আক্রান্ত জগন্নাথদেব

সোমনাথ মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ দেখে স্বামী বিবেকানন্দ মন্তব্য করেছিলেন, এই মন্দির যেন সহিষ্ণু হিন্দুধর্মের প্রতীক, যা বার বার বৈদেশিক আঘাত সত্ত্বেও নিশ্চিহ্ন হয়নি। পুরীর জগন্নাথ মন্দির দর্শন করে এমন মন্তব্য করেননি তিনি, তবে করতেই পারতেন। সোমনাথ মন্দিরের মতো জগন্নাথ মন্দির, জগন্নাথ বিগ্রহ দ্বিতীয় দৃষ্টান্ত যা বার বার বিজাতীয় বৈদেশিক আক্রমণের লক্ষ্য হয়েছে। নৃশংসভাবে লাঞ্ছিত ও লুণ্ঠিত হয়েছে এবং আবার স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।

জগন্নাথদেব প্রথম আক্রান্ত হন ১৫৬৮ খ্রিস্টাব্দে। এই সময় ওড়িশায় দুঃসময় ঘনিয়ে আসে। প্রথম এই আক্রমণে যে নেতৃত্ব দেন তার জন্ম-পরিচয় নিয়ে ইতিহাসে বিভিন্ন মত, বিতর্ক চালু থাকলেও সে কালাপাহাড় নামেই কুখ্যাত। এক মতে তার নাম কালাচঁাদ বন্দ্যোপাধ্যায়, ভিন্ন মতে কালাচঁাদ ভাদুড়ি। পূর্ববঙ্গের অধুনা বাংলাদেশের ব্রাহ্মণ। ব্রাহ্মণ হলেও সে রণনৈপুণ্যে দক্ষ ছিল। এই জন্য গৌড়ের আফগান সুলতান তাকে ফৌজদার করেন। সুদর্শন এই ব্রাহ্মণ সন্তানের প্রণয়ে আবদ্ধ হয় সুলতান-তনয়া। ফলে, সে সুলতান কন্যাকে বিবাহ করতে বাধ্য হয় এবং সুলতানের ইচ্ছায় তাকে ধর্ম ত্যাগ করে মুসলমান হতে হয়। কথিত আছে, সে পুনরায় স্বধর্মে ফিরে যেতে চেয়েছিল, প্রায়শ্চিত্তেও ইচ্ছুক ছিল কিন্তু আচার সর্বস্ব প্রাণহীন সমাজপতিরা তাতে সম্মত হতে পারেননি। সমাজপতিদের এই গোঁড়ামির জন্য সে প্রতিশোধস্পৃহায় ধ্বংসলীলায় মেতে ওঠে। সুলতানের সাগ্রহ সম্মতি নিয়ে বিশাল সৈন্যবাহিনীর সাহায্যে পথের দু’ধারের মন্দির, মঠ ধ্বংস করতে করতে সে শ্রীক্ষেত্রে পৌঁছয়।

সে সময় ওড়িশার রাজা ছিলেন মুকুন্দদেব। তিনি বাধা দিতে গিয়ে নিহত হন। কালাপাহাড় মন্দিরের ধন-রত্ন লুঠ করে, মন্দির তছনছ করে জগন্নাথ বিগ্রহ নিয়ে বাইরে আসে। হাতির পিঠে চামড়ার দড়ি দিয়ে খুব শক্ত করে বিগ্রহ বাঁধা হলো। তার পর বিগ্রহ চলল সমুদ্রের তীরে। হাতি চলেছে বিগ্রহ নিয়ে। পেছনে চলেছে অগণিত যবন সৈন্য। তাদের আল্লাহু আকবর ধ্বনিতে শ্রীক্ষেত্রের আকাশ-বাতাস মুখরিত। হঠাৎ কোথা থেকে আবির্ভূত হলেন অদ্ভুত এক পুরুষ। দীর্ঘ শীর্ণকায় অস্থিচর্মসার। মাথায় পাগড়ি। পরনে কেবল হাঁটু পর্যন্ত ধুতি। গলায় ঝুলছেমৃদঙ্গ। উন্মত্ত যবন সেনাদের পেছনে পেছনে কিছুটা দূরত্ব রেখে তিনিও চলেছেন মৃদঙ্গ বাজাতে বাজাতে। এই পুরুষের নাম বিশরা মহান্তি।

