২০১৪-এর জুলাই থেকে ২০১৯ জুলাই–টানা ৫ বছর ধরে রাজ্যপাল হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের দায়িত্ব পালন করা সত্ত্বেও ৩০ জুলাই তাঁর বিদায় বেলায় হাজির হলেন না মুখ্যমন্ত্রী। এমনকি ছোটবড় কোনও মন্ত্রীও নন। আমলারাই পুস্পস্তবক আর শুভেচ্ছা বিনিময়ে দায়িত্ব সারলেন। প্রথাগত সৌজন্যের দিক থেকে এটা যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে ধূলিসাৎ করে দেওয়া এবং বঙ্গসংস্কৃতির ঐতিহ্যের উপর সজোরে চপেটাঘাত তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
তবে এ ঘটনা আবার অবাক হওয়ার মতো কোনও ঘটনাও নয়। কারণ পশ্চিমবঙ্গ নামক রাজ্যে মন্ত্রিসভার সঙ্গে রাজ্যপালের বিরোধিতার ইতিহাস দীর্ঘ। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত সময়টা বাদ দিলে ১৯৬৭ থেকে ১৯৭১ এবং তারপর ১৯৭৭ থেকে আজ অবধি এ রাজ্যে রাজ্য বনাম রাজ্যপালের সংঘাতটাই দস্তুর হয়ে উঠেছে। যেন এটাই অভ্যাস। অথবা এটাই নিয়ম। কী আইনশৃঙ্খলার প্রশ্নে, কী সামাজিকতার প্রশ্নে, অথবা শিক্ষা সংক্রান্ত প্রশ্নে এই সংঘাত এক আবহমানকালের অশ্রাব্য মূর্ছনার সৃষ্টি করেছে যা গণতন্ত্রের পক্ষে শুধু কলঙ্কজনক নয়, গণতন্ত্রের লজ্জা।
স্বাভাবিক ভাবে রাজ্য বনাম রাজ্যপালের সম্পর্কের অবনতির প্রশ্ন থেকেই এসে পড়ে কেন্দ্র বা রাজ্যের সংঘাতের প্রশ্ন। কারণ রাজ্যপাল সব রাজ্যেই নিযুক্ত হন কেন্দ্রের প্রতিনিধি হিসেবে। তাঁর নিজস্ব কিছু সাংবিধানিক দায়িত্ব ও কর্তব্যও নির্ধারণ করা আছে। যেমন রাজ্য ও কেন্দ্রের কর্তব্য ও অধিকারও সাংবিধানিকভাবে সুনির্দিষ্ট। সেই সব কর্তব্য ও অধিকারের প্রশ্নেও পশ্চিমবঙ্গই প্রথম সারির একটি রাজ্য যা আয়তনে তেমন বড়সড় না হলেও গলাবাজিতে বেশ বড়। ফলে কেন্দ্র-রাজ্যের সম্পর্কের পুনর্বিন্যাস নিয়ে অন্যান্য অনেক রাজ্যেরই কিছু নির্দিষ্ট বক্তব্য থাকলেও তা নিয়ে চরম পরিণতিতে পৌঁছবার ইতিহাস বারে বারে সৃষ্টি হয়েছে পশ্চিমবঙ্গেই। তৃণমূল কংগ্রেসের ২০১১ সাল থেকে ৮ বছর এই ইতিহাস অতীতের সব মাত্রাকেই ছাড়িয়ে গেছে। তাতে রাজ্যের লাভ কিছুই হয়নি। ক্ষতির পরিমাণ বরং বেড়েছে। কারণ রাজ্যের মানুষ এটা বোঝেন, রাজনৈতিক রঙ দিয়ে প্রশাসন চালালে সে প্রশাসন ব্যর্থ হতে বাধ্য। মনে রাখা দরকার ভারতবর্ষের প্রশাসনিক পরিকাঠামো যুক্তরাষ্ট্রীয় এবং সেখানে কেন্দ্রের ভূমিকাকে অস্বীকার করে বা শুধু মাত্র রাজনৈতিক বিরোধিতা করে সাংবিধানিক ভূমিকা পালন করা যায় না।
