প্রণব মুখার্জি কেমন মানুষ ছিলেন? দাম্ভিক? রসবােধহীন? রাশভারী? স্বার্থপর? প্রতিহিংসাপরায়ণ? পশ্চিমবঙ্গ বিমুখ?
উত্তর খুঁজব পরে। তার আগে কিছু স্মৃতিচারণ করা যাক। দীর্ঘ ৩০ বছরের ওপর সাংবাদিকতা করেছেন কলকাতায় ও দিল্লিতে, এমন কোনও ব্যক্তি খুঁজে পাওয়া ভার, যাঁরা প্রণব মুখার্জির সান্নিধ্যে আসেননি। তার মধ্যে যাঁরা দীর্ঘদিন কাটিয়েছেন দিল্লিতে, তাঁরা এসেছেন প্রণব মুখার্জির অন্তরঙ্গ বৃত্তে। আমি ১৯৮৪ সাল থেকে টানা বেশ কয়েকবছর কাটিয়েছি দিল্লিতে। অবশ্য সেই পরিধির মধ্যে বহুবার দিল্লি-কলকাতা জার্নিও করতে হয়েছে। পেশার সূত্রেই। স্বাভাবিকভাবে প্রণব মুখার্জি অনেকের মতােই আমার কাছেও ছিলেন প্রণবদা।
তখন রাজীব গান্ধী প্রধানমন্ত্রী। প্রণবদার রাজনৈতিক অবস্থান বেশ দুর্বল। যে কোনও কারণেই হােক, রাজীব গান্ধীর সঙ্গে প্রণবদার তখন গড়ে উঠেছে রাজনৈতিক দূরত্ব। সঠিক কারণটা প্রকাশ্যে বলা যাবে না কোনােদিনই, কারণ রাজীব গান্ধী কিংবা প্রণব মুখার্জি দুজনের কেউই কখনও সে কথা স্পষ্ট করেননি। এরকম একটা সময়েই একবার একটি বেশ চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে আসে যে, রাজীব গান্ধী যুব কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সভাপতি থাকাকালীন নাকি প্রবল প্রতাপশালী ইন্দিরা- ঘনিষ্ঠ প্রণব মুখার্জিকে ডেকে পাঠিয়ে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত করেছেন। দুর্নীতিটা ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের এক আমলার মেয়ের বিয়েতে অত্যন্ত মূল্যবান একটি উপহার দেওয়া। বিস্তারিত তথ্যে সৌজন্যবশত যাচ্ছি না। তবে একটা কথা বলতেই হবে, সেই সময়েই প্রণব মুখার্জি ধীরুভাই আম্বানির ব্যবসায়িক উন্নয়নে একটু বেশি মন দিয়ে ওনলি বিমল’ডাকনামটি অর্জন করে ফেলেছেন। প্রণব মুখার্জি অস্বীকার করেননি, কারণ রাজীব গান্ধী যা বলেছিলেন, তামিথ্যা নয় এবং তিনি এরমধ্যে কোনও দুর্নীতি খুঁজে পাননি। কিন্তু রাজীবের গোঁসা তাতে বেড়েই গিয়েছিল।
বেশ জমিয়েই লিখেছিলাম খবরটা। এবং এমনও মনে হয়েছিল যে ইন্দিরা হত্যার পর প্রণব মুখার্জিকে মন্ত্রী না করে অপমান করার পিছনে রাজীব গান্ধীর পুরনাে গোঁসাটাই হয়তাে কাজ করেছিল।।
না, প্রণবদা সব দেখেও কোনােদিন জানতে চাননি, কেন লিখেছি খবরটা? কিন্তু শুভ্রাদি, মানে তাঁর স্ত্রী শুভ্রা মুখােপাধ্যায় স্নেহের সুরেই ধমকেছিলেন : ‘খবর না লিখলেই হতাে না?
