॥১॥

আধুনিক সংস্কৃতি ও সাহিত্যের দীর্ঘ-বিসর্পিত পথরেখা। আদি আছে, অন্ত নেই!…

কুহেলিকার অস্পষ্টতায় ঢাকা সে ছায়াচ্ছন্ন পথে সবেগে যাত্রা করেছিলেন এক সবল মানুষ ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে। প্রতিভাদীপ্ত তাঁর ললাট, হাতে উজ্জ্বল দীপশিখা। সে যাত্রীর নাম রামমোহন রায়। সংস্কৃতির সাগর-সঙ্গমের দিকে যাত্রাপথে তাঁর সঙ্গী হলেন আরও অনেক তীর্থপথিক। কলরবে মুখরিত হল পায়ে-চলার পথখানি। হঠাৎ একদিন থেমে গেল ক্লান্ত পথিকের অগ্রগতি!

কিন্তু দীপ নিভল না; দীপশিখাও রইল অম্লান। সে দীপ হাতে রামমোহনের পদচিহ্ন অনুসরণ করে এগিয়ে গেলেন তাঁর সুযোগ্য শিষ্য মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ।

সংস্কৃতির সাগর-সঙ্গমের দিকে যাত্রাপথে তাঁর সঙ্গী হলেন আরও অনেক তীর্থপথিক। পূর্ব দিকে প্রসারিত সে-পথের রেখা।

সে পথের ওপর ছড়িয়ে পড়ল পাশ্চাত্য আকাশের উজ্জ্বল আলোকচ্ছটা দেবেন্দ্রনাথেরই অন্যতম সঙ্গী অক্ষয়কুমারের সাধনায়। তীর্থপথের রেখা স্পষ্টতর হয়ে উঠল। দৃষ্টির আচ্ছন্নতা গেল আরও কেটে।

সে দৃষ্টির আলোকে তীর্থপথিকেরা দেখতে পেলেন সংস্কৃতির গঙ্গা-যমুনা সঙ্গম যেন অতি নিকটে। কিন্তু সংস্কৃতি-সঙ্গমের কলধ্বনিময় প্রবাহ-ই তাঁদের দৃষ্টিবিভ্রম ঘটিয়েছিল। আসলে পূর্ব ও পশ্চিম আকাশের মিশ্রিত আলোকে দীপ্তোজ্জ্বল সংস্কৃতির সাগর-সঙ্গম এখনও অনেক দূরে। সংস্কারমুক্ত দৃষ্টি দিয়ে দূর-দিগন্তে অবস্থিত সংস্কৃতির সে সাগর-সঙ্গমের স্বপ্নে বিভোর দেবেন্দ্রনাথেরই সহযাত্রী আর একজন তীর্থপথিক।

বিসর্পিত পথের একপার্শ্বে দাঁড়িয়ে তিনি যাত্রীদের এ মিছিল দেখছেন। কখনও তাঁদের সঙ্গে খানিকটা এগোচ্ছেন, কখনো বা থম্‌কে দাঁড়াচ্ছেন। উন্নত ললাটে তাঁর সুগভীর চিন্তার রেখা।

অনুভব করছেন এ পথিক মনে মনে, দূর-দিগন্তে অবস্থিত সংস্কৃতির সাগর-সঙ্গমে পৌঁছতে হলে আগে চাই তীর্থপথিকের মনে অপরাজেয় শক্তি, সম্পূর্ণ স্বচ্ছ সংস্কারমুক্ত দৃষ্টি, আর ক্লান্তিহীন দীর্ঘপথ চলবার জন্য দেহে অপরিমিত বল।

‘নায়মাত্মা বলহীনেন লভ্যঃ’—বল ছাড়া মানুষ আত্মস্থ হবে কী করে? সে বল লাভের জন্য প্রথমে চাই মুক্তজ্ঞানের চর্চা, যে জ্ঞান এনে দেবে চিত্তে স্বাতন্ত্র্যবোধ। এ স্বাতন্ত্র্যবোধের ফলেই মানুষের মনে জেগে উঠবে নিত্য নব আদর্শলাভের চেষ্টা জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে। সে বিচিত্র ভাব ও কর্মাদর্শই জীবনপথের পথিককে পৌঁছে দেবে সংস্কৃতির উদার সাগরসঙ্গমে।

সে তীর্থপথিক আরও অনুভব করলেন, সংস্কৃতি-চর্চার নামে সংস্কৃতি-বিলাস দিয়ে লক্ষ্যে পৌঁছনো যাবে না। তার জন্যে চাই অক্লান্ত কর্মোদ্যম। জ্ঞানের আলোকে দৃষ্টি যদি স্বচ্ছ না হয়, তা হলে সংস্কৃতির বিসর্পিত ও দুর্গম পথে মানুষ চলবে কী করে? আর সমাজের মুষ্টিমেয় পুরুষ যদি এ শিক্ষা পায়, তাতেও চলবে না—এ দূরান্তরের পথে ‘আত্মার সঙ্গিনী’ সংস্কারমুক্ত নারী যদি সাহচর্য দেয়, তা হলে পুরুষ চিত্তে পাবে বল, তার যাত্রাপথ হবে সুগম। সেজন্য নারীর চিত্তেও জ্ঞানের নির্মল আলোক ছড়িয়ে দিতে হবে। দূর করে দিতে হবে নারীর জীবনের পথ থেকে সকল রকমের বাধা–সমাজের অবাঞ্ছিত নিষ্ঠুর অত্যাচার, সংস্কারের দুর্মর গ্লানি। তবে তো বহুযুগান্তরব্যাপী অন্তঃপুরে শৃঙ্খলিতা খাঁচার পাখি হয়ে উঠবে মুক্তপক্ষ বনবিহঙ্গী—মৃতপ্রায় বাঙালি জাতির জীবনে জেগে উঠবে মুক্তির জয়সঙ্গীত!

উদ্দেশ্য স্থির হয়ে গেল। এবার লক্ষ্যে পৌঁছবার আয়োজন। দৃঢ়পদবিক্ষেপে তখন অগ্রসর হলেন সে উন্নতললাট প্রতিভাদীপ্ত যুবক আধুনিক বাঙালি সংস্কৃতির সাগর-সঙ্গম অভিমুখে ঊনবিংশ শতাব্দীর চতুর্থ দশকে। এ তীর্থপথিকের নাম পুণ্যশ্লোক ঈশ্বরচন্দ্র শর্মা।

॥২॥

পূর্বসূরী রামমোহন বা সমসাময়িক কালের দেবেন্দ্রনাথের মতো আভিজাত্য গৌরব নেই; সমকালীন ‘ইয়ং বেঙ্গল’দের মতো পাশ্চাত্ত্য সাহিত্য ও দর্শনের দিগন্তপ্রসারী সমুদ্রবক্ষে তরণীও ভাসাননি তিনি। সম্বলের মধ্যে আছে তাঁর উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত রাঢ়ীয় কুলীন ব্রাহ্মণের প্রবল তেজস্বিতা, প্রাচীন ভারতীয় বিদ্যায় অগাধ অধিকার, প্রতিকূল শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে জয়ী হবার উদগ্র কামনা, চারদিকের ঘটনাস্রোতের প্রতি সদাজাগ্রত দৃষ্টি, আর সংস্কারাচ্ছন্ন অনগ্রসর মানুষের জন্যে তাঁর উদার অন্তরের সহজ মমত্ববোধ–ইংরেজিতে যাকে বলে ‘হিউম্যানিজম’।

