পশ্চিমবঙ্গ: শ‍্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের রাজ্যের ঐতিহ্যকে নষ্ট করার ষড়যন্ত্র করছে কারা?

বিজেপির জাতীয় নেতারা ভারতের প্রতি বাংলার সাংস্কৃতিক, নৈসর্গিক ও আধ্যাত্মিক অবদান ইত্যাদির প্রশংসা করছেন, কিন্তু আজকের পশ্চিমবঙ্গ আদতে তার অতীত গৌরবের ধ্বংসাবশেষমাত্র।

• শুধুমাত্র একটি শপিংমল বানানোর জন্য বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যবহৃত জিনিসপত্র ক্রমাগত ক্ষতিগ্রস্ত ও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁর বাড়িটি বা নিদেনপক্ষে তাঁর ব্যবহৃত জিনিসপত্র রক্ষার্থেও কোনো প্রকৃত উদ্যোগ গ্ৰহন করেনি।

• বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুত্রবধূর বাড়ি ‘আরন‍্যক’ -এর প্রতি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উপেক্ষা ধীরে ধীরে সেটিকে ধ্বংসের মুখে নিয়ে যাচ্ছে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেল পদক চুরি হয়ে গিয়েছে, সাম্প্রতিক অতীতে ‘বুলডোজার’ দিয়ে ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছে বিশ্বভারতীর গেটটিও, অন‍্যদিকে ক্ষতি করা হচ্ছে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উত্তরাধিকারীর বাড়ির। কারা পশ্চিমবঙ্গের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নষ্ট করার ষড়যন্ত্র করছে?

•হিন্দু হোমল্যান্ড থেকে হিন্দু গরিমার চিহ্ন অপসারণের প্রচেষ্টা কি তবে পশ্চিমবঙ্গের​ আন্তঃসীমান্ত-সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের লক্ষণ?

২০২১ সালের বিধানসভা ভোটের পাঁচ মাস আগে, রাজনৈতিকভাবে পশ্চিমবঙ্গ রয়েছে এক অসহায় অন্তর্বর্তী অবস্থানে। পাঁচ মাস পর হয় রাজ্যটি সুনিশ্চিত ও সচেতনভাবে আত্মঘাতী হবে নয়ত আত্ম উদ্ধারের পথে চলতে মনস্থ করবে। কি হতে চলেছে তা স্থির করবে আগামী নির্বাচনের ফলাফল। স্বাধীনতার সময় থেকেই পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যটি রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের শিকার। ফলতঃ অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি বাঙ্গালা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বুদ্ধিগত এবং আধ‍্যাত্মিক দিক থেকেও। অবিরাম ‘ব্রেইন-ড্রেন’ এর অন্যতম মূল কারণ। যদিও বিজেপির জাতীয় নেতারা ভারতের উপর বাংলার সাংস্কৃতিক, নৈসর্গিক ও আধ্যাত্মিক অবদান ইত্যাদির প্রশংসা করছেন, কিন্তু আদতে বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ তার অতীত গৌরবের​ ধ্বংসাবশেষমাত্র। বাংলার জনগণের একটি বিরাট অংশ আপন ভালো-মন্দ বোঝার ক্ষমতা পর্যন্ত হারিয়ে ফেলেছেন বলে প্রতীত হয়। অসার রাজনীতি বাংলার মেধার গ্রাফটিকে অধঃপতিত করেছে।

শ্রীমতী মিত্রা​ বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেকে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুত্রবধূ বলে দাবি করে ফেসবুকে একটি পোস্ট লিখেছিলেন। সুকান্ত সদন অডিটোরিয়াম সংলগ্ন ব্যারাকপুর রেলস্টেশনের​ কাছে তাঁদের বাড়ি ‘আরণ্যক’ ভেঙে পড়ছে কারণ তাঁদের বাড়ির পিছনের প্রাচীরের সীমানায়​ গত দু’বছর ধরে গড়ে উঠছে একটি শপিংমল। বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের অনুমতি না নিয়েই তাঁদের বাড়ির পিছনের বাউণ্ডারি ওয়াল ভেঙে দেওয়া হয় বলে মিত্রাদেবীর অভিযোগ। বারবার পৌর প্রশাসনের কাছে আবেদন জানিয়েও লাভ হয় নি। ব্যারাকপুর পৌরসভার চেয়ারম্যান মিত্রা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ির ক্ষতিগ্রস্ত অংশের মেরামত/ বা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন, কিন্তু সে প্রতিশ্রুতি কার্যকরী হয় নি। মিত্রা​ বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন যে তাঁদের বাড়ির এক অংশ যে কোনও দিন ভেঙে পড়ে বাড়ির লোকজনের মৃত্যু ঘটতে পারে। এ বিষয়ে তাঁরা ও প্রতিবেশীরা ভীত ও উদ্বিগ্ন।

