান শত্রু বাঙ্গালি, যাঁরা পাশ্চাত্যের ধাঁচে শিক্ষিত। ইংরেজি শিক্ষাই এদের হাতে তুলে দিয়েছে ইংরেজনিধনের হাতিয়ার। ইংরেজি ভাষার মাধ্যমেই চিনেছে পাশ্চাত্য স্বাধীনতার স্বরূপ। তাই নেমেছে স্বাধীনতার আস্বাদন লাভে। ইংরেজ প্রভুত্বের খুঁটি নাড়ানোর প্রচেষ্টায়। বুদ্ধিমান কার্জন অল্প চিন্তাতেই বুঝে নিয়েছিলেন বাঙ্গালিকে খর্ব করার চরম অস্ত্র একটাই। যেটা তার শিক্ষাদীক্ষা, রাজনৈতিক চেতনা, সাহিত্যের গৌরবকে অকালমৃত্যুর অন্ধকার গহূরে ঠেলে পাঠানো। অস্ত্র হবে উচ্চ শিক্ষার সংকোচন। ১৯০৪ সালে কার্জন ইউনিভার্সিটি বিল পাশ করালেন। এর আগে ১৯০৩ সাল থেকেই চলছিল প্রস্তুতি। কার্জনের শেষ ব্রহ্মাস্ত্র। বঙ্গভঙ্গ।।

বাঙ্গলা মানে :

বাঙ্গলা বলতে বোঝাত সিলেট, গোয়ালপাড়া, গারো পাহাড় পর্যন্ত। ১৮৭৪ সালে বাঙ্গলা থেকে অসমকে হেঁটে বাদ দেওয়া হলো। তৈরি হলো নতুন অসম প্রদেশ। সিলেট, কাছাড়, গোয়ালপাড়া তিনটি বাংলা ভাষাভাষী জেলাকে বাঙ্গলার মাটি থেকে উপড়ে নিয়ে জুড়ে দেওয়া হলো অসম প্রদেশে। ১৯০৩ সালে নতুন করে স্থির। হলো চট্টগ্রাম, ঢাকা, ময়মনসিংহ যোগ হবে অসমের সঙ্গে।

দেশদ্রোহিতা :

ময়মনসিংহের জমিদার শক্ত শিরদাঁড়ার মানুষ। কার্জন সাহেব তার বাসভবনে অতিথি হয়ে এলে মহারাজা আপ্যায়নের ত্রুটি রাখলেন না। কিন্তু প্রত্যাখ্যান করলেন। কার্জনের প্রস্তাব।

এরপরে কার্জন গেলেন ঢাকায়। সেখানে। এক বিরাট বক্তৃতা ফেঁদে বসলেন। বঙ্গভঙ্গের ফলে ঢাকার মুসলমানদের কী কী সূবর্ণ সুযোগ মিলবে দিলেন তার ফিরিস্তি। প্রস্তাব কার্যকর হলে ঢাকাই হবে নবগঠিত প্রদেশের রাজধানী। বাড়বেমুসলমানদের ঐক্য। তারা বড়ো হবার এমন সুযোগ পাবে যা মুসলমান রাজাদের আমলেও হয়নি। কার্জন সার্থক হলেন। মন গলল ঢাকার নবাব সলিমুল্লার। রাজি বঙ্গবিচ্ছেদে। দেশদ্রোহিতার বিনিময়ে তিনি পেলেন নগদ দশ হাজার পাউন্ড। এই উৎকোচের আসল উদ্দেশ্য হলো মুসলমানকে জমি ছিনিয়ে নিতে হবে হিন্দুর উষ্ণবুকের পাশ থেকে, নিবিড় আলিঙ্গন থেকে। ইতিমধ্যেই কার্জনের জুটে গেল আর এক সঙ্গী। ময়মনসিংহের এক ক্ষুদে জমিদার নবাব আলি চৌধুরি।

মুসলিম লিগ ও হিন্দু গণহত্যা :

১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন একদিকে যেমন পূর্ণ স্বদেশী ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, যা ব্রিটিশ ভারতের ভিত নড়িয়ে দিয়েছিল, সমগ্র দেশকে ঐক্যবদ্ধ করতে সহায়তা করেছিল, ঠিক তেমনি সেই সময়েই তৈরি হয় মুসলিম লিগ, দেশদ্রোহিতার অনন্য নজির, যা দেশকে টুকরো করে ফেলেছে।

| ঢাকার শাহবাগে ১৯০৬-এর ২৮-৩০ ডিসেম্বর প্রায় আট হাজার প্রতিনিধির উপস্থিতিতে ঢাকার নবাব খাজা সলিমুল্লাহ, আগা খান প্রমুখ মুসলমান নেতা সেদিন ভারতবিদ্বেষের যে বীজ বপন করেছিল তার রেশ বয়ে চলল আরও চার দশক।

