হিন্দুর প্রায় প্রতিটি আচার অনুষ্ঠানের পেছনেই ক্রিয়াশীল কোনো না কোনো । আর্থ-সামাজিক ভাবনা। একটু। নিবিড়ভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে ওইসব অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে ধর্মীয় নয়, লোকায়ত দর্শনই বেশি গুরুত্ব পেয়ে থাকে। কেবল কিছু সংস্কার ‘সু’ অথবা ‘কু’ এর পেছনে বড়ো ভূমিকা নিয়েছে। তা নয়, এগুলির পেছনে কাজ করেছে। এক ধরনের বিজ্ঞানমনস্কতাও। কিন্তু কোনো সময়েই সেগুলি বিজ্ঞানের নামে করার কোনো নির্দেশ দেওয়া হয়নি। বিজ্ঞান সম্পর্কে এই আপাত উদাসীনতার কারণেই বিশেষ করে পাশ্চাত্যের সমালোচকরা হিন্দুর আচার অনুষ্ঠানকে ঢালাও ভাবে কুসংস্কার বলে আখ্যাত করে নিজেদের সভ্যতার বড়াই করে থাকেন।
হিন্দুর এমনই একটি অনুষ্ঠান। অম্বুবাচী। বর্তমানে এর ধর্মীয় রূপটি প্রাধান্য পেয়েছে। কিন্তু প্রাচীন শাস্ত্র, স্মৃতিগ্রস্থ ইত্যাদির অনুশীলনে জানা যায়, অম্বুবাচী সংক্রান্ত ধর্মীয় বিধিনিষেধ। ইত্যাদি সবই পরবর্তীকালের আরোপিত। যেমন, বর্তমানে প্রচলিত ধারণা, অম্বুবাচীর সময় পৃথিবী রজঃস্বলা হয়। তাই ধরিত্রী হয় অশুচি। কিন্তু এ ব্যাপারে রঘুনন্দনের ঠিক পূর্ববর্তী স্মৃতিকার গোবিন্দানন্দ একটি সঙ্গত প্রশ্ন তুলেছেন, তার ‘বর্ষক্রিয়ামৌমুদী’ গ্রন্থে। বলেছেন, ভূমেরশুদ্ধি: কুত: আধুনিকরা বলেন, এই সময় পৃথিবী অপবিত্র হয়। কিন্তু বাস্তবে তা হতে পারে না। কারণ সত্যিই যদি পৃথিবী অশুদ্ধ-অপবিত্র হতো, তাহলে খাওয়া-দাওয়া সমস্তই নিষিদ্ধ। হতো।
গোবিন্দানন্দর এই বক্তব্য থেকে বোঝা যায়, অম্বুবাচীর সময় পৃথিবী অপবিত্র হয় এই ধারণা প্রাচীনকালে ছিল । না। এটা সম্পূর্ণভাবেই আধুনিক বা পরবর্তীকালের সংযোজনা।
দ্বিতীয় যে সত্যটি এই বক্তব্য থেকে। উঠে আসে, তাহলো অম্বুবাচীর সময় । খাওয়া-দাওয়া সম্পর্কে কোনো নিষেধই ছিল না। এটিও সম্ভবত পরবর্তীকালের ব্রাহ্মণপণ্ডিতদের কোনো স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট নির্দেশ।
যাইহোক, এই বক্তব্যের আলোয় অম্বুবাচীর উৎসসন্ধানে অগ্রসর হলে দেখা যাবে, ভারত মূলত কৃষিভিত্তিক দেশ। কৃষিই এদেশের অর্থনীতির মূল ভিত্তি। সেই ভিত্তিকে মজবুত করতে এবং এই কৃষিজীবিকার সুষ্ঠু বিকাশের স্বার্থেই অম্বুবাচীর মতো অনুষ্ঠানের প্রবর্তন করা হয় একসময়।
আষাঢ়ের নববর্ষার সূচনায় মূলত দেশের কৃষক সমাজ এবং কৃষিজমিকেও কিছুটা বিশ্রাম দেওয়ার অভিপ্রায়েই এই অম্বুবাচীর আয়োজন। বঙ্গদেশে মূলত ৭ আষাঢ় থেকে তিনদিন এবং ওড়িশায় জ্যৈষ্ঠ সংক্রান্তি থেকে তিনদিন অম্বুবাচী পালিত হয়। ওড়িশায় অম্বুবাচীর নাম রজউৎসব।
প্রাচীন যেসব তথ্য পাওয়া যায়, তার থেকে জানা যায়, নববর্ষায় কৃষককুল। নতুন উদ্যমে কৃষিকর্ম শুরুর আগে যাতে নিজেরা সুস্থ থাকতে পারে, নানা আনন্দ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সৃজনশক্তি অর্জন করতে পারে, তারই জন্য সমাজকর্তারা অম্বুবাচীর মতো একটি অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা করেন। ওই সময়। খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে কোনো বিধিনিষেধ তো ছিলই না, বরং বিশেষ ভোজের আয়োজন করা হতো। বনভোজনের মতো অনুষ্ঠান, লোকনৃত্য, গান বাজনারও আয়োজন করা হতো, এখন অনুষ্ঠানও করেন অনেকে।