ফেসবুকে এই ব‍্যাপারে বিস্তৃতভাবে লেখার পর তিনি আরও জানান যে লেখক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যবহৃত​ অতীতের​ বহু দ্রব‍্যসামগ্ৰী বিধ্বংসী নির্মাণ কাজটির কারণে ইতিমধ্যেই নষ্ট হয়ে গিয়েছে। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যবহৃত সমস্ত জিনিস সংরক্ষণের​ যোগ‍্য হলেও, কেবলমাত্র​ শপিংমল তৈরির জন্য সেগুলি একে একে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার বাড়ি বা অন্ততঃপক্ষে ঐ ব্যবহৃত অমূল্য দ্রব্যসামগ্রীর রক্ষার্থে কোনো উদ্যোগই​ নেয়নি। বঙ্গসমাজ যদি সত্যই জীবিত থাকত, তবে এমত ক্ষতির সম্ভাবনা থাকতো না। তাহলে কি এই ঘটনা পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান অভিজাত সমাজের​ অসংবেদনশীলতার দিকে ইঙ্গিত করছে? এ কি বাংলার মেধার দৈন্যেরই প্রকট প্রদর্শন?

যাঁরা বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে জানেন, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে তাঁরা জানেন। তাঁদের কাছে এই সাহিত্যিকের পরিচয় আলাদাভাবে দেওয়ার কিছু নেই। বাঙালী মানসিকতায় তাঁর প্রভাব কী ছিল, তা-ও তাঁরা নিশ্চয়ই জানেন। সত্যজিৎ রায়ের অমর সৃষ্টি, ‘পথের পাঁচালী’ শ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়েরই উপন্যাস ”পথের পাঁচালী”-অবলম্বনে সৃষ্ট। সত্যজিৎ রায়ের প্রথম রঙিন চলচ্চিত্র “অশনি সংকেত” ও বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত “অশনি সংকেত”- উপন্যাসের চিত্রায়ন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং ১৯৪৩ সালে বাংলার মহাদুর্ভিক্ষের প্রাক্কালে একজন পুরোহিতের​ জীবন কিভাবে পরিবর্তিত হয়েছিল সেই ছবিই চিত্রিত হয়েছে বিভূতিভূষণের উপন‍্যাস ও সত্যজিতের চলচ্চিত্রে। যাঁরা বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন তাঁদের জন্য হয়তো এইটুকু তথ্যপরিচিতি প্রয়োজনীয় ছিল। আর যাঁরা বিভূতিভূষণকে জানেন তাঁরা জানেন যে স্টলওয়ার্ট ঐ সাহিত্যিকের অগণিত অমর সৃষ্টি মানবমনকে কি গভীর আবেগ এবং কতখানি অন্তহীন আধ্যাত্মিকতার অনুভূতি প্রদান করার ক্ষমতা রাখে।

বিভূতিভূষণ প্রকৃতির মাধ্যমে আধ্যাত্মিকতাকে স্পর্শ করেছেন। প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যেকার ঐশ্বরিক সংযোগের চিত্রায়ণ করেছেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর সাহিত্যে। শ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালী’তে “পথ” হল প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে, জন্ম থেকে জন্মান্তরে, দেশ থেকে দেশান্তরে, লোক থেকে লোকান্তরে, নক্ষত্রলোক থেকে নক্ষত্রলোকান্তরে অশেষ যাত্রার পথ। আত্মা এবং ‘পথের’ এক চিরন্তন যাত্রার ছবি তিনি এঁকেছেন, যে পথ অমরত্বের দিক নির্দেশ করে। এইরকম সাহিত্যিকের​ পুত্রবধূ বর্তমান পশ্চিমবঙ্গে তাঁর বাড়িকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য কাঁদছেন। বাঙালীর কি এখনও তার সংস্কৃতি ও বুদ্ধি নিয়ে গর্ব করা উচিত?

