সাম্প্রতিক তিনটি উপনির্বাচনের ফলাফল দেখাল কেন্দ্র সরকার নির্বাচনের সঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনের তালমিল খুঁজতে যাওয়ায় বৃথা। কয়েক বছর ধরে সারা ভারতেই এই প্রবণতা নজরে পড়ছে। ২০১৮ সালের বিধানসভা নির্বাচনের ক্ষেত্রে মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, ছত্তিসগড় তিনটি রাজ্যের ভোটদাতাদের যে দলীয় পচ্ছন্দ ছিল কয়েকমাস পরের লোকসভা নির্বাচনে তা আমূল বদলে যায়। বিধানসভায় কংগ্রেস ক্ষমতা দখল করলেও লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির বিপুল জয় হয়। এই বিষয়টা মাথায় রাখলে তিনটি বিধানসভাতেই তৃণমূল দলের বড়ো জয় হলেও তা অভূতপূর্ব এমনটা নয়।
এমনকী উপনির্বাচনের ফলাফল বহুক্ষেত্রেই বড়ো প্রেক্ষাপটে গিয়ে পড়লে অনেক সময়ই তার পুনরাবৃত্তি হয় না। ২০১৮ সালেরই লোকসভা নির্বাচনের ৬ মাস আগে সমাজবাদী ও বহুজন সমাজবাদী দলের জোট উত্তরপ্রদেশে বিজেপিকে হারানোর পরই হাওয়া উঠে যায় কেন্দ্রে নরেন্দ্র মোদী সরকারের নতমস্তকে বিদায় আসন্ন। বিরোধীরা নতুন নতুন জোটে। আগ্রহী হয়ে ওঠে। লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল এই ধরনের চিন্তাকে সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণ করে। তবে কেবলমাত্র অতীত কিছু পরিসংখ্যান ও ট্রেন্ডের উদাহরণের ভিত্তিতে মমতা। ব্যানার্জির এই সাফল্যকে আদৌ খাটো করে দেখা যায় না ও উচিতও নয়। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে মানুষের ভোট দেওয়ার গতিমুখকে এই নির্বাচনে সম্পূর্ণ তার স্বপক্ষে নিয়ে আসার কৃতিত্ব তারই। সে সময় তৃণমূল কংগ্রেসের বড়োসড়ো ক্ষতি হয়েছিল।
পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজনৈতিকভাবে একটি অতি সংবেদনশীল ও সচেতন রাজ্যে কী লোকসভার ভোট কী স্থানীয় পঞ্চায়েতের নির্বাচন প্রতিটিতেই মানুষের উত্তেজনা থাকে তুঙ্গে, আর ফলাফলকে নিয়ে চলে চুলচেরা বিচার। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশের পর রাজ্যে একটা ধারণা বদ্ধমূল হয়েছিল যে মমতা সরকারের ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বিদায় নিশ্চিত। বিজেপিই পর্দার পেছনে শূন্যস্থান পূরণ করতে অপেক্ষমান। সময় এলেই দায়িত্ব গ্রহণ করবে। বিশেষ করে দুটি বিধানসভা কেন্দ্রে লোকসভার সময়কার বিজেপির বিশাল ব্যবধানকে হেলায় মুছে দিয়ে জয় হাসিল করা প্রমাণ করছে। মমতার এখনও পর্যাপ্ত রাজনৈতিক গোলাবারুদ যা রয়ে গেছে তা দিয়ে যে কোনো লড়াইয়ে ফিরে আসা যায়। অবশ্যই বিধানসভা নির্বাচনের জন্য ২০২১-এর মে মাস পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু তার মধ্যেই এই ফলাফল বোঝাল যে তিনি লোকসভার ফলাফল পরবর্তী হতচকিত অবস্থা অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছেন। গত ছ’ মাসে পশ্চিমবঙ্গবাসী কিছু টা নিস্তেজ ও চরিত্রবহির্ভূতভাবে চুপচাপ একজন মুখ্যমন্ত্রীকে দেখতে অভ্যস্ত হচ্ছিল। তিনটি উপনির্বাচনের বড়ো জয় তাকে আবার চরম আক্রমণাত্মকভাবে ফিরিয়ে আনবে বলেই ধরে নেওয়া যায়।
ফলশ্রুতিতে পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক হানাহানি আর হিংসা যা ভারতের রাজনৈতিক মানচিত্রে বিশিষ্ট অবস্থান করে নিয়েছে তা যে কোনো মুহূর্তে বেড়ে যাওয়ার সম্ভবনা রয়েছে। ইতিমধ্যেই জেলাগুলি থেকে খবর আসতে শুরু করেছে বিজয়ী তৃণমূল কর্মীরা উজ্জীবিত হয়ে সদ্য পরাজয়ের ফলে কিছুটা ম্রিয়মাণ বিজেপি কর্মীদের ওপর হিংস্মাতক প্রতিশোধস্পৃহা চরিতার্থ করছে।
ভোটের ফলাফল বিশ্লেষণ করে একটা জিনিস পরিষ্কার উঠে এসেছে যে জাতীয় নাগরিকপঞ্জী নিয়ে বিজেপি’র অবস্থান ও তৎপরতাকে মমতা ব্যানার্জি অত্যন্ত চতুরভাবে লোকের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করার, ঘর হারানোর, নাগরিকত্ব হারানোর উদ্বেগ সৃষ্টিতে তুমুলভাবে সফল হয়েছেন। বিজেপি যখন বোঝাচ্ছে লোকসভায় নাগরিকত্ব সংশোধন বিল পাশ হলেই জাতীয় নাগরিকপঞ্জীর কাজে হাত দেওয়া হবে। এর ফলে হিন্দু শরণার্থীরা নাগরিকত্ব পেয়ে যাবেন। মমতা তখন সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে অসমে এনআরসি চালু করার ফলে। কেবলমাত্র মুসলমানরা নয় হিন্দুরাও অসমে তালিকা থেকে বাদ পড়ে নিজের দেশেই উদ্বাস্তু হয়ে গেছেন ঘোষণা করে তুমুল আতঙ্কের পরিস্থিতি তৈরি করেন। এই উদ্বাস্তুদের মধ্যে গোখা, রাজবংশীরাও। রয়েছেন জানিয়ে তিনি উত্তরদিনাজপুর অঞ্চলে নিশ্চিত ফল পেয়েছেন।
অসমে এনআরসি তৈরির ক্ষেত্রে প্রচুর ভুল ত্রুটি হয়েছে। তার সংশোধন ও পরিমার্জনের কাজ চললেও মমতা ব্যানার্জি বলেছেন এখানেও ওই একই ঘটনা ঘটবে। হিন্দুরা উদ্বাস্তু হয়ে পড়বেন। তিনি এখানে। এনআরসি কিছুতেই হতে দেবেন না। হিন্দুদের মধ্যে এই চাপা অথচ চরিত্রগতভাবে আতঙ্কজনক প্রচারের পরিণতিতে লোকসভা ভোটে যে হিন্দুরা বিজেপিকে সমর্থন করেছিল তাদের মধ্যে একটি বিশাল অংশ মমতা দিকে সরে গেছে তার হিসাব করাই দুষ্কর। ভোটের নির্ণায়ক মাত্রার এই দোলাচল সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করেছে রাজ্যে এনআরসি করতে না দেওয়া নিয়ে মমতার বিধ্বংসী প্রচার মানুষ বিশ্বাস করেছে। এর বিপরীতে এনআরসি ও সিএবি-র সদর্থক প্রয়োজনীয়তা নিয়ে বিজেপি কোনো পাল্টা আক্রমণ শানিয়ে উঠতে পারেনি। ভবিষ্যতে এনআরসি হবেই স্থানীয় নেতাদের এই নিয়ে নিরন্তর প্রচার বিজেপিকে মমতার জালেই ফাসিয়ে দিয়েছে।
ভারতবর্ষের বিস্তীর্ণ প্রান্তে বিজেপি দীর্ঘদিন ধরে প্রতিষ্ঠিত দল হলেও পশ্চিমবঙ্গে বড়ো সংখ্যার নাগরিকদের দল হওয়ার ক্ষেত্রে বিজেপি এখনও তুলনামূলকভাবে নতুন। বস্তুত ২০১৪ সালের আগে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে দলের বিরাট সাফল্যের কিছুটা প্রতিফলিত গৌরবের ভাগীদার হিসেবেই ছিল পশ্চিমবঙ্গে দলের পরিচিতি। অনেকটাই যেন মূল রাজনীতি বৃত্তের বাইরের পরিসরে থাকা। সর্বভারতীয় বড়ো বড়ো নেতারা রাজ্যে এলে তাদের সন্তোষজনকভাবে আপ্যায়ন করা ও যথাযথ আতিথেয়তায় যাতে ত্রুটি না হয় সেদিকে দৃষ্টি দেওয়াই ছিল দলের প্রধান কর্তব্য। এমন পরিস্থিতি আমূল পালটে গেছে। এগুলি আর আদৌ বাস্তব নয়।দলের মধ্যে চলছে তীব্র দ্বন্দ্ব। এক শ্রেণী ভাবছে এটি একটি ছোট কিন্তু দৃঢ় সঙ্ঘবদ্ধ অরাজনৈতিক সংগঠন অন্য এক শ্রেণী যারা মমতার মতো নিজেকে তুলে ধরে রাজনীতির আলো শুষে নেওয়ায় বিশ্বাসী তারা এর বিরুদ্ধে লেগে পড়েছে। এই মতবিরোধের আদৌ সমাধান হয়নি। আর স্থানীয় কোনো উপযুক্ত নেতার অভাবে কেন্দ্রের বড়ো বড়ো নেতাদের মাথা ঘামানোর ওপর অতিগুরুত্ব আরোপ করা হচ্ছে। এরই পরিণতিতে বিজেপির চিরাচরিত তকমা-বাঙ্গালির চিন্তা চরিত্র সংস্কৃতির সঙ্গে দল খাপ খায় না—এই মানসিকতাটি মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। এগুলির কোনোটিই কিন্তু অপ্রতিরোধ্য কোনো সমস্যা এমন নয়। কিন্তু এটিকে কাটিয়ে উঠতে দরকার জাতীয় রাজনীতির গতিমুখের সঙ্গে প্রাদেশিক রাজনীতির সফল মিশ্রণ। বিগত লোকসভা নির্বাচনে মমতা ব্যানার্জি একটি জগাখিচুড়ি চরিত্রের জাতীয় দৃষ্টিকোণ নিয়েছিলেন। যেখানে সকলে মিলে তাকে প্রধানমন্ত্রী বানিয়ে দেবে। এটি সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়।
অন্যভাবে, বিজেপি যদি সেই ভুলেরই পুনরাবৃত্তি করে অর্থাৎ রাজ্য রাজনীতির ক্ষেত্রে মোদী-অমিত শাহ দিয়ে বিধানসভা বৈতরণী পেরোতে চায় তাহলে ভুরাডুবি হবে। এই প্রক্রিয়া মমতা ব্যানার্জির হাতে কেকতুলে দেওয়ার মতোই হঠকারী। কেননা তিনি একজন দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ও নির্মম রাজনীতিবিদ যিনি স্থানীয় স্তরের মেঠো দাগের রাজনীতির পাকা খেলোয়াড়।
পশ্চিমবঙ্গ কিন্তু উদ্ভাবনী রাজনীতির গবেষণাগার হয়ে ওঠার সম্ভবনা রাখে যা দাদা বা গুন্ডানির্ভর রাজনীতির পরিসরের বাইরে। কিন্তু তা করতে গেলে সব ধরনের প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক ছাঁচ ভেঙে ফেলতে হবে।
স্বপন দাশগুপ্ত
(লেখক রাজ্যসভার সদস্য)
2019-12-05