দু’ বছর আগে যেদিন তৃণমূল কংগ্রেসের সেকেন্ড-ইন-কম্যান্ড মুকুল রায় দলত্যাগ করে গেরুয়া শিবির বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন, সেইদিনই পরিষ্কার হয়েছিল, তৃণমূলের আকাশ থেকে তারা খসা শুরু হলো। তারপর থেকেই তৃণমূল শিবিরকে দলত্যাগের আশঙ্কা গ্রাস করতে শুরু করে। নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁকে ঘিরে থাকা মোসাহেব ও কুশীলবরা যতই মুখে আস্ফালন করুন না কেন যে মুকুল রায়ের মতো ‘বিশ্বাসঘাতকরা’ দল ছাড়লে দলের ক্ষতির বদলে বরং মঙ্গলই হবে, আসলে বুক ধড়পড়ানি শুরু হয়ে গিয়েছিল তখনই। কারণ তৃণমূল মানেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলে নেত্রীর জবরদস্তি প্রচার যতই প্রবল হোক না কেন, দলের সবাই এমনকী নেত্রী নিজেও জানেন, তৃণমূল স্তরে দলটিকে পৌঁছে দিয়েছিলেন একজনই। তিনি মুকুল রায়। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে ব্যক্তিবিশেষের ‘ইমেজ’ ব্র্যান্ড হিসেবে গড়ে তোলা যায় সেটা যেমন সত্যি, আবার এটাও অস্বীকার করা যাবে না, ব্র্যান্ডটাকে প্রচারের দায়িত্বও নিতে হয়। ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে হয়। মানুষকে বোঝাতে হয়। না বোঝালে, মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে না পারলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তো কোন ছাড়, একটা গুঁড়ো মশলার ব্র্যান্ডও ইমেজ নিয়ে টিকে থাকতে পারত না।
তৃণমূল কংগ্রেস শিবিরে ওই সেলসম্যানের কাজে একক দক্ষতা দেখিয়ে ছিলেন মুকুল রায় তার সাংগঠনিক দক্ষতা দিয়ে। নইলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো স্বার্থপর রাজনৈতিক নেত্রী মুকল রায়কে দলের দ্বিতীয় প্রধানের শিরোপা কোনোদিনই দিতেন না। মুকুল রায় দল ছেড়েছেন সেদিনই যেদিন তাঁর গলা থেকে সম্মানের সূচকটি কেড়ে নিয়ে স্বয়ং নেত্রী তার সদ্য নাবালকত্ব উত্তীর্ণ (বয়সে, রাজনীতিতে নয়) ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে রাজনৈতিক উত্তরাধিকারীর আসনে অভিষিক্ত করেছেন। দলের অভ্যন্তরে রাম-শ্যাম-যদু-মধুরা ওই নব্য যুবরাজকে করলার রস গেলার মতো সহ্য করে নিলেও, মুকুল রায় পারেননি। হয়তো তিনি শিরদাঁড়াটাকে আর বেশি নোয়াতে পারেননি বলেই।
কিন্তু সেদিন থেকেই যে দলের ভাঙন শুরু হয়ে গিয়েছিল তা প্রকাশ্যে ধরা না পড়লেও, তৃণমূলের অন্দরমহলের কুশীলবরা ভালো করেই বোঝেন। এবার লোকসভা নির্বাচনের মুখে তা বেশ স্পষ্ট যখন দু’জন বর্তমান সংসদ সদস্য সৌমিত্র খাঁ এবং অনুপম হাজরা দলত্যাগ করে যোগ দিলেন বিজেপি-তে। আর দলের মধ্যে প্রায় বজ্রপাত করে দল ছাড়লেন তৃণমূল নেত্রীর বিশ্বস্ত সৈনিক, ভাটপাড়ার বিধায়ক অর্জুন সিংহ যাঁকে হাতে ধরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শিখিয়েছিলেন কীভাবে গণতন্ত্রের মন্দির বিধানসভায় লুম্পেন-রাজ প্রতিষ্ঠা করতে হয়। কেমন করে বহুমুল্যের ঐতিহ্যবাহী আসবাবপত্রগুলি ভাঙচুর করতে হয় (নভেম্বর ১১, ২০০৬), আর কেমনভাবে পঞ্চায়েত নির্বাচনে উত্তর ২৪ পরগনায় ফলাফল বিরোধী শূন্য করতে হয়। অনুতাপের আগুনে পুড়তে পুড়তে অসহ্য হয়ে ওঠায় অর্জুন সিংহ এখন গেরুয়া শিবিরে।
অনুতপ্ত শুধু অর্জুন সিংহ, সৌমিত্র খাঁ কিংবা অনুপম হাজরাই নয়, দলের অভ্যন্তরে বড়ো, মেজো, সেজো নেতা-নেত্রীদের অনেকেই, কারণ সব নেতা-নেত্রীই যে কংগ্রেস ভেঙে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন নিজেদের ধান্দা গোছাবার তালে, তা নয়। অনেকেই তৃণমূলে যোগ দিয়েছিলেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক মননশীলতা, সততা এবং সাহসের প্রতি সম্মান জানিয়ে। বামফ্রন্ট আমলে কংগ্রেস নেতাদের তরমুজসম (বাইরে সবুজ ভিতরে লাল) মানসিকতায় বীতশ্রদ্ধ হয়ে দল ছেড়েছিলেন অজিত পাঁজার মতো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বও। কিন্তু তিনিও একটা সময় তৃণমূল শিবির থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন বীতশ্রদ্ধ হয়ে।