এ মূলধন নিয়ে বিদ্যাসাগর ঝাঁপিয়ে পড়লেন সমকালীন সমাজ, সংস্কৃতি ও শিক্ষা আন্দোলনের বিক্ষুব্ধ তরঙ্গের মধ্যে। রামমোহন বা দেবেন্দ্রনাথের মতো প্রচুর অবকাশ বা স্বাধীনতা প্রথম কর্মজীবনে তাঁর ছিল না, বাংলাদেশে যে নতুন চাকুরিজীবী মধ্যবিত্তশ্রেণী ক্রমে ক্রমে সমাজের মধ্যে মাথা উঁচিয়ে উঠছে, তারই প্রতীক বিদ্যাসাগর—অন্নসংস্থানের জন্য প্রথমে লালদীঘির পাশে ফোর্ট-উইলিয়ম কলেজের সাহিত্যের অধ্যাপক (সেরেস্তাদার পণ্ডিত), তার পর গোলদীঘির সংস্কৃত কলেজের প্রথমে অধ্যাপক ও পরে অধ্যক্ষ, এবং আরও পরে অধ্যক্ষতার সঙ্গে সঙ্গে স্কুলসমূহের ইন্সপেক্টরের কাজ।

ফোর্ট উইলিয়মে কাজ করবার সময়ও (১৮৪১ ) দেখা যায়, বিদ্যাসাগরের ‘শুধু দুটি অন্ন খুঁটি কষ্ট ক্লিষ্ট প্রাণ’ বাঁচিয়ে রাখবার জন্যে ক্লান্তিহীন প্রয়াস,—মাইনের ৫০টি টাকার মধ্যে ২০টি টাকা পিতামাতা ও পরিবারবর্গের ভরণপোষণের জন্যে বাড়িতে পাঠিয়ে বাকি ৩০ টাকা দিয়ে বৌবাজারে বাড়ি ভাড়া, ৯ জন লোকের খাইখরচা প্রভৃতি করে পয়সার অভাবে চলছে বৌবাজার থেকে লালদীঘির পারে রাইটার্স বিল্ডিং পর্যন্ত হেঁটে কলেজে যাওয়া। কিন্তু যে অদম্য জ্ঞানস্পৃহা বিদ্যাসাগর-চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য—জীবনের এত কৃচ্ছসাধনার মধ্যেও সে প্রবৃত্তি তখনও তাঁর মনে সজীব। ফোর্ট উইলিয়ম কলেজে অধ্যাপনার অবকাশে নিজের চেষ্টায় উৎকৃষ্ট হিন্দি ও ইংরেজি লেখা ও পড়া দুই-ই শিখেছিলেন বিদ্যাসাগর। যে পরহিতৈষণা পরবর্তীকালে তাঁর চরিত্রে গৌরব দান করেছে, তার প্রারম্ভও হয় এ সময়ে। তাঁর বৌবাজারের বাসা ছিল একই সঙ্গে তাঁর বাসস্থান ও জ্ঞানচর্চার কেন্দ্রস্থল। এখানেই দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে তিনি ইংরেজি শিক্ষা করেন (বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ, ২য় খণ্ড–বিনয় ঘোষ পৃষ্ঠা ২৩৮-২৩৯); এখানেই রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে (রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পিতা) সংস্কৃত পড়াতে গিয়ে তিনি প্রাচীন পদ্ধতিতে সংস্কৃত পড়ার দুরূহতা উপলব্ধি করেন—যার ফলে পরবর্তীকালে সহজ উপায়ে সংস্কৃত শিক্ষার জন্য তিনি রচনা করেন ‘উপক্রমণিকা’ ও ‘ব্যাকরণ কৌমুদী’।

(রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ–শিবনাথ শাস্ত্রী। পৃ ১৮৯-১৯০)। এ সময় প্রচলিত ঘুণে-ধরা সমাজ ও শিক্ষার সংস্কারকামনা বিদ্যাসাগরের মনে নিশ্চয়ই জাগত; ইতিপূর্বে ছাত্র জীবনেই তিনি সৃজ্যমান বাঙালি সংস্কৃতির ক্ষেত্রে নবীন ও প্রাচীনের প্রবল দ্বন্দ্ব স্বচক্ষে দেখেছেন; তাঁর কর্মজীবনে সে-দ্বন্দ্ব ক্রমশঃ নিস্তেজ হয়ে এলেও, একেবারে স্তিমিত হয়নি।(বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ, ২য় খণ্ড–বিনয় ঘোষ। পৃষ্ঠা ২৩৯)। কিন্তু যে মধ্যবিত্ত জীবনের ধূসর ছায়ায় তাঁর জীবন তখন প্রবহমান, সে সময় সমাজ বা শিক্ষার সংস্কারের বড় বড় সমস্যা মাথায় এলেও তা সমাধান করবার মতো সময় বা সুযোগ তাঁর ছিল কোথায়?

সময় বা সুযোগ না থাকার কারণ—১৮৪১ থেকে ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এ দশবছর বিদ্যাসাগর অক্লান্ত চেষ্টা ও সাধনা দিয়ে ভবিষ্যৎ কর্মজীবনের জন্য নিজেকে গড়ে তোলবার কাজে ব্যস্ত। এ সময়টার মধ্যে বিদ্যাসাগর একটানা চার বছর ফোর্ট-উইলিয়ম কলেজের সেরেস্তাদারের কাজ, তারপর তিন মাস সংস্কৃত কলেজের সহকারী সম্পাদকের কাজ, তারপর এক বছর নয় মাস ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের হেড-রাইটার ও কোষাধ্যক্ষের কাজ করেন। তারপর ১৮৫০-এর ৫ই ডিসেম্বর তিনি সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক, এবং তার এক মাস পরেই (১৮৫১, ২২শে জানুয়ারি) সে কলেজের অধ্যক্ষের পদে উন্নীত হন।(বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ, ২য় খণ্ড–বিনয় ঘোষ পৃষ্ঠা ২৩৬)।

সেদিনের কলকাতার নবোদ্ভিন্ন বিত্তকুলীন সমাজে যে-কোনও জনহিতকর কাজে হাত দিতে হলে পদমর্যাদার দরকার, অর্থেরও দরকার—দারিদ্র্যের সঙ্গে নিরন্তর সংগ্রাম করে বিদ্যাসাগরের মনে নিশ্চয়ই এ বোধ জেগেছিল। তাই সে-যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সরকারি কলেজের অধ্যক্ষের পদ এবং অধ্যক্ষজীবনের শেষের দিকে সম্মানজনক স্কুলসমূহের পরিদর্শকের কাজ পেয়ে হয়ত তিনি কিছুটা আত্মতৃপ্তি লাভ করেছিলেন। কিন্তু ‘মূল্যহীনেরে সোনা করবার’ কাজে যাঁর জীবন উৎসর্গীকৃত, তাঁর যে ‘সঞ্চিত ধনে উদ্ধত অবহেলা’ থাকবে সে তো স্বাভাবিক। ১৮৫১ থেকে ১৮৫৮ পর্যন্ত এ সাতবৎসর কাল তিনি কলেজের অধ্যক্ষতা ও বিদ্যালয়সমূহের পরিদর্শনের কাজে নিজেকে ব্যাপৃত রেখে, সে একচ্ছত্র বৃটিশ-অধিকারের যুগেও, শিক্ষাসংস্কার ও শিক্ষাবিস্তার কার্যে যে স্বাধীন কর্মোদ্যমের পরিচয় দিয়েছিলেন তা আজকের যুগের শ্রেষ্ঠ শিক্ষাব্রতীর জীবনেও দুর্লভ। কিন্তু শিক্ষাবিস্তার ও সংস্কারমূলক জনহিতকর কাজ করতে গিয়ে যখনই তিনি বাধা পেলেন তৎকালীন রক্ষণশীল সরকার থেকে, তখনই তিনি লোভনীয় বেতনের উচ্চপদ ত্যাগ করতে একমুহূর্তও দ্বিধা করেননি।

সে-যুগের পক্ষে এতবড় সম্মানজনক চাকরি বিনা দ্বিধায় ত্যাগ করা বিদ্যাসাগরের অনমনীয় ব্যক্তিত্বের পরিচায়ক সন্দেহ নেই। তাঁর সে প্রবল ব্যক্তিত্ব সে-যুগের অধিকাংশ মেরুদণ্ডহীন বাঙালির আত্মমর্যাদাজ্ঞানহীন আচ্ছন্ন দৃষ্টির সামনে যে একটা বিরাট আদর্শের সন্ধান দিয়েছিল তাও খুবই সম্ভব। এভাবে সরকারি চাকরি-জীবনের আকস্মিক পরিসমাপ্তির পর বিদ্যাসাগর এসে দাঁড়ালেন বৃহত্তর সমাজ-জীবনের প্রশস্ত ক্ষেত্রে। এর পর শুরু হল বিদ্যাসাগরের কর্মজীবনের দীর্ঘতম পর্ব, যা ব্যাপ্ত হয়ে আছে সুদীর্ঘ বত্রিশ বছর (১৮৫৯ থেকে ১৮৯১ সাল )—তাঁর মৃত্যুকাল পর্যন্ত। কিন্তু তাঁর সমাজ-সংস্কার-প্রচেষ্টার পরিচয় নেওয়ার আগে আজীবন শিক্ষাব্রতী বিদ্যাসাগরের মানব-মাহাত্ম্যবোধের অন্যতম নিদর্শন শিক্ষা সংস্কার ও শিক্ষা প্রচারের কিছুটা পরিচয় দেওয়া প্রয়োজন।

॥৩॥

পাশাপাশি দুটো শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশের তৎকালীন অন্যতম সংস্কৃতির কেন্দ্র। একটিতে চলছে ইংরেজি সাহিত্য ও পাশ্চাত্য যুক্তিবিদ্যার (লক, হিউম, মিল, বেন্থাম প্রভৃতির) অবাধ আলোচনা, আর একটিতে সংস্কৃত ব্যাকরণ (মুগ্ধবোধ), সংস্কৃত অলঙ্কার (সাহিত্যদর্পণ, কাব্যপ্রকাশ, রসগঙ্গাধর), সংস্কৃত কাব্য-নাটক (রঘুবংশ, কুমারসম্ভব, মেঘদূত, কীরাতার্জুনীয়, শিশুপালবধ, নৈষধচরিত ইত্যাদি), বেদান্ত, স্মৃতি (মিতাক্ষরা, দায়ভাগ, দত্তক মীমাংসা ইত্যাদি), জ্যোতিষ (লীলাবতী, বীজগণিত প্রভৃতি) এবং ছিটেফোঁটা ইংরেজি-চর্চা। এক বিদ্যালয়ের ছাত্র অধিকাংশই তৎকালীন কলকাতার বিত্তবান ও প্রগতিশীল হিন্দু পরিবারের আদরের দুলালেরা; আর এক বিদ্যালয়ের ছাত্র রক্ষণশীল উচ্চবংশের সন্তানেরা। এক বিদ্যালয়ের ছাত্রদের দৃষ্টি পশ্চিমদিকে, আর এক বিদ্যালয়ের ছাত্রদের দৃষ্টি পূর্বদিকে। একদলের মনোভাব-‘A single shelf of a good European library was worth the whole native literature of India and Arabia’, আর একদলের মনোভাব ‘ব্যাদে সবই আছে’র মতো। একদল বলছিল—’If there is anything that we hate from the bottom of our heart, it is Hinduism’, আর একদলের মনোভাব—সনাতন হিন্দুধর্মই একমাত্র সত্য। একদলের কাছে ইউরোপীয় পোশাকপরিচ্ছদ পরিধান, সুরাপান (এককালে বেশ্যাসক্তিও), নিষিদ্ধ-মাংস-ভোজন প্রগতিশীলতার প্রধান লক্ষণ; আর একদলের কাছে এ সমস্তের সংস্পর্শ বিষবৎ এড়ানোই সংস্কৃতির অন্যতম চিহ্ন। এত বিপরীতধর্মী শিক্ষা ও সংস্কৃতির আদর্শ বাংলাদেশে আর কোনদিন বোধহয় দেখা যায়নি।

হিন্দু-কলেজে ছাত্রাবস্থায় রাঢ়ীয় কুলীনবংশের দরিদ্র সন্তান বিদ্যাসাগর কলকাতার সংস্কৃতিক্ষেত্রে এ ভাববিপ্লব নিশ্চয়ই দেখে থাকবেন; কিন্তু এ ভাবান্দোলন তাঁর মনে কী প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল তা জানবার উপায় নেই। কোনও প্রতিক্রিয়া হলেও, বড়বাজারের সে অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘরবাসী ঈশ্বরচন্দ্রের সেদিকে মন দিয়ে সমসাময়িক আন্দোলনে সক্রিয় কোনও অংশ গ্রহণ করবার সময় বা সুযোগ ছিল না। জ্ঞানতাপস ঈশ্বরচন্দ্রের জ্ঞানসমুদ্রে সন্তরণই ছিল এ সময় প্রধান কাজ। তারপর ছাত্রজীবনে সাফল্যের পর ফোর্ট উইলিয়ম কলেজে তিনি যে শুধু চাকরি করতেন তা নয়, কর্মের অবসরে ফোর্ট উইলিয়ম কলেজে বসে একদিকে তিনি নতুন বাংলা-সাহিত্য-নির্মাণের প্রয়াস পেয়েছেন, আর একদিকে তার ইউরোপীয় বন্ধুদের সাহায্যে ইউরোপীয় ভাষাচর্চায় আত্মনিয়োগ করেছেন তার প্রমাণ আছে। এ ইউরোপীয় ভাষায় ব্যুৎপত্তি তাঁর স্পর্শকাতর মনের সামনে নিশ্চয়ই খুলে দিয়েছিল ইউরোপীয় জ্ঞান বিজ্ঞানের অজ্ঞাত রাজ্য। তার যুগসচেতন চিত্তে লেগেছিল এ যুগের ছোঁয়া। এ যুগ-শিক্ষাকে আমাদের দেশীয় শিক্ষার প্রাচীন ধারার সঙ্গে মিশিয়ে বাঙালি চিত্তকে উদার সংস্কৃতির গঙ্গা-যমুনা-সঙ্গমে কী করে পৌঁছে দেওয়া যায়, এ চিন্তা এ সময় তাঁর মনে জেগেছিল—এ অনুমান একেবারে অহেতুক মনে হয় না। অবশেষে বহুবাঞ্ছিত সুযোগ এল, যখন বিদ্যাসাগর সংস্কৃত-কলেজের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হলেন ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দের। ২২শে জানুয়ারি। তখন থেকে লেগে গেলেন তিনি যুগোপযোগী শিক্ষা-সংস্কারের কাজে।

ইতিপূর্বে লালদীঘির ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের শাসনশৃঙ্খলার সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন বিদ্যাসাগর; তাই সর্বপ্রথমে সংস্কৃত কলেজের শ্লথ নিয়ম-শৃঙ্খলা তাঁর কাছে অসহ্য মনে হল। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি ছাত্র ও শিক্ষকদের কঠোর নিয়মানুবর্তী করে তুললেন। প্রতি অষ্টমী ও প্রতিপদে কলেজ-ছুটির বদলে ইংরেজি স্কুলের মতো প্রতি রবিবার ছুটির দিন ধার্য হল। এর মধ্যেও আমরা বিদ্যাসাগরের আধুনিক মনের পরিচয় পাই। কলেজে ছাত্র-নির্বাচন ব্যাপারে যে বর্ণ বৈষম্য প্রচলিত ছিল, ‘হিউম্যানিস্ট’ বিদ্যাসাগরের কাছে তা মনে হল মধ্যযুগীয় বর্বর প্রথার মতো। সমস্ত দেশের মধ্যে প্রাচ্যবিদ্যার আদর্শে ওই একটি মাত্র শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান; তার দ্বারও যদি অব্রাহ্মণদের নিকট বন্ধ থাকে, তাহলে দেশে শিক্ষা-বিস্তারের আশা কোথায়? তাই তিনি ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দে কায়স্থদের নিকট, এবং ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে সকল জাতির নিকট সংস্কৃত কলেজের উচ্চশিক্ষার দ্বার উন্মুক্ত করে দিলেন।