কেন্দ্র-রাজ্য সংঘাতের প্রথম সূত্রপাত হয় পশ্চিমবঙ্গেই। ১৯৬৭ সালে যখন যুক্তফ্রন্ট পরিমার্জিত হয়ে ফের ক্ষমতায় আসে সে সময় নানা সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক কারণে তৎকালীন রাজ্যপাল ধরমবীর সরকার ভেঙে দিয়ে রাজ্যে এক চরম বিশৃঙ্খলার পরিস্থিতি তৈরি করেন। পরিস্থিতি এমন এক পর্যায়ে যায় যে প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষের নেতৃত্বাধীন পি ডি এফ সরকারও অবিরেই ধসে যায় এবং ১৯৭২ সালে এক অরাজক পরিস্থিতির মধ্যেই ক্ষমতায় আসে কংগ্রেস, সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের নেতৃত্বে। তখন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের সঙ্গে ম্যাডামের সম্পর্ক অতি ঘনিষ্ঠ। ফলত ১৯৭৭ সালে রাজ্যে নতুন বিধানসভা নির্বাচনের সময় পর্যন্ত কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক নিয়ে বিশেষ শ্লোগান শোনা যায়নি। মিছিল চোখে পড়েনি। কিন্তু ১৯৭৫-এর জরুরি অবস্থা জারির দায় মাথায় নিয়ে যখন ইন্দিরা বিদায়ের মতো এক ঘটনা গোটা দেশকে স্তম্ভিত করেছিল, তখন থেকেই কেন্দ্র-রাজ্যের সম্পর্কের তিক্ততা চরমে পৌঁছল। মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর নেতৃত্বাধীনে নতুন বামফ্রন্ট সরকার ঐক্য ও গণতন্ত্র রক্ষার স্বার্থে অঙ্গরাজ্যগুলির ক্ষমতা সম্প্রসারণের দাবিতে সোচ্চার ছিল প্রথম থেকেই। ওই সব দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ইন্দিরা গান্ধী বিচারপতি সরকারিয়ার নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠন করেন ১৯৮৩ সালে। কিন্তু রিপোর্ট মেলে পাঁচ বছর পর। সেই রিপোর্ট বামপন্থীরা মেনে নেননি। কারণ প্রথম থেকেই সি পি আই (এম) নেতা এম এস নাম্বুদিরিপাদের পেশ করা ১১ দফা প্রস্তাব কার্যকর করার দাবিতেই সোচ্চার ছিল বামদলগুলি। সবকটি ছিল রাজ্যের স্বার্থে রাজ্যের হাতে অধিক অধিকার সম্প্রসারণের পক্ষে। এই পশ্চাদপটে বিভিন্ন বিরোধী দল শাসিত চার রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের ডাকা শ্রীনগরের সম্মেলন ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এই সম্মেলনে অংশ নিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও, অন্ধ্রপ্রদেশ, ত্রিপুরা, কর্নাটক এবং রাজনৈতিক দলগুলির তরফে সি পি আই (এম), সি পি আই, জনতা পার্টি, ইউনাইটেড ফ্রন্ট, কংগ্রেস (স), আকালি দল, জনবাদী পার্টি এবং ন্যাশনাল কনফারেন্স। বিজেপি ও লোকদল শ্রীনগর সম্মেলনে যোগ দেয়নি। এই সম্মেলনে সর্বসম্মতভাবে রাজ্যপালের পদের অপব্যবহার রোধ করা সম্পর্কে বলা হয়েছিল, “সাম্প্রতিক ইতিহাস নিঃসন্দেহে প্রমাণ করেছে যে,এ যাবৎ রাজ্যপালরা কেন্দ্রে আসীন শাসক দলের নেতাদের অঙ্গুলি নির্দেশ ব্যতিরেকে এভাবে কাজ করা তাঁদের পক্ষে সম্ভব নিশ্চয়ই হয়নি।