না, জবাব দেওয়ার ধৃষ্টতা দেখাইনি। না, বলিনি, সাংবাদিকের কাজ খবর করা। মুখ দেখে খবর করা বা না করার দায় একজন সাংবাদিকের থাকে না যদি না তার কোনাে ব্যক্তিগত স্বার্থ থাকে। এর পরেও কিন্তু শুভ্রাদিকখনও দূরে ঠেলেননি। চা খাইয়েছেন, জলখাবার খাইয়েছেন, রবীন্দ্রসংগীত শুনিয়েছেন, মেয়ে শর্মিষ্ঠার নাচের অনুষ্ঠানেও আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।
মাঝে কেটে গেছে আরও দুটো বছর। অপমানিত প্রণব মুখার্জি কংগ্রেস ছেড়েছেন। গড়েছেন রাষ্ট্রীয় সমাজবাদী কংগ্রেস। প্রচারে এসেছেন পশ্চিমবঙ্গে। আমি এসেছি তার প্রচার কভার করতে।।
শান্তিনিকেতনে বিশ্রামরত প্রণবদার সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকার। আর কেউ নেই। কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে আসা, নতুন দল করা— এসব নিয়ে নানা প্রশ্নের মধ্যেও একবারও রাজীব গান্ধী কিংবা কংগ্রেস প্রসঙ্গে তিনি কোনও বিরুদ্ধ সমালােচনা করেননি। বরং বারে বারেই বলেছেন, “কেউ যদি ভুল রাজনীতি করে, তাহলে তার দায় কংগ্রেস নেবে কেন? কংগ্রেসের উচিত ভুল সংশােধন করা। সেদিন আমি ইচ্ছে করেই তুলেছিলাম ১৯৮২-র ঘটনা যখন রাজীব গান্ধী তাকে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত করেছিলেন। শুধু এটাই মিলিয়ে নিতে যে আমার খবরের প্রতিবাদ করেন কিনা, তা জানতে। না, প্রতিবাদ করেননি। ধমকও দেননি। বরং বলেছিলেন, “তােমার কাজ তুমি করেছ। আমি কেন প্রতিবাদ করব? আর খবরটা তাে ভুল নয়।
কিন্তু প্রণবদা যে কীভাবে ধমক দিতে পারেন, তারও একটা অভিজ্ঞতার কথা বলি। তখন আমি কলকাতায়। সদ্য গৃহীত বাজেট প্রসঙ্গে কংগ্রেসের বিধান ভবনে প্রণবদার প্রেস কনফারেন্স। একটি ইংরেজি কাগজের এক সাংবাদিক একটা প্রশ্ন করলেন বাজেট নিয়েই। প্রণবদা উত্তর দিলেন এবং বুঝিয়ে ছিলেন, প্রশ্নকর্তার সংখ্যাতত্ত্বে ভুল আছে, তাই প্রশ্নটাও ভুল হচ্ছে। ওই সাংবাদিক তা মানবেন না। প্রণবদা বার বার তিনবার বােঝালেন। কিন্তু ভবি ভােলবার নয়। এবার বােমা ফাটল। ধৈর্যশীল মাস্টারমশাই প্রণবদার হাতে ভাগ্যিস বেত ছিল না। চিৎকার করে উঠলেন— ‘সংখ্যাতত্ত্ব তুমি আমায় শেখাবে? বাজেট তুমি আমায় বােঝাবে? শােন…’ বলে পরপর পাঁচ বছরের বাজেট বিশ্লেষণ করে গেলেন টানা আধঘণ্টা ধরে প্রতিটি বছরের দফাওয়ারি আর্থিক বরাদ্দের সংখ্যাতত্ত্ব আউড়ে। মাথা ঝা ঝা করছে। কান ভো ভো করছে আর হাঁ হয়ে ভাবছি। বাবা, কার সঙ্গে লেগেছে। এমন যাঁর স্মৃতিশক্তি তার সঙ্গে তর্ক? কভি নেহি! ইংরেজি কাগজের ওই সাংবাদিকটিও ‘থ।
কিন্তু না, বকাঝকাটাও ছিল দাদার মতােই। রাজনীতিবিদের মতাে নয়। ভ্যানিটি, গ্ল্যামার—
এসবের মােহকখনও জড়াতে পারেনি প্রণবদাকে। শুভ্রাদিকেও নয়। ক্ষমতার চরম শীর্ষে থেকেও কলকাতার ঘরের ছােটো ডিভানেই একটু সরে বসে বসতে বলতেন। এমন কোনাে অভিজ্ঞতা হয়নি যেদিন কোনাে প্রশ্নের উত্তর দেননি। নিজের গ্রামের গল্প বলতে শুরু করলে থামতেন না। কীর্ণাহার, মিরিট, বড়দি, বড়দা, ছােটো ছােটো ভাই-বােনদের কথা বলতেন অকপটে। স্পষ্ট করেই বলতেন— “আমি আস্তিক। একথা বলতে আমি দ্বিধা করি না। আমি ঈশ্বর বিশ্বাসী। আমি পারিবারিক পরম্পরার অনুগামী। পরিবারের নিয়ম মেনেই প্রতি বছর বাড়ির দুর্গাপুজোয় চণ্ডীপাঠ করি। আমার ভালাে লাগে।
‘গীতা পাঠ করেন প্রণবদা?’