সমুদ্রের তীরে একটা স্থানে হাতি থামল। কাঠের উপর কাঠ সাজিয়ে চিতা সাজানো হলো। জগন্নাথ হিন্দু দেবতা। তার সৎকারও হবে হিন্দু মতে। তাই চিতা জ্বলে উঠল লেলিহান শিখায়। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার, অনেকক্ষণ ধরে জ্বললেও বিগ্রহ পুরোপুরি ভস্মীভূত হলো না।

কালাপাহাড় অধৈর্য হয়ে অর্ধদগ্ধ বিগ্রহ ফেলে দিয়ে তার বাহিনী নিয়ে সেখান থেকে চলে গেল। কিছু দূরে সবার অলক্ষে অপেক্ষা করছিলেন আর মৃদঙ্গ বাজাচ্ছিলেন বিশরা। তিনি যেন এই মুহূর্তের জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। যবনসৈন্য সরে যেতেই তিনি দারুবিগ্রহ থেকে জগন্নাথের আত্মস্বরূপ ব্রহ্ম উদ্ধার করে মৃদঙ্গের খোলের ভিতর ভরে নিয়ে চলে এলেন কটকের কাছে কুজাঙ্গায়। বিশরা মহান্তির আনা ব্ৰহ্ম মহানদীর ব-দ্বীপে কুজাঙ্গায় অনাড়ম্বরভাবে পূজিত হতে লাগল।

১৫৯০ খ্রিস্টাব্দে ওড়িশায় রাজনৈতিক পালাবদল হলো। সম্রাট আকবরের সেনাপতি মানসিংহ ওই বছর ওড়িশা আক্রমণ করে আফগানদের বিতাড়িত করলেন। এর ফলে ওড়িশায় রাজনৈতিক, সামাজিক কিছুটা সুস্থিতি ফিরে এল। ভাঙাচোরা মন্দিরগুলির সাধ্যমতো সংস্কার হতে লাগল, পুজোপাঠও শুরু হলো।

ওড়িশার সিংহাসনে রাজা হয়ে বসেছেন ‘ভৈ’ বংশের রামচন্দ্রদেব। রাজসিংহাসনে রাজা বসলেও ‘রত্নবেদি’ যে বিগ্রহ-শূন্য। জগন্নাথহীন। ওড়িশায় একটা কথা চালু আছে, ওড়িশার অন্য নেতার নহিক প্রয়োজন। ওড়িশার নেতা স্বয়ং নারায়ণ, সেই নারায়ণই নেই। তাই প্রজাদের মনে নিরানন্দ।

রামচন্দ্রদেব তখন যত্ন নিলেন জগন্নাথদেবকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে। তিনি মানসিংহের অনুমতি নিয়ে শাস্ত্রসম্মত বিধি অনুযায়ী উপযুক্ত দারুর সন্ধানে লোকজন প্রেরণ করলেন। সিংহল ব্রহ্মপুরের কাছে দারবিগ্রহের বৃক্ষ মিলল। রত্নবেদিতে নবকলেবরে জগন্নাথ আবার প্রতিষ্ঠিত হলেন, সেই ব্রহ্মবস্তু যা কুজাঙ্গায় পূজিত হচ্ছিল তা স্থাপিত হলো জগন্নাথের হৃদিকরে। স্বভাবত ধর্মপ্রাণ মানুষ খুশি হলো তাদের প্রাণের দেবতাকে ফিরে পেয়ে।

কিন্তু এই আনন্দ বেশিদিন স্থায়ী হলোনা। ১৬০৭ সালে ওড়িশা মোগল সাম্রাজ্যের একটি স্বতন্ত্র সুবা বা প্রদেশের মর্যাদা পেল। কটক হলো সুবাসদর। সুবাদার হাসিম খানের জায়গিরদার রাজপুত কেশো দেও মারু রথযাত্রার দিনে উৎসবের মধ্যে পুরী আক্রমণ করে রথগুলিকে পুড়িয়ে দিল। তাণ্ডব থেকে বিগ্রহও রেহাই পেল না। অসংখ্য মানুষ নিহত হলো। অবাধে লুণ্ঠন চলল। উৎসবের আনন্দ মুহূর্তে হাহাকারে পরিণত হলো।