সংবিধান প্রণেতাদের সুস্পষ্ট উদ্দেশ্য, বাস্তবিক পক্ষে, সংবিধানের বয়ান ও অর্ন্তনিহিত বক্তব্য, সমস্ত উল্লেখযোগ্য দিক থেকেই, লঙ্ঘিত হয়েছে, যেমন সে দিকগুলো হল : রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনাক্রমে এবং তাঁর সম্মতিক্রমে রাজ্যপাল নিয়োগ, রাজ্যপালের কার্যকালের পূর্ণ মেয়াদ বজায় রাখার নিশ্চয়তা, রাজ্যপালদের মেধা ও প্রতিষ্ঠা, রাষ্ট্রপতির শাসন প্রবর্তন এবং বিশেষ করে মুখ্যমন্ত্রীদের নিয়োগ ও আইনসভা বাতিল করার ব্যাপারে কেন্দ্রের নির্দেশ বা অনুশাসন ব্যতিরেকে স্বাধীনভাবে স্বকার্য সম্পাদনের ক্ষেত্রে রাজ্যপালের অধিকার ও কর্তব্য। আমারা মনে করি রাষ্ট্রপতির পদমর্যাদার সঙ্গে রাজ্যপাল পদের মর্যাদার কোনও পার্থক্য থাকবে না। ….” এই প্রস্তাবে আরও বলা হয় : ” বহু রাজ্যের বর্তমান অর্থনৈতিক ভারসাম্যহীনতা, বঞ্চনা ও অনগ্ৰসরতা অর্থনৈতিক ক্ষমতা ও সম্পদের অতিরিক্ত কেন্দ্রীকরণের ফলশ্রুতি। …. নিজেদের হাতে সম্পদ প্রচুর পরিমাণে কেন্দ্রীভূত হওয়ায় কেন্দ্র অঞ্চলে অঞ্চলে ও রাজ্যে রাজ্যে সম্পদ বরাদ্দের ব্যাপারে প্রায়ই পক্ষপাতিত্ব করছে”। প্রস্তাবে নির্দিষ্ট ভাবে নয়টি বিষয়ে উল্লেখিত করে বলা হয়, “এই বৈঠক দাবী করে যে কেন্দ্র ও রাজ্যগুলির মধ্যে আর্থিক ব্যবস্থাবলীর ক্ষেত্রে পরিবর্তনের সাপেক্ষে প্রস্তাবগুলি কার্যকর করা হোক।”
পরে ১৯৮৪ সালের জানুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত হয় কলকাতা সম্মেলন। ওই সম্মেলনে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সংক্রান্ত প্রস্তাব ছাড়াও অ-কংগ্ৰেস (আই) রাজ্যের সরকারগুলিকে দুর্বল করার জন্য কংগ্রেস (আই)-র চেষ্টার নিন্দা করে প্রস্তাব নেওয়া হয়। সেখানেও ১০ দফা দাবি প্রস্তাব আকারে গৃহীত হয়। স্বয়ং জ্যোতি বসু তাঁর স্মৃতিকথা “যতদূর মনে পড়ে’তে লিখেছেন – ” …. আমরা কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক পুনর্বিন্যাসের বিষয়কে শুধুমাত্র নেতৃবৃন্দের আলোচনার টেবিলে সীমাবদ্ধ রাখতে চাইনি। সাধারণত মানুষকেও এর মধ্যে টেনে আনতে পেরেছিলাম।” ‘৮৪-র অষ্টম অর্থ কমিশনের সুপারিশ প্রসঙ্গে ‘কেন্দ্রের চরম অবিচারের বিরুদ্ধে ‘ বামফ্রন্টকে উদ্যোগী হতে হয়েছে। জ্যোতি বসু লিখে গেছেন, “কত সব অদ্ভুত অজুহাতেই যে আমাদের বঞ্চিত করা হয়েছে ভাবা যাবে না। …. রাজনৈতিক কারণেই এরকম বৈষম্য।”
ইতিহাসের পাতায় বাম দলগুলির নেতৃত্বে এই কেন্দ্র-বিরোধী আন্দোলন একটা মাত্রা পেলেও একথা কোনও ভাবেই অস্বীকার করা যাবে না যে, কেন্দ্র-বিরোধী হয়ে কোনও রাজ্য সরকারই উন্নয়নের পথে সঠিক ভাবে হাঁটতে পারে না। অভিযোগের সারবত্তা থাকুক আর না থাকুক একথা তো বামফ্রন্ট এড়িয়ে যেতে পারবে না যে, তাদের এই আন্দোলনের মধ্যেও ছিল রাজনীতি এবং তা ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস (আই) দলের বিরুদ্ধে রাজনীতি। এই বিরুদ্ধ-রাজনীতির মধ্যে দিয়েই টানা ৩৪ বছর বামফ্রন্ট জনগণকে আটকে রেখেছিল ঠিকই, কিন্তু রাজ্য বা রাজ্যবাসী এগোতে পারেনি। ক্রমাগত পিছিয়েই পড়েছে একপেশে কেন্দ্র-বিরোধিতার ফলে।
