নানারকমের স্লোগান নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি আবারও হয়ে উঠেছে সরগরম (অবশ্যই নেতিবাচকভাবে, কারণ ইতিবাচক রাজনীতি পশ্চিমবঙ্গ দীর্ঘদিন হল ভুলে গিয়েছে)। ‘জয় শ্রী রাম’ স্লোগান শুনলেই অতিমাত্রায় উত্তেজিত হয়ে পড়ছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কারণ তিনি ও তাঁর অনুগামীদের প্রিয় স্লোগান ‘জয় বাংলা’, যদিও ‘জয় বাংলা’ হল বাংলাদেশের জাতীয় স্লোগান। কলকাতার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে নেতাজী জয়ন্তী উদযাপনের মঞ্চে এই স্লোগান দিয়েই বাংলাদেশের জয় ঘোষণা করেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী, গত ২৩শে জানুয়ারী। একথা সত্য যে সুভাষ ছিলেন অবিভক্ত ভারতের নেতাজী এবং তাঁর সময়ে বাংলাও ছিল অবিভক্ত। কিন্তু তা বলে কি অধুনা বাংলাদেশ নেতাজীকে তাদের জাতীয় বীরের তালিকায় রেখেছে? রাখে নি। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর দলের নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন জনসভায়, ভারতের সংসদে এমনকি নেতাজী স্মরণ করতে গিয়েও বাংলাদেশের জাতীয় স্লোগান তুলছেন। পশ্চিমবঙ্গের নৈকট্য বাকি ভারতবর্ষের সঙ্গে অপেক্ষাকৃত কম আর বাংলাদেশের সঙ্গেই অপেক্ষাকৃত বেশি, এমন একটি অসত্যবহ ইঙ্গিত সকলের কাছে স্পষ্ট পৌঁছে দেওয়ার উদ্দেশ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রয়াস নিরলস।
যে খবর সপ্তাহাধিককাল আগে দেশজুড়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল তা হল—ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে নেতাজী জয়ন্তী উদযাপন উপলক্ষ্যে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এক মঞ্চে উপস্থিত থেকেও নেতাজী-স্মরণে ভাষণ দিতে অস্বীকার করেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। একদল লোক তাঁর এহেন উদ্ধত আচরণকে নেতাজীর অপমান হিসাবে চিহ্নিত করেছে, কিন্তু তিনি এই অভিযোগ মানতে রাজী হন নি। আত্মপক্ষ সমর্থনে মমতা দাবি করেছেন যে – ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে নেতাজি জয়ন্তী উদযাপনে অংশ নেওয়ার আগেই পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তরফ থেকে নেতাজীর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন তিনি করেই এসেছেন, অতএব নেতাজীকে অপমান করার প্রশ্ন ওঠে না। বরং দোষ তিনি চাপিয়েছেন বিজেপির উপরেই। বলেছেন—সরকারি অনুষ্ঠানে বিজেপির রাজনৈতিক স্লোগান ওঠার কারণেই বিরক্ত হয়ে ভাষণ-বয়কট করেছিলেন তিনি।
ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে ওঠা ৩টি স্লোগানের মধ্যে, দুটি স্লোগান ছিল ‘ভারতমাতা কি জয়’ এবং ‘জয় হিন্দ’। সেই অর্থে একমাত্র ‘জয় শ্রী রাম’ স্লোগানটিকেই কি ‘বিজেপির স্লোগান’ হিসাবে চিহ্নিত করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়? কিন্তু রাম নামে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেন এতখানি উত্যক্ত হন সে প্রশ্নের আসল উত্তরের খোঁজ পেতে অনেকেই আগ্রহী। আদতে ‘জয় শ্রী রাম’ জাতিধর্ম নির্বিশেষে ভারতীয়দের স্লোগান। কিন্তু কেন এই স্লোগান বিজেপির রাজনৈতিক স্লোগানের তকমা পেয়ে গেল সেটি একটি পৃথক আলোচ্য বিষয় এবং এক্ষেত্রে অপ্রাসঙ্গিক। বাস্তবে ভারতবর্ষে শ্রীরামচন্দ্র শুধুমাত্র দেবতা নন, তিনি ভারতীয় মানুষের সমাজ-রাজনৈতিক পরিচয়েরও প্রতীক। রাম ও ভারতবর্ষ অবিচ্ছেদ্য। তাহলে ‘জয় শ্রী রাম’ স্লোগানে এত আপত্তি কেন? সম্ভাব্য আদত কারণগুলি খুঁজে বের করার প্রয়াস করব।
শ্রী রামকে অবজ্ঞা করার প্রবণতাটি পশ্চিমবঙ্গে কয়েক দশকের ধারাবাহিক প্রয়াসের পরিণাম। এর সূচনা হয়েছিল কম্যুনিস্টদের দ্বারা, আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সময়ে এসে তা ধারণ করেছে বিকট রূপ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জমানায়, পশ্চিমবঙ্গের সরকারী বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণীর পাঠ্য পুস্তকে রঘুবীর শ্রী রামচন্দ্র বর্ণিত হয়েছেন যাযাবর চরিত্র হিসাবে। “অতীত ও ঐতিহ্য” শীর্ষক ষষ্ঠ শ্রেণির ইতিহাস বইয়ে বলা হয়েছে ‘রাম’ শব্দটির সংস্কৃত অর্থ ‘রোমিং’ এবং সংস্কৃত শব্দ ‘রাম’ এসেছে ইংরেজি শব্দ ‘রোমিং’ থেকে এসেছে কারণ উভয়েরই অর্থ একই — ভ্রমন। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ক্লাস সিক্সের পাঠ্যপুস্তক অবলীলায় পরিবেশন করেছে এমনই এক মিথ্যা আখ্যান এবং ‘রাম’ শব্দের চরম ভ্রান্ত ভাষাগত ব্যাখ্যা। ‘যাযাবর রাম ঘুরতে ঘুরতে এসে গিয়েছিলেন আমাদের দেশে এবং ধীরে ধীরে পরাস্ত করেছিলেন এদেশের আদি বাসিন্দাদের’—এমত বিকৃতি ছড়ানোর সুবিধার্থেই হয়ত বাল্মীকি রামায়নের কোনো বিদগ্ধ রেফারেন্স দেওয়াই হয় নি সরকারি পাঠ্যপুস্তকে। কিন্তু কেন পশ্চিমবঙ্গে বিকৃত করা হল শ্রীরামচন্দ্রকে? কি প্রয়োজন ছিল শিশুমনে এমন কদর্য মিথ্যাচারের কালিমা লেপন করার? সম্ভাব্য উত্তর রয়েছে এ রাজ্যের ইতিহাসের মধ্যে।
১৯৪৭-এ অবিভক্ত ভারতবর্ষের বিভাজনের সময় মুসলিম লীগ চেয়েছিল গোটা বঙ্গপ্রদেশকেই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করতে। অবিভক্ত বঙ্গপ্রদেশের জনবিন্যাস তখন অন্যরকম ছিল। ১৯৪১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী সেখানে ছিল ৪১.২০% হিন্দু এবং ৫৫.৬৫% মুসলমানের বাস, আর ১৯৫১ সালের আদমশুমারিতে এসে সেই হিসেব গিয়ে দাঁড়ায় ৪২.৩৮% হিন্দু এবং ৫৬.৪৮% মুসলমানে। ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় এবং বাংলার অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় পশ্চিমবঙ্গের সৃষ্টি হয় হিন্দু হোমল্যান্ড হিসেবে অবিভক্ত বঙ্গপ্রদেশের হিন্দুদের জন্য এবং তা ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়। হিন্দু বাঙালীর পক্ষে ইসলামিক পূর্ব পাকিস্তানে সাংস্কৃতিক অস্তিত্ব রক্ষা করে, সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকা সম্ভব ছিল না। কিন্তু অবিভক্ত বঙ্গপ্রদেশের এমন একটি লোভনীয় অংশ হারানোর পর রাজনৈতিকভাবে হিংস্র হয়ে ওঠে মুসলিম লীগ। কলকাতা দখল ছিল তাদের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। তৎকালীন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় সমৃদ্ধতম শহর কলকাতাকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করতে উৎসুক ছিলেন মহম্মদ আলী জিন্নাহ। তদুপরি, জওহরলাল নেহেরুও গোটা বঙ্গপ্রদেশকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করতে আপত্তি করেন নি মোটেই এবং ব্রিটিশরাও চেয়েছিল তেমনই। (নেহেরু ও ব্রিটিশরা কেন এমন চেয়েছিলেন তা দুটি পৃথক বিষয়, যা এখানে আলোচ্য নয়) যাই হোক, যদিও পশ্চিমবঙ্গকে হিন্দু বাঙালীর স্বভূমি হিসাবে তৈরি করা হয়েছিল, তৎসত্ত্বেও মুসলিম লীগের নজর সর্বদাই ছিল এই রাজ্যের উপর। শ্যামাপ্রসাদের রাজনৈতিক চালে ১৯৪৭ সালে অবিভক্ত বাংলা দখলের লড়াইয়ে সাময়িকভাবে তারা হেরে গেলেও পশ্চিমবঙ্গ দখলের যুদ্ধ তারা জারি রাখে। ‘যেন তেন প্রকারেন’ যে কোনও সময় পশ্চিমবঙ্গ দখল করার স্বপ্ন তারা দেখতে থাকে।
মুসলিম লীগের রাজনৈতিক উত্তরসূরীরা পশ্চিমবঙ্গের শাসকদলের সাথে গড়ে তোলে এক রাজনৈতিক বোঝাপড়ার সম্পর্ক। এমন সম্পর্ক তৈরি করতে তাদের কোনো অসুবিধা হয় নি কারণ ষাটের দশকের গোড়া থেকেই পশ্চিমবঙ্গের সমাজ-রাজনীতি ও ভাবজগতের ওপর চেপে বসছিল কমিউনিজম এবং ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি ভারতের স্বাধীনতার প্রধান শর্ত হিসাবে ইসলামিক পাকিস্তান গঠনের পক্ষে সোচ্চার দাবী তুলেছিল। ভারত-বিভাজনের সময় এদেশের কম্যুনিস্টরা ছিল মুসলিম লীগের ‘সপক্ষের লোক’। এহেন কম্যুনিজম-অধ্যুষিত একটি রাজ্যের শাসকদলের সাথে রাজনৈতিক বোঝাপড়ার সম্পর্ক গড়ে তুলতে কোনো অসুবিধা লীগের রাজনৈতিক উত্তরসূরীদের হওয়ার কথা নয়, হয়ও নি। ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনের পর পশ্চিমবঙ্গের কম্যুনিস্টদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে ২২১৬.৭ কিলোমিটার দীর্ঘ, প্রায়-উন্মুক্ত পশ্চিমবঙ্গ- বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে অনবরত পশ্চিমবঙ্গে অনুপ্রবেশ করেছিল বাংলাদেশী মুসলিমরা এবং ১৯৭৭ সাল থেকে পশ্চিমবঙ্গের কমিউনিস্ট শাসক সব দেখেও না দেখার ভাণ করে ছিল। সেটিই ছিল লীগের রাজনৈতিক উত্তরসূরীদের সঙ্গে এ রাজ্যের কম্যুনিস্টদের সূক্ষ্ম রাজনৈতিক বোঝাপড়া। ক্রমাগত অনুপ্রবেশ হিন্দু-হোমল্যাণ্ড পশ্চিমবঙ্গের জনবিন্যাসকে নীরবে বদলে দিয়েছিল কম্যুনিস্টদের পরোক্ষ সহযোগিতায়। ইন্দো-বাংলাদেশ সীমান্ত ধরে অবিচ্ছিন্ন মুসলিম অনুপ্রবেশ ছিল পশ্চিমবঙ্গ দখলের একটি গেরিলা কৌশল। মুসলিম লীগের উত্তরসূরী এই ইসলামপন্থীরাই পশ্চিমবঙ্গে রাম-বিরোধিতার বর্তমান মূল চালিকাশক্তি বলে বোধ হয়। প্রশ্ন উঠতেই পারে যে ইসলামপন্থীরা কেন শ্রীরামের অবমাননা করতে এতখানি উদগ্ৰীব হবেন? উত্তর হল—হবেন কারণ শ্রীরামচন্দ্রের আদর্শ একমাত্রিক ইসলামিক সংস্কৃতির বিপরীত মেরুতে অবস্থান করে। বলা যেতে পারে শ্রীরামই হলেন মৌলবাদী ইসলামিক রাজনীতির অ্যান্টিডোট বা প্রতিষেধক।
মর্যাদা পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীরামচন্দ্র ভারতীয় পুরুষের আদর্শ। বলিষ্ঠ, সাহসী, শক্তিশালী ও কৌশলী হওয়ার পাশাপাশি তিনি পরম শৃঙ্খলাপরায়ন ও সামাজিকভাবে দায়বদ্ধ। সামগ্রিক সমাজকল্যাণে ব্যক্তিগত সবকিছু উৎসর্গ করতে প্রস্তুত শ্রী রাম। তিনি মর্যাদা পুরুষোত্তম। কার্যক্ষেত্রে ভুল করেছেন, কিন্তু নিজ ভুলের দায় স্বীকার করতে পিছপা হন নি, নিজের বিরুদ্ধে ওঠা কোনো অভিযোগকে অস্বীকারও করেন নি। পুরুষোত্তম রাম ভারতীয় পৌরুষের প্রতীক, ভারতীয় পুরুষের আদর্শ। “হরে রাম হরে রাম, রাম রাম হরে হরে, হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে” বাংলার প্রতিটি সাধারণ মানুষের মুখে উচ্চারিত মন্ত্র। এ রাজ্যের অনেকেই দীক্ষা মন্ত্র হিসেবেও পেয়েছেন রাম মন্ত্র। এমন এক চরিত্রের আধ্যাত্মিক সুরক্ষা বজায় থাকলে সাধারণ বাঙালী সমাজকে ইসলামের দিকে আকর্ষণ করা অসম্ভব। সুতরাং, পশ্চিমবঙ্গে, কমিউনিস্ট এবং তাদের উত্তরসূরী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় উভয়েই শ্রীরামের প্রতি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কদর্য প্রচার করেছেন। রঘুবীর শ্রী রামচন্দ্র অবিভক্ত বেঙ্গল প্রভিন্সের ইসলামীকরণের অ্যাজেণ্ডার পথে আদর্শগত ও আধ্যাত্মিক বাধা।
শুধুমাত্র আধ্যাত্মিক শক্তি নয়, শ্রীরামচন্দ্র অপরিসীম শারীরিক শক্তি, বীরত্ব এবং শৌর্যেরও প্রতিমূর্তি। কোনও সাধারণ মানুষ যদি এইসমস্ত গুণাবলীর অধিকারী হওয়ার চেষ্টা করে তবে উগ্র ইসলামপন্থীদের পক্ষে তা অনুকূল নয়। শারীরিকভাবে শক্তিশালী পুরুষকে সহজে বশ্যতা স্বীকার করানো যায় না। উপরন্তু বাঙালী হিন্দু জাতি শ্রীরামচন্দ্র ও মহাবীর শ্রীহনুমানের আদর্শে শারীরিক শক্তি অর্জন করলে, তাদের বিরুদ্ধে ইসলামিক ধাঁচের গণহত্যা চালানোও সহজ হবে না। সুতরাং, ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে, পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চ্যাটার্জী জানিয়েছিলেন যে ‘লাঠিখেলা’কে পশ্চিমবঙ্গের কোনো স্কুলে শারীর শিক্ষা সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করার অনুমতি দেওয়া হবে না। লাঠিখেলার মত শারীরিক সক্ষমতা ও ক্ষিপ্রতার চর্চাকে ‘ধর্মীয় উগ্রবাদ’ বলে অভিহিত করেছিলেন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। কমিউনিস্টরাও বাংলার ঐতিহ্যবাহী কুস্তি, লাঠিখেলা ও শারীরিক কসরতের ব্যাপারে বাঙালীকে নিরুৎসাহিত করেছিল। কিন্তু কেন? সম্ভবত সাধারণ বাঙালী পুরুষকে শারীরিকভাবে দুর্বল ও ভীরু করে তোলার জন্য । একই পদ্ধতি অনুসরণ করেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন সরকারও।
