বাংলা ভাষায় পাষণ্ড শব্দটির অর্থ সবাই জানেন। কিন্তু পাষণ্ড নামে আসলে একটি সম্প্রদায় ছিল। সেই সম্প্রদায়ের আচরণের জন্য নির্দয় আর নিষ্ঠুর মানুষের বিশেষণ হয়ে গেল পাষণ্ড। তেমনই বাংলা ভাষায় হিপােক্রিট শব্দের প্রতিশব্দ হল ভণ্ড। কিন্তু ভণ্ড শব্দটা দিয়ে ঠিকঠাক হিপােক্রিট শব্দটার ‘পাঞ্চ’ আসে না।
বর্তমান সময়ে বাংলার একাংশ সংবাদপত্রের ভূমিকা দেখে এই হিপােক্রিট শব্দবন্ধনীটি ব্যবহার করা যেতে পারে। এসব পত্রিকাগুলির প্রাথমিক লক্ষ্য রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ ও বিজেপির আদ্যশ্রাদ্ধ করা।
যাঁরা এই গণতান্ত্রিক ভারতবর্ষের বিপক্ষে, তাঁদের আজ অস্তিত্বের সংকট উপস্থিত। ভারতীয় গণতন্ত্র এত শক্তিশালী চেহারাতে আগে কখনও আসেনি। জ্যোতি বসু, হরকিষণ সিংহ সুরজিং আর অর্ধেন্দুবিকাশ বর্ধনেরা বামপন্থকে ভারতীয় গণতন্ত্রের মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছিলেন। ভারতের সংসদে বামপন্থীদের সংখ্যা পঞ্চাশেরও বেশি হয়েছিল। আজ ধীরে ধীরে কমতে কমতে চার থেকে পাঁচ জনে ঠেকেছে। এই বামপন্থার সামনে ভরসা বস্তারের ল্যান্ডমাইন, দান্তেওয়াড়ার জওয়ান মারার সাফল্য কিষেনজির ফেলে যাওয়া জঙ্গলমহল। তাই এই অতিবিপ্লবীদের সমর্থক বুদ্ধিজীবীদের সামনেও বেশি রাস্তা খােলা নেই।
কংগ্রেস আর অতিবাম বুদ্ধিজীবীদের বাস্তুতন্ত্র তাতে নতুনভাবে যােগ দিয়েছেন কিছু প্রাক্তন আমলা। স্বাধীনতার আগে থেকেই নেহরুকে ঘিরে তৈরি হওয়া মৌচাক দেশপ্রেমিক মানুষকে ব্যথা দিয়েছিল।
প্রিয়ংবদের গ্রন্থ ভারতীয় রাজনীতিকে দো আখ্যান। এতে নেতাজি সুভাষচন্দ্র আর গান্ধীজির পত্রালাপ আছে। দুজনেই আসন্ন ক্ষমতা লাভের পরে দুর্নীতির বিষয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। স্বাধীনতার পরে ক্ষমতার মধুতে রাজনীতিকদের সঙ্গে লুটোপুটি খেতে শুরু করলেন একশ্রেণির আমলাও। ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি গান্ধীজি রাজনৈতিক দল হিসাবে কংগ্রেসকে ভেঙ্গে দিতে চাইলেন যাতে এই দলের ডিভিডেন্ড ভাঙিয়ে আর কেউ না খেতে পারে।
কাকতালীয়ভাবেই হয়তাে সেদিনের প্রার্থনাসভার পরেই নাথুরাম গডসে মহাত্মা গান্ধীকে হত্যা করল। অদ্ভুতভাবে পুলিশ, গােয়েন্দা বিভাগ কেউই আগাম কোনও আঁচ পেল না।
স্বাধীন ভারতবর্ষে ব্রিটিশ চলে গেলেও ব্রিটিশরাজের শােষণ অব্যাহত থাকল। মুষ্টিমেয় নেতা, সব সুখ ভােগ করতে লাগল। আর কোটি কোটি নিরন্ন মানুষ তার জোগান দিতে থাকল। এই বােঝাপড়ার সমীকরণে যুক্ত হয়ে গেলেন একশ্রেণির উচ্চপদস্থ আমলা। নতুন বােতলে ঢালা হতে থাকল পুরােনাে মদিরা। ১৯৪৮ সালেই সামনে উঠে এল ‘জিপ কেলেংকারী’।
১৮ মে ২০১৪ সালে ‘দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকার রবিবারের সম্পাদকীরের শিরােনাম ছিল ইন্ডিয়া: অ্যানাদার ট্রেস্ট উইথ ডেস্টিনি। সম্পাদকীয়ের প্রথম লাইনটিই ছিল, এতদিনে ইংরেজ সরকার পাকাপাকি ভাবে ভারত ছেড়ে গেল। কারণ বিগত দিনে ভারতের শাসন আসলে ইংরেজ শাসনেরই ধারাবাহিকতা ছিল।
এই প্রথম প্রকৃত অর্থে নরেন্দ্র মােদির জয় ঔপনিবেশিক যুগের অবসান ঘটিয়ে সাধারণ ভারতীয়ের হাতে ক্ষমতা এল। খুব ভালাে করে খোঁজ নিয়ে দেখুন এই লেখক প্রিয়ংবদ বা দ্য গার্ডিয়ানের সঙ্গে আরএসএসের সুদূর সম্পর্ক আছে কি না?