যে বাড়ি ভেঙে পড়ছে তার নাম আরণ‍্যক। যাঁরা আরণ্যক পড়েছেন, তাঁরা সম্ভবতঃ ধাক্কাটি নিতে পারবেন না। মানুষ ও প্রকৃতি একত্রে অন্তর্নির্মিত, উভয়ের আত্মা চিরন্তন, একীভূত — বাঙালি ‘ক্লাসিক’ উপন্যাস আরণ‍্যক-এ চিত্রিত​ হয়েছে। বাঙালীর​ মন সংবেদনশীল ছিল, কিন্তু আর নেই। বর্তমান পশ্চিমবঙ্গে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের গেট ‘বুলডোজ’ করা হবে, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুত্রবধূ তাঁর বাড়ি বাঁচানোর জন্য সোশ্যাল মিডিয়ায় চিৎকার করে কাঁদবেন, আর বাঙালী চুপ করে ঘরে বসে পপকর্ন খেতে খেতে তৃতীয় শ্রেণীর রিয়্যালিটি শো দেখবে। বিশ্বভারতীর গেটের স্থাপত্যের​ নকশাটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেই অনুমোদন করেছিলেন। এটি বিশ্ব ভারতীর নিজস্ব নকশা এবং এই নকশাই রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের লোগোতেও। সেই গেট যে ভাঙ্গা হল, (বুলডোজার চালানোর মধ্যে যে জিঘাংসা ফুটে উঠেছিল, তা কি ভোলার?) সেই ধ্বংস যে ইচ্ছাকৃত, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। এমত ইচ্ছাকৃত ধ্বংসের কী কোনো​ তাৎপর্য নেই?

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুত্রবধূর বাড়ির এই অবস্থার খবর সংবাদ টিভি চ্যানেলগুলি প্রচার করেছিল, কিন্তু রাজ‍্য সরকার তা সত্ত্বেও কোনও ইতিবাচক, সফল পদক্ষেপ নেয়নি। এগুলিকে বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র বলে সন্দেহ না করার কোনও কারণ নেই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেল পদকটি চুরি হয়ে গিয়েছে, বিশ্বভারতীর গেট ‘বুলডোজড’ হয়েছে, আবার অন্যদিকে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উত্তরাধিকারীর বাড়িও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কারা পশ্চিমবঙ্গের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নষ্ট করার ষড়যন্ত্র করছে? হিন্দু হোমল্যান্ড থেকে হিন্দু গরিমার চিহ্ন অপসারণের প্রচেষ্টা কি তবে পশ্চিমবঙ্গের​ আন্তঃসীমান্ত-সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের লক্ষণ?

বর্তমান রাজ‍্য সরকারের থেকে প্রয়োজনীয় সহায়তার আশ্বাস পেলেও আদত সহায়তা না পেয়ে, পশ্চিমবঙ্গের মানুষ এই বাড়ি এবং সাহিত্যিকের স্মৃতিবিজড়িত অমূল্য সব জিনিসপত্র রক্ষার্থে ব্যারাকপুরের সাংসদ শ্রী অর্জুন সিংয়ের সাহায্য দাবি করেছেন। শ্রী জে পি নড্ডার সাম্প্রতিক দাবি অনুযায়ী বিজেপি পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি শ‍্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের রাজ্য ও ঐতিহ্যের প্রতি ভারতীয় জনতা পার্টি চিরদায়বদ্ধ। তিনি এ-ও বলেছেন যে এ রাজ্যের সর্বপ্রকার বিশেষত্ব রক্ষা করার ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের সত্যিকারের রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী বিজেপিই। এই জাতীয় দাবির সত্যতা প্রমাণার্থে বিজেপির উচিত আরণ্যক বাড়িটির রক্ষার্থে উদ্যোগী হওয়া। শ‍্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বেঁচে থাকলে এ কাজ করতেন। গেরুয়া শিবির যদি বাংলার আত্মাকে, বাংলার আবেগকে সত্যই স্পর্শ করতে চায় তবে তাদের জন্য এই বিষয়টি অত‍্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।

দেবযানী ভট্টাচার্য্য
Debjani Bhattacharyya

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.