‘করি বই কী! আমি মনে করি ধর্ম যে যার সে তার। বুক ফুলিয়ে ঢাকপিটিয়ে আমি হিন্দু ব্রাহ্মণ বলার লােক নই। তবে রাজনৈতিক জীবনে আমার গীতা ভারতের সংবিধান। গত ৫০ বছর ধরেই ওই সংবিধানকে গীতার মতােই সম্মান দিয়েছি।
জীবনে দুঃখবােধ ছিল অনেক। কিন্তু তা কোনােদিন প্রকাশ্যে আনেননি। তবে একেবারে জীবনের শেষ পর্যায়ে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের আমন্ত্রণে নাগপুরে গিয়ে বক্তৃতা দেওয়ার পর আক্ষেপ করেছিলেন, “আমার বক্তৃতা দেওয়ার ছবিটা রয়ে গেল। মানুষের মনে। কিন্তু আমার বক্তৃতাটা মানুষ মনে রাখল না।আপাদমস্তক কংগ্রেস কর্মী প্রণব মুখার্জির আরও একটা আক্ষেপ ছিল—‘স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর থেকেই দক্ষিণপন্থী শক্তি ও অন্যদিকে বামপন্থী দলগুলি যদি কংগ্রেস বিরােধিতা এভাবে না করত, তাহলে আজ কংগ্রেসের এই অবস্থা হতাে না।
অসম্ভব বিচক্ষণতা, তীব্র বুদ্ধিমত্তা, অসাধারণ স্মৃতিশক্তি ও মেধা, অর্থনীতি-বােদ্ধা, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ, লড়াইয়ের ময়দানে অনন্ত কর্মযােদ্ধা, বিশ্রাম বিমুখ, মােহ বিমুখ, প্রায় নিঃশত্রু এক প্রবল ক্ষমতাধারী মানুষটার হাতে সবশক্তি উজাড় করে দিয়েছিলেন তার মা-বাবা। কিন্তু তার জীবনের সবচেয়ে বড়াে প্রাপ্তি ছিল—তার হৃদয়। ওইটুকু মানুষ, কেউ কেউ ভালােবেসেই ঠাট্টা করত ‘বেঁটে বামুন’ বলে, অথচ কী বিশাল হৃদয়। তা না হলে যে কংগ্রেসের নেতা জওহরলাল পদে পদে একদা ফাসাতে চেয়েছেন প্রখর হিন্দুত্ববাদী বীর সাভারকারকে, সেই কংগ্রেসেরই অভিন্ন অঙ্গ হয়ে তিনি যেতে পারতেন নাগপুরে আরএসএসের সদর দপ্তরে বক্তৃতা দিতে ?
প্রণবদা কিছু না। রাজনীতিবিদ নন, অর্থনীতিবিদ নন, সমাজবিদ নন, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ নন– প্রণব মুখার্জি একটা ইতিহাস। পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাস। বাঙ্গালির ইতিহাস। ভারতের ইতিহাস।
ভালাে থাকুন। শান্তিতে থাকুন প্রণবদা।
সুজিত রায়
2020-09-07