শিক্ষালাভের উদ্দেশ্য সম্পর্কেও বিদ্যাসাগরের দৃষ্টিভঙ্গী ছিল অত্যন্ত বাস্তবপন্থী। যে শিক্ষা শিক্ষার্থীকে সমাজজীবনের উচ্চতম মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করে না, সে শিক্ষার মূল্য কতখানি—এ প্রশ্ন এ সময় বিদ্যাসাগরের মনে জাগল, যখন তিনি দেখলেন সংস্কৃত-কলেজের উচ্চতম উপাধিধারী ছাত্রকে সরকারি উচ্চতম পদ (ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট) দেওয়া হয় না, অথচ হিন্দু-কলেজ ও কলকাতা-মাদ্রাসায় উত্তীর্ণ ছাত্রদের সে-পদ দেওয়া হয়। এ  নিয়ে আরম্ভ হল বিদ্যাসাগরের অক্লান্ত চেষ্টা। সে চেষ্টা অবশেষে ফলবতী হল। তদানীন্তন সরকার বিদ্যাসাগরের যুক্তির মূল্য বুঝে শেষ পর্যন্ত সংস্কৃত-কলেজের ছাত্রদেরও শাসন-বিভাগে উচ্চতর পদে (ডেপুটি ম্যাজিস্টেট) নিযুক্ত করতে স্বীকৃত হলেন।

দয়ার সাগর ছাত্রবন্ধু বিদ্যাসাগর। কিন্তু যে দয়া ছাত্র-সমাজকে নিয়ম-শৃঙ্খলার পরিপন্থী করে তোলে, সে দয়া তার কাছে অর্থহীন। সংস্কৃত কলেজের প্রতিষ্ঠাকাল ১৮২২ থেকেই সংস্কৃত কলেজের ছাত্রদের শিক্ষার জন্য কোনও বেতন লাগত না। এতে ছাত্রেরা ইচ্ছামতো কলেজে যাওয়া-আসা করত। এ শৃঙ্খলাহীনতা দূর করবার জন্যে নিয়মব্রতী বিদ্যাসাগর ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দে ছাত্রবেতন দু’টাকা এবং ১৮৫৪ সন থেকে এক টাকা করে ধার্য করলেন। এতে ঈপ্সিত ফল ফলল। ছাত্রেরা নিয়মানুবর্তী হয়ে কলেজে যাওয়া-আসা করতে লাগল। শুধু মাত্র ছাত্র নয়, শিক্ষকদের মধ্যেও যেখানে তিনি শৈথিল্য দেখলেন, কঠোর হস্তে সে শিথিলতা দূরীভূত করে সংস্কৃত-কলেজকে অন্যান্য ইংরেজ-পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো আধুনিক করে তুললেন।

বিদ্যাসাগরের সুস্থ ও সুশৃঙ্খল নিয়মাধীনে সংস্কৃত কলেজের কাজ চলতে লাগল। এবার তিনি অভ্যন্তরীণ শিক্ষাসংস্কারে মন দিলেন। যে ‘মুগ্ধবোধ ব্যাকরণ’ আয়ত্ত করতে বিদ্যাসাগর নিজে অনেক চোখের জল ফেলেছেন, পাঠ্যক্রম থেকে সে বোপদেবের ‘মুগ্ধবোধ’-পাঠ তিনি তুলে দিলেন। সে জায়গায় প্রবর্তিত করলেন তিনি বাংলায় লেখা স্বরচিত ‘সংস্কৃত ব্যাকরণের উপক্রমণিকা’ ও ‘ব্যাকরণ কৌমুদী’। সংস্কৃত কাব্য ও গদ্য হতে সুনির্বাচিত অংশ নিয়ে তৈরি ‘ঋজুপাঠ’ও ছাত্রদের পাঠ্য করা হল। এতে অতি অল্প সময়ের মধ্যে ছাত্রদের কাছে সংস্কৃত-শিক্ষার পথ সুগম হল। সেকালের সংস্কৃত-শিক্ষার পক্ষে এ যে কতবড় সংস্কার তা আজকের শিক্ষাব্রতীদের পক্ষে অনুভব করা অত্যন্ত শক্ত।

এর পর আরম্ভ হল কলেজের ইংরেজি শিক্ষা-সংস্কার। ইংরেজি শিক্ষার ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগর পক্ষপাতী ছিলেন আধুনিক Direct Method-এর। তাই সংস্কৃতের মাধ্যমে ভাস্করাচার্যের ‘লীলাবতী’ ও ‘বীজগণিত’ শিক্ষার স্থানে তিনি ইংরেজির মাধ্যমে গণিত-শিক্ষার ব্যবস্থা করলেন। ইংরেজি শিক্ষা আগে ছিল ঐচ্ছিক, বিদ্যাসাগর ইংরেজিকে একটি আবশ্যিক শিক্ষার বিষয় হিসেবে নির্দিষ্ট করে দিলেন। ইংরেজি ও ইংরেজির মাধ্যমে অঙ্ক-শিক্ষার জন্য উপযুক্ত বেতনে শিক্ষকও নিযুক্ত হলেন।

বিদ্যাসাগর যখন তাঁর প্রিয় সংস্কৃত কলেজের শিক্ষার্থীদের নিজের শিক্ষাদর্শে গড়ে তোলার কাজে ব্যস্ত, সে সময় (১৮৫৩ সনে) শিক্ষা-পরিষদের আমন্ত্রণে কাশী সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ ডাঃ ব্যালেন্টাইন এলেন সংস্কৃত-কলেজের কার্যধারা পরিদর্শন করতে। কলেজের কার্যক্রম পরিদর্শন করে ডাঃ ব্যালেন্টাইন সংস্কৃত কলেজে প্রচলিত শিক্ষাকে আরও কার্যকরী করে তুলতে হলে কী কী উপায় অবলম্বন করা দরকার সে-সম্পর্কে শিক্ষা-পরিষদের নিকট একটি বিস্তৃত রিপোর্ট দেন। শিক্ষা-পরিষদ সে-রিপোর্ট বিদ্যাসাগরের নিকট পাঠিয়ে দিলে, বিদ্যাসাগর ব্যালেন্টাইনের শিক্ষা-সংস্কার-সংক্রান্ত সমস্ত মতামত সমর্থন করতে না পেরে যে-সমালোচনা শিক্ষা-পরিষদের নিকট পাঠিয়ে দেন—সেটি, এবং ইতিপূর্বে ১৮৫০ সালে সংস্কৃত কলেজের প্রচলিত শিক্ষাপ্রণালী ও বিধিব্যবস্থা সংস্কারের জন্য শিক্ষা-পরিষদের নিকট পাঠানো বিস্তৃত রিপোর্টটি “বাংলাদেশের আধুনিক শিক্ষার ইতিহাসে দুটি যুগান্তকারী দলিলরূপে গণ্য হবার যোগ্য।” এ দুখানি রিপোর্টে বিদ্যাসাগর শিক্ষা-সংস্কার সম্পর্কে যে সমস্ত মতামত নির্ভীকভাবে ব্যক্ত করেন, তা ছিল সে-যুগের পক্ষে অত্যন্ত অগ্রসর। প্রথম রিপোর্টে তিনি প্রচলিত সংস্কৃত-শিক্ষার অসার অংশ বর্জন করে আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষার আদর্শে সংস্কৃত-কলেজের শিক্ষাকে উন্নীত করতে উপদেশ দেন। ব্যালেন্টাইনের রিপোর্টের উত্তরে বেদান্ত ও সাংখ্য যে ভ্রান্ত দর্শন—তাঁর এ নির্ভীক উপলব্ধি বিদ্যাসাগর সে-যুগের প্রাচীনপন্থী সমাজের মধ্যে বাস করেও প্রকাশ করতে দ্বিধা করেননি। তারপর ডাঃ ব্যালেন্টাইন বেদান্তের সঙ্গে পাশ্চাত্য দর্শনের সামঞ্জস্য অনুভব করবার ক্ষমতা অর্জনের জন্য সংস্কৃত-কলেজের ছাত্রদের যেখানে বার্কলের “Inquiry” পড়তে উপদেশ দিচ্ছেন, সে জায়গায় বিদ্যাসাগর শিক্ষা-পরিষদকে পরামর্শ দিচ্ছেন সংস্কৃত-কলেজে ‘খাঁটি’ পাশ্চাত্য দর্শন শিক্ষার ব্যবস্থা করতে। তা হলে, বিদ্যাসাগরের মতে, সংস্কৃত কলেজের ছাত্ররা প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দর্শনের তুলনামূলক বিচার করে সত্যে উপনীত হ’তে সহজেই সক্ষম হবে। ব্যালেন্টাইনের প্রস্তাবিত শিক্ষা-ব্যবস্থার মধ্যে ছিল প্রাচীনপন্থী সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতদের মনস্তুষ্টির চেষ্টা। বিদ্যাসাগর তীক্ষ্ণ বুদ্ধিবলে শিক্ষাক্ষেত্রে পাশ্চাত্য ‘ডিপ্লোম্যাট’ ব্যালেন্টাইনের এ অপচেষ্টা-প্রবৃত্তিকে ধরে ফেলেন, এবং শিক্ষার ক্ষেত্রে সে-অপচেষ্টাকে বাধা দেন। সুদূরপ্রসারী দৃষ্টি দিয়ে বিদ্যাসাগর দেখতে পেয়েছিলেন, বাংলাদেশে প্রাচীনপন্থীদের যুগ অবসিত প্রায়। কর্ম ও ভাবচঞ্চল বিদেশি ইংরেজদের সংস্পর্শে এসে নতুন যুগচেতনা জেগে উঠছে দেশের দিকে দিকে; অতএব শিক্ষার ক্ষেত্রেও অনগ্রসর প্রাচীন দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে বসে থাকলে চলবে না— দেশকে নতুন আদর্শে জাগাতে হলে, শিক্ষার ক্ষেত্রে নতুন কর্মপন্থা অবলম্বন করতে হবে।