আঘাত ও অত্যাচারে মানুষ মুষড়ে পড়লেও কিছুদিন পর আবার নব উদ্যামে মন্দিরের সংস্কার করে জগন্নাথ বিগ্রহ প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত নিজেদের তত্ত্বাবধানে গোপনে মন্দিরের মধ্যে বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করে পুজোপাঠ শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু তিন বছর পর ১৬১১ খ্রিস্টাব্দে আবার শ্রীমন্দিরে আঘাত নেমে এল। এবার হামলার নেতৃত্বে স্বয়ং সুবাদার কল্যাণ সিংহ। কিন্তু মন্দির আক্রান্ত হলেও বিগ্রহত্রয় অক্ষত থেকে যায় সেবায়েতদের সক্রিয়তায়। তাঁরা খবর পেয়েছিলেন, কল্যাণ সিংহ আসছেন মন্দিরের বিগ্রহ ধ্বংস করতে। তারা বিলম্ব না করে বিগ্রহ নিয়ে চলে যান চিল্কার জনহীন দ্বীপে।

১৬২৭ সালে দিল্লির মসনদে বসেন শাজাহান। ওড়িশার সিংহাসনে বসেছেন পুরুষোত্তমদেবের পর নরসিংহদেব। কিন্তু মন্দিরে দেবতা নেই। দীর্ঘদিন ধরে জগন্নাথদেবমন্দির থেকে দুরে চিল্কার কোনো দ্বীপে সংস্থিত।নরসিংহদেব জগন্নাথ প্রতিষ্ঠার জন্য বার বার সম্রাট শাজাহানের কাছে দরবার করেন, সঙ্গে নিয়ে যান আকর্ষণীয় ভেট।

দীর্ঘদিন ধরে কাতর আবেদনের পর শাজাহানের সম্মতি মিলল। পুনরায় জগন্নাথ প্রতিষ্ঠিত হলেন রত্নবেদিতে। জগন্নাথকে ফিরিয়ে আনার কৃতিত্বে নরসিংহদেব ওড়িশায় খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন। এই জনপ্রিয়তার ফলে তিনি ষড়যন্ত্রের শিকার হন এবং জীবনহানি ঘটে। এরপর ওড়িশায় নেমে আসে অরাজকতা। হত্যা-প্রতিহত্যায় রক্তাক্ত হয়ে ওঠে শ্রীক্ষেত্রের মৃত্তিকা। দীর্ঘ টালবাহানার শেষে অনিশ্চয়তার অধ্যায় অতিক্রম করে ওড়িশায় রাজা হন দিব্যসিংহদেব (১৬৮৯ থেকে ১৭১৬ খ্রিস্টাব্দ)। সেই সময় দিল্লির মসনদে চরম হিন্দুধর্ম বিদ্বেষী আওরঙ্গজেব। তিনি অসংখ্য বিগ্রহ ধুলিসাৎ করছেন ক্রুদ্ধ পরধর্ম বিদ্বেষে। যখন তিনি দক্ষিণ ভারতে তখন হিন্দুজনমানসে জগন্নাথদেবের প্রভাব সম্পর্কে অবগত হন। এরপর তিনি আর দেরি করলেন না, সুবেদার এক্রাম খাঁকে এই কাজে পাঠানো হলো। বাদশার ইচ্ছে, কাফেরদের ঘৃণিত পুতুলগুলি তার কাছে এনে দিতে হবে।

১৬৯২ খ্রিস্টাব্দে এক্রাম ও তার ভাইয়ের নেতৃত্বে সৈন্যবাহিনী জগন্নাথধাম ঘিরে ফেলল। প্রথমে যবনবাহিনী মন্দিরের মধ্যে পৈশাচিক উল্লাসে দাপাদাপি করে লুঠপাট চালাল, তারপর এক্রাম খাঁ চলল গর্ভগৃহের দিকে।

সেইসময় দিব্য সিংহ তাঁকে নিরস্ত করার জন্য নিবেদন করলেন দিল্লির বাদশাহ বিগ্রহগুলি চেয়েছেন, তিনি নিজের হাতে বিগ্রহগুলি তুলে দেবেন। এর অন্যথা হবে না। কিন্তু তাড়াহুড়োর দরকার কী?তারা সুদূর দিল্লি থেকে এসেছেন, তারা এই রাজ্যের অতিথি, মাননীয় মেহমান, কাজেই রাজার অতিথিশালায় বিশ্রাম নিন দু’দিন। তাদের আদর আপ্যায়নের কোনো ত্রুটি হবে না। তারপর বিগ্রহ নিয়ে বাদশাহের কাছে যাবেন।

