ভারত-বাংলাদেশ ম্যাচে ভারত তখন সবেমাত্র জিতেছে। ফেসবুকে পোস্ট হতে শুরু করল ভারত খেলায় জিতল, কিন্তু হৃদয় জিতল বাংলাদেশ। ম্যাচের আগের পরিস্থিতি ছিল সাংঘাতিক। বাংলা পক্ষের পালের গোদার নামে কথাটা রটলেও, রটনাটা ঘটনাই ছিল। এই বাঙ্গালি বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী সুকৌশলে প্রচার করছিল ভারতীয় দলের খেলোয়াড়রা সবাই ‘গুটকাখোর’, বাংলাদেশে এগারো জন বাঙ্গালি খেলোয়াড়। সুতরাং সব বাঙ্গালিরই বাংলাদেশকে সমর্থন করা উচিত। ইংল্যান্ড ভারতকে হারিয়ে দেওয়ায় সেমিফাইনালে পাকিস্তানে যাওয়ার রাস্তা কঠিন হয়ে যাওয়ায়, পাক মিডিয়া ও তাদের কিছু ক্রিকেটারের সুরে সুরে মিলিয়ে ফেসবুকে কটাক্ষ উপচে পড়ল ভারত তার প্রাক্তন প্রভুদের প্রতি ভক্তি প্রদর্শন করল বলে। এমন যে কতশত নমুনা আছে। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ভারতের কাছে বিপুলভাবে হারার পর ভারতে রানরেট চাঙ্গা হয়, সেমিফাইনালে যাবার পথ প্রশস্ত হয়, তখন সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রশ্ন ওঠে সেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ যারা এককালে ক্রিকেট দুনিয়া কাপাত, প্রথম দুটি বিশ্বকাপও জেতে, তারা কেন ভারতের সামনে এভাবে আত্মসমর্পণ করবে?
সবচেয়ে ভয়ংকর পরিস্থিতি তৈরি হলো, নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে সেমিফাইনালে ভারতের লড়ে হারার পর। একজন উচ্ছ্বসিত হয়ে লিখল : ‘দেশ যার যার, ভারতের হারে আনন্দ সবার। এক কবি, জীবনে কোনওদিন ক্রিকেট ব্যাট চোখে দেখেছে কিনা সন্দেহ, তার আনন্দ ফুটে উঠতে দেখা গেল। ব্যাটিং-এ ভারত ৫ রানে ৩ উইকেট হারাতেই আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে সে লিখত বোলিং সুইং-এর সামনে পড়তেই ভারতের ব্যাটিং জারিঝুরি শেষ। ধোনি-রবীন্দর জাদেজা সেদিন নেহাত ভাগ্যের পরীক্ষায় ব্যর্থ হয়েছিলেন, নচেৎ এই ধরনের বাচাল মূখদের অশিক্ষিতামোর জবাব পেতে বেশি সময় লাগতো না। ভাবছেন এগুলি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। ফেসবুকে কিছু অপোগণ্ডের নিজস্ব মতামত?
বিষয়টি যে এত সহজ নয়, তা জানান দিয়েছে ভারত-বিদ্বেষী ও পাক-প্রেমীদের মুখপত্র সেই দৈনিকটি। খোদা’ কবি-কন্যা ‘ডি-ফ্যাক্টো এডিটর’ ও নকশালি নিধিরাম সর্দার সম্পাদক এবং এদের সম্পাদকীয় চালাচামুণ্ডাদের জন্য এই পত্রিকার চরিত্র সবারই জানা। রবিবারে তাদের সম্পাদকীয়র তলায় কিছু সামাজিক-রাজনৈতিক বিষয় প্রকাশিত হয় রসিকতা (এই বস্তুটি আগে ছিল, এখন নিখাদ ভাঁড়ামি)-র ঢঙে অল্প কথায় কিছু লেখা প্রকাশ হয়। ভারত হারার পর সেই ভঁড়ামির অনুচ্ছেদও দেখা গেল তার চরিত্র পাল্টে ফেলেছে। ভাড়ামির রূপ দেওয়ার একটা দুর্বোধ্য চেষ্টা হলেও দেখা গেল বিষয়টা নিয়ে তাদের ‘সিরিয়াসনেস’, কিছুটা আক্ষেপের সুরেই তাদের বক্তব্য আগে ভারত। হারলে খেলোয়াড়দের কুশপুতুল পোড়ানো, বাড়ি-ঘর ভাঙচুর এসব