ব্যালেন্টাইনের রিপোর্টের উত্তরে বিদ্যাসাগর এ সম্পর্কে শিক্ষা-পরিষদকে লেখেন–

“বাংলা দেশে যেখানে শিক্ষার বিস্তার হইতেছে, সেইখানেই পণ্ডিতদের প্রভাব কমিয়া আসিতেছে। দেখা যাইতেছে, বাংলার অধিবাসীরা শিক্ষালাভের জন্য অত্যন্ত ব্যগ্র। দেশীয় পণ্ডিতদের মনস্তুষ্টি না করিয়াও আমরা কী করিতে পারি, তাহা দেশের বিভিন্ন অংশে স্কুল-কলেজের প্রতিষ্ঠাই আমাদের শিখাইয়াছে। জনসাধারণের মধ্যে শিক্ষাবিস্তার ইহাই এখন আমাদের প্রয়োজন। আমাদের কতগুলি বাংলা স্কুল স্থাপন করিতে হইবে, এইসব স্কুলের জন্য প্রয়োজনীয় ও শিক্ষাপ্রদ বিষয়ের কতগুলি পাঠ্যপুস্তক রচনা করিতে হইবে, শিক্ষকের দায়িত্বপূর্ণ কার্যভার গ্রহণ করিতে পারে, এমন একদল লোক সৃষ্টি করিতে হইবে; তাহা হইলেই আমাদের উদ্দেশ্য সফল। মাতৃভাষায় সম্পূর্ণ দখল, প্রয়োজনীয় বহুবিধ তথ্যে যথেষ্ট জ্ঞান, দেশের কুসংস্কারের কবল হইতে মুক্তি, শিক্ষকদের এই গুণগুলি থাকা চাই। এই ধরনের দরকারী লোক গড়িয়া তোলাই আমার উদ্দেশ্য–আমার সঙ্কল্প। ইহার জন্য আমাদের সংস্কৃত কলেজের সমস্ত শক্তি নিয়োজিত হইবে।”

একই সঙ্গে বিদ্যাসাগরের এ আদর্শবাদী ও বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গী তাকে অনুপ্রেরণা দিয়েছিল সংস্কৃত-কলেজের অধ্যক্ষ থাকাকালীন নর্মাল স্কুল, বাংলাদেশের চারিটি জেলায় মডেল স্কুল ও বাংলা পাঠশালা স্থাপন এবং নিজে পাঠ্যপুস্তক রচনা করে এবং অন্য পণ্ডিতদের রচনায় উৎসাহিত করে বাংলাদেশে জনশিক্ষার পথ সুগম করে দিতে। যে শিক্ষা ও সংস্কৃতি এতদিন ছিল নগরকেন্দ্রিক, বিদ্যাসাগরের অক্লান্ত বিদ্যা-বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে তা প্রসারিত হতে থাকল বাংলাদেশের দিকে দিগন্তরে। এ জনশিক্ষা প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে বাঙালি সংস্কৃতির ইতিহাসে নতুন অধ্যায় যোজিত হল।

বাংলাদেশের অগণিত অশিক্ষিত জনসাধারণের মধ্যে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার বহুবিস্তৃত ধারাকে প্রবাহিত করে দিতে গিয়ে এ চিন্তা বিদ্যাসাগরের মনে হওয়া স্বাভাবিক : অবিদ্যা এবং কুসংস্কারে আচ্ছন্ন নারীজাতির মনকেও যদি উদার শিক্ষার আলোকে উদ্বোধিত করে না তোলা যায়, তা হলে দেশের সামগ্রিক সংস্কৃতি বিকাশের আশা সুদূরপরাহত। সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষতা করবার সময়েই বিদ্যাসাগরের স্ত্রী-শিক্ষাবিস্তারের চেষ্টা বাংলাদেশের সংস্কৃতির ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। বিদ্যাসাগরের স্ত্রী-শিক্ষা-বিস্তার প্রচেষ্টায় দুটো সুস্পষ্ট স্তর লক্ষ করা যায়। প্রথমতঃ, নারীশিক্ষা-দরদী ড্রিঙ্ক ওয়াটার বীটন সাহেবের সহকর্মী হিসেবে ‘বীটন নারীবিদ্যালয়’-এর মারফতে কলকাতায় নারীশিক্ষা প্রচলনের চেষ্টা। দ্বিতীয়তঃ, সরকারি সাহায্যে বাংলাদেশের অন্ধকারাচ্ছন্ন গ্রামগুলিতে ব্যাপকভাবে স্ত্রী-শিক্ষা-বিস্তারের প্রয়াস। কলকাতায় বা গ্রামে স্ত্রী-শিক্ষা বিস্তার করতে গিয়ে নানা দিক থেকে বিদ্যাসাগরের সামনে বাধা ছিল অনেক, তথাপি তাঁর উদ্দাম প্রাণাবেগের সামনে সমস্ত বাধা তৃণের মতো ভেসে গিয়েছিল সেদিন। এই ‘বীটন বালিকা-বিদ্যালয়’কে কেন্দ্র করে ক্রমে ক্রমে নারীশিক্ষার বিকাশ হয় কলকাতা শহরে, এবং বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক পুনরুজ্জীবনের ক্ষেত্রে উত্তরকালে একটা নবজীবনের স্পন্দন অনুভূত হয়—ইতিহাসের ধারা যারা অনুসরণ করেন তাঁরা সকলেই এ খবর জানেন। স্ত্রীশিক্ষা-বিস্তারে বিদ্যাসাগর প্রধানতঃ আদর্শবাদী হলেও, ‘বীটন নারী-বিদ্যালয়’-সংলগ্ন নর্মাল স্কুলের মাধ্যমে বাঙালি শিক্ষিকা তৈরি করার অসুবিধা সম্পর্কে বিদ্যাসাগরের বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গী আমাদের বিস্মিত করে। এ প্রসঙ্গে তাঁর সুহৃৎ মিস কার্পেন্টারের সঙ্গে তাঁর মতভেদ হয়, এবং ১৮৭২ সনে বাংলার ছোটলাট সার জর্জ ক্যাম্পবেল যখন বীটন-বিদ্যালয়-সংলগ্ন নর্মাল স্কুলটি তুলে দিতে আদেশ দিলেন তখন সকলেই বুঝতে পারলেন যে, নর্মাল স্কুলের ধর্মসংস্রবহীন শিক্ষার মাধ্যমে হিন্দু নারী-শিক্ষিকা তৈরি করা যে অসম্ভব, বিদ্যাসাগরের এ অনুমান ছিল সম্পূর্ণ সত্য। সরকারি সহযোগিতায় বিদ্যাসাগর ১৮৫৭-র মে মাস থেকে ১৮৫৮ সনের মধ্যে বাংলাদেশের বিভিন্ন গ্রামে অন্ততঃপক্ষে ৩৫টি বালিকা-বিদ্যালয় স্থাপন করেন, যার ছাত্রীসংখ্যা ছিল প্রায় ১,৩০০। ১৮৫৭ সনের সিপাহী-বিদ্রোহের ফলে সরকারের আর্থিক বিপর্যয় উপস্থিত হওয়ায়, সরকার বিদ্যাসাগর-প্রতিষ্ঠিত বালিকা বিদ্যালয়গুলিকে আর্থিক সাহায্য দিতে অস্বীকৃত হন। এতে বিদ্যাসাগরের আরব্ধ স্ত্রী শিক্ষা-প্রচার কাজে বাধার সৃষ্টি হল। এদিকে তদানীন্তন ডিরেক্টর অব পাবলিক ইনস্ট্রাকশনের সঙ্গে মতবিরোধের ফলে বিদ্যাসাগর কলেজের ৫০০ টাকা বেতনের অধ্যক্ষপদে ইস্তফা দিলেন। চারদিক থেকে সকল বাধাবিপত্তি যেন ষড়যন্ত্র করে বিদ্যাসাগরের এ মহৎ প্রয়াসকে ব্যর্থ করে দিতে উদ্যত হল। কিন্তু বিদ্যাসাগর দমলেন না। নিজের চেষ্টায় ‘নারী-শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভাণ্ডার’ খুলে তিনি বেসরকারি চাঁদায় বিদ্যালয়গুলিকে সাহায্য করতে লাগলেন। সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ থাকাকালীন মাত্র আট বছরের মধ্যে বাংলাদেশের স্ত্রী-শিক্ষার ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগর যে আলোড়ন উপস্থিত করেছিলেন, বাংলাদেশের সংস্কৃতি-বিকাশের ইতিহাসে তা স্মরণীয় হয়ে থাকবে। বস্তুতঃ, স্ত্রী-শিক্ষা-বিস্তারে বিদ্যাসাগর সেদিন যদি তার সমস্ত প্রয়াসকে নিয়োজিত না করতেন, তা হলে আধুনিক সংস্কৃতির বহুমুখী অগ্রগতি যে সম্ভব হত না তা বলাই বাহুল্য। বিদ্যাসাগরের এই মানবতাবাদী স্ত্রী-শিক্ষা-আন্দোলনই পরবর্তীকালে বিকাশ লাভ করেছে স্ত্রী-জাতিকে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যে প্রতিষ্ঠিত করবার আন্দোলনে; আর আধুনিক ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যে প্রতিষ্ঠিত নারীর সমাজ-জীবনে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করার ফলেই বিচিত্রধর্মী আধুনিক বাঙালি সংস্কৃতি সহস্রদল পদ্মের মতো বিকশিত হয়ে ভারতীয় তথা পৃথিবীর চর্যাসম্পন্ন জাতিদের মধ্যে বাঙালিকে একটা মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছে। 

সরকারি সহায়তায় ব্যাপকভাবে স্ত্রী-শিক্ষা-প্রচার-কার্যে আকস্মিকভাবে বাধা এলেও, আজীবন শিক্ষাব্রতী বিদ্যাসাগর তার কর্মজীবনের শেষ স্তরেও এদেশের শিক্ষা-আন্দোলনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। সংস্কৃত-কলেজের অধ্যক্ষপদ ত্যাগ করলেও, বইয়ের ব্যবসা হতে তখন বিদ্যাসাগরের আয় প্রচুর (মাসিক প্রায় তিন-চার হাজার টাকা)। ক্রমে ক্রমে সেই সঞ্চিত অর্থ দিয়ে বাদুড়বাগানে বাসের জন্য বাড়ি কিনলেন, নিজের জ্ঞানচর্চার জন্য দেশী-বিদেশী মূল্যবান বই কিনে নিজের গ্রন্থাগারকে সমৃদ্ধ করে তুলতেন। কিন্তু এতেও শিক্ষাব্রতী বিদ্যাসাগরের তৃপ্তি হল না, সম্পূর্ণভাবে দেশীয় অধ্যাপকদের পরিচালনায় তিনি ১৮৭৩ সনে মেট্রোপলিটান কলেজ স্থাপন করলেন। ১৮৭৯ সনে এ কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমতি পেয়ে ফার্স্ট-গ্রেড কলেজে পরিণত হল, এবং ১৮৮১ সনে এ কলেজ থেকে বি.এ. পরীক্ষায় পাঠানো ছাত্ররা বেশ কৃতিত্বের সঙ্গে পাস করল। সম্পূর্ণভাবে দেশীয় লোক দ্বারা পরিচালিত এই প্রতিষ্ঠানের অসামান্য সাফল্য দেখে একদিকে তৎকালীন শাসক ইংরেজদের যেমন বিস্ময়ের সৃষ্টি হয়েছিল, তেমনি বাঙালিদের আত্মপ্রত্যয়ও গেল শতগুণে বেড়ে। জাতীয় সংস্কৃতির ক্রমবিকাশের ইতিহাসে এই মেট্রোপলিটান কলেজ প্রতিষ্ঠা এবং সার্থকভাবে তার কার্য-পরিচালনা একটি স্মরণীয় অধ্যায় সন্দেহ নেই।

॥৪॥

সমাজ-চিন্তা-নিরপেক্ষ শিক্ষা মানুষের মনে সৃষ্টি করে সংস্কৃতির নামে সংস্কৃতিবিলাস—সে শিক্ষা করে মানুষের মনকে শুষ্ক প্রাণহীন। পারিপার্শ্বিক সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন এ ধরনের বিশিষ্ট ব্যক্তি নিজের চারদিকে একটা সূক্ষ্ম ভাবমণ্ডল তৈরি করে অহংকৃত আত্মপ্রসাদ লাভ করে। ইংরেজিতে এ শ্রেণীর সংস্কৃতিবিলাসীদের বলা হয় ‘dilettante’। সৌভাগ্যের বিষয়-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগর dilettante ছিলেন না, যেমন ছিলেন না ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে আরও অনেক চিন্তানায়ক মনীষী। এই সমাজ-চিন্তাশ্রিত শিক্ষাই এ যুগের চিন্তানায়কদের প্রেরণা দিয়েছিল বিচিত্রধর্মী সংস্কৃতি-নির্মাণে—যে সংস্কৃতির বিশিষ্ট রূপ দেখি আমরা সে-যুগের সাহিত্য-প্রচেষ্টায়, সমাজ ও ধর্ম সংস্কারে এবং কিছুটা রাষ্ট্রচেতনায়।

এ সমাজ-চিন্তাই স্বভাবতঃ মানবদরদী বিদ্যাসাগরকে জীবন-মধ্যাহ্নে টেনে আনল সমসাময়িক সমাজ-সংস্কারের বিক্ষুব্ধ ক্ষেত্রে।

বিদ্যাসাগরের যে সমাজ-সংস্কার-প্রচেষ্টা সে-যুগের ঘুণে-ধরা রক্ষণশীল বাঙালি সমাজে বিক্ষোভের তরঙ্গ তুলেছিল, তার মধ্যে প্রধান হল—বিধবা-বিবাহের অবাধ প্রচলন, এবং বহু-বিবাহ ও বাল্যবিবাহ প্রথার উচ্ছেদ।

কৌলীন্য প্রথার বিষময় ফল দাঁড়িয়েছিল এরূপ : বিত্তকৌলীন্যহীন তথাকথিত কুলীন ব্রাহ্মণেরা একাধিক বিবাহ করে নিজেদের জীবিকার পথ সুগম করত, নিজেদের ভ্রান্ত বংশকৌলীন্য রক্ষা করবার জন্য কন্যার পিতারা আত্মমর্যাদাজ্ঞানহীন এবং অনেক সময় বৃদ্ধ কুলীন বরের সঙ্গে বালিকাকন্যার বিবাহ দিতেন এবং তার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি দাঁড়াত বালবৈধব্য এবং সমাজের মধ্যে নানা ব্যভিচারের সৃষ্টি।

