ষষ্ঠ বেতন কমিশন নিয়ে ‘ধীরে চলো’ নীতিতেই এগোচ্ছে রাজ্য সরকার। সময় নেওয়ার এই অভিযোগ শুধু বিরোধীদের নয়। তৃণমূল কংগ্রেসের সরকারি কর্মচারী সংগঠনও সম্প্রতী বলেছে, দ্রুত বকেয়া ডিএ এবং বর্ধিত বেতন দেওয়া উচিত।
রাজ্যে সরকারি কর্মীদের বেতন বৃদ্ধির দাবি দীর্ঘদিনের। ২০১৬ সালে বিধানসভা নির্বাচনের ঠিক আগে আগে ২০১৫ সালের ২৭ নভেম্বর, অর্থনীতিবিদ অভিরূপ সরকারের নেতৃত্বে ষষ্ঠ বেতন কমিশন গঠন করা হয়েছিল। কমিশনের কাজ শুরু হতেই দীর্ঘ সময় লেগে যায়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে দ্বিতীয়বার সরকার গঠনের পরে রাজ্য সরকার কর্মচারীদের জন্য ১০ শতাংশ অন্তর্বর্তী ভাতা ঘোষণা করে। এখনও পর্যন্ত মোট পাঁচ বার কমিশনের মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়েছে। লোকসভা নির্বাচনের পরে শেষবার সাত মাসের জন্য কমিশনের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে যার সময় শেষ হচ্ছে আগামী ২৬ ডিসেম্বর।
সম্প্রতী মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, ডিসেম্বরে ষষ্ঠ বেতন কমিশনের রিপোর্ট জমা পড়লে যতটা সম্ভব বেতন বাড়ানো হবে। কিন্তু বেতন বাড়াতে গিয়ে রাজ্য সরকারের জনপ্রিয় প্রকল্পের কোনওটি বন্ধ করতে চান না তিনি। এরই সঙ্গে সঙ্গে তিনি বলেন, “কমিশন এখনও কাজ শেষ করতে পারেনি। তাই সরকারও কিছু করতে পারছে না। কমিশন রিপোর্ট জমা দেওয়ার জন্য ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় চেয়েছে।” এনিয়ে তিনি কমিশনের চেয়ারম্যান অভিরূপ সরকারকে ডেকে কথা বলবেন বলেও জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। এই বক্তব্যের পরে অভিরূপ সরকার ‘দ্য ওয়াল’-কে বলেন, “কমিশন সময় চায়নি। এটা ভুল কথা। সরকারই কমিশনের মেয়াদ বাড়িয়েছে।”
কে ঠিক, কে ভুল সেটা জানার থেকেও সরকারি কর্মচারীরা চান দ্রুত জমা পড়ুক রিপোর্ট আর চাল হোক বর্ধিত বেতন। কারণ, কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীদের তুলনায় এই রাজ্যে বেতনের ব্যবধার ক্রমশই বাড়ছে।
এমনকি ত্রিপুরাতে বিজেপি সরকার কেন্দ্রের হারে বেতন চালু করেছে।
এখন কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মীদের যে বেতন কাঠামো তাতে রাজ্যে একই পদমর্যাদার কর্মী হাতে পান অর্ধেক টাকা। সপ্তম বেতন কমিশন কার্যকর হওয়ার পরে যা দাঁড়িয়েছে, তাতে আর্থিকভাবে রাজ্য সরকারি কর্মীরা রীতিমতো লজ্জাজনক জায়গায়। কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীদের জন্য সপ্তম বেতন কমিশনের সুপারিশ কার্যকর হওয়ায় সব স্তরের কর্মীর মূল বেতন ২.৫৭ গুণ বেড়েছে। ন্যূনতম মূল বেতন ৭ হাজার টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ১৮ হাজার টাকা। এই রাজ্যে এক জন গ্রুপ ডি কর্মী চাকরি শুরুর সময়ে বেতন পান মোটামুটি সাড়ে ১২ হাজার টাকা। সেখানে সপ্তম বেতন কমিশন কার্যকর হওয়ায় কেন্দ্রীয় সরকারি এক জন গ্রুপ ডি কর্মী নিয়োগের সঙ্গে সঙ্গে বেতন পাচ্ছেন ২২ হাজার টাকার মতো।
কিন্তু রাজ্যে বেতন বৃদ্ধি নিয়ে এখনও কোনও আশার আলো দেখা যাচ্ছে না। সোমবার মুখ্যমন্ত্রী যে ইঙ্গিত দিয়েছেন তাতে আগামী ডিসেম্বরে কমিশনের রিপোর্ট জমা পড়লে যতটা সম্ভব বেতন বাড়ানো হবে। কমিশনের চেয়ারম্যান জানিয়েছেন, গত এক বছরে তাঁরা সময় বাড়াতে বলেননি। এখন রাজ্য সরকার যদি ফের মেয়াদ না বাড়ায় তবে ডিসেম্বরে জমা পড়তেই পারে রিপোর্ট।
অনেকেই আশা করেছিলেন ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনের কাছাকাছি সময়ে গিয়ে কার্যকর হতে পারে বেতন কমিশনের সুপারিশ। কিন্তু অভিরূপ সরকারের দাবি সত্যে হলে তার আগে রিপোর্টই জমা নেয়নি সরকার। তাই এখন নতুন জল্পনা ২০২১ সালে পরবর্তী বিধানসভা নির্বাচনের আগে ২০২০ সালের কোনও একটা সময়ে কার্যকর হতে পারে নতুন বেতন কাঠামো। কিন্তু এখানেও রয়েছে প্রশ্ন। রাজ্যের যা আর্থিক সঙ্গতি তাতে কি কেন্দ্রীয় সরকারের হারে বেতন মিলবে?