একশ্রেণির আমলা মমতা আর দুর্নীতির চিটগুড়ে পতঙ্গের মতো আটকে গিয়েছিলেন। একটা কথা ভেবে বলুন তাে, আমি একজন অবসরপ্রাপ্ত বা কর্মরত সরকারি কর্মচারী। আমার বিরােধী মত প্রকাশের জন্য প্রতিশােধ নিতে সরকার আমার বিরুদ্ধে সরকার কখনও রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা আনতে পারে। কিন্তু কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলকে আমি ভয় পাব কেন? সিএজি বাহাদুরকে আমার তখনই ভয় হবে যখন সরকারি আমলা রূপে আমার বা আমার পরিবারের সম্পত্তির সঙ্গে আমার আয়ের সঙ্গতি থাকবে না।
একটি দল এই বিরাট ভারতভূমিকে নির্দয়ভাবে লুণ্ঠন করেছে। এই দুর্নীতিগ্রস্ত নেতামন্ত্রীদের এঁটোকাটার ছিটেফোঁটা কিছু দুর্নীতিগ্রস্ত আমলাও পেয়েছেন বরাবর। তাই ওই দলের প্রতি তাঁদের অকৃত্রিম কৃতজ্ঞতা আছে। সেই কারণেই ১৯৭১ সালের ২৫ জুন যে জরুরি অবস্থা জারি হয়েছিল তাকে এইসব পণ্ডিত স্বাধীন বহুত্ববাদী গণতন্ত্রের উপর আঘাত বলে মনে করেন না। বাংলার লিখতেপড়তে জানা মানুষদের এতটা নির্বোধ মনে করেন এই পণ্ডিতম্মন্যরা?
এই বঞ্চিতের দল আজ মরিয়া হয়ে তাদের নখ-দাঁত বের করেছে। যে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের জন্য আজ কলকাতা-সহ পশ্চিমবঙ্গটা ভারতে আছে তাঁর চরিত্রহনে এঁরা উদ্যোগী হয়েছেন। যে মানুষটা দেশকে অখণ্ড রাখার জন্য কাশ্মীরে প্রাণ দিলেন, বাংলার সেই বীর সন্তানের নামে কলকাতা বন্দরের নাম হবে না কেন? যেসব বস্তাপচা অভিযােগ এঁরা করছেন তার সবিস্তার ব্যাখ্যা করে বই পুস্তক প্রকাশিত হয়েছে।
তথাগত রায়, অনির্বাণ গাঙ্গুলি, অবধেশ কুমার সিংহ আর তরুণ বিজয়দের পুস্তকে থেকে পর্যন্ত শ্যামাপ্রসাদের প্রতিটি কাজের বিবরণ আছে। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের উপরেও শতাধিক গবেষণামূলক পুস্তক প্রকাশিত হয়েছে। তাই সারা ভারতবর্ষে কোথাও সংঘ বা বিজেপির বিরােধীরাও কেউ আর গান্ধিজির হত্যার জন্য আরএসএস দায়ী বা সংঘ দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরােধিতা করেছে বলে অসত্য কথা বলেন না। এই কলকাতাতেই এখনও এই মিথ্যার বেসাতি চলে।