বিরোধিতা ছিল। কিন্তু এ কথা মেনে নিতে দ্বিধা নেই যে, অকংগ্ৰেসী সরকার বা দলগুলির এই কেন্দ্র-বিরোধিতা ছিল সর্বতোভাবে সাংবিধানিক অধিকারের উপর নির্ভরশীল। কখনই তা ব্যক্তিগত আক্রমণের স্তরে নেমে আসেনি।
ইতিহাসই বলে, ১৯৫২ সালের প্রথম নির্বাচনের পর এ রাজ্যে প্রথম মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়কে বলা হত পশ্চিমবাংলার প্রধানমন্ত্রী। না সাংবিধানিকভাবে নয়। কিন্তু দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহরুর ওপর একজন মুখ্যমন্ত্রী হয়েও যে জোর ফলানোর ক্ষমতা তাঁর ছিল, পরবর্তীকালে সেই ক্ষমতা আর কোনও মুখ্যমন্ত্রী দেখাতে পারেননি। দুজনেই কংগ্রেসী হলেও রাজ্য বঞ্চিত হচ্ছে এমন ঘটনা ঘটলেই বিধানচন্দ্র সরাসরি ফোন করতেন জহরলালকে। এবং এ কথা তো সবার জানা যে, ড. বিধানচন্দ্র রায় জওহরলাল নেহরুকে ‘জওহর’ বলে ডাকতে অভ্যস্ত ছিলেন। ভিন্ন রাজনীতির মানুষ হয়েও ইন্দিরা গান্ধী কিংবা রাজীব গান্ধীর সঙ্গে, এমনকি নরসীমা রাওয়ের সঙ্গেও জ্যোতি বসুর সম্পর্ক কখনও তিক্ত হয়নি। মনমোহন সিং প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীনও কেন্দ্র-বিরোধিতার সুর থেকে বামফ্রন্ট বিচ্ছিন্ন হয়নি। কিন্তু সম্পর্কের সংঘাত এমন পর্যায়ে পৌঁছয়নি যে প্রধানমন্ত্রীর মুখ দেখব না পণ করে বসেছিলন জ্যোতি বসু। ফলে যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামো ও সম্পর্ক নিয়ে যতই প্রশ্ন উঠুক না কেন, গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পরিবেশ কখনও তিক্ত হয়ে ওঠেনি।
কিন্তু তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের আমলে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কেন্দ্র-বিরোধিতার সুর পৌঁছেছে সপ্তমে এবং সমস্ত সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক রীতিনীতি বিসর্জন দিয়ে সংঘাত পৌঁছে গেছে এমন একটি পর্যায়ে যেখানে মুখ্যমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন নতুন মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পর্যন্ত বয়কট করেন। নীতি আয়োগের বৈঠক বর্জন করেন। প্রকাশ্য জনসভায় প্রধানমন্ত্রীকে ‘তুই’ বলে সম্মোধন করেন এবং স্ব-ইচ্ছায় কেন্দ্রীয় প্রকল্পগুলির নাম বদলে দেন এবং সেগুলির নামকরণ এমনভাবে করা হয় যাতে সাধারণ মানুষের ধারণা হয়, প্রকল্পগুলি কেন্দ্রের নয়, রাজ্য সরকারের।
