সেনাবাহিনীর নিয়োগে বেহাল অবস্থানে পশ্চিমবঙ্গ

নদিয়ার এক গণ্ডগ্রামের ছেলে সুরেশ বিশ্বাস (১৮৬১-১৯০৫) দেশত্যাগ করে কীভাবে বিভিন্ন দেশ ঘুরে ব্রাজিলে পৌঁছেছিলেন, সে এক রূপকথার মত কাহিনী। যোদ্ধা হিসাবে সে দেশে সম্মান ও কর্ণেল উপাধি পেয়েছিলেন। তাঁর নামে চিহ্ণিত হয়েছে রাস্তা। ইন্দ্রলাল রায় ছিলেন (২ ডিসেম্বর ১৮৯৮ – ১৮ জুলাই ১৯১৮) প্রথম ভারতীয় বাঙালি বিমান চালক এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী একমাত্র ভারতীয় বৈমানিক। তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তির পক্ষে যুদ্ধ করে মারা যান। ফ্রান্সের পক্ষ হয়ে জার্মানির বিপক্ষে বেশ কয়েকটি সামরিক অভিযানে যুদ্ধবিমান চালনায় দক্ষতার পরিচয় দেন। কাজী নজরুল ইসলামও ছিলেন সেনাবাহিনীতে। আজ এ সবই হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস। যুদ্ধে বাঙালি এখন কোথায়? তার ওপরেই আলোকপাত এই লেখায়।

সেনাবাহিনীতে নিয়োগে ভারতের রাজ্যতালিকায় যথেষ্ঠ নিচের দিকে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। এ রাজ্যের প্রাক্তন সেনাকর্তাদের অনেকের বক্তব্য, এই ছবিটা আরও ইতিবাচক হওয়া দরকার। যদিও আশার কোনও হদিশ মেলেনি।

সেনাবাহিনীর ‘অগ্নিপথ’ প্রকল্প নিয়ে ক’দিন ধরে দেশের বিভিন্ন জায়গায় প্রবল অশান্তি দেখা দিয়েছে। এর পরেই জনমানসে প্রশ্ন উঠেছে, দেশের কোন অঞ্চল থেকে কী ধরণের নিয়োগ হচ্ছে। নিয়োগ পদ্ধতিটাই বা কী? ২০২০-র ১১ মার্চ লোকসভার প্রশ্নোত্তরপর্বে প্রতিরক্ষামন্ত্রকের তরফে জানানো হয়,
২০১৭ থেকে ২০১৯-এর মধ্যে ভারতীয়ের প্রতি ১০ লক্ষ জনসংখ্যার মধ্যে সেনাবাহিনীতে কাজ পেয়েছেন গড়ে ৩৭ জন।

তালিকায় সবচেয়ে ওপরে রয়েছে হিমাচল প্রদেশ। উল্লেখিত সময়সীমায় ওই রাজ্যে প্রতি ১০ লক্ষ জনসংখ্যার মধ্যে সেনাবাহিনীতে গড়ে ৪০২ জন কাজ পেয়েছেন। এর পরে উত্তরাখন্ড— ২৭১জন।৩০টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের তালিকায় ২২ নম্বর স্থানে যুগ্মভাবে আছে পশ্চিমবঙ্গ ও দিল্লি— ১৯ জন। সবচেয়ে নিচে গোয়া— ৪ জন। এর ঠিক ওপরে
ওড়িশা— ১৪ জন। তালিকায় চন্ডিগড়, লাদাখ ও লাক্ষাদ্বীপের কোনও হিসেব নেই। তবে প্রতিবেশী নেপালের ৬৩ জনের উল্লেখ আছে।

———এটা একটা তালিকা করে নিতে হবে—————
সেনাবাহিনীতে নিয়োগে ভারতে কে, কোথায়

অন্ধ্রপ্রদেশ ২৬
অরুণাচল প্রদেশ ১২৭
অসম ২৩
বিহার ২২
ছত্তিশগড় ২১
গোয়া ৪
গুজরাট (১) ১৬ হরিয়ানা ১২২ হিমাচল প্রদেশ ৪০২ ঝাড়খন্ড ২১ কর্ণাটক ২২ কেরালা ২৬ মধ্যপ্রদেশ ২৫ মহারাষ্ট্র ৩৩ মনিপুর ১০৪ মেঘালয় ২৬ মিজোরাম ১৩৯ নাগাল্যান্ড ৫৩ ওড়িশা ১৪ পাঞ্জাব ১৭৪ রাজস্থান ৫৭ সিকিম ১৯০ তামিলনাড়ু (২) ২৩
তেলাঙ্গানা ১৭
ত্রিপুরা ১৮
উত্তরাখন্ড ২৭১
উত্তরপ্রদেশ ২৮
পশ্চিমবঙ্গ ১৯
নেপাল ৬৩
কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে—