২৯ জুলাই ১৯৪৬। বোম্বাইতে মুসলিম লিগের অধিবেশনে হিন্দুদের বিরুদ্ধে ১৬ আগস্ট প্রত্যক্ষ সংগ্রামের ডাক দেন জিন্না। বলেন, আমি নীতিকথার আলোচনায় যেতে চাই না। আমাদের হাতে বন্দুক আছে এবং আমরা তা ব্যবহার করতে প্রস্তুত।

লাঠিসোঁটা ও অন্যান্য অস্ত্র হাতে কলকাতার রাস্তায় জড়ো হয় পঞ্চাশ হাজার জেহাদি মুসলমান, যা তখনকার সবচেয়ে বড়ো সমাবেশ। মুসলিম লিগের প্রত্যক্ষ সংগ্রামদিবসের ডাকে তারা হিন্দুদের বিরুদ্ধে জেহাদে প্রস্তুত। মঞ্চে উপবিষ্ট মুসলিম লিগ নেতৃবৃন্দ হোসেন সুরাবর্দি, খাজা নাজিমুদ্দিন, আবুল হাসিম, এম এস ইস্পাহিনি ও তপশিলি মোর্চার যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল। বাঙ্গলার প্রধানমন্ত্রী সুরাবর্দি সমবেত মুসলমান জনতাকে বললেন, “সেনা ও পুলিশকে সংযত করা হয়েছে। ২৪ ঘণ্টা সময় দিলাম— যা করতে পারিস কর।”

ময়দানে সভা ভাঙতেই উন্মত্ত মুসলমান জনতা আক্রমণ করে হিন্দু জনতা ও দোকানপাটের ওপর! ক্যানিং স্ট্রিট, ওয়েলেসলি স্ট্রিট, কর্পোরেশন স্ট্রিট, ধর্মতলা স্ট্রিট, মানিকতলা রোড, বিবেকানন্দ রোডে গণলুঠ হয়। বিখ্যাত দোকান কমলালয়। স্টোর্স, ভারতকলা ভাণ্ডার, লক্ষ্মী স্টোর্স লুঠ হয়। উত্তর ও মধ্য কলকাতার হিন্দুপাড়াগুলি আক্রান্ত হয়। আক্রান্ত হয় গড় পাড়, নারকেলডাঙা, ফুলবাগান, বেলেঘাটা, পার্ক সার্কাস, কলুটোলা, চিৎপুর প্রভৃতি অঞ্চলের প্রায় প্রতিটি হিন্দু বাড়ি। অভিনেতা ছবি বিশ্বাস থেকে গণিতজ্ঞ যাদব চক্রবর্তী, রাজা দেবেন্দ্র মল্লিক থেকে ডেপুটি পুলিশ কমিশনার এস এন মুখার্জি। কেউই সেদিন রেহাই পাননি। ক্যানেল ওয়েস্ট স্ট্রিট, গ্যাস স্ট্রিট, ফিরার্স লেন, মেটিয়াবুরুজ, লিচু বাগান। প্রভৃতি অঞ্চলে হিন্দুদের নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। | এই হত্যালীলা অপরিকল্পিত ছিল না, বরং নাৎসি পার্টির ইহুদি গণহত্যার দ্বারা অনুপ্রাণীত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলার ও নাৎসি পার্টির ইহুদি বিদ্বেষ, মুসলমান নেতাদের হিটলারের প্রতি অনুরক্ত করে তোলে। বসনিয়া-ক্রোয়েশিয়ার হাজার হাজার মুসলমান, নাৎসি পার্টির মিলিয়েশিয়ায় যোগদান করে এবং ব্যাপক হারে সার্ব নিধনযজ্ঞে মেতে ওঠে। ভারতের মুসলিম লিগও ব্যতিক্রমী ছিল না। নাৎসি পার্টির ধাঁচে গড়ে ওঠে মুসলিম ন্যাশানাল গার্ড। ১৬ আগস্টের জন্য তাদের পুরোদমে চলতে থাকে রণ প্রস্তুতি। টানা দুদিন এক তরফা মার খেয়ে ১৭ আগস্ট হিন্দুরা বিভিন্ন আখড়া ও ব্যায়াম সমিতির মাধ্যমে সংগঠিত হয়ে শুরু করে পালটা মার। গোপাল মুখার্জি, যুগল ঘোষ, ভানু বোসরা অত্যন্ত বীরত্বের সঙ্গে শুরু করে প্রতিরোধ ও প্রতিশোধ। হতাশ সুরাবর্দি নিরুপায় হয়ে রণে ভঙ্গ দেন। এদিকে পাকিস্তান দাবির উন্মত্ততায় পূর্ববঙ্গ তখন বারুদের স্কুপে পরিণত হয়েছে। নোয়াখালি ও ত্রিপুরা বাঙ্গলার দ্বিতীয় ও চতুর্থ মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলা। কোজাগরী লক্ষ্মীপূজার দিন শুরু হয় হিন্দুদের সার্বিক গণহত্যা, ধর্ষণ ও গণধর্মান্তরকরণ। শয়ে শয়ে আক্রান্ত হয় নমঃশূদ্র, কৈবর্ত ও যুগীবাড়ি। নষ্ট করা হয় মাছ ধরার জাল ও নৌকা, তাঁতির তার ও সুতো। শুধুমাত্র টাকাপয়সা, সোনাদানা লুঠ করা হয়নি। বরং টিনের চাল, বেড়ার দেওয়াল, কাঠের দরজা এমনকী পরনের কাপড়টিও লুঠ করা হয়। পুরুষদের কুপিয়ে অথবা জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করা হয় এবং পরিবারের নারীদের গণধর্ষণ করা হয়। তারপর নারীদের মাটিতে ফেলে পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে সিঁথির সিঁদুর মুছে দিত মৌলবিরা। বিয়ে দিয়ে দিত কোনো এক