অথচ এমন নয় যে, রাজ্যগুলিতে কেন্দ্রীয় অর্থের বাজেট বরাদ্দ কমানো হচ্ছে। সব রাজ্যেই গত কয়েক দশক ধরেই বরাদ্দ অর্থের পরিমাণ বেড়েছে অনেক। রাজনৈতিক কারণে হয়তো কিছু রাজ্যের সাংবিধানিক অধিকারে হস্তক্ষেপও হচ্ছে। কিন্তু এ ধরনের কেন্দ্র-রাজ্য সংঘাতের ইতিহাস তো নতুন কিছু নয়। অতএব তা নিয়ে সেসমস্ত রাজনৈতিক মূল্যবোধ ভুলে বিষয়টাকে ‘কলতলার মেয়েদের ঝগড়ার’ পর্যায়ে নিয়ে যেতে হচ্ছে কেন? কোন রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা থেকে?
২০১১-র পর নতুন ভাবে সংঘাতের সূত্রপাত বামফ্রন্টের ফেলে যাওয়া ঋণভার ঘিরে। তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসার পরেই ওই ঋণ মুকুবের দাবি রেখেছিল কেন্দ্রের কাছে। কেন্দ্রের মোদী সরকার সে দাবি মেনে নেয়নি এবং কেন তা সাংবিধানিকভাবে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়, তারও ব্যাখ্যা দিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেন্দ্রের এই পদক্ষেপকে রাজনৈতিক বিরোধিতা বলে প্রচার শুরু করে দিলেন এবং প্রকাশ্যে ঘোষণা করলেন, তিনি ওই ঋণের টাকা ফেরৎ দেবেন না। লাভটা কী হল ? সুদের পরিমাণ বাড়ল। সেই সুদ মেটাতে বাজার থেকে ফের ঋণ করতে হল। তার আবার সুদ জমতে লাগল। ফলত সব মিলিয়ে পশ্চিমবঙ্গের দেনার পরিমাণ এই মুহূর্তে ৩,৯৪,০০,০০০ টাকা। বামফ্রন্টের ফেলে যাওয়া ঋণের পরিমাণ ১,৯৩,০০,০০০ টাকা। অবস্থাটা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, পঞ্চদশ অর্থ কমিশনকেও ছুটে আসতে হয়েছে পশ্চিমবঙ্গে, কীভাবে এই ঋণের বোঝা কমানো যায় তার পরামর্শ দেবার জন্য।
অথচ মজার ব্যাপার রাজ্য সরকারের দান-ক্ষয়রাতির অন্ত নেই। ক্লাব পিছু প্রথমে ২ লক্ষ টাকা পরে ১লক্ষ টাকা করে আরও তিন বছর, প্রতি পুজো কমিটিকে দশ হাজার টাকা, কন্যাশ্রী, রূপশ্রী, যুবশ্রী ইত্যাদি প্রকল্পে অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ব্যয়। এমনকি বিষমদে মৃত্যুর জন্যও পরিবার পিছু ২ লক্ষ টাকার ক্ষতিপূরণ দেবার মধ্যে যে ‘উন্নয়ন’ নেই, আছে ‘রাজনীতি’ তা জলের মতোই পরিষ্কার।
সব কিছু ছাপিয়ে গেছে ২০১৯-এর ভোট পূর্ব প্রচারে প্রকাশ্য প্রধানমন্ত্রীকে অশ্রাব্য ভাষায় আক্রমণ করা। সেখানে কোনও শিষ্টাচার মুখ্যমন্ত্রী মানেননি। কোনও সংস্কৃতির ঐতিহ্যকে পরোয়া করেননি। সংবিধানের অধিকারের সমস্ত বেড়াজাল ভেঙে তিনি কেন্দ্র-বিরোধিতার নামে মোদী বিরোধিতার রাজনীতি করেছেন মাত্র। কেন্দ্রের নানা রাজ্য-বিরোধী ভূমিকায় বহু রাজ্যই অসন্তুষ্ট। কিন্তু কেউই বলেননি প্রধানমন্ত্রীকে কোমরে দড়ি বেঁধে জেলে ভরবেন। কেউই বলেননি, মাটি আর পাথরকুচি দিয়ে তৈরি ‘রসগোল্লা’ খাওয়াব। কোন বিরোধী মুখ্যমন্ত্রীই আওয়াজ তোলেননি – ‘মোদীজি চোর’
এ কেমন বিরোধিতা?