রাজ্যে অভিরূপ সরকারের নেতৃত্বে গঠিত ষষ্ঠ বেতন কমিশন এখনও পর্যন্ত সেভাবে কাজ শুরুই করতে পারেনি বলেই খবর। নবান্ন সূত্রে খবর, আর্থিক সঙ্গতি না থাকাতেই কমিশন নিয়ে ‘ধীরে চলো’ নীতি নিয়েছে সরকার।
রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পরেই এই ‘ধীরে চলো’ নীতির কথা জানিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি সেই সময়ে বলেন, নতুন বেতন কমিশন বসিয়ে তার সুপারিশের ভিত্তিতে রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের বেতন বাড়াতে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আপত্তি নেই। কিন্তু তাদের শর্ত, এ বাবদ যে বাড়তি আর্থিক বোঝা রাজ্যের ঘাড়ে চাপবে, কেন্দ্রকেই তার দায় নিতে হবে।
কেন্দ্র যে দাবি কোনওভাবেই মানবে না সেটা বুঝে পরে অবশ্য ষষ্ঠ বেতন কমিশন গঠন করে রাজ্য। কিন্তু সেই কমিশন কতটা বেতন বৃদ্ধির সুপারিশ করতে পারে?
হিসেব বলছে, বাম আমলে ২০০৯ সালে রাজ্যে পঞ্চম বেতন কমিশনের সুপারিশ মেনে কর্মীদের বেতন ও পেনশন বৃদ্ধি হয়েছিল গড়পড়তা ৬০ শতাংশ। কিন্তু এখন কেন্দ্রের যা বেতন কাঠামো তার সঙ্গে বেতনবৃদ্ধির সমতা রাখতে গেলে প্রায় ৮০ শতাংশ বেতন বাড়াতে হবে রাজ্যকে। কিন্তু তেমনটা কি আদৌ সম্ভব?
অতটা আশা করছেন না রাজ্য সরকারি কর্মীরাও। ৩০ শতাংশ বেতন বৃদ্ধি হলেই অনেক বলে মনে করছেন তাঁরা। নবান্নের হিসেব বলছে, এখনই বেতন-পেনশন দিতে খরচ হয় বছরে প্রায় ৫৪ হাজার কোটি টাকা। নতুন হারে বেতনবৃদ্ধি কার্যকর করতে হলে সরকারের অতিরিক্ত খরচ দাঁড়াবে প্রায় ৮৫ হাজার কোটি টাকা।
বর্ধিত বেতনের দায় দিল্লির ঘাড়ে চাপাতে চেয়ে চতুর্দশ অর্থ কমিশনের কাছে টাকা চেয়েছিল রাজ্য সরকার। যুক্তি ছিল, কেন্দ্র সপ্তম বেতন কমিশন গঠন করেছে বলেই চাপে পড়ে রাজ্যকে ষষ্ঠ বেতন কমিশন গঠনের কথা ঘোষণা করতে হয়েছে। তাই বর্ধিত বেতন-কমিশনের যাবতীয় আর্থিক দায় কেন্দ্রকেই বহন করতে হবে। কমিশন অবশ্য রাজ্যের ওই দাবিতে কর্ণপাত করেনি। কারণ কোনও রাজ্যকেই এমন সুযোগ দেয় না কেন্দ্র। উল্টে অর্থ মন্ত্রক জানায়, রাজ্য সরকারকেই নিজেদের রাজস্ব আয় বাড়িয়ে এবং খরচের লাগাম টেনে বেতন বৃদ্ধির চাপ সামলাতে হবে।
২০০৯-’১০ সালে পঞ্চম বেতম কমিশনের সুপারিশ মানতে গিয়ে রাজ্যের খরচ বেড়েছিল প্রায় ২৩ হাজার কোটি টাকা। সেই ধাক্কা সামলাতে বাজার থেকে দেদার ঋণ নেয় বাম সরকার। তথ্য বলছে, ২০০৯ সালে রাজ্যের ঘাড়ে ঋণের বোঝা ছিল ১ লক্ষ ৪৫ হাজার কোটি। সেই মেয়াদি ঋণের সুদ দিতে হচ্ছে এখন। এর পরেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারের আমলে নেওয়া ঋণের চাপ রয়েছে। গত সোমবারই মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন চলতি বছরে সুদ বাবদ কেন্দ্রকে ৫২ হাজার কোটি টাকা দিতে হবে।