বিরাট পুরুষ শ্রীকৃষ্ণ বহুরূপে তাঁর প্রকাশ

গভীর সাধনার বাইরে এ সন্ধান। ত্রুটি থাকতে পারে। তবুও বলি শ্রীকৃষ্ণ হলেন বহু গুণের সমন্বয়। বিশেষ গুণের অনেক চরিত্রই যেন শব্দ যোগে কৃষ্ণ নামের সঙ্গে মিশে গেছে কিংবা কোনো কাহিনিকে বিশ্বাসযোগ্য করতে জনপ্রিয় কৃষ্ণ নামটি ব্যবহার করা হয়েছে যার ফল কৃষ্ণ নির্দিষ্ট কোনো একটি চরিত্রে বাঁধা না পরে ‘কৃষ্ণ’ শব্দটি শত শত চরিত্রের মাঝে গুরুত্ব পেয়েছে। ওই নাম শব্দটির এতটাই প্রভাব ছিল যে, এ শব্দের সঙ্গে মিশে গেলে কোনো কলঙ্ক, ভয় স্পর্শ করতে পারে না। বৈদিক যুগে ঋগ্বেদের প্রথম মণ্ডলে কৃষ্ণ ঋষিই হোন কিংবা অষ্টম মণ্ডলে অশুমতি তীরে বসবাসকারী অসুরাধিপতি, যেই হোন না কেন, আসলে কৃষ্ণ হলেন সূর্য-জ্যোতির সমতুল কোনো জ্যোতি বা শক্তি। যে শক্তি কৃষিজীবী ও অরণ্যবাসীদের মাঝে কোনো এক বা একাধিক শক্তিকে বধ ও বশ করেছিল তারা কিন্তু এ শক্তিকে নিজের মতো রূপ দিয়ে নিজেদের স্বকীয়তা বজায় রেখেছিল।
যাদব জাতির উপাস্য দেবতা সূর্য। মহাভারতকে গুরুত্ব দিলে এ বিচারে শ্রীকৃষ্ণ যদু বংশের বৃষ্ণি কুলের। প্রপিতামহ দেবমীর ঐতরেয় আরণ্যক মতে কৃষ্ণহারীত গোত্রীয়। ঘটক জাতক টীকায় কৃষ্ণ কর্ণহয়ন গোত্রীয়। কৌশিতকী ব্রহ্মণ অংশ মতে অঙ্গীরস গোত্রীয়। ছান্দোগ্য উপনিষদমতে অঙ্গিরা ঋষির বংশজাত ‘ঘোর’ নামক এক ঋষি শ্রীকৃষ্ণকে যজ্ঞ বিষয়ক অক্ষিতিমসি (পরিপূর্ণ), অচ্যুতমসি (অক্ষয়), প্রাণসংশিতমসি (প্রাণ রূপেসূক্ষ্ম তত্ত্ব) এই তিন মন্ত্র দিয়েছিলেন। পুরোহিত যদুকরের এ মন্ত্রগুলিই শ্রীকৃষ্ণকে যোগী পুরুষে পরিণত করতে পারে। পুরাণ মতে শ্রীকৃষ্ণ সন্দীপনি মুনির শিষ্য। কুলপুরহিত গর্গ। নানা মতে কৃষ্ণ যেই হোন না কেনে কৃষ্ণ এমন সব গুণের সমন্বয় যা আকৃষ্ট করে। আকৃষ্ট করে চিরস্থায়ী সুন্দর আনন্দ রূপনিয়ে।কৃষ্ণ শব্দে ‘কৃষ্ণ’ ধাতুর অর্থই হলো আকর্ষণ। বিষ্ণুর মতো কোনো দৈব রূপ না নিয়েও গোপাল রূপেও আকর্ষণীয়। ‘গো’অর্থে গোরু বা পৃথিবী যাইহোক না কেন, কৃষ্ণ দুয়েরই রক্ষক হয়ে লৌকিক- অলৌকিক সত্তা নিয়ে আকর্ষণের বস্তু। আলযুক্ত কৃষিক্ষেত্রে পার্শ্ববর্তী বনাঞ্চল থেকে ঢুকে পড়া বাঘের হাত থেকে গোসম্পদ রক্ষাকারী সাধারণ বাগাল রূপেও কৃষ্ণ আকর্ষণীয়। জট বংশীয় নীচ শূদ্র পশুপালক বা আভীর ট্রাইবের অন্তর্গত পশ্চিম ভারতের কোনো পশুপালক; অর্থাৎ কৃষ্ণ পশুপালক হিসাবেই বেশি গুরুত্ব পেয়েছেন। সুন্দর দেহ ও বিপিনবিহারী কেশ নিয়ে পীতাম্বর। হাতে বাঁশি কিংবা বিষ্ণুচক্র। কখনো কদমবৃক্ষ তলে গোপ-গোপীদের সঙ্গে। আবার কখনো যুদ্ধভূমিতে। শ্রুতি নির্ভর ‘কৃষ্ণ’ রূপ মানুষের মুখে ঘুরতে ঘুরতে এক দুই তিন করে। একটির পর একটি ঘটনার সঙ্গ পেয়েছে।
রাধারূপ নিয়ে কৃষ্ণ রূপ এমনই একটি উদাহরণ হতে পারে। মাগধরাজ জরাসন্ধের জামাতা কংস। কংস মথুরা রাজ উগ্রসেনের পুত্র। বসুদেব সন্তান সম্ভাবনাময়ী রোহিণীকে। মথুরার কাছে ঘোষ পল্লীতে নন্দ নামে এক গোপ ব্যবসায়ীর গৃহে রেখে, মথুরার রাজকন্যা দেবকীকে বিবাহ করেন। এমন সময় কংসের কানে আসে তার মৃত্যুর কারণ দেবকীর অষ্টম গর্ভের সন্তান। পিতা উগ্রসেনকে সিংহাসনচ্যুত করে রাজ্যাধিকারকারী কংস ভগ্নী ও ভগ্নীপতিকে কারাবন্দি করেন। দেবকীর প্রতিটি সন্তানকে কংস নিজ হাতে হত্যা করেন। অবশেষে যমুনার এপারেমথুরার কারাগারে অষ্টম পুত্রের জন্ম হলো।নাম কৃষ্ণ। ওদিকে রোহিণীর গর্ভে যে পুত্র জন্ম নিয়ে নিয়েছে তার নাম বলরাম। বোন সুভদ্রা অর্জুনের স্ত্রী। কথিত আছে ভাদ্র মাসে কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে কৃষ্ণের জন্মমুহূর্তে যমুনার ওপারে গোকুল ব্রজপুরী বৃন্দাবনে নন্দ ঘোষের স্ত্রী যশোদার কোলে জন্ম নিয়েছিল যোগমায়া। নররূপী নারায়ণের দু’স্থানে দু’রূপে জন্ম। নানা অলৌকিক কাহিনিকে আশ্রয় করে বসুদেব নন্দের অনুমতি নিয়ে যশোদার কোলে কৃষ্ণকে রেখে সদ্যোজাত যোগমায়াকে নিয়ে আসেন কংস কারাগারে। কংস ভেবে নিয়েছিলেন এ যোগমায়াই দেবকীর অষ্টম সন্তান। আবার কোনো অলৌকিক কারণেই তার এই বিশ্বাস ভঙ্গ হয়। কৃষ্ণের এরূপজন্মের ঘটনাটি পতঞ্জলি মহাভাষ্য অনুসারে তৃতীয়-দ্বিতীয় খ্রিস্টপূর্ব। অন্য মতে দশম খ্রিস্টপূর্বাব্দে। কিন্তু বিষ্ণুপুরাণ মতে মহাভারতের যুদ্ধই হয়েছিল ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে কিংবা অন্য গণনামতে ১৪৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। যদি তিনির্ভর সংরক্ষিত ঋগ্বেদের বিচারে আসা যায় ব্যাখ্যাকার যাস্ক থেকে ৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের এবং তিনি নিজে তার পূর্বের সাতজন পরস্পর বিরোধী ব্যাখ্যাকারদের প্রসঙ্গ টেনেছেন। সহজ ব্যাখ্যায় দ্বাপর যুগ হিসাবেই চিহ্নিত হয়। আর বৌদ্ধ ও জৈন সাহিত্যের বর্ণনা মতে কৃষ্ণের আবির্ভাব খ্রিস্টপূর্ব দশম কিংবা নবম শতকের প্রথম ভাগ।
কৃষ্ণ ভোজবংশীয় কংসকে বধ করে কংস পিতা উগ্রসেনকে রাজত্ব ফিরিয়ে দেন। কন্যাদের কথা ভেবে কৃষ্ণকে লক্ষ্য করে জরাসন্ধ বারে বারে আক্রমণাত্মক হওয়ায় কৃষ্ণ মথুরা ত্যাগ করে সাগরদ্বীপ দ্বারকায় চলে যান। প্রথম জীবনে কংসের আক্রমণও তাকে এক প্রকার যাযাবরে পরিণত করেছিল। কৃষ্ণের নীতি হলো, সংকটের মুখে বহু মানুষকে ঠেলে দেওয়া নয়; সংকটকে মৃত্যু মুখে ঠেলে দেওয়া। একই সঙ্গে সময়ের উপর সবকিছু ছেড়ে দিয়ে নিষ্কাম কর্ম করে যাওয়া।নিষ্কামের অর্থই হলো ভক্তি। কর্ম এবং ভক্তির সমন্বয়েই তিনি জ্ঞানী। গোপালক কৃষ্ণের গোরগুলি যেমন এখানে-ওখানে গেছে তৃণরসের সন্ধানে। তাদের সাথী কৃষ্ণও খুঁজে নিয়েছেন তৃণরসের ন্যায়শক্তির উৎস।শক্তির উৎস খুঁজতে খুঁজতে এবং সে শক্তিকে সবার মঙ্গলের জন্য ব্যবহারের ইচ্ছা নিয়ে তিনি দার্শনিক ঋষি ও কুট কৌশলীর বহুরূপ নিয়ে বিরাট পুরুষে পরিণত হয়েছেন। এমন এক যোগীপুর ভক্তের জন্য সংকোচ ভেঙে সারথিও হয়েছেন এবং বহু জনের স্বামী হয়েছেন। ভক্তাত্মার সঙ্গে পরমাত্মা কৃষ্ণ সহজেইমিশতে পারেন। তাইতো কৃষ্ণকে ঘিরে এত লৌকিক আচার ও ব্যাখ্যা। লৌকিক ব্যাখ্যাগুলি বারে বারে উচ্চারিত হয়ে এতটাই জনপ্রিয় হয়েছে যে, তা ধর্মীয় ব্যাখ্যার সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। কিংবা বিকৃত হয়ে মুল ব্যাখ্যাই হারিয়ে গেছে।
বেদে ‘রাধো বিশাখে’ বলতে বিশাখা নক্ষত্র চিহ্নিত হয়েছে। ললিত মাধব (১ম অঙ্ক) মতেও রাধার অপর নাম তারা। যদিও এও ঠিক সূর্য ও বিষ্ণু বা কৃষ্ণ এবং তারকা ও গোপী শব্দার্থে অভিন্ন। সূর্য তেজের কাছে কোনো একটি তারার হারিয়ে যাওয়ার মধ্যে আশ্চর্য কিছু নেই। রাসলীলার মতো কোনো খেলায় গোপ-গোপীদের মধ্য থেকে কৃষ্ণের পাশাপাশি এক গোপী হারিয়ে যাওয়া— এ ভ্রমকে আশ্রয় করেই রাধার কল্পনা। ঈর্ষাজনিত এ কল্পনা বিষয়টিকে কামনার পর্যায়ে ফেলেছে। অথচ মহাভারতকে কেন্দ্র করে রচিত শ্রীমদ্ভাগবতে রাধার কোনো স্পষ্ট উল্লেখ নেই। কৃষ্ণ নানা বয়সের গোপ-গোপীদের আদরের। গান্ধর্বী প্রধান গোপী। কৃষ্ণযাত্রায় রাধা ও চন্দ্রাবতী একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী। চৈতন্য পূর্বে রাধা ও চন্দ্রবতীর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। মহাভারতে কর্ণের পালিতা মাতা রাধা-তো এই প্রসঙ্গে আসেই না। চৈতন্য পরবর্তী পর্যায়ে রাধার উপস্থিতি কৃষ্ণ সাধনাকে প্রেম সাধনায় পরিণত করেছে। শক্তি মন্ত্রের পাশে গুরুদীক্ষার নতুন মন্ত্র হিসাবে প্রেম মন্ত্রের আবির্ভাব ঘটলো। বলাবাহুল্য নবদ্বীপের জগন্নাথ মিশ্র ও শচীদেবীর পুত্র চৈতন্যদেব অর্থাৎ গৌর বিশ্বস্বরের জন্ম ৭ মার্চ ১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দে। সর্পবিষে মৃত লক্ষ্মীপ্রিয়া এবং পরবর্তীকালে বিষ্ণুপ্রিয়ার স্বামী। সন্ন্যাসী ঈশ্বর পুরীর শিষ্য। কাটোয়ায় কেশব ভারতীর কাছে সন্ন্যাস দীক্ষা নেন। ষোড়শ শতকে চৈতন্যজীবনী গ্রন্থ চৈতন্যভাগবত লেখেন বৃন্দাবন দাস। সপ্তদশ শতকে চৈতন্যচরিতামৃত লেখেন কৃষ্ণদাস কবিরাজ। চৈতন্যদেবের সঙ্গী নিত্যানন্দের জন্ম ১২ জানুয়ারি ১৪৭৩ খ্রিস্টাব্দে। বীরভূমের বীরচন্দ্রপুরের হাড়াই পণ্ডিত ও পদ্মাবতীর সাত ছেলে ছেলের একজন। বাড়ুরী বংশের নিত্যানন্দ অর্থাৎ নিতাই এক সন্ন্যাসী গৃহেই মানুষ। খড়দহে পড়েছিল চরণ। স্ত্রী জাহ্নবা দেবী। পুত্র বীরভদ্র। সমসাময়িক ভগবত পুরাণ নিয়ে লীলা ভিত্তিক শ্রীকৃষ্ণ বিজয় রচয়িতা মালাধর বসুর জন্ম ১৪৭৮ খ্রিস্টাব্দে বর্ধমানে কুলীন গ্রামে। রাজস্থানে মীরাবাঈয়ের জন্ম ১৪৯৮ খ্রিস্টাব্দে। ভক্তই যদি দেবতার সঙ্গে পুজিত হন, তাহলে আরাধিকা রাধা কোন সময়কালের ভক্ত— এ উত্তরের সন্ধানে গেলে কৃষ্ণের মতো রাধার মানবরূপের সন্ধান করতে হয়। প্রথম-দ্বিতীয় খ্রিস্টাব্দে মহারাষ্ট্রীয় প্রাকৃতে সপ্তশতীর গাথায় রাধা প্রসঙ্গ আছে। ব্রহ্মবৈবর্ত্ত পুরাণ প্রাচীন পুরাণ নয়। এই পুরাণে রাধার উল্লেখ আছে। বিষ্ণুভক্ত যুবতী রাধা শিশু কৃষ্ণকে বিষ্ণু জ্ঞানে জড়িয়ে ধরেন।ভক্ত রাধার এরূপব্যাখ্যা ত্রয়োদশ শতকে বড়ুচণ্ডীদাস রচিত শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ভে গ্রাম্য প্রণয় লীলায় পরিণত হয়। ছড়িয়ে থাকা রাধা-কৃষ্ণ কথা কোনো বিশেষ কবি কাব্য রূপ দিয়েছেন। যেহেতু ধর্ম গ্রন্থ নয়, কাব্যের প্রয়োজনে চরিত্র ব্যাখ্যা বদলানো স্বাভাবিক। ১৩৫০ থেকে ১৫০০ খ্রিস্টাব্দ সময়কালে শিক্ষিত সমাজে বা পরিশীলিত সমাজে বেশ জনপ্রিয় ছিল। আর একটি ধারা ঐতিহ্যাশিত হয়ে আঞ্চলিক ভূখণ্ডের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রইল। বঙ্গসংস্কৃতি জুড়েই তার বিবিধ রূপ। বঙ্গের বাইরেও।
বঙ্গীয় উপজাতিদের নৃত্য-গীত হলো ঝুমুর। যৌন কামনার সহজ রূপ নিয়ে বিষয় হয়েছে রাধা-কৃষ্ণ। পশ্চিম বর্ধমান, পশ্চিম বাঁকুড়া, উত্তর-পশ্চিম পুরুলিয়া-সহ ঝাড়খণ্ড অঞ্চলে এ নৃত্য-গীতের চর্চা। ঝাড় খণ্ড ‘ডোম্বচাণ্ডালী’শব্দ দ্বারাও চিহ্নিত। যেন উত্তর রাঢ়বঙ্গের ডোমচাঁড়ালী। এ নৃত্য-গীত রাধা নয় শক্তির আরাধনা। আসলে নৃত্য-গীতের উৎসই হলো শক্তির চর্চা। অর্থাৎ আক্রমণ ও আক্রমণ থেকে রক্ষার কৌশল। রাধার প্রবেশ এ নৃত্য-গীতের চেনা ছক অনেকটাই বদলে দিয়েছিল। কোথাও কামনা ভালোবাসায় পরিবর্তিত হলো আবার কোথাও কামনার পর্যায়ে রূপান্তরিত হয়ে গেল। কোচবিহারে কানাই ধামলী পালাগানে রাধা-কৃষ্ণের কথপোকথনের মাধ্যমে কাহিনি এগিয়েছে। মাদার বাঁশের জারিতেও গুরুত্ব পেয়েছে ধামাইল দলের কৃষ্ণ-কাহিনিও। বিভিন্ন পালাগানে লোকশ্রুতি নির্ভর কৃষ্ণ কাহিনি গুরুত্ব পেয়েছে। উত্তরবঙ্গে তন্ত্রসাধনার গান তথা তুখা ভাব সংগীতেরও বিষয় হয়েছে রাধা-কৃষ্ণ। সাধক চিত্তের মিলন-বিরহ ও অন্যান্য প্রসঙ্গ। ফাল্গুনী পূর্ণিমাতে দোলযাত্রার উল্লেখ বলতে একমাত্র বৃহদ্ধর্ম পুরাণে পুষ্পরাগ নিক্ষেপ প্রসঙ্গটি আছে। যেন প্রকৃতিই দেবতাকে দোলাচ্ছে। লোকনাট্য -সহ যাত্রাপালায় বা নাট গীতিকায় এসেছে কথা ও লৌকিক গাথা নির্ভর রাধা-কৃষ্ণ প্রসঙ্গ। পাঁচালী গোষ্ঠী সুরেও। কৃষ্ণ বয়সের প্রতি স্তবকে স্পর্শ। করে। পুতুলনাচের বিষয়ও হয়েছে গোপী পুতুল নাটক। আবার শুধু পুতুল গড়নেও নয়, শিশুকে ঘুমপাড়াতে ঘুমপাড়ানি ছড়াতেও এসেছে কৃষ্ণ প্রসঙ্গ। ধাঁধা, প্রবাদ সর্বত্র। কথায় আছে কানু ছাড়া গীত নেই। কৃষ্ণ গান থেকে শ্যামলীলা। পটচিত্রে, মন্দির ফলকে নকশিকাঁথার সরাচিত্রে, পাথর ও ধাতু মূর্তি নির্মাণ সর্বত্র রাধা-কৃষ্ণের রূপ ফুটে উঠেছে।
কৃষ্ণ যখন স্বয়ং দ্বারকায় অবস্থান করছেন, তখনই কৃষ্ণ এতটাই জনপ্রিয় কিংবা মহাভারত রচনা কালে এতটাই জনপ্রিয় যে, ব্যাসদেব । কৃষ্ণের বাল্যজীবন নিয়ে পুনরায় উল্লেখ প্রয়োজন মনে করেননি। কিন্তু অন্য গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রের বাল্য পরিচয় রয়েছে। বলাবাহুল্য, গুজরাটের পশ্চিম উপকূলে দ্বারকা বন্দর কিন্তু কৃষ্ণের দ্বারকা ‘ভেট দ্বারকা’সমুদ্রের নীচে চলে গেছে। কৃষ্ণ কথা ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। লৌকিক ব্যাখ্যাকে দূরে রেখে দার্শনিক ব্যাখ্যা মতে, কৃষ্ণ এক ছিলেন, নিজেকে আস্বাদন। করার জন্য বহু হয়েছেন। এ ব্যাখ্যা মতে কৃষ্ণ থেকেই রাধার উৎপত্তি। কিন্তু কাব্য মতে রাধা সাগর রাজা ও পদুমার কন্যা। অন্যমতেবৃষভানু। ও কৃত্তিকার কন্যা। যেই কৃত্তিকা সেই কীর্তিদা সেই কলাবতী। বোন অলঙ্গমঞ্জুরী, ভাই শ্রীদাম। বৃক ও জটিলার পুত্র অর্থাৎ যশোদারই সহোদর। আয়ন ঘোষ রাধার স্বামী। রাধার ননদ কুটিলা। লীলাসঙ্গিনী বড়াই। রাধার হঠাৎ উপস্থিতি, আবার এই মানব পরিচয় এ সবকিছু মিশে কৃষ্ণলীলাকে বড়োই চমকপ্রদ করেছে। বিশেষ করে রাধার রূপমাধুর্য এবং বিবাহিত জীবনএ দুয়ে কৃষ্ণ চরিত্রকেই অসহায় করেছে। বড়ায়ীর পরামর্শে রাধা কৃষ্ণকে পতিরূপে পেতে কাত্যায়িনী ব্রতও করেছে। তার উপর রুক্মিণী-সহ কৃষ্ণের কোনো স্ত্রী স্বামীর পাশে বিগ্রহ রূপে স্থান না পাওয়াটিও এক প্রকার রাধারই জয়। হরা অর্থাৎ রাধা ভক্তেরই প্রতিক হয়ে দেবী রূপ পেয়েছেন। সৌর্যপুর নগরের যজ্ঞ দত্ত ও সোমশার পুত্র নারদও সে স্থান পাননি। শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্মধারী বিষ্ণুর উপাসনার পাশাপাশি ক্রমশ গুরুত্ব পেয়েছে কৃষ্ণের দাস্য ভাবের উপাসনা। আশ্রয় শ্রীরাধিকার চরণ। নানা বর্ণের মানুষ ভেক নিয়ে বৈষ্ণব হয়েছেন। সঙ্গে চিড়ে দধি মহোৎসব। ১৫০৯ খ্রিস্টাব্দে চৈতন্যদেবের কথা ও সুরের মিলনের কীর্তনকে গীতি সুর থেকে সরিয়ে পদাবলীর গান গাইবার যেনতুন ঢঙের প্রবর্তন ঘটান, তাই হলো হরিনাম সংকীর্তন। জাহ্নবীদেবীর উদ্যোগে মহোৎসবের সূচনা ১৫৮৩ খ্রিস্টাব্দে রাজা সন্তোষ দত্তের সহযোগিতায় রাজশাহির খেজুরিতে ছয়টি বিগ্রহ নির্মাণ করে।
‌খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে মথুরায় শূরসেন গোষ্ঠীর মধ্যে ভারতীয় হেরাক্লেস’অর্থাৎ কৃষ্ণের পুজো হতো। এমন মত চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের আমলে আসা গ্রিক পর্যটক মেগাস্থেনিসের বিবরণে রয়েছে। দ্বাদশ শতকের পরবর্তী সময়ে ভক্তিবাদকে আশ্রয় করেই মূলত কৃষ্ণ পূজার প্রচলন অন্য মতে কৃষ্ণ স্বয়ং ভগবান। তিনি মহাভারত যুদ্ধের মাধ্যমে অধর্মের সঙ্গী আর্যদের এবং বীর অনার্যদের মৃত্যুর কারণ। সেই কৃষ্ণ সাধারণ অনার্য জরা ব্যাধের হাতে মানবলীলা সংবরণ করেন। কথিত মতে পূর্ব জন্মে ওই ব্যাধ ছিলেন সুগ্রীব। যোগাবিষ্ট অবস্থায় থাকা কৃষ্ণের সুন্দর পদযুগলকে হরিণ বা পাখি ভেবে তির নিক্ষেপ করেছিলেন ওই ব্যাধ। কথিত মতে কৃষ্ণের দাহক্রিয়া সমাধার পর দেহাবশিষ্ট সমুদ্রের জলে ভাসানো হয়েছিল। যা কাঠ হয়ে নীলগিরি পর্বতে ঠেকেছিল। এ কাঠেই পুরীর জগন্নাথের মূর্তি নির্মিত হয় এমনই বিশ্বাস। কিছু সত্য আর কিছু রূপক কল্পনা তথা দিব্য ভাবলোকের মিলন ঘটিয়ে কৃষ্ণকে ঘিরে সেজে উঠেছে নানা কথা। দৈত্য বধ থেকে ক্রিড়া-কৌতুক প্রতিটি ঘটনাচিত্র একে অপরের থেকে আলাদা হয়ে বিচিত্র রূপ পরিগ্রহ করেছে। যেন এ ঘটনাগুলি একজনই ঘটাতে পারেন। ওই একজনকে আশ্রয় করে এ সম্ভব নয়; তাও ভাবা যায়। কৃষ্ণ যেন প্রকৃতির শব্দ। যাকে অনুভব করা যায় কিন্তু ধরা যায় না।
অনেক চরিত্রের মধ্যে ধরা দেয় কিন্তু সেই চরিত্রগুলির ভিড়েই হারিয়ে যায়।
চূড়ামণি হাটি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.