আসলে তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের এই লড়াই কোনও আদর্শের লড়াই নয়। স্বার্থপূরণের লড়াই। তা না হলে শিক্ষা ক্ষেত্রে রাজনৈতিক একাধিপত্য কায়েম করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলির উপচার্য নিয়োগ ইসুতে রাজ্যপালের বিরোধিতা করার মতন মানসিকতা নিয়ে এগোত না রাজ্য সরকার। সমস্ত অধিকারের বেড়াজাল ভেঙে সংখ্যালঘুদের তোষণের কারণে সমালোচনার মুখে পড়তে হত না রাজ্য সরকারকে। আর সরকারি প্রকল্পে নয়ছয় করার কথা তো মুখ্যমন্ত্রী নিজমুখে স্বীকার করে নিয়েছেন। গোটা রাজ্যে তাঁর দলের লোকদের ‘কাটমানি’ নেওয়ার কথা তো কোনও বিজেপি নেতা বলেননি।
এরকম এই অবাস্তবিক এবং অ-বিজ্ঞানসম্মত পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে রাজ্য সরকারকে কেন্দ্র-বিরোধিতার অভিমুখ বদলাতে হবে। কারণ রাজ্য সরকারের তোলা অভিযোগ বুমেরাং হয়ে ফিরে আসছে রাজ্যের দিকে। যখন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বরাবর অভিযোগ তুলেছেন, জনসেবামূলক প্রকল্পে কেন্দ্র আর্থিক বরাদ্দ পাঠাচ্ছে না, তখনই কিন্তু তিনি কেন্দ্রীয় প্রকল্পগুলিকে রাজ্যের প্রকল্প বলে মিথ্যা প্রচারে নেমেছেন। নিজে দেশ ভাঙার চক্রান্তে মদত দিয়ে অভিযোগ আনছেন, কেন্দ্রীয় সরকার দেশ বিভাজনের চেষ্টা করছে। এসবই দেশদ্রোহিতার সমতুল্। তৃণমূল কংগ্রেস সরকার ও দল এবং দলের সুপ্রিমোর ( পোস্ট একটাই। বাকি সব ল্যাম্পপোস্ট) মনে রাখা দরকার–রাজ্যের মানুষ ১৯৬৭ সাল থেকে রাজ্য রাজনীতির ছক্কা-পাঞ্জায় উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সম্ভাবনা থেকে একটু একটু করে দূরে সরে গেছে। এখন মানুষের পিঠ ঠেকেছে দেওয়ালে। ঠেকেছে বলেই বুঝতে পেরেছে–আর নয়। এবার ঘুরে দাঁড়াতে হবে। কেন্দ্রের সঙ্গে অকারণে ঝগড়া নয়। হাত মেলাতে হবে। পশ্চিমবঙ্গে সবুজ দুর্গ ভেঙে ফেলে গড়তে হবে গেরুয়া দুর্গ। ভাঙতে হবে কেন্দ্রের বিরোধিতার নামে ঠুনকো সস্তার রাজনীতি। কেন্দ্রের ভ্রূকুটি থেকে বাঁচতেই হবে, বাঁচাতেই হবে পশ্চিমবঙ্গকে। আজকের বাংলার শপথ সেটাই।