ধর্ষকের সঙ্গে। নোয়াখালি ও ত্রিপুরায় আক্রান্ত হয়েছে অগণিত মন্দির ও হিন্দুদের ঠাকুর ঘর, গোমাংস নিক্ষেপ করে অপবিত্র করা হয় মন্দির এবং দেওয়ালের সর্বত্র লিখে দেওয়া হয় আল্লাহু আকবর।

শ্যামাপ্রসাদ ও পশ্চিমবঙ্গ গঠনের প্রস্তাব :

বেসরকারি মতে নোয়াখালির গণহত্যায় পাঁচ থেকে দশ হাজার হিন্দুকে হত্যা করা হয়। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও অসম রাজ্যে আছড়ে পড়ে হাজার হাজার বাঙ্গালি উদ্বাস্তু। এভাবেই পাকিস্তান আন্দোলনের চারাগাছটি একটু একটু করে বিষবৃক্ষের মতো বেড়ে উঠছিল। শ্যামাপ্রসাদ এই বিষবৃক্ষের সম্ভাবনা আগেই বুঝতে পেরেছিলেন। হিন্দু মহাসভা ও ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের গ্রামীণ সংগঠনের সহায়তায় শ্যামাপ্রসাদ পাকিস্তান আন্দোলনের অঙ্কুরেই বিনাশ করার সংকল্প নেন। এই সময়ে বাবাসাহেব আম্বেদকারের ভূমিকাও অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য। ১৯৪০ সালে লিখিত হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক ও পাকিস্তান দাবি নিয়ে লিখিত তাঁর বই–পাকিস্তান অর দ্য পার্টিশান অব ইন্ডিয়া। সেখানে তিনি এই সিদ্ধান্তে আসেন যে একজন হিন্দু, সে যে বর্ণেরই হোক না কেন, মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে তার ভবিষ্যৎ অন্ধকার বই আর কিছুই নয়। তার এই সিদ্ধান্ত বাঙ্গলার তপশিলি সম্প্রদায়ের নেতৃবর্গকে বাঙ্গলাভাগের পক্ষ নিতে অন্তত নৈতিক সমর্থন জানাতে সহায়তা করে। অবশেষে দলমত নির্বিশেষে সর্বস্তরের বাঙ্গালি এগিয়ে আসেন বাঙ্গলায় হিন্দু বাসভূমি গড়ার লক্ষ্যে।