হতো, এবার সব চুপ কেন? এরপরেই এসেছে সেই কটাক্ষ — সেমিফাইনালে হারুকগে পাকিস্তানের কাছে না হারার সান্ত্বনা? এই সংবাদপত্রের পাকিস্তান প্রেম হাল সময়ে, এটা ঠিক নয়। এই পত্রিকার এক রিপোর্টের (পরে অবশ্য তিনি ঘাড়ধাক্কা খান) তার সহকর্মীর হয়ে এইরকমই একটি ব্যঙ্গ প্রতিবেদন লিখেছিলেন। তাঁর সেই সহকর্মীটি ক্রিকেটে পাকিস্তানের হয়ে দালালি করতে গিয়ে উল্টোডাঙ্গার মোড়ে জনগণের হাতে হেনস্থার শিকার হয়েছিলেন। এদেরই সম্পাদকীয় পৃষ্ঠায় কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক ‘নিরপেক্ষ হয়ে ক্রিকেট উপভোগ করুন, ভারতকে সাপোর্ট করবেন না গোছের তত্ত্ব প্রকাশ করেছিলেন। এক খুব নামি সাংবাদিক যতদিন এদের ‘স্পোর্টস এডিটর ছিলেন ততদিন এদের ক্রীড়া প্রতিবেদন লোকে পড়তো। এখন যারা লিখছে তার একটু-আধটু খেলা বুঝলেও পাক-তাবেদার সম্পাদকীয় বিভাগের চাপে খেলার সঙ্গে রাজনীতি গুলিয়ে দিচ্ছে। ফলে সেই অখাদ্য-অপাঠ্য লেখাগুলোর ক্রীড়াপ্রেমী পাঠকও নেই।
এবার ফেসবুকে বিশ্বকাপের একটি ‘কমন ট্রেন্ড’ পাওয়া গিয়েছে, হঠাৎ করে কিছু লোক ‘ক্রিকেট-বোদ্ধা’ হয়ে গেল, যে লোকগুলির ফেসবুক ওয়ালে রাজনৈতিক উস্কানি আর মোদী বিরোধিতার মুখোশের আড়ালে দেশবিরোধিতা ছাড়া আর কিছু নেই। ভারত পাকিস্তান বা বাংলাদেশকে না হারিয়ে ওই দেশগুলি ভারতকে আড়ালে ক্রিকেট বোদ্ধার বর্ম এরা রক্ষা করতো না, ক্রিকেট ভক্তির আড়ালে যে দেশের প্রতি এদের তীব্র ঘৃণা জমে আছে তা উগরে দিয়েছে ভারতের দুর্ভাগ্যজনক ব্যাটিং বিপর্যয়ের পর। এই লোকগুলোই পুলওয়ামায় নিহত ভারতীয় জওয়ানদের শহিদের মর্যাদা দিতে আপত্তি করেছিল, প্রত্যাঘাতে ভারতীয় বাহিনী বালাকোটে জঙ্গি ঘাঁটি নিশ্চিহ্ন করার পর জঙ্গিদের প্রতি সহানুভূতি দেখিয়েছিল। এই লোকগুলিই ‘মোদী-বিরোধিতা মানে দেশ-বিরোধিতা নয়’ গোছের তত্ত্ব সামনে এনে লোকসভা জোট বিরোধীদের জেতাতে মরিয়া চেষ্টা চালিয়েছিল। ২০১৯-এর বিশ্বকাপ ক্রিকেট প্রমাণ করল এই লোকগুলি চরিত্রে আসলে পাকপন্থী ভারত-বিদ্বেষী। একথা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে পাকিস্তান ভারতকে তাদের ঘোষিত শত্রুরাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত করেছে। তাই ‘ক্রিকেটে ভারত-পাক ম্যাচে আমি নিরপেক্ষ’ এই পরিস্থিতি জঙ্গি মদতপুষ্ট পাকিস্তান রাখেনি। সুতরাং ভারতেরও তা। রাখবার দায় নেই। এক হাতে তালি বাজে না।
২০১৯-র লোকসভা নির্বাচনের সময় এদের পাক-প্রেম মোদী বিরোধিতার তত্ত্বে যাও বা কিছুটা আড়াল ছিল, নির্বাচনের কিছুদিনের মধ্যে বিশ্বকাপ ক্রিকেট তাকে বেআব্রু করল। ক্রিকেটের সঙ্গে যারা রাজনৈতিক সংযোগ ঘটাতে মরিয়া, তারাই সুচতুর ভাবে ক্রিকেটের সঙ্গে ‘দেশপ্রেম’-কে বিযুক্ত করতে সচেষ্ট। এদের চিনে রাখা জরুরি। কারণ এদেশে বসবাসকারী ঘর শত্রুরা আমাকে আপনাকে এদেশের যে কোনও সাধারণ নাগরিককে যে কোনও মুহূর্তে বিপদে ফেলতে পারে।
বিশ্বামিত্র-র কলম
2019-07-19