মুসলিম লীগের যেসব রাজনৈতিক উত্তরসূরীরা আজও পশ্চিমবঙ্গ দখলের জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে, তারা চারিত্রিক দিক থেকে উগ্ৰ প্রকৃতির। শ্রীরামচন্দ্র তাদের কাছে এক সুবিশাল আধ্যাত্মিক বাধা। এরাজ্যে তাদের প্রবেশের পথ প্রশস্ত করেছিল কম্যুনিস্টরা আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নির্বাচনে জয়ী হওয়ার জন্য এই গোষ্ঠীটিকে সরাসরি তুষ্ট করে চলার বিপজ্জনক পথ অবলম্বন করেছেন। এরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সরবরাহ করেছে তাঁর ভোট ব্যাঙ্ক, সীমান্তের ওপার থেকে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের পশ্চিমবঙ্গে ঢুকিয়ে। পরিবর্তে দাবী করেছে সমাজ-রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের ইসলামীকরণ। এইভাবেই পশ্চিমবঙ্গ দখল করার সত্তর বছর আগেকার পরিকল্পনা কার্যকর করার প্রয়াস বজায় রেখেছে ইসলামিক লবি। বিগত ছয় দশক ধরে বাঙালী ভদ্রলোক সমাজের গ্রুমিং হয়েছে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কম্যুনিস্ট আদর্শে। কম্যুনিস্ট গ্রুমিং তাঁদেরকে চিন্তনগতভাবে সরিয়ে নিয়ে গেছে তাঁদের মূল ধর্ম-সাংস্কৃতিক পরিচয় থেকে দূরে, এমনকি উস্কানি দিয়েছে হিন্দুত্বের বিরুদ্ধে যাওয়ার জন্যও। ফলস্বরূপ, তাঁরা হয় রাজ্যে কট্টরপন্থী ইসলাম আগ্রাসনের আসন্ন বিপদ চিহ্নিত করতেই ব্যর্থ হয়েছেন অথবা এরাজ্যের বহু তথাকথিত বিদগ্ধজন হয় ভয়ে অথবা অর্থের বিনিময়ে সে বিপদকে উপেক্ষা করে ক্রমাগত দাঁড়িয়েছেন কম্যুনিস্ট শাসক ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশে। ইসলামপন্থীদের নীরবে প্রশ্রয় দিয়ে এ রাজ্যে তাদের জন্য এক উর্বর ভূমি তৈরী করেছিল কম্যুনিস্টরা। তাদের উত্তরসূরী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর আপোষহীন ও আক্রমণাত্মক মনোভাব নিয়ে এই লবিকে ব্যবহার করেছেন নিতান্তই ব্যক্তিগত ক্ষমতার লোভে। ফলে পশ্চিমবঙ্গ হয়ে পড়েছে সমাজ-সাংস্কৃতিকভাবে বিপদগ্রস্ত।