এ সমাজ-বিধ্বংসী প্রথার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ পুঞ্জীভূত হয়ে উঠেছিল রামমোহনের সমাজ-সংস্কার-প্রচেষ্টায় এবং ইয়ংবেঙ্গলদের সর্বপ্রকার কুসংস্কারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণায়। ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক হতে চতুর্থ দশক পর্যন্ত এই বিক্ষুব্ধ ভাবান্দোলন ছাত্রাবস্থায় ও প্রথম কর্মজীবনে বিদ্যাসাগর দেখেছিলেন; কিন্তু বিত্ত-কৌলীন্য ও সামাজিক বিশিষ্ট মর্যাদা না থাকায় বিদ্যাসাগর পত্রিকার পৃষ্ঠায় এ সম্পর্কে আলোচনা করা ছাড়া (১৭৭৬ শকের ফাল্গুন সংখ্যায় ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’য় ‘বিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব’ দ্রষ্টব্য) তেমন কোনও সক্রিয় কর্মপন্থা গ্রহণ করতে পারেননি। সংস্কৃত-কলেজের সম্মানজনক অধ্যক্ষের পদ লাভ করবার পর বিদ্যাসাগর সে ঈপ্সিত সুযোগ পেলেন। ইতোমধ্যে শিক্ষা বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে প্রগতিশীল একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণীও সমাজের মধ্যে গড়ে উঠেছে। বিদ্যাসাগর সে প্রগতিশীল জনসাধারণের আনুকূল্য লাভ করে ১৮৫৫ সনের ৪ঠা অক্টোবর ‘বিধবা বিবাহ আইন’ প্রবর্তনের জন্য সরকারের কাছে আবেদন করেন। সরকার সে আবেদনের গুরুত্ব উপলব্ধি করে ১৮৫৬ সালে ‘বিধবা বিবাহ আইন’ সিদ্ধ বলে ঘোষণা করেন। কিন্তু বিদ্যাসাগর জানতেন, শুধু আইন প্রণয়ন করে আদর্শ-লাভ সম্ভব নয়। তাই নিজে উদ্যোগী হয়ে নিজের পুত্রের এবং আরও কয়েকজন যুবকের বিধবা-বিবাহ দেন। এভাবে বহু-যুগ-সঞ্চিত অনড় সমাজের বুকে বিদ্যাসাগর যে প্রচণ্ড আঘাত হেনেছিলেন, তার ফলে সংস্কারান্ধ হিন্দুর অচলায়তনের ভিত্তিমূল পর্যন্ত নড়ে উঠেছিল সেদিন। “১৮৫৪-৫৬-৫৭ সালে তাঁর এইসব সামাজিক ক্রিয়ার যে প্রতিক্রিয়া হয়–বাংলাদেশের ইতিহাসে, তার আগে বা পরে, আর কোনও ব্যক্তির কর্মের ফলে তা হয়েছে বলে মনে হয় না।” ২ গুহাশ্রয়ী জীবের চোখে তীব্র আলোর ঝলক যখন লাগে তখন এরূপ প্রতিক্রিয়া হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু প্রতিক্রিয়া যাই হোক—আলোকের দূত যারা, তারা আলোক বিকীর্ণ করে যাবেনই। বিদ্যাসাগরের জীবনের সর্বপ্রধান সৎকর্ম’ এভাবে সাধিত হল, আর প্রচণ্ড আঘাত-সংঘাতে সংস্কারবিমুখ তৎকালীন বাঙালির চেতনা ক্রমশঃ জেগে উঠতে লাগল একটা নতুন জীবন, নতুন সংস্কৃতির প্রত্যাশায়। প্রবল আশাবাদী বিদ্যাসাগর সমাজ-সংস্কারের ক্ষেত্রে তার অসামান্য সাফল্যে উৎসাহিত হলেন। অতঃপর সমাজের অপর দুষ্টক্ষত—‘বহু-বিবাহ’ রহিত করবার জন্য ১৮৫৫ সনে এবং ১৮৬৬ সনে দু’বার সরকারের কাছে আবেদন করলেন। এ প্রচেষ্টায় বিদ্যাসাগর ব্যর্থ হলেন। ব্যর্থ হলেও, তৎকালীন অন্ধকারাচ্ছন্ন বাঙালির অন্তর হতে সংস্কারের নীরন্ধ্র অন্ধকার দূর করবার জন্য বিদ্যাসাগর সেদিন যে আলোকোজ্জ্বল দীপ জ্বেলেছিলেন, সে দীপই পথ দেখিয়েছিল উত্তরসূরীদের সংস্কৃতির ক্ষেত্রে নতুন পথরেখা অনুসন্ধান করতে। বিদ্যাসাগরের সামাজিক সংস্কারের প্রচেষ্টার মূল্য হল এখানে।

॥৫॥

বাংলা সাহিত্যে বিদ্যাসাগরের রচনার মূল্য বহুআলোচিত, অতএব সংক্ষেপে এ সম্পর্কে আলোচনা করে বিদ্যাসাগর-প্রসঙ্গ শেষ করব।

সাহিত্যে একশ্রেণীর লেখক দেখা যায়, যারা সৃষ্টি-ক্ষমতাহীন হওয়া সত্ত্বেও প্রচুর লেখেন খ্যাতির লোভে, আর-এক শ্রেণীর লেখক সৃষ্টি-ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও সৃষ্টিমূলক রচনা না করে শিক্ষা ও জ্ঞানমূলক রচনায় আত্মনিয়োগ করেন। জাতির বৃহত্তর কল্যাণব্রতে উদ্বুদ্ধ হয়ে সাম্প্রতিক অনেক কথাশিল্পী সম্বন্ধে যদি প্রথম মন্তব্য প্রযোজ্য হয়, তা হলে শেষোক্ত মন্তব্য প্রতিভাধর লেখক বিদ্যাসাগর সম্পর্কে সম্পূর্ণ সত্য।

বিধবা-বিবাহের শাস্ত্রীয়তা এবং বহু-বিবাহের অশাস্ত্রীয়তা প্রমাণ করে প্রস্তাব রচনা করবার পর তৎকালীন পণ্ডিতেরা বিদ্যাসাগরকে অত্যন্ত হীনভাবে রচনার মাধ্যমে আক্রমণ করেন।

এ সমস্ত আক্রমণের উত্তরে বিদ্যাসাগর বেনামীতে ‘অতি অল্প হইল’, ‘আবার অতি অল্প হইল’, ‘ব্রজবিলাস’, ‘রত্নপরীক্ষা’ প্রভৃতি কয়েকখানি হাস্য ও ব্যঙ্গরসাত্মক বই লেখেন। এ সমস্ত বইয়ের ভেতর বিদ্যাসাগরের যে নির্মল রসবোধ এবং গতিশীল ভাষা-সৃষ্টি-ক্ষমতার পরিচয় পাওয়া যায় তাতে সঙ্গতভাবেই অনুমান করা চলে যে, বিদ্যাসাগর যদি পাঠ্যপুস্তক-রচনায় সময় ক্ষেপ না করে সৃষ্টিমূলক রচনা আত্মনিয়োগ করতেন, তা হলে বাংলা-সাহিত্যে রসসৃষ্টি বিদ্যাসাগরের সময় থেকেই শুরু হবার সম্ভাবনা ছিল। ছাত্র-জীবনেও বিদ্যাসাগরের রসবোধ যে কত প্রখর ছিল—তাঁর সাহিত্যাধ্যাপক সুরসিক জয়গোপাল তর্কালঙ্কারের নির্দেশে সরস্বতীর উদ্দেশে তাঁর রসাত্মক শ্লোক-রচনাও তার প্রমাণ। তাঁর প্রথম অনুবাদ ‘বেতাল-বিংশতি’ পাঠ করলে মনে হয়, বিদ্যাসাগর তাঁর সাহিত্য-জীবনের প্রথম হতেই গতিশীল গদ্য-রচনায় বেশ নিপুণ ছিলেন। তাঁর বিধবা-বিবাহ-বিষয়ক স্বাধীন রচনাগুলিতে আবেগধর্ম প্রবল। ‘সীতার বনবাস’, ‘শকুন্তলা’ অনুবাদ হলেও, তার মধ্যে বিদ্যাসাগরের চিত্রধর্ম রচনা-দক্ষতা বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সৃষ্টিকার্যের উপযোগী এত ক্ষমতা সত্ত্বেও বিদ্যাসাগর খ্যাতির প্রলোভন ছেড়ে ছাত্রপাঠ্য পুস্তক (বেতাল-পঞ্চবিংশতি, বোধোদয়, বর্ণপরিচয়, শকুন্তলা, কথামালা প্রভৃতি), অথবা দেশি ও বিদেশি বিষয় অবলম্বনে জ্ঞানমূলক রচনা-কার্যে (যেমন–তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় প্রকাশিত) তাঁর সুদীর্ঘ সাহিত্য-জীবন অতিবাহিত করতে গেলেন কেন, সে-কথা মনে ওঠা স্বাভাবিক।