এক সময় যা ছিল সম্পূর্ণভাবেই একটি লৌকিক অনুষ্ঠান পরবর্তীকালে কী। করে তার সঙ্গে ধর্মীয় অনুষ্ঠান যুক্ত হয়। তা সঠিকভাবে নির্দেশ করা এখন খুবই কঠিন। তারচেয়েও বড়ো কথা, লক্ষ্যের চেয়েও উপলক্ষ্যই এখন যেন বড়ো হয়ে দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে সমাজের পতিহীনাদের উপর এ যেন এক নির্যাতন। বিধবাদের ক্ষেত্রে যেন এক নির্মম আচার হিসেবে আয়োজিত হয়েছে। এক সময় বিধবাদের নির্জলা একাদশীর উপবাস পালনে বাধ্য করে তাদের উপর একধরনের সামাজিক নির্যাতন চালানো হতো। অম্বুবাচীও যেন অনেকটা সেই জায়গায়ই নিয়েছে। এই তিনদিন বিধবাদের উনুন জ্বালানো নিষেধ। রান্না করা সবরকম খাবার খাওয়া বারণ। ফলমূল খাওয়া যায়, কিন্তু সেটাও যেন না খেলেই ভালো হয় এমন মানসিকতাও কাজ করে কোনো কোনো সময়।
তবে শুধু বিধবা নয়, কোনো কোনো নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ, যতি ও সন্ন্যাসীও অম্বুবাচী পালন করেন ব্রত হিসেবে। কিন্তু বিশেষ করে বিগত শতকেও অম্বুবাচী যেন এক আত্মনিগ্রহের অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।
প্রাথমিক পর্বে অম্বুবাচীর সঙ্গে পূজাঅর্চনার তেমন একটা ব্যবস্থা ছিল না। কিন্তু পরবর্তীকালে বিশেষ করে দেবী কামাখ্যার সঙ্গে অম্বুবাচীর যেন এক অতি ঘনিষ্ঠ যোগ দেখা যায়। অসমে কামাখ্যা পাহাড়ে দেবী কামাখ্যার মন্দিরে এই সময় বিরাট মেলা বসে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভক্তদের সমাবেশ ঘটে এই সময়। দেবীর মন্দির কিন্তু বন্ধ থাকে এই তিনদিন।
কামাখ্যা মন্দিরের মতোই এখন দেশের বিভিন্ন ছোটো বড়ো মন্দিরেও। অম্বুবাচীর মেলার আয়োজন করা হয়। অম্বুবাচী বলতে সকলেই এখন কামাখ্যা দেবীর মেলা এবং বিধবাদের খাওয়া-দাওয়ায় নিষেধের কথাটিই জানেন। অম্বুবাচীর প্রকৃত পরিচয়টি যেন হারিয়ে গেছে এই ধরনের উৎসব ও ব্রত অনুষ্ঠানের আড়ালে। লৌকিক জীবনে অম্বুবাচীর গুরুত্ব বা বিশেষ ভূমিকার কথা এমনকী কৃষকরাও প্রায় বিস্মৃত হয়েছেন।
অবশ্য এটাই যেন কিছুটা স্বাভাবিক, এক সময় ভারতের কৃষি ব্যবস্থা ছিল সম্পূর্ণ বৃষ্টি নির্ভর। সে সময় পয়লা আষাঢ় ওই দেশে বর্ষা আসত এবং তার । ওপর নির্ভর করেই হতো চাষাবাদ। কিন্তু। এখন সব দিক থেকেই অবস্থার পরিবর্তন। ঘটেছে। প্রথমত ঋতুচক্রের যে পরিবর্ত এসেছে তাতে এখন আর পয়লা আষাঢ়। থেকে বর্ষার শুরু হয় না। বরং প্রকৃত বর্ষা আসতে আসতে শ্রাবণ এসে যায়। তাই আষাঢ়ের গোড়ায় অম্বুবাচী পালনের তৎকালিক গুরুত্ব অনেকটাই কমে । গিয়েছে। তাছাড়া, এখন কৃষি আর শুধু বৃষ্টি নির্ভর নয়। বরং নানা ধরনের সেচ ব্যবস্থার সাহায্যে সারা বছর ধরেই চলে কৃষিকর্ম। তাই বছরের কোনো নির্দিষ্ট সময়ে কৃষকদের ছুটি দেওয়ার যে তাৎপর্য তাও হারিয়ে গেছে অনেকটাই। এবং এসব কারণেই বাঙ্গলার কৃষক ও লৌকিক জীবন থেকে অম্বুবাচী যেন হারিয়ে গিয়েছে।
লৌকিক জীবনে অম্বুবাচীর তাৎপর্য হ্রাস পেলেও ধর্মীয় দিক থেকে অম্বুবাচী আবার যেন নতুন এক ধরনের গুরুত্ব অর্জন করেছে। তন্ত্রসাধনা এবং দেবী আরাধনার প্রচলিত মার্গে অম্বুবাচী। নতুনভাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। এই সামাজিক বিবর্তন অম্বুবাচীর মতোই হিন্দুর বহু আচার অনুষ্ঠানকে আমাদের কাছে পরিবর্তিত রূপে তুলে ধরেছে। বলতে কী, এই বিবর্তন এবং সমন্বয়ই হিন্দু ধর্মের প্রাণ প্রবাহকে নিত্য বহমান রেখেছে।
নন্দলাল ভট্টাচার্য