সেই বীতরাগ বছরে বছরে তীব্র হয়েছে। ২০১১ সালে রাজ্যের ক্ষমতায় আসার পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের যে বিচিত্র পরিবর্তন গোটা দেশের মানুষ প্রত্যক্ষ করেছেন, দলের আভ্যন্তরীণ নেতা-নেত্রীরা তার উত্তাপ বুঝেছেন হাড়ে হাড়ে। ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ অবস্থা প্রায় সকলেরই কারণ যাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় দল বড়ো হলো, ক্ষমতায় এল, তারাই এখন নেত্রীর কাছে দূরের বাসিন্দা। আর তার প্রিয়জনরাজনীতির বাইরের জগত থেকে (চলচ্চিত্র শিল্পী, শিল্পী, কবি, সাংবাদিক) উড়ে আসা পরিযায়ী পক্ষীযুথই তার ঘনিষ্ঠ বলয়। রাজনীতির যারা এখনও সেই বলয়ের শরিক, তারা মূলত সংখ্যালঘু এবং মস্তান সদৃশ ব্যক্তিত্ব। কারণ নেত্রী জানেন, তার রাজনীতির তুরুপের তাস সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ভোট আর মস্তানদের ছাপ্পা মারার কেরামতি।
২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনে হঠাৎ করে চিত্রতারকাদের (দেব, মুনমুন সেন, সন্ধ্যা রায়, শতাব্দী রায়, তাপস পাল) এবং সেই সঙ্গে সাংবাদিক (সারদা চিটফান্ড খ্যাত কুণাল ঘোষ) এবং শিল্পী (যোগেন চৌধুরী)-দের ধরে বেঁধে এনে রাজ্যসভা কিংবা লোকসভা নির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়ার পর থেকে জলঘোলা হতে শুরু করেছিল। কিন্তু হাতের সামনে বিকল্প ছিল না।
২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের মুখে যখন বিজেপির শক্তি বেড়েছে, যখন বিকল্প হিসেবে রাজনীতিবিদদের সামনে হাজির নতুন সুযোগ, তখন এতদিন ধরে গুমরে থাকা নেতা-নেত্রীরা একটু একটু করে নড়াচড়া শুরু করেছেন।
যেমন বিধাননগরের মেয়র সব্যসাচী দত্ত। তিনি শুধু মুকুল ঘনিষ্ঠই নন, দলের আর্থিক পুষ্টি তৈরির অন্যতম কারিগরও। সেই সব্যসাচী দত্তকে বিধাননগরের মেয়র পদে বসিয়ে মূল রাজনীতি থেকে ব্রাত্য করে রাখায় তার ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন বারে বারে। এখন তিনি মুকুল রায়কে বাড়িতে বসিয়ে লুচি-আলুরদম খাইয়ে দলের অভ্যন্তরে সমালোচনা এবং হুমকির মুখে পড়লেও, লুচি-আলুরদমের পলিটিক্স থেকে বিরত হননি। বরং প্রকাশ্যেই বিবৃতি দিয়েছেন, ভবিষ্যতে শুধু মুকুল রায় কেন, যে কোনও রাজনীতিরই কুশীলবরা তার বাড়িতে এলে তিনি সৌজন্যের লুচি আলুরদম খাওয়াবেন। এমনকী মুকুল রায়কেও প্রয়োজনে আবার।
এবার নির্বাচনের দশ জন বর্তমান সংসদ সদস্যকে প্রার্থীপদের ছাড়পত্র দেওয়া হয়নি। এর মধ্যে রয়েছে সেসব আসনগুলি সেগুলি হলো—কোচবিহার, কলকাতা দক্ষিণ, দার্জিলিং, ঝাড়গ্রাম, বসিরহাট, মেদিনীপুর, বোলপুর, বিষ্ণুপুর এবং কৃষ্ণনগর। নতুন মুখ এসেছে অনেকগুলি। তার মধ্যে অত্যাশ্চর্য সংযোজন বাংলার দুই লাস্যময়ী চিত্রতারকা মিমি চক্রবর্তী এবং নুসরত জাহান। বসিরহাটে গত লোকসভা নির্বাচনে জয়ী তৃণমূল প্রার্থী ইদ্রিশ আলিকে সরিয়ে উলুবেড়িয়া বিধানসভার উপনির্বাচনের প্রার্থী করায় তিনি রীতিমতো ক্ষুব্ধ। প্রকাশ্যে কিছু না বললেও তিনি নাকি দলের ঘনিষ্ঠ মহলে ফোস করেছেন এই বলে যে “আমি কেউটের বাচ্চা। যেদিন ছোবল দেব, সেদিন ঝাড়বংশে নির্বংশ হবে সব। স্মরণ করতে দ্বিধা নেই— পার্ক সার্কাস, তপসিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে কয়েকবছর আগের দাঙ্গার নেপথ্য কারিগর ছিলেন এই ইদ্রিশ আলি। অপেক্ষায় আছেন, দল ছাড়বেন কবে।
দক্ষিণ দিনাজপুরের তৃণমূলের প্রতিষ্ঠাতা নেতা বিপ্লব মিত্র আশা করেছিলেন, এবারে অন্তত উড়ে আসা জুড়ে বসা কলকাতার নাট্যকর্মী এবং চিটফান্ড কাণ্ডে পরোক্ষে জড়িত অর্পিতