সালটা ১৮৫৩।হুগলী বর্ধমান সীমান্ত অঞ্চলে দশঘরার কাছে এক অভিজাত বাড়ি।বেলা ১১টা হবে।ঘরের মধ্যে আয়োজন করা হয়েছে এক আলোচনা সভার। পাড়ার গন্যমান্য ব্যক্তিরা উপস্থিত, রয়েছেন গৃহকর্তা স্বয়ং। জলখাবারের লুচি ছোলার ডাল নানা মিষ্টি পরিবেশিত হচ্ছে।সুখাদ্যের সুঘ্রানে ঘর মাতোয়ারা।আহার সমাপনে হবে আলোচনা। বিষয়বস্তু একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা যাতে মেয়েদের জন্যও শিক্ষার সুযোগ থাকবে।গৃহকর্তা উদার মানসিকতা সম্পন্ন। তিনি খুবই উদ্যোগী এই ব্যাপারে।কিন্তু গ্রামের মানুষেরা মেয়েদের বাইরে আসতে দিতে নারাজ।তাই আজ তিনি বিদ্যাসাগর মহাশয়কে আমন্ত্রন জানিয়ে এনেছেন মানুষকে বোঝানোর জন্য। চলছে তারই প্রস্তুতি।
এমন সময় একটি সাদা থান পড়া ছোট্ট ৬/৭ বছরের মেয়ে দৌড়ে এলো ঘরে। বাবা বাবা, মা কে বলোনা, আমার খুব খিদে পেয়েছে। দাদারা লুচি খাচ্ছে, আর আমি চাইলেই মা বলছে, ছিঃ আজ একাদশী না।খাবার কথা বলতে নেই মা। কিন্তু বাবা,আমি সকাল থেকে কিচ্ছু খাইনি।একটু জল পর্যন্ত না।তুমি,মা,দাদারা কেউ একাদশী করোনা।আমায় কেন করতে হবে! আমার বুঝি খিদে পায়না? সকলের সামনে লজ্জায়,আর মেয়ের প্রতি মায়ায় করুন হয়ে ওঠে জমিদার বাবুর মুখ।আস্তে করে বলেন, এখানে সভা চলছে মা, তুমি ঘরে যাও। করুন দৃষ্টিতে সকলের পাতের দিকে তাকিয়ে বিফল মুখে ভেতরের ঘরে ঢুকে যায় একরত্তি অভাগা মেয়েটি।আর তার পরেই রূপোর থালা বাটিতে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের জন্য সুখাদ্য সাজিয়ে ঘরে আসে বামুন ঠাকুর। বিদ্যাসাগর বলেন শরীরটা ঠিক নেই,আমি খাবোনা কিছু।নিয়ে যাও।বামুন ঠাকুর নিয়ে যান থালা ধরে।গৃহকর্তার অনুরোধ উপরোধেও দাঁতে কাটেন না কিচ্ছু।
শুরু হয় সভা। গ্রামের মানুষদের কাছে প্রথমেই তিনি তুলে ধরেন নারী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথা।সমাজে নারীদের অবদানের কথা। ইতিহাসের পাতা থেকে তুলে ধরেন পশুপালন, কৃষিকাজ সবকিছুরই সূত্রপাত নারীদের হাত ধরে, সেই অমুল্য তথ্য। এক এক করে বলে চলেন ইউরোপে কিভাবে শিক্ষিত নারীরা বিপ্লবে, সমাজ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে তার উদাহরন। জোরালো আপত্তি ওঠে গ্রামের মানুষগুলির কাছ থেকে।ইউরোপের কথা বাদ দিন, আমাদের ধর্মে সমাজে নারীদের বাইরে বেরনো, শিক্ষা নেওয়া পাপ। ব্রহ্মাস্ত্র ছাড়েন বিদ্যাসাগর। কালিদাস কার বরপুত্র?শিক্ষার জন্য আমরা কার কাছে প্রার্থনা করি?দেবী সরস্বতী, তিনি একজন নারী। এর পরেও বলবেন পাপ?তারপর বেদের পাতা থেকে তুলে আনেন অপালা ঘোষা গার্গী লোপামুদ্রাদের। নারী শিক্ষা বিষয়ে শ্লোকগুলি বলতে থাকেন একের পর এক। তীক্ষ্ণ যুক্তি,উদাহরন আর বাগ্মীতার সামনে ভেঙে পড়ে সংস্কারের দেওয়াল। সকলে সম্মত হন নারী শিক্ষার বিষয়ে। বিদ্যাসাগর মহাশয় উপলব্ধি করেন,ইউরোপ নয়, সংস্কার ভাঙতে হবে বেদ কে হাতিয়ার করেই।গৃহকর্তার মুখে তখন বিজয়ীর গৌরব।
সকলে চলে যাবার পর গৃহকর্তা বলেন এবার আপনার ভোজনের ব্যবস্থা করি।একাদশী তাই অন্নের ব্যবস্থা নেই। এইবার লুচি খান কয়েকটা। শরীর আশাকরি সুস্থ হয়েছে। বিদ্যাসাগর মহাশয় বলেন, শরীর আমার সুস্থই আছে,ক্ষত আমার মনে।আমি নারীদের শিক্ষার জন্য ছুটছি,কিন্তু এই বিধবা নারীরা,তাদের দুঃখ,তাদের প্রতি এই ধর্মীয় অমানবিকতা এই দিকে সম্পূর্ণ উদাসিন ছিলাম আমি। ছিঃ ছিঃ, ভাবতেই আমার গ্লানি হচ্ছে। রামমোহন রায় মহাশয় তাদের বাঁচিয়ে ছিলেন জ্বলন্ত চিতা থেকে। কিন্তু ওরা মরছে, রোজ জ্বলছে খিদেয়,অবহেলায়,অমানবিকতায়। আপনার কন্যা আজ চোখ খুলে দিয়েছে। আচ্ছা, আপনি পারেন না, মেয়ের পুনর্বিবাহ দিতে? ওর সামনে তো সারা জীবনটা পড়ে আছে। ও বাঁচুক নতুন করে। বিদেশে তো কতো হচ্ছে। আপনি শুরু করুন। গম্ভীর হয়ে উঠলো গৃহকর্তার মুখ। তিনি বললেন, প্রথমত সমাজ মানবে না। আমাদের প্রাচীন ধর্মেও এর কোন স্বীকৃতি নেই। তারপর হিন্দু ম্যারেজ অ্যাক্টেও রি-মেরেজের কোন আইন নেই। তাই ওর কপাল নিয়েই ওকে এইভাবেই বাঁচতে হবে। আমি নিরুপায়।বিদ্যাসাগর মহাশয় বললেন, স্ত্রী শিক্ষার পাশাপাশি আমার নতুন লড়াই শুরু হোল। এদেশের ছোট ছোট অসহায় বিধবা কন্যাদের বাঁচানোর লড়াই। সমাজ এবং আইন দুটোই পরিবর্তন করবো। শপথ নিলাম আজ। আমায় বিদায় দিন। জলগ্রহন না করে বেরিয়ে পরলেন তিনি।
শুরু হোল লড়াই, আক্ষরিক অর্থেই লড়াই। একদিকে কলেজে অধ্যাপনা,বই ছাপানোর কাজ, তাঁর গড়ে তোলা বিদ্যালয়ের জন্য অর্থ সংগ্রহ,সেগুলিকে তো আর বন্ধ হতে দেওয়া যায়না, তার সঙ্গে রাতের পর রাত জেগে বেদ উপনিষদ পুরান মনু সংহিতা ঘেঁটে চলা, কোথায় আছে নারীর পুনর্বিবাহের বিধান। সিন্ধুর থেকে মুক্তো তোলার মতোই কঠিন সে অনুসন্ধান।দিনের পর দিন,রাতের পর রাত।অবসরের সময় কই?এর সঙ্গে কলকাতার শিক্ষিত সমাজের স্বাক্ষর সংগ্রহ, সরকারের কাছে বিধবা বিবাহ প্রচলনের জন্য পিটিশন জমা দেওয়া।
এদিকে শুরু হয়েছে নতুন বিপত্তি। কলকাতার রক্ষনশীল দল, পুরোহিত সমাজ বিধবা বিবাহের ঘোর বিপক্ষে। তারা কিছুতেই মেনে নেবেনা এই অনাচার। তারা পাল্টা আবেদন করেছে সরকারের কাছে, ধর্মবিরোধী এই আইন চালু হলে সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে তারা। বিদ্যাসাগরের বাড়ির সামনে চলছে প্রতিবাদ ব্যঙ্গ বিদ্রুপের ঝড়। নারীদের প্রতি তাঁর সহানুভুতি নিয়ে অশ্লীল কটূক্তি। বাড়িতে যখন তখন পড়ছে ঢিল,ময়লা,আবর্জনা। একদিন বিদ্যাসাগরকে হামলার মুখেও পড়তে হয়েছে রাস্তায়। বঙ্কিমচন্দ্র বিষবৃক্ষ উপন্যাসে সূর্যমুখীকে দিয়ে বলালেন-” যে বিধবা বিবাহের ব্যবস্থা করে, সে যদি পণ্ডিত হয়, তবে মূর্খ কে!” এইসব কটাক্ষেও কিন্তু বিদ্যাসাগর অনড়। লড়াই তাঁর জীবনে। যিনি ওই দারিদ্র কাটিয়ে কলকাতায় ছাপাখানার ব্যবসা খুলতে পারেন,যিনি উত্তাল নদী সাঁতরে পার হতে পারেন দুর্যোগের রাত্রে,যিনি নিজ খরচে ২১টি বালিকা বিদ্যালয় চালানোর সাহস দেখান, যিনি স্পর্ধা রাখেন ব্রিটিশের সামনে জুতো পড়া পা তুলে ধরার, তার কাছে কোন বাধাই বাধা নয়।কিন্তু বড়লাটের দপ্তর বলেছে বেদ পুরানে কী কোন উদাহরন আছে পুনর্বিবাহের? না হলে আইন পাশ করা মুশকিল। রক্ষনশীলদের চটিয়ে কিছু করার ইচ্ছা নেই ডালহৌসির।
তাই রাতের পর রাত জেগে পুঁথি পত্র পড়ছেন তিনি। কম আলোয় চোখের সমস্যা হচ্ছে, ক্লান্তিতে অনিদ্রায় শরীর ভেঙে পড়ছে, হতাশা আসছে মনে। কিন্তু পরক্ষনেই চোখে ভাসছে ওই একরত্তি বিধবা মেয়েটির করুণ মুখখানি,সারা দেশের হাজার হাজার বিধবা নাবালিকার অসহনীয় জীবনের দীর্ঘশ্বাস শুনতে পাচ্ছেন তিনি। আবার শুরু হচ্ছে তাঁর অন্বেষণ। তারপর, তারপর পাওয়া গেলো সেই মুক্তো।পরাশর সংহিতার অমর সেই শ্লোক “নষ্টে মৃতে প্রবরজিতে ক্লীবে চ পতিতে পতৌ/ পচস্বাপতসু নারীনাং পতিরন্যো বিধয়তে।”(স্বামী মারা গেলে, সন্ন্যাস নিলে, নিখোঁজ হলে,সন্তানগ্রহনে অক্ষম হলে,অধার্মিক ও অত্যাচারী হলে পত্নী আবার বিবাহ করতে পারে।)
তিনি ছুটলেন সরকারের দ্বারে। প্রমান করলেন বিধবা বিবাহ শাস্ত্রসম্মত। আর বাধা রইলো না কিছুই। ১৮৫৬ সালের ১৬ই মতান্তরে ২৬ শে জুলাই পাশ হোল বিধবা বিবাহ আইন। লক্ষ লক্ষ বাল্য বিধবা পেলো মুক্তির আশ্বাস। শুধু চালু করেই ক্ষান্ত থাকলেন না। নিজের পুত্রের বিধবার সাথে বিবাহ দিয়ে দেখিয়ে দিলেন সমাজকে। এখানেই তিনি অনন্যসাধারন। সিংহহৃদয় এর মধ্যে কুসুমকোমল অনুভুতির প্রকাশ।আমরা আজ ১৫০বছর পরেও যে সংস্কার কাটিয়ে উঠতে পারলাম না, তিনি সেই যুগে দাঁড়িয়ে করে দেখালেন তা।
আজ সেই মহামানবের প্রয়ান দিবস।তিনি চলে গেছেন সেই ১৮৯১ সালে। কিন্তু রয়ে গেছে তাঁর লড়াই,তাঁর আদর্শ,তাঁর অবদান। যে আদর্শ আলো দেখিয়েছে আপামর বাঙালিকে। যার হাত ধরে আমাদের অক্ষর চিনতে শেখা। সেই মহামানবকে প্রয়ান দিবসে জানাই শত প্রনাম।”বেঁচে থাকো বিদ্যাসাগর চিরজীবী হয়ে।”
গৌতম দত্ত