শিক্ষা-সংস্কার ও সমাজ-সংস্কারের ক্ষেত্রে যেমন লোক হিতৈষণা, তেমনি সাহিত্য-রচনার ক্ষেত্রেও এই লোকহিতৈষণা বিদ্যাসাগরকে অনুপ্রাণিত করেছিল শিক্ষা ও জ্ঞানমূলক সাহিত্য-রচনায়। এ প্রেরণাবলেই সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতি ভিন্ন প্রবৃত্তির অধিকারী হয়েও বিদ্যাসাগর দেবেন্দ্রনাথ, অক্ষয়কুমারকে সুদীর্ঘ ষোলোবছর ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’ প্রকাশে (১৮৪৩-১৮৫৯) অকুণ্ঠ সাহায্য করতে দ্বিধা করেননি। শুধু ‘তত্ত্ববোধিনী’র প্রবন্ধ-নির্বাচনে নয়, অনেক সময় সম্পাদক অক্ষয়কুমারের রচনা পরিমার্জিত করে দিয়ে আবার কোনও সময় নিজে বহু জ্ঞানমূলক রচনা লিখে তিনি ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’র সমৃদ্ধির জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতেন। এত কর্মব্যস্ততার মধ্যেও তিনি একবৎসর তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সম্পাদনার গুরু ভার গ্রহণ করেছিলেন। তিনি এ কথা উপলব্ধি করেছিলেন—গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে রচিত এ পত্রিকাখানি সমসাময়িক বাংলাদেশে জ্ঞানবিস্তারে ও গদ্য-সাহিত্যের মেজাজ-পরিবর্তনে যথেষ্ট সহায়তা করবে। বাস্তবিকপক্ষে বিদ্যাসাগর ও অক্ষয়কুমার দত্তের অক্লান্ত চেষ্টায় ‘তত্ত্ববোধিনী’র পৃষ্ঠায় জ্ঞান-বিজ্ঞানের যে বিস্তৃত চর্চা ও আলোচনা হত, তা সমসাময়িক বাংলা-সাহিত্য-পাঠ-বিমুখ ‘ইয়ং বেঙ্গল’দের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে দেরি করেনি। বিদ্যাসাগরের ক্লান্তিহীন আনুকূল্য না পেলে একা অক্ষয়কুমারের পক্ষে যে বাংলা গদ্যের মান উন্নয়ন এত অল্পসময়ের মধ্যে সম্ভব হত না, তা বলাই বাহুল্য। ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’ প্রসঙ্গে দেবেন্দ্রনাথ ও অক্ষয়কুমারের নামের সঙ্গে বিদ্যাসাগরের নামও একসঙ্গে উচ্চারিত হওয়া উচিত। দেবেন্দ্রনাথের মতো বিদ্যাসাগরও অক্ষয়কুমারের একজন প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। বস্তুতঃ এ তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’ই ছিল মানবতাবাদী বিদ্যাসাগরের নিকট তত্ত্ববোধিনী-সভায় যোগ দেওয়ার অন্যতম আকর্ষণ।

স্কুল-পাঠ্য পুস্তক রচনা করতে গিয়ে এ-কথা বিদ্যাসাগরের মনে হওয়া স্বাভাবিক যে,পাঠ্যপুস্তকের মারফতে শিক্ষা দিয়ে যদি পাঠক-সম্প্রদায় তৈরি করা না যায়, তা হলে উচ্চাঙ্গের রস-সাহিত্য উপভোগ করবে কে? সেজন্যই খুব সম্ভব বিদ্যাসাগরের এ পাঠ্যপুস্তক-রচনার জন্য প্রাণান্তকর প্রয়াস। শিল্পী-মন থাকা সত্ত্বেও শিল্প-সৃষ্টি-কার্যে সম্পূর্ণরূপে তিনি আত্মনিয়োগ করেননি, যদিও এ কথা অনস্বীকার্য–পরবর্তী শিল্পস্রষ্টাদের তিনিই অন্যতম স্রষ্টা। বাংলা সাহিত্যে বিদ্যাসাগরের সুনির্দিষ্ট স্থান হল এখানে।

বাণীভঙ্গীতে সর্বপ্রথম ছন্দোস্পন্দ ও কলানৈপুণ্যের অবতারণায় বাংলা গদ্যরীতি বিদ্যাসাগরের হাতে অকস্মাৎ কীরূপে প্রসাধিত হয়েছিল, সে প্রসঙ্গও বহু আলোচিত। অতএব সে সম্পর্কেও আর বাগ বিস্তারের প্রয়োজন নেই। শুধু এ কথা মন্তব্য করেই এ আলোচনার পরিসমাপ্তি ঘটানো যেতে পারে—সমসাময়িক বাংলা সাহিত্যের উৎকর্ষের জন্য যুগোপযোগী যে সংস্কারের প্রয়োজন ছিল, বিদ্যাসাগর নিষ্ঠার সঙ্গে সে-কাজে আত্মনিয়োগ করেছিলেন; তাঁর জীবৎকালেই তাঁর উত্তরসূরীদের হাতে বাংলা সাহিত্যের যে বিকাশ হয়েছিল তা কখনই সম্ভব হত না, যদি না তিনি তাদের জন্য সাহিত্যসৃষ্টির উপযোগী ভাষা সৃষ্টি করতেন।

॥৬॥

বাংলাদেশের সংস্কৃতির ধারা যাঁরা অনুসরণ করেন তাঁরা নিশ্চয়ই এ কথাটা স্বীকার করবেন যে, যে-মানবমুখিনতা আধুনিক সংস্কৃতির প্রধান বৈশিষ্ট্য–তার প্রারম্ভ বিদ্যাসাগরের জীবন-জিজ্ঞাসায়। যদিও তাঁর রচনায় এমন কোনও কথার উল্লেখ নেই, তথাপি বিদ্যাসাগর গ্রিক দার্শনিক পিথাগোরাসের মতো বলতে পারতেন—’Man is the measure of all things’। কোনও আনুষ্ঠানিক ধর্ম নয়, কোনও বিশিষ্ট সমাজ নয়, কোনও আদর্শ মতবাদ নয়—তাঁর কাছে সবকিছুর একমাত্র মানদণ্ড হল মানুষ। বিদ্যাসাগরের উদার হৃদয়ে অনুভূত এ গভীর মানবতাবোধই যুগধর্মের প্রেরণায় সহস্র ধারায় বিকাশ লাভ করে সৃষ্টি করেছে আধুনিক শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির।

(রচনাটি পুনর্মুদ্রিত। বিলুপ্ত বাংলা মাসিক সাহিত্য পত্রিকা “বসুধারা”র দ্বিতীয় বর্ষ, চতুর্থ সংখ্যা, শ্রাবণ, ১৩৬৫-তে প্রথম প্রকাশিত।)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.