১৯৪৬-এর শেষের দিকে বিপ্লবী উপেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি, কৃষক নেতা হেমন্ত কুমার সরকার, শ্যামাপ্রসাদ ও অন্যান্য বাঙ্গালি হিন্দু নেতৃত্ব পশ্চিমবঙ্গ গঠনের উদ্দেশ্যে বাঙ্গলা ভাগ করে বেঙ্গল পার্টিশন লিগ তৈরি করেন। ১৫ মার্চ, ১৯৪৭-এ শ্যামাপ্রসাদ কলকাতায় অনুষ্ঠিত একটি সম্মেলনে বাঙ্গালি হিন্দুর স্বভূমির প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন। ভাষাবিদ সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় ও ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদারশ্যামাপ্রসাদের বক্তব্যকে পূর্ণ সমর্থন জানান। ২৯ মার্চ ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের বার্ষিক সাধারণ সভায় বঙ্গভাগের প্রস্তাবে সম্মতি দেন বর্ধমানের মহারাজা উদয়চঁাদ মহাতাব, কাশিম বাজারের শীশচন্দ্র নন্দী-সহ বাঙ্গলার অন্যান্য জমিদার। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে তারকেশ্বরে হিন্দু মহাসম্নেলনে নির্মলচন্দ্র চ্যাটার্জি বলেন, বাঙ্গলাভাগ বাঙ্গালি হিন্দুদের জীবনমরণের প্রশ্ন। শ্যামাপ্রসাদ বাঙ্গলাভাগকে হিন্দুস্বার্থ সুরক্ষার একমাত্র পথ বলে তুলে ধরেন। ৪ এপ্রিল বঙ্গীয় কংগ্রেস অধিবেশনে ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়, ক্ষিতীশচন্দ্র নিয়োগী, ডাঃ প্রমথনাথ ব্যানার্জি, কুমার দেবেন্দ্রলাল খান-সহ অন্যান্য নেতৃত্ব শ্যামাপ্রসাদের উপস্থিতিতে বাঙ্গলাভাগের প্রস্তাব গ্রহণ করেন। ২৩ এপ্রিল অমৃতবাজার পত্রিকার মাধ্যমে নেওয়া ৫ লক্ষাধিক মানুষের ৯৮ শতাংশ বাঙ্গালি হিন্দু বাসভূমির পক্ষেই রায় দেন। ২৩ এপ্রিল শ্যামাপ্রসাদের ডাকেই কলকাতায় পরিবহণ ধর্মঘট হয়। পার্টিকে তোয়াক্কা না করে কমিউনিস্ট পার্টি নিয়ন্ত্রিত ট্রাম কোম্পানি কর্মচারী ইউনিয়নের সদস্যরা শ্যামাপ্রসাদের ডাকে সাড়া দিয়ে ধর্মঘট পালন করেন। তপশিলি নেতা প্রেমহরি বর্মণ বলেন উত্তরবঙ্গের তপশিলি মানুষেরা পশ্চিমবঙ্গ গঠনের পক্ষে। ১৮ জুন মতুয়া মহাসঙ্রে নেতা প্রমথনাথ ঠাকুর একটি জনসভায় পশ্চিমবঙ্গ গঠনের পক্ষে জোরালো বক্তব্য রাখেন।

