সাম্প্রতিক অতীতে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নানা দলের রাজনৈতিক লড়াইয়ের পাশাপাশি আর একটি সমান্তরাল প্রচার দৃষ্টি ও শ্রুতিগোচর হচ্ছে। জনগণকে সমস্ত রাজনৈতিক দলকে বর্জন করে নোটাতে ভোট দিতে বলা হচ্ছে। কিন্তু কেন?
শুরুতেই বলা প্রয়োজন যে পশ্চিমবঙ্গে যেভাবে নির্বাচন হয়, ভারতবর্ষের অন্যান্য রাজ্যের নির্বাচনী পরিস্থিতি ঠিক সেরকম নয়। পশ্চিমবঙ্গের ভোটারেরা সবসময় রুলিং পার্টির নজরবন্দি থাকে এবং রুলিং পার্টির লোকেরা চিহ্নিত করে ফেলে যে, কোন বাড়ি থেকে কে বা কারা বিরোধী প্রার্থীকে ভোট দিতে পারে। ভোটের আগে ও পরে তাদেরকে হুমকি, মার, খুন ইত্যাদি করা হয়ে থাকে। বামফ্রন্টের আমলেও এসব হতো; মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও সেই রাজনৈতিক সংস্কৃতিই অধিগ্রহণ করেছেন। ইদানীং আমরা সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে দেখতে ও শুনতে পাচ্ছি যে তৃণমূলের নেতারা কীভাবে প্রকাশ্য জনসভায় মানুষকে হুমকি দিচ্ছেন যে ভোটের পর প্রতিবাদীদের ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে বুঝে নেওয়া হবে!
এখানকার বহুসংখ্যক সাধারণ মানুষ অনেক সময়ই রাজনৈতিক দলের চাপে ভোট দিতে যাওয়া থেকে বিরত হতে বাধ্য হন। হয় ভোট দিতে পারেন না, নয়তো যাকে ভোট দিতে বলা হয় বা জোর করা হয়, তাকেই ভোট দেন। যদিও ইদানীং পুরুলিয়া, ঝাড়গ্রামের লোক ভোটের বাক্সে প্রতিবাদ করার একটা গণতান্ত্রিক সাহস দেখাতে শুরু করেছেন।
অন্যান্য রাজ্যগুলির চিত্র পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে পৃথক। পশ্চিমবঙ্গের মতো এমন সর্বব্যাপী মানসিক সন্ত্রাস অন্য রাজ্যগুলোতে নেই। তাই নোটা-ইস্যুর গুরুত্ব অন্যান্য রাজ্যের জন্য যতটা, পশ্চিমবঙ্গের জন্য হয়তো তার চেয়ে কিছু কম। তবুও তা একেবারে অগ্রাহ্য করার মতো নয়। দেখে নেওয়া যাক পশ্চিমবঙ্গের নোটা-চিত্রটি ঠিক কেমন।
নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে মোট ভোট পড়েছিল ৪,৪৬,৯৭, ৭৯১টি এবং তার ১.৫২ শতাংশ অর্থাৎ ৮, ৩২,১৪৮টি পড়েছিল নোটাতে। অর্থাৎ রাজ্যের ২৯৪টি বিধানসভা আসনের প্রত্যেকটিতে গড়ে ২৮৩০টির মতন ভোট নোটায় পড়ে ছিল। সংখ্যার বিচারে পশ্চিমবঙ্গে সবচেয়ে বেশি নোটা ভোট পড়েছে এমন দশটি বিধানসভা কেন্দ্র (মানের নিম্নক্রমে, অর্থাৎ বেশি থেকে কম, এই ক্রমানুসারে) এইরকম—
১. ছাতনা, ২. কার্শিয়াং, ৩. নাগরাকাটা, ৪. কুমারগ্রাম, ৫. দার্জিলিং, ৬. চুচুড়া, ৭. বিনপুর, ৮. রঘুনাথপুর, ৯. মাদারিহাট, ১০. সোনামুখী।
আর সবচেয়ে কমসংখ্যক নোটা ভোট পড়েছে যেসব বিধানসভা কেন্দ্রগুলিতে সেগুলি (মানের ঊর্ধ্বক্রমে, অর্থাৎ সবচেয়ে কম থেকে ক্রমান্বয়ে বেশি, এই অর্ডারে) এইরকম—
১. হাওড়া উত্তর (নোটা ভোট পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে সবচেয়ে কম পড়েছে এই কেন্দ্রে), ২. পটাশপুর, ৩. কাকদ্বীপ, ৪. ভগবানপুর, ৫. হরিহরপাড়া, ৬. ময়না, ৭. নন্দীগ্রাম, ৮. কুলপি, ৯. বাগদা, ১০. পাথরপ্রতিমা।
ভোটের শতাংশের বিচারে নোটার সর্বাধিক শতাংশ কার্শিয়াং বিধানসভা কেন্দ্রে, ৪.৫৩ শতাংশ। কিন্তু মোট সংখ্যার বিচারে সবচেয়ে বেশি নোটা ভোট পড়েছে বাঁকুড়ার ছাতনাতে, ৭৭০৯টি, শতাংশের বিচারে ৪.৩১ শতাংশ।
আর একটি উল্লেখযোগ্য পর্যবেক্ষণ হলো, যে যে কেন্দ্রে ৯০ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছে, তার প্রায় কোথাওই নোটা ভোটের পার্সেন্টেজ রাজ্যের নোটা ভোটের গড় পার্সেন্টেজ, ১.৫২ শতাংশকে ছাড়ায়নি। অপরপক্ষে, যে সমস্ত কেন্দ্রে নোটা ভোটের পার্সেন্টেজ ১.৯ শতাংশের বেশি, অর্থাৎ গোটা রাজ্যের নোটার গড় পার্সেন্টেজের থেকে বেশি হয়েছে, তার কোথাওই মোট কাস্টেড ভোটের পার্সেন্টেজ ৯০ শতাংশ হয়নি।
কলকাতার মধ্যে সংখ্যার বিচারে সবচেয়ে বেশি নোটা ভোট পড়েছে বেহালা পশ্চিম কেন্দ্রে, ৪,১৩৭টি ও বেহালা পূর্ব কেন্দ্রে, ৩,৯১৯ টি। যদিও পার্সেন্টেজের বিচারে কলকাতার মধ্যে সর্বাধিক নোটা ভোট পড়েছে রাসবিহারী কেন্দ্রে। শতাংশের বিচারে ২.৮১ শতাংশ যেখানে নোটা ভোটের সংখ্যা হলো ৩, ৮৭২।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, হঠাৎ এই নোটাতে ভোট দেওয়ার বিষয়টা আজ এত বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে কেন? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আগে একবার দেখে নেওয়া প্রয়োজন নোটার তাৎপর্য। নোটা অর্থাৎ নান অব দ্য অ্যাবাভ। অর্থাৎ যিনি নোটাতে ভোট দিচ্ছেন, তিনি উক্ত কেন্দ্রের প্রার্থীদের কাউকেই তার নিজের প্রতিনিধি হিসেবে যোগ্য মনে করতে পারছেন না বলেই নোটাতে ভোট দিচ্ছেন। ২০০৯ সালে নির্বাচন কমিশন এমন ভোটারদের কথা ভেবেই নোটা আইনের প্রভিশন প্রথমবার আনতে চায়। তৎকালীন কংগ্রেস সরকার তার বিরোধিতা করেছিল, কিন্তু ২০১৩ সালে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে নোটা আইন কার্যকর হয়।
কিন্তু ওই পর্যন্তই। নোটা ভোটের অন্য কোনো গুরুত্ব নেই। নোটা ভোটার তার ভোটের মাধ্যমে দেশের সরকার গঠনে ইতিবাচক বা নেতিবাচক, কোনো ভূমিকাই পালন করতে পারবেন না। মনে করুন, কোনো কেন্দ্রে যদি ১০০ জন ভোটার ভোট দিয়ে থাকে এবং তার মধ্যে ৮০ জনও যদি নোটাতে ভোট দেয় তাহলেও বাকি ২০ জনের ভোটের ভিত্তিতেই উক্ত কেন্দ্রের সমস্ত প্রার্থীদের মধ্যে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে প্রার্থী নির্বাচিত হবে। অর্থাৎ ওই ৮০টা ভোট কেবলমাত্র অগ্রাহ্যই করা হবে। বাকি ২০টি ভোটের মধ্যে যে প্রার্থী সবচেয়ে বেশি ভোট পাবে, সেই হবে ওই কেন্দ্রের নির্বাচিত প্রার্থী। অর্থাৎ কোনো কেন্দ্রের অধিকাংশ নির্বাচক ভোটারও যদি ওই কেন্দ্রের কোনো দলের কোনো প্রার্থীকেই পছন্দ না করে এবং নোটাতে ভোট দেয়, অর্থাৎ ওই কেন্দ্রে যদি নোটা ভোটে জেতে, তাহলেও এমন হবে না যে ওই কেন্দ্রে ভোটই পরিত্যক্ত হলো। নতুন প্রার্থীতালিকা তৈরি করে ওই কেন্দ্রে যে আবার নতুন করে নির্বাচন হবে, তা কিন্তু নয়। নোটাতে পড়া ভোটগুলি অগ্রাহ্য করা হবে এবং বাকি ২০টি ভোটের ভিত্তিতেই ওই কেন্দ্রের ভোটের ফলাফল ঘোষিত হবে। নোটা আইনের প্রভিশন তাই। অর্থাৎ নোটা একটি নখদন্তহীন, অপদার্থ আইন। আরও স্পষ্ট ভাবে বলতে গেলে যে অধিকার মানুষের স্বতঃসিদ্ধ অর্থাৎ ভোট না নিয়ে থাকার অধিকার, নোটা আইন শুধু সেই অধিকারকে আইনত মান্যতা দেয় মাত্র। অর্থাৎ কারুর ভোট যাতে বেআইনিভাবে অন্য কেউ দিয়ে যেতে না পারে, নোটাতে ভোট দিয়ে শুধু সেটুকুই নিশ্চিত করা যায় মাত্র। নোটাতে ভোট দেওয়া আর ভোট না দেওয়ার আইনগত তাৎপর্য সমান। দেশগঠনে এর কোনো ভূমিকা নেই।
অর্থাৎ বর্তমানে যাঁরা নোটাতে ভোট দিতে বলছেন, তারা মূলত মানুষকে নিজেদের ভোট নষ্ট করতে বলছেন এবং চাইছেন দেশের মানুষ দেশ ও রাষ্ট্রগঠনে কোনো ভূমিকাই না নিক। তারা চাইছেন যে বিভিন্ন দলের যারা ডেডিকেটেড ভোটার তেমন কিছু অল্পসংখ্যক লোকই দেশে বিধানসভা ও লোকসভা নির্বাচনের ভাগ্য নির্ধারণ করুন। কারণ বহু লোক যদি নোটাতে ভোট দেন তবে সেই ভোটগুলো বাতিল হবে, ফলে যে ক’টি কমসংখ্যক ভোট নানা দলের মধ্যে ভাগ হবে, তার ভিত্তিতেই সরকার গঠন হবে।
উত্তরবঙ্গের কালচিনিতে ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি টিএমসির কাছে হেরে যায় মাত্র ১৫১১ ভোটে যেখানে নোটা ভোট ছিল ৪৫২৪টি। পশ্চিমবঙ্গে এরকম ২৩টি বিধানসভা কেন্দ্র আছে যেগুলিতে জয়ের ব্যবধানের চেয়ে নোটা ভোটের সংখ্যা ছিল বেশি। এই কেন্দ্রগুলিতে যদি নোটা ভোটগুলি দ্বিতীয় স্থানাধিকারী প্রার্থীর ঝুলিতে পড়ত, তবে নির্বাচনের ফলাফলই অন্যরকম হতে পারত। কেউ হয়তো বলবেন যে, এর মানে হলো, এইসব কেন্দ্রে নোটা ভোটই নির্ণায়ক ভূমিকা নিয়েছে। কিন্তু বাস্তব হলো, যেহেতু নোটা ভোট আসলে ভোট না দেওয়ার সমতুল্য, সেহেতু এই কেন্দ্রগুলিতে আসলে নোটা ভোট দাতাদের ঔদাসীন্যের কারণে হয়তো কেন্দ্রের বেশিরভাগ মানুষের অপছন্দের প্রার্থী নির্বাচিত হয়ে যেতে পেরেছেন। এ আসলে গণতন্ত্রের পরাজয়ই।
অর্থাৎ এক কথায় বলতে গেলে নোটা-প্রচারকারীরা চাইছেন দেশের সাধারণ জনগণ মনের শান্তির জন্য ভোট দিক কিন্তু দেশগঠনে তাদের ভোটের কোনো ভূমিকা না থাকুক। কিন্তু সাধারণ নিরপেক্ষ ভোটারের কর্তব্য হলো দেশ গঠনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করা। ভোট দেওয়া তাদের অধিকার শুধু নয়, কর্তব্যও। নোটা নয়, বরং নিজেদের বিবেচনাশক্তি কাজে লাগিয়ে যে রাজনৈতিক দলকে অপেক্ষাকৃত কম খারাপ বলে মনে হবে, তাকেই ভোট দিন। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবত যথার্থ পর্থনির্দেশ করেছেন যে, নোটাতে ভোট দিলে অপেক্ষাকৃত অনুপযুক্ত যে-ব্যক্তি নির্বাচনে লড়ছেন তার পথকেই সুগম করা হয়।
নোটা-ভোটারদের মনে রাখা প্রয়োজন যে আইনের দৃষ্টিতে নোটার বোতাম টেপার অর্থ হলো তারা নিজেরা স্বেচ্ছায় নিজেদেরকে অগ্রাহ্য করতে বলছেন। কারুর সুপরিকল্পিত প্রচারের শিকার হয়ে নিজেই নিজেকে গুরুত্বহীন ঘোষণা করার কাজ আশা করি কোনো বুদ্ধিমান মানুষ করবেন না।
দেবযানী ভট্টাচার্য
2019-04-22