আসলে আজ দুই ভারতবর্ষ মুখােমুখি দাঁড়িয়েছে। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে মুছে দিতে চেয়েছিলেন একদল রাজনৈতিক নেতা আর তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা। মুখার্জি কমিশনের রিপাের্ট থেকে পরিষ্কার যে, ভারত স্বাধীন হবার পরেও নেতাজি বেঁচেছিলেন। মুখার্জি কমিশনে কলকাতার অধ্যাপক হরি বাসুদেবন ও পূরবী রায়ের মতাে বিশেষজ্ঞরা ছিলেন। এই কয়েকদিন আগে করােনা ছিনিয়ে নিয়ে গেল হরি বাসুদেবনকে।
কিন্তু ভালাে করে খোঁজ নিয়ে দেখুন হরি বাসুদেব বা পূরবী রায়ের মতাে ঐতিহাসিকদের সঙ্গে আরএসএসের সুদূর কোনও সম্পর্ক আছে কি না। কিন্তু এঁরা বলেছেন আর সেইসঙ্গে জাস্টিস মুখার্জি লিখিত ভাবে রিপাের্টে জানিয়েছেন যে, তাইহােকু বিমান দুর্ঘটনাতে নেতাজি সুভাষচন্দ্রের মৃত্যু হয়নি। স্বাধীনতার পরেও রাশিয়াতে নেতাজি সুভাষচন্দ্র জেলবন্দি ছিলেন। এত বছর পরে নেতাজি আর তাঁর আজাদ হিন্দ বাহিনীকে কেন্দ্রীয় সরকার স্বীকৃতি দিয়েছে। ২০১৮ সালের ২১ অক্টোবর সিঙ্গাপুরে আজাদ হিন্দ সরকারের প্রথম ত্রিবর্ণরঞ্জিত জাতীয় পতাকা উত্তোলনের স্মরণে লালকেল্লা থেকে ভাষণ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মােদি। এ এক নতুন ভারতবর্ষ।
আরেক ভারতবর্ষ এতকাল নেতাজিকে জাপানের প্রধানমন্ত্রী তােজোর কুকুর বলেছে। ড. শ্যামাপ্রসাদকে সাম্প্রদায়িক আখ্যা দিয়েছে। এই ভারতবর্ষে যেমন মিডিয়া মাফিয়া, দুর্নীতিগ্রস্ত আমলারা আছেন, মন খারাপ হওয়া তথাকথিত অতিবামপন্থী বুদ্ধিজীবী আছেন, তেমন হতাশ রাজনৈতিক নেতারাও আছেন। এঁদের সকলের পছন্দ এক ছিল, ‘বলা ভারি শক্ত সবচেয়ে ভালাে খেতে গরিবের রক্ত’। খুব মন দিয়ে ভেবে দেখুন এইসব রাজনৈতিক দল অনেক বড় বড় কথা বলেছে।
কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত কতজন তপশিলি জাতি, তপশিলি উপজাতি বা অন্য অনগ্রসর জাতির কিংবা নরেন্দ্র মােদির মতাে হতদরিদ্র পরিবারের কাউকে শীর্ষনেতৃত্বে নিয়ে এসেছে। এরা ইংরেজের ফেলে যাওয়া এলিট ক্লাবের কালচার চালিয়ে এসেছে। যে ক্লাবের দরজায় লেখা থাকত কুকুর এবং ভারতীয়দের প্রবেশ নিষেধ।
ওই ক্লাবের দরজা ভেঙে ভারত মহাসাগরের জলে ফেলে দিয়েছে আরএসএস আর বিজেপি। আজ সাধারণ ভারতবাসীর জন্য স্বাধীনতা এসেছে। নজরুল ইসলামের ভাষায়, “চির অবনত তুলিয়াছে আজ গগনে উচ্চ শির”। এই ভাৱতই জিতবে, কারণ সাধারণ মানুষ অন্যায় শোষণ আর মেনে নেবেন না।
ড. জিষ্ণু বসু