পশ্চিমবঙ্গ আন্দোলন সর্বাত্মকভাবে সফলতা লাভে সুরাবর্দি-সহ লিগ নেতারা প্রমাদ গোনে এবং অখণ্ড বাঙ্গালিজাতির ধুয়ো তুলে সুচতুরভাবে স্বাধীন যুক্তবঙ্গের প্রস্তাব দেন। প্রস্তাবকদের মধ্যে ছিলেন। কলকাতার কসাই সুরাবর্দি, লিগের কট্টরপন্থী ও তাত্ত্বিক নেতা আবুল হাসিম ও তরণ নেতা ফজলুর কাদের চৌধুরী। প্রস্তাবিত অখণ্ড বাঙ্গলার ইসলামিকরণ দেখে উৎফুল্ল জিন্না স্বাধীন যুক্তবঙ্গের প্রস্তাবে পূর্ণ সমর্থন জানায়। গান্ধীজী-সহ কংগ্রেসের শীর্ষনেতারা দ্বিধা বিভক্ত। বাঙ্গলার কতিপয় কংগ্রেস নেতা স্বাধীন যুক্তবঙ্গের ফঁদে পা দিলেন। স্বাধীন যুক্তবঙ্গের তীব্র বিরোধিতা করলেন শ্যামাপ্রসাদ। কলকাতার দাঙ্গা ও নোয়াখালির গণহত্যার উদাহরণ তুলে তিনি যুক্তি দিলেন যেহেতু স্বাধীন যুক্তবঙ্গের শাসন ক্ষমতায় লিগ নেতারাই থাকবেন সেহেতু বাঙ্গালি হিন্দুরা কোনোমতেই তাদের বিশ্বাস করবেনা। উপরন্তু পরবর্তীকালে এইযুক্তবঙ্গ যে পাকিস্তানে যুক্ত হয়ে যাবে না তার নিশ্চয়তা কী? এর মধ্যে ৩ জুন মাউন্ট ব্যাটন ভারত ভাগের প্রস্তাব দেন। ঠিক বাঙ্গলা ও পঞ্জাবে আইনসভায় ভোটাভুটির মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। বাঙ্গলার মুসলমান বিধায়করা ১২৬-৯০ ভোটে পাকিস্তানের পক্ষে সিদ্ধান্ত নেয়। প্রত্যুত্তরে ২০ জুন পশ্চিমবঙ্গ গঠনের বিধায়কেরা ৫৮-২১ ভোটে নিজেদের ভারতভুক্তির পক্ষে মত প্রকাশ করেন। ৩ জুলাই, ১৯৪৭ পশ্চিমবঙ্গের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ। নেন প্রফুল্লকান্তি ঘোষ।তার সঙ্গে শপথ নেন মন্ত্রীসভার প্রথম দশজন সদস্য।

১৫৯৯ সালে ইসলামি শাসনের বশ্যতা অস্বীকার করে সর্বাত্মক স্বাধীনতা লাভ করেছিলেন মহারাজা প্রতাপাদিত্য। তার প্রায় সাড়ে তিনশো বছর পর আরব সাম্রাজ্যবাদের বুকচিরে বাঙ্গালি হিন্দু গরিমার পুনরুত্থান ঘটল পশ্চিমবঙ্গ স্থাপনের মধ্য দিয়ে।। পশ্চিমবঙ্গ দিবস উদযাপনের সার্থকতা :

স্বাধীনতার পর এবং অতি সম্প্রতি ভারতবর্ষে নতুন নতুন প্রদেশের জন্ম হচ্ছে। প্রতিটি প্রদেশই অত্যন্ত গৌরবের সঙ্গে বর্ণাঢ্যভাবে তাদের প্রতিষ্ঠা দিবস পালন করে। পশ্চিমবঙ্গের ঐতিহাসিকভাবে আত্মপ্রকাশ ঘটলেও সত্তর বছর ধরে কেন দিনটি পালনে সরকার বাহাদুরের অনাগ্রহতা বিষয়টি ভাববার! ১৯৪৭ সালের ২০ জুন যে ৫৮-২১ ভোটে পশ্চিমবঙ্গ গঠনের প্রস্তাব পাশ হয়, তার বিরোধী ২১ জন সদস্যই মুসলমান ছিলেন। আইনসভায় তিন কমিউনিস্ট নেতা, সিপিআই-এর জ্যোতি বসু, রতনলাল ব্রাহ্মণ প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেন। তৃতীয় জন রদপনারায়ণ রায় ভোটাভুটিতে অংশ নেননি। তার পরেও বামশাসিত পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘ চার দশকে এই ইতিহাসকে ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে কোন রহস্যে !

যদি পশ্চিমবঙ্গের জন্ম না হতো, তাহলে এই সম্পূর্ণ ভূখণ্ডই পূর্ব পাকিস্তানে চলে যেত। সমগ্র পূর্ব ভারতের সাতটি রাজ্য ও সিকিমও ভারতের বাইরে চলে যেত। কারণ এই আটটি রাজ্যের সঙ্গে ভারতের যোগাযোগের একমাত্র পথ কেবলমাত্র পশ্চিমবঙ্গের ওপর দিয়েই গেছে। স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম কখনই হতো না। বাঙ্গালি সংস্কৃতি অবলুপ্ত হয়ে যেত, যেভাবে পাকিস্তানে আঞ্চলিক ভাষা সংস্কৃতি বিলীন হয়ে গেছে। ভারতের অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্ব দ্রুত বিপন্ন হতো।

প্রবীর ভট্টাচার্য্য

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.