ঠেকায় পড়লে মানুষ এমন অনেক কাজ করে বা করতে বাধ্য হয় যা স্বাভাবিক অবস্থায় তার কাছে অপ্রত্যাশিত। সাধারণ নির্বাচনে বিজেপির কাছে পর্যদস্ত হবার পর পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তেমনই এক কাণ্ড বাধিয়েছেন। তিনি উপলব্ধি করেছেন, তার দলের নেতা-কর্মীরা কাটমানি খায়। তার হুকুম, যারা কাটমানি খেয়েছেন অবিলম্বে তা সাধারণ মানুষকে ফেরত দিতে হবে। বলা বাহুল্য এমন একটি নির্দেশ মমতার কাছে অপ্রত্যাশিত। কারণ, কিছুদিন আগে চুচুড়ায় এক সভামঞ্চ থেকে মমতাই বলেছিলেন, দলের কর্মীরা যে অর্থ সংগ্রহ করবেন তার ৭৫ শতাংশ পাবে দল। বাকি ২৫ শতাংশ পাবেন আদায়কারী। বলা বাহুল্য, মমতার কাটমানি ফেরত দেওয়ার নির্দেশে গুরুতর সঙ্কটের সম্মুখীন হয়েছে এই ২৫ শতাংশ পকেটস্থ করা নীচু তলার নেতা-কর্মীরা।
প্রশ্ন উঠতে পারে মমতা এমন একটা নির্দেশ কেন দিলেন? তিনি কি জানতেন না এর ফলে তারই দলের কর্মীরা জনরোষের মুখোমুখি হতে পারেন? বস্তুত, স্বাধীনোত্তর কালে তৃণমূল সরকারের মতো এমন নৈরাজ্যবাদী অগণতান্ত্রিক এবং দুর্নীতিগ্রস্থ সরকার পশ্চিমবঙ্গ দেখেনি। তৃণমূল দল এবং সরকারের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি। প্রসঙ্গত একটা কথা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে, বামফ্রন্ট আমলে যে সামাজিক দুবৃত্তায়ন শুরু হয়েছিল সেটাইচরম পরিণতি লাভ করেছে তৃণমূল আমলে। একথা সকলেই জানেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম কংগ্রেসের আঁতুড়ঘরে হলেও তাঁর রাজনৈতিক ডিএনএ আলাদা। তিনি বামপন্থী ঘরানার রাজনীতিবিদ। সিপিএমের মতো তিনিও রাজ্যকে প্রথমে বিরোধীশূন্য করার কথা ভেবেছেন। উদ্দেশ্য, তার সরকার হাজারো দুর্নীতি করলেও যাতে স্রেফ কোনও রাজনৈতিক বিকল্প না থাকার কারণে মানুষ বারবার তার দলকেই ভোট দেন। ২০১১ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত এই উদ্দেশ্য পূরণে মমতার কোনও অসুবিধে হয়নি। কিন্তু এবারের সাধারণ নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদী সব হিসেব উল্টে দেন। বিভিন্ন জনসভায় তিনি বারবার তৃণমূলের দুর্নীতির দিকে ইঙ্গিত করেন। শুধু তাই নয়, তৃণমূল সরকারকে ‘ভোলাবাজের সরকার’, ‘জগাই মাধাই সরকার এবং খোদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে “স্পিডব্রেকার দিদি ইত্যাদি বিশেষণে ভূষিত করে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের পাথরচাপা ক্ষোভ উসকে দেন। এর ফল কী হয়েছে তা আজ আর কারোও অজানা নয়। মানুষ যেমন নরেন্দ্র মোদীর মধ্যে একজন সর্বমান্য নেতাকে খুঁজে পেয়েছে ঠিক তেমনি বিজেপি হয়ে উঠেছে সম্ভাব্য রাজনৈতিক বিকল্প। বলা বাহুল্য, পশ্চিমবঙ্গের এহেন পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বাধ্য করেছে কাটমানি ফেরত দেবার মাধ্যমে নিজের এবং নিজের দলের ভাবমূর্তি মেরামত করবার কাজে মন দিতে।
এই প্রসঙ্গে আরও একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। কাটমানি বাবদ কত টাকা সরকারি কর্মী অফিসার এবং তৃণমূলের কর্মীরা খেয়েছেন? অন্তত কোনও একটি অর্থবর্ষকে ভিত্তি করে আমরা একটা সম্ভাব্য টাকার অঙ্কে পৌঁছতেই পারি। মনরেগা প্রকল্পের কথাই ধরা যাক। সরকারের দাবি, ২০১৮-১৯ অর্থবর্ষে ২১.৬৪ কোটি মানুষকে একশো দিনের কাজ প্রকল্পে কাজ দেওয়া হয়েছে। এই প্রকল্পে যে কাটমানি চলে তার প্রমাণ বীরভূমের মল্লারপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের বিরুদ্ধে কাটমানি ফেরত দেবার দাবিতে আন্দোলন শুরু করেছেন ওখানকার মানুষ। ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ইন্দ্রনীল দাশগুপ্তের মতে, সরকারের দেওয়া তথ্য ভিত্তি করে বলা যায়, শুধু ১০০ দিনের কাজ প্রকল্পেই ৩০ হাজার কোটি টাকার কাটমানি দেওয়া-নেওয়া হয়ে থাকতে পারে। এরপর আছে বাঙ্গলার আবাস যোজনা (সম্ভবত প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার বাঙ্গলা সংস্করণ) এবং স্বামী বিবেকানন্দ স্বনির্ভর প্রকল্প। দুটিতেই ১০ শতাংশ করে কাটমানি দেওয়ার নিয়ম। মূলত এই তিনটি প্রকল্পেই সর্বাধিক কাটমানি চলে। এবং সেই টাকায় ভাগ বসান তৃণমূলের নীচের তলা থেকে ওপরের তলার তাবৎ নেতা-কর্মী ও মন্ত্রীরা।
তৃণমূলের সাংসদ শতাব্দী রায় যথার্থই বলেছেন। তার মতে, কাটমানি নেওয়া হয় চেন সিস্টেমে। ফেরতও দেওয়া উচিত সেইভাবে। এরকম যেন না হয় নীচের তলার কর্মীরা টাকা ফেরত দিলেন আর তাতে ওপরতলার রেট আরও বেড়ে গেল!কিন্তু বেড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধবে কে? তৃণমূলে এখন রুইকাতলারা সাধু, চোর শুধু চুনোপুঁটিরা। ঠেকায় পড়ে এদের আঁশবটির মুখে ফেলে দিলে দলটা বাঁচবে তো? দল না বাঁচলে কিন্তু সিংহাসন বা রাজমুকুট কিছুই থাকবে না।
সন্দীপ চক্রবর্তী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.