প্রস্তাবটা মন্দ নয়। সৈন্যবাহিনীর মতোই এক্রাম ও তারর ভাইও পথশ্রমে ক্লান্ত। একটু জিরিয়ে নিলে খারাপ হয় না, বিশেষ করে রাজ অতিথিশালায় আশা করা যায় আদর যত্নের কোনো খামতি হবে না। আপাতত এক্রাম তার কাজ স্থগিত রাখলো। তারা সানন্দে রাজার অতিথিশালায় এল। সঙ্গের তাদের পারিষদবর্গ আর সেনাবাহিনী চলল সেনাছাউনিতে।

এক্রাম ভাইষেরা যেমন ভেবেছিল রাজা দিব্যসিংহ বরং তার বেশিই আয়োজন করেছেন। পান-ভোজনের ঢালাও ব্যবস্থা। সুরার সঙ্গে সুন্দরীও। আজ ভারত তথা এই পশ্চিমবঙ্গ থেকে হাজার হাজার মানুষ পুরী যান। জয় জগন্নাথ ধ্বনিতে মুখর হন। সমুদ্রে স্নান করেন। কিন্তু ক’জন বাঙ্গালি খবর রাখেন– জগন্নাথদেবের কথা ভেবে সুন্দরী যুবতীরা সানন্দে এক্রাম ভাই ও তাদের পার্ষদের দেহদান করে রাজার অতিথিশালায় ইচ্ছা করে আটকে রেখেছিলেন!

এক্রামভাইয়েরা যখন সুরা ও সুন্দরীতে আসক্ত, রাজার শিল্পীরা তখন গোপনে নিভৃতে নকল বিগ্রহ নির্মাণে ব্যস্ত। শিল্পীদের দিনরাতের পরিশ্রমে চন্দনকাঠের নকল বিগ্রহ তৈরি হলো। রাজকোষ থেকে মুক্তো এল। সেই মুক্তো দিয়ে তিনিটি বিগ্রহের উজ্জ্বল। চকচকে চোখ হলো। ততদিনে আসল বিগ্রহগুলিকে যবনবাহিনীর অলক্ষ্যে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে চিল্কাহুদের দূর দুর্গম নির্জনতায়। এক্রামভাইদের হাতে দিব্য সিংহ নকল বিগ্রহগুলি তুলে দিলেন। তারা বিগ্রহ পেয়ে খুব খুশি। সেই বিগ্রহগুলি তারা নিয়ে চলে গেল। বীজাপুরে বাদশাহ আওরঙ্গজেবের হাতে তুলে দিতে। আওরঙ্গজেব নিজের হাতে পৈশাচিক উল্লাসে বিগ্রহ তিনটির মুক্তোর চোখ খুবলে তুলে নিলেন, তারপর বিগ্রহগুলি চূর্ণবিচূর্ণ করে ধুলোয় মিশিয়ে দিলেন।

রাজা দিব্য সিংহের বুদ্ধিতে এবং কয়েকজন সুন্দরী যুবতীর আত্মত্যাগে সেবার জগন্নাথদেব রক্ষা পেলেন। কিন্তু তারপরও আক্রমণের ধারা অব্যাহত থেকেছে। ওড়িশার জনজীবন বিপর্যস্ত হয়েছে। কিন্তু ওড়িশা রাজ্যটি ব্রিটিশদের অধিকারে আসার পর জগন্নাথের উপর আক্রমণ ও লুণ্ঠনে ছেদ পড়ে। ১৮০৩ সালের ১৮ সেপ্টেম্বরের পর। আর কোনো লুঠেরা বা পরধর্ম বিদ্বেষী সিংহদ্বার অতিক্রম করার সাহস পায়নি।

জগন্নাথদেবের ওপর এই যে বার বার অত্যাচার হয়েছে, কখনও প্রভুর বিগ্রহটুকরো টুকরো হয়েছে, কখনো আগুনে পুড়েছে, কখনো মাটির তলায় আশ্রয় নিতে হয়েছে। এই জঘন্য কুৎসিত আক্রমণের মধ্যে প্রথম তিন আক্রমণের নেতৃত্ব দেয় তিন হিন্দু সন্তান।

এর মতো লজ্জা আর কী আছে! এই কাজ আত্মবিস্মৃত হিন্দুর পক্ষেই হয়তো সম্ভব।

উজ্জ্বল কুমার মণ্ডল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.