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সময়ে এসে, বাংলা ভাষাও হয়ে পড়ছে বিকৃত। বাংলা ভাষার শব্দভাণ্ডারে আরবি ও উর্দু শব্দের অবাধ প্রবেশের ফলে পৃথিবীর সমৃদ্ধতম ও সুমিষ্টতম ভাষাটির সাবলীলতা ও সৌন্দর্য বিঘ্নিত ও বিনষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়েছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমবঙ্গ সরকার এ রাজ্যের স্কুল পাঠ্যক্রমে এই বিকৃত বাংলাভাষাকে শুধু অন্তর্ভুক্তই করেনি, বাংলাভাষার ধ্বনিগত, আধ্যাত্মিক ও গুণগত বিকৃতিকে অফিসিয়ালি অনুমোদন করার ধৃষ্টতাও দেখিয়েছে। এই সকল ঘটনা পর্যবেক্ষণের প্রেক্ষিতে এমন সন্দেহ না করার কোনো কারণ নেই যে ইসলামপন্থী ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মধ্যে একটি অশুভ, স্বার্থান্বেষী আঁতাত তৈরি হয়েছে। পাঠকদের মনে করিয়ে দেওয়া যেতে পারে যে ২০১৮ সালের অক্টোবর মাসে কলকাতার এক সভায় পশ্চিমবঙ্গের ইমাম অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে দাবি তোলা হয়েছিল যে কলকাতার পুলিশ কমিশনার মুসলিমদের মধ্য থেকে নির্বাচন করতে হবে। সেই সঙ্গে ইমাম ভাতার ১০০% বৃদ্ধিও তাঁরা দাবী করেছিলেন। কোভিড মহামারী চলাকালীন ইমামরা চিঠি লিখে মুখ্যমন্ত্রীকে পরামর্শ দিয়েছিলেন যে ঈদ-উল- ফিতর উৎসব পালন করার সুবিধার্থে মুখ্যমন্ত্রী যেন লকডাউন শিথিল করার সিদ্ধান্ত না নেন, কারণ মহামারীর বছরে ইমামরা ঈদ-উল-ফিতর উৎসব ধুমধাম করে পালন করতে চাইছেন না। এই ইমামরাই আবার মহামারী সত্ত্বেও বকরি ঈদ বিনা বাধায় পালনের দাবিও জানিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রীর কাছে। এইধরণের প্রতিটি দাবি মুসলিম ধর্মগুরুরা জানিয়ে থাকেন প্রেস কনফারেন্স করে এবং মুখ্যমন্ত্রীকে সরাসরি পত্রপ্রেরণের মাধ্যমে। অযাচিত পরামর্শ দেওয়ার মাধ্যমে এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে কার্যতঃ নিজেদের অঙ্গুলিহেলনে পরিচালনা করার ধৃষ্টতা পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম ধর্মগুরুরা অনবরত প্রর্দশন করে গিয়েছেন। তাঁদের শেখানো বুলিই বুঝি সরকারী সিদ্ধান্ত হিসাবে গৃহীত ও প্রকাশিত হয়েছে প্রায়শঃই।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আমলে পশ্চিমবঙ্গ এভাবেই পরিণত হয়েছে এক মুসলিম-ধর্মগুরু-নিয়ন্ত্রিত রাজ্যে। ইমামরাই বোধ করি সাহস জোগাচ্ছেন মমতা ব্যানার্জীর ভোট ব্যাংক ভরিয়ে তাঁকে ভোটে জয়ী করার আশ্বাস দিয়ে। সুতরাং, এই ক্ষমতাপ্রদায়ক, পৃষ্ঠপোষক গোষ্ঠীটিকে অমান্য বা বিরক্ত করার সৎসাহস তাঁর নেই। এদেরকে তুষ্ট করে চলার তাগিদই বোধ হয় ‘জয় শ্রী রাম’ ধ্বনির প্রতি অসহিষ্ণু হতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বাধ্য করেছে। রঘুবীর শ্রীরামচন্দ্র ও উগ্ৰ ইসলাম হল আদর্শগত দিক থেকে দুই বিপরীতমেরুর ধারণা এবং এই দুই ভাবধারা কখনো একত্রিত হতে পারে না। জনকেন্দ্রিক, বহুমাত্রিক রামরাজ্যের স্লোগান ‘জয় শ্রী রাম’। সহস্রাব্দ-প্রাচীন অথচ চিরনূতন ভারতধর্ম পালনের শপথবাণী ‘জয় শ্রী রাম’। কিন্তু যাঁরা ধর্মগুরু-নিয়ন্ত্রিত, স্বার্থান্বেষী ও একমাত্রিক খিলাফতের পৃষ্ঠপোষক, তাঁরা কি কদাপি শ্রীরামচন্দ্রের জয়গান করতে পারেন?
দেবযানী ভট্টাচার্য্য