দিল্লি ১৯
জম্মু ও কাশ্মীর ১৮৫,

*১ দাদরা এবং নগর হাভেলি ও দমন এবং দিউ-সহ
*২ পুডুচেরি এবং আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের নিয়োগ-সহ
————————

সেনাবাহিনীতে মূল নিয়োগটা হয় কীভাবে?
সরাসরি ভারতীয় সেনাবাহিনীর ওয়েবসাইট www.joinindianarmy.nic.in – এ গিয়ে ‘Officer Entry Apply/Login’ অপশনে ক্লিক করতে হবে। এর পর নিজের নাম ও অন্যান্য তথ্য রেজিস্টার করে উল্লেখিত কিছু তথ্য পূরণ করতে হবে। কোন পদের জন্য আবেদন করছেন, তা উল্লেখ করে ওই ওয়েবসাইটেই আবেদন করতে হবে। পরের স্তরে লিখিত ও অন্যান্য পরীক্ষার তথ্য সরাসরি আবেদনকারীদের জানিয়ে দেওয়া হবে।

শর্ট সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে মাঝে মাঝে একাধিক পদে নিয়োগ করা হয়। আবেদন গৃহীত হলে পরীক্ষা দিতে হয়। গত ফেব্রুয়ারি নাগাদ এরকম ২০০টি পদে নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ঘোষণায় বলা হয়, অফিসার পদে নির্বাচিত যোগ্য প্রার্থীদের চলতি বছরের আগামী অক্টোবর মাস থেকেই প্রশিক্ষণ শুরু হবে। তামিলনাড়ুতে হবে এই প্রশিক্ষণ। বিভিন্ন পদে মোট ১৯১টি শূন্যপদ রয়েছে। এই পদগুলির জন্যই অবিবাহিত পুরুষ ও মহিলারা আবেদন করতে পারবেন। সেনাবাহিনীর তরফে যে শর্তগুলি রয়েছে, তা পূরণ করলেই অবিবাহিত পুরুষ ও মহিলারা আবেদন করতে পারেন। সেনাবাহিনীতে কর্মরত থাকাকালীন কোনও জওয়ান বা আধিকারিকের যদি মৃত্যু হয়, তবে তাঁর বিধবা স্ত্রীও আবেদন করতে পারবেন। শিক্ষাগত যোগ্যতা- ইঞ্জিনিয়ারিং স্নাতকর।

কোন পদে কত নিয়োগ
এসএসসি টেক (পুরুষ) – ১৭৫ টি পদ, এসএসসি টেক (মহিলা) – ১৪টি পদ ও
বিধবাদের নিয়োগ- ২টি পদ।
এ ছাড়া, সম্প্রতি 136th Technical Graduate Cource (TGC) পদে চাকরির ঘোষণা করা হয়েছিল। চাকরিপ্রার্থীদের ১১ মে থেকে এই পদের জন্য আবেদন করতে বলা হয়। শেষ তারিখ ছিল ৯ জুন, ২০২২। এতে আবশ্যিক ছিল চাকরিপ্রার্থীকে ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি কোর্স উত্তীর্ণ হতে হবে। চূড়ান্ত বর্ষের ছাত্ররাও এই পদের জন্য আবেদন করতে পারেন। আবেদনকারীর বয়স চাওয়া হয় ১.১.২০২৩ -এর মধ্যে ২০-২৭ বছরের মধ্যে। যে কোনও ভারতীয় নাগরিকই এই পদের জন্য আবেদন করতে পারবেন। PET, SSB Interview, Medical Test-এর মাধ্যমে প্রার্থী বাছাই করা হয়।

ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাদার্ন কম্যান্ডের সদর দফতরের তরফে সম্প্রতি আগ্রহী প্রার্থীদের থেকে আবেদন চেয়ে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। নূন্যতম যোগ্যতা হিসেবে প্রার্থীদের দশম শ্রেণিতে পাশই যথেষ্ট। বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হওয়ার ৪৫ দিনের মধ্যে আবেদনপত্র জমা করতে হবে। ওয়াশার ম্যান বিভাগে মোট শূন্য পদের সংখ্যা ৩৯। তার মধ্যে সংরক্ষিত আসনের বিভাজন কিছুটা এরকম- অসংরক্ষিত ১৯, এ ছাড়া বিভিন্ন স্তরের জন্য রয়েছে নির্দিষ্ট সংখ্যক সংরক্ষিত আসন। অন্যদিকে, ট্রেডসম্যান মেট বিভাগে মোট শূন্য পদের সংখ্যা ২৬। তার মধ্যে সংরক্ষিত আসনের বিভাজন
আবেদনকারীর বয়স হতে হবে ১৮ থেকে ২৫-এর মধ্যে। বিজ্ঞাপনে চাওয়া সমস্ত নথি সঠিকভাবে সই-সহ পাঠাতে হবে The Commandant, Military Hospital, Defence Colony Road, Chennai, Tamilnadu, PIN- 600032-এই ঠিকানায়। ৪৫ দিনের মধ্যে পৌঁছানো রেজিস্টার্ড পোস্ট বা স্পিড পোস্টে পাঠানো আবেদনপত্রই শুধুমাত্র গ্রহণ করা হবে। আবেদনপত্র পাঠাতে খরচ হবে ১০০ টাকা।

অর্থাৎ, বিভিন্ন স্তরে নানাভাবে নিযুক্তি হয়। অবসরপ্রাপ্ত এক সেনাকর্তা এই প্রতিবেদককে বলেন, অফিসারের নিচের স্তরে (পিবিওআর) নিয়োগের পাশাপাশি অফিসার মর্যাদার নিয়োগে বিভিন্ন এন্ট্রি পয়েন্ট আছে। যেমন এনডিএ (ন্যাশনাল ডিফেন্স একাডেমি), স্থায়ী কমিশনের জন্য আছে ওটিএ (অফিসার ট্রেনিং একাডেমি)। আছে শর্ট সার্ভিস কমিশন। শুধুমাত্র সেনাবাহিনীর জন্য একটি বড় সংখ্যক স্থায়ী নিয়োগ হয় ইন্ডিয়ান মিলিটারি একাডেমিতে। তিনটি শাখার জন্য যৌথ পরীক্ষাও হয়। পিবিওআর-এর যাঁরা অফিসার হিসাবে উপযুক্ত বলে বিবেচিত হন, তাঁদের জন্য আছে আইএমএ-র আর্মি ক্যাডেট কলেজ (এসিসি)। আইএমএ-তে স্নাতক হওয়ার আগে তাঁদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এ ছাড়া আছে আরসিও (রেজিমেন্টাল ক্যাডার অফিসার)। স্নাতক/ পদোন্নতি যোগ্য বলে মনে করা হলে কয়েকটি বিশেষ পরিষেবার জন্য, তাঁদের বিবেচনা করা হয়। আইএমএ-তে যাওয়ার আগে তাঁদের গয়াতে একটি সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।

সেনাবাহিনীতেও একটা সময় ছিল বাঙালিদের প্রাধান্য
অবসরপ্রাপ্ত সেনাকর্তা সব্যসাচী বাগচি এই প্রতিবেদককে বলেন, স্বাধীনতার সময়ই সেনাবাহিনীর বেঙ্গল রেজিমেন্ট উঠে যায়। রাজপুত ব্যাটেলিয়ানে এখনও দুটি বাঙালি কোম্পানি আছে। কিন্তু যথেষ্ঠ যোগ্য বাঙালি আবেদনকারী পাওয়া যায় না। ব্রিটিশ আমল থেকে বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ার্স, বোম্বে ইঞ্জিনিয়ার্স এবং ম্যাড্রাস ইঞ্জিনিয়ার্স নামে তিনটি বিভাগ আছে। কিন্তু বাঙালি ইঞ্জিনিয়ার যৎসামান্য। এএমসি (আর্মি মেডিক্যাল কোর)-র ৮০ শতাংশ বাঙালি চিকিৎসক ছিলেন। বাঙালিপ্রধান বলে বিভাগটিকে বলা হত বিএমসি। এখন সেনাবাহিনীতে বাঙালির খোঁজ মেলে না।

কেন এই হাল? সব্যসাচীবাবুর মতে, “বাঙালির আয়েসি আচরণ, কষ্ট না করে সহজে প্রাপ্তির প্রত্যাশা, পরশ্রীকাতরতা, নিজেদের মধ্যে ঐক্যের অভাব, উন্নাসিকতা, ঝুঁকি নিতে না চাওয়ার প্রবণতা— সব মিলিয়ে এই অবস্থা।“

ঘুরে দাঁড়ানোর কোনও পথ আছে? সব্যসাচীবাবুর জবাব, “না। আমি কোনও পথ দেখি না। বাঙালি এখন ভীষণভাবে নেতিবাচক রাজনীতিতে নিমজ্জিত। সেনাবাহিনীর আদর্শ দেশই প্রথম, দেশই শেষ কথা। বাঙালি সার্বিকভাবে তা ভাবে না। পেশাদারিত্বের পথে হাঁটতে চায় না। সব ব্যাপারে রাজনীতি করে।“

অশোক সেনগুপ্ত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.