ভোটের মরশুমে দলবদল নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে প্রচুর মতামত উঠে আসছে। উভয়দিকের বক্তব্যই বেশ মনোগ্রাহী। এমনটা মোটেই নয় যে বিপক্ষে যারা লিখেছেন তারা যুক্তিহীন কিছু লিখছেন। বরং পক্ষে যারা লিখছেন তাদের লেখায় অনেক সময়েই দলীয় দায়বদ্ধতার ছাপ খুবই স্পষ্ট যুক্তির চেয়েও।
কিন্তু এরপরও এ বিষয় নিয়ে নির্দিষ্ট বক্তব্য রাখা বেশ কঠিন। কেন?
ফ্যাক্ট হচ্ছে, হিমন্ত বিশ্বশর্মা না এলে আসামে বিজেপির ঐ জয়টা আসে না। তেমনি ত্রিপুরায় বিরোধী দল না ভাঙাতে পারলে ঐ জয়টা বিজেপি পায় কিনা তাও নিশ্চিত নয়।
এখন এখানকার বামপ্রচার বিজেপিকে যেমন তাদের মতোই আরেকখানা স্ট্রাকচার হিসেবে প্রেজেন্ট করেছিল, এবং এখানকার বড় অংশের লোকজন(এই লেখকও পড়ে তার মধ্যে) যা জেনে এসেছিল, আদপে বিজেপি মোটেই তেমন জিনিস নয়। বামেরা তাদের রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডার স্বার্থেই এটা প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে গেছে যে বিজেপি হল তাদেরই মত একটি তথাকথিত “আদর্শিকভাবে রিজিড” দল, শুধু বামেরা হচ্ছে আদর্শিকভাবে “প্রগতির পক্ষে রিজিড”, আর বিজেপি হচ্ছে আদর্শিকভাবে “দুর্গতির পক্ষে রিজিড”… অর্থাৎ বামেরা তাদের প্রচারে বিজেপিকেও তাদের মত তথাকথিত “বিশুদ্ধবাদী” হিসাবে প্লেস করেই যাবতীয় সমস্ত ন্যারেটিভ দিত এবং দেয়। কারণ তাদের এই পদ্ধতি “প্রাথমিক শত্রু তত্ত্ব” এস্টাবলিশের জন্য জরুরী ছিল।
.এখন বাস্তবে বামেদের ঐ ন্যারেশন বাদ দিলে সর্বভারতীয় স্তরে যা ঘাঁটাঘাঁটি করে দেখলাম, তাতে বিজেপি কোনকালেই বামেদের মত “বিশুদ্ধতার বাতেলা” দেয় নি। তারা কাশ্মীরে পিডিপির সাথে জোট করেছে, তেমন মমতাকে রেল দিয়েছে, তেমন জ্যোতি বসুর সাথে হাত ধরে দাঁড়িয়েওছে।
তারা বারেবারে এই উদাহরণ রেখেছে যে তারা “যখন যেমন তখন তেমন”… মেঘালয়ে গরু খেলেও ভোট লাগবে, ইউপিতে গরু না খেলেও ভোট লাগবে। নির্বাচন করেন নির্বাচকমণ্ডলী। এবং গণতন্ত্রে নির্বাচকমণ্ডলীকে কনভিন্স করাই তাদের মোটো। পাতি আদর্শিক বুলি কপচানো নয়।পাঠক লক্ষ্য করুন, এই যে “বিজেপি এলেই গরুকে মা বলতে হবে, গোমূত্র খেতে হবে” জাতীয় বালখিল্য অথচ “পপুলার প্রচারলাইন” কিন্তু মূলতঃ বিজেপি বিরোধীদের। বিজেপি নামক দলটির কেন্দ্রীয় থিঙ্ক ট্যাঙ্ক এসবের ধারপাশ দিয়েও যায় না গোবলয়ের ভোট ছাড়া।
তো মেইন পয়েন্টটা কি?
পয়েন্ট এটাই যে এই প্রথমবার একটি কেন্দ্রীয় ডানপন্থী দল, পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে এফর্ট দিচ্ছে। খুব বাস্তব কথা হচ্ছে, বর্তমান শাসকদল এখানে যে লাইনে ক্ষমতায় এসেছিল তা বামপন্থী ধ্বংসাত্মক লাইনেরই ডুপ্লিকেট। বর্তমান সরকারের জমি নীতি শিল্পসম্ভাবনা শেষ করেছে এটা বাস্তব, ফলতঃ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা নিম্নগামী। উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতির সূত্র মেনে মূদ্রাস্ফীতি থাকছেই ফলে ক্রয়যোগ্য জিনিসের মূল্য উর্দ্ধগামী। চাষ বা ইত্যাদিতে প্রযুক্তির প্রয়োগ নেই। রাস্তা, বিদ্যুৎকেন্দ্র এমনকি হাসপাতাল এক্সটেন্ড করতেও জমি নীতির ভূত। রাজ্য সরকারী কোষাগার শূন্য। ফলে ধারদেনা করে টুকটাক দান খয়রাত ছাড়া বিভিন্ন সরকারি পদে নিয়োগও বন্ধ।
মোটামুটিভাবে “তোমার শালা আমার শালা ভেনেজুয়েলা ভেনেজুয়েলা” টাইপের আবহ।
তো যেটা বলার সেটা হল ৩৪ বছরের বাম শাসনের পরও নীতিগতভাবে বাম শাসনই এই রাজ্য এক্সপেরিয়েন্স করে চলেছে এবং গোদা কথাটা হচ্ছে অর্থনৈতিকভাবে তলানিতে অবস্থান করছে।
এমতাবস্থায় একটি ডানপন্থী “ধান্দাবাজ” দল খুব দরকার। যারা “ধান্দা” করতে হয় কিভাবে এটা জানবে। “ধন্দা” মানে প্রফিট মেকিং। বেওসা। এবং পশ্চিমবঙ্গের সেই পুঁজিটাই দরকার। এনিহাউ। নাহলে এই স্টেট ভাগাড়ে যাবেই। বিধাতাও ঠেকাতে পারবে না।
নরসীমা-উত্তর কংগ্রেসও নেরুভিয়ান অসভ্যতা ছেড়ে পুঁজির খোলা পথে গেছিল। সেই কংগ্রেসী নীতিতেও কোন সমস্যা নেই। গত পাঁচ বছরে সেই কং-নীতির সাথে বিজেপির অর্থনৈতিক নীতির কোন পার্থক্য আমি পাইনি তেমন। কিন্তু মজার ঘটনা দেখুন, বামপন্থীরা এখন সেই কংগ্রেসের হাতচিহ্নের হয়ে দেওয়াল লিখে এসে বিজেপি কেন তৃণমূলত্যাগীদের দলে নিচ্ছে তা নিয়ে ট্রোল নামাচ্ছে! “আদর্শবাদের পরাকাষ্ঠা” অনুভব করুন পাঠক।.
তো কথা হল, ভারত গণতান্ত্রিক। এখানে কোন আদর্শ ততক্ষণই গ্রহণীয় যতক্ষণ নির্বাচকমণ্ডলীর তা পছন্দ হবে। নির্বাচকমণ্ডলী আদর্শের জাঙ্গিয়ার মাপে তৈরী হবে না, আদর্শিক জাঙ্গিয়াকে নির্বাচকমণ্ডলীর মাপে হতে হবে, এই সার বুঝ কেন্দ্রীয় দলগুলি বোঝে। আর বামপন্থীরা, বিশেষত কমিউনিস্টরা গণতন্ত্রের এই বিষয়টাকে ভয়ানক ভয় পায়, পেত, পাবেও। কারণ তাদের আদর্শিক জাঙ্গিয়ার মাপ পুর্বনির্ধারিত। ডিজাইন এদিক ওদিক হতে পারে, কিন্তু হাতিকে নিজেদের মাপের জাঙ্গিয়াটা পরাতে তারা বদ্ধপরিকর। এখন বেওসায়ী এসে বিভিন্ন হাতির বিভিন্ন মাপের জাঙ্গিয়া সাপ্লাই দিলে হাতিদের জাঙ্গিয়ার মাপে নিজেদের তৈরী করার ইচ্ছা না’ও হতে পারে। বামপন্থীদের আদর্শিক বাসরে তখন ঘুঘু চরবে, ডিম পাড়বে।
বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে খোলাখুলি ওপেন গেম খেলছে। “তুমি ততক্ষণ আমার শত্রু, যতক্ষণ তুমি আমার মুখোমুখি দাঁড়াচ্ছ।” এই নির্বাচনী নীতি নিয়েই বিজেপি আসাম, ত্রিপুরায় সাফল্য পেয়েছে, এবং পশ্চিমবঙ্গে কনসেন্ট্রেট করেছে।
এটা খুবই যৌক্তিক প্রশ্ন যে, গ্রাউন্ড লেভেলের কর্মীরা যাদের কাছে মার খেল, গালি খেল তারা এখন কি করবে? তাদের সম্মানের কি হবে?এটা অবশ্যই বিজেপির রাজ্যনেতৃত্বের স্থির করা উচিত যে কিভাবে তারা বসিরহাটে ইদ্রিশের ডান হাতকে ক্যান্ডিডেট করলেও নিজেদের কর্মীদের কনভিন্স করতে পারবে।
আমার মতে এখানেও তাদের বামেদের ট্রিক্স নেওয়া উচিত। “ব্যক্তি নয় চিহ্ন”… লেফ্ট ডিক্টেটরিয়াল লাইন। চিহ্ন দেখেই সমর্থন। ব্যক্তিকে প্রশ্ন করা যায়, ব্যক্তি নিয়ে প্রশ্ন ওঠানো যায়, “চিহ্ন” প্রশ্নস্বরূপ।
নীচুতলার কর্মীরাই আসলে দল। বাম, ডান, মধ্য, সবার। নেতৃত্বের সফলতা সেখানেই যেখানে তারা নীচুতলার কর্মীকে কনভিন্স করতে পারেন যে দল আসলে তারাই। তারা না থাকলে দলও নেই। নির্দিষ্ট আদর্শিক বুকনিবাজি পশুখামারে চলে, মুক্ত গণতন্ত্রে চলে না।
এখন দেখা যাক, ডান, বাম মধ্যদের মধ্যে কারা নির্বাচকমণ্ডলীকে আশ্বস্ত করতে সফল হয়। কিভাবে সফল হচ্ছে মনে হয় না এটা বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। অন্ততঃ দলবদলের ইস্যুতে। দলবদল একটি গণতান্ত্রিক পদ্ধতি। বরং দলদাসত্ব গণতান্ত্রিক নয়।পক্ষে বিপক্ষে ভাবনাচিন্তা চলুক। সমস্যা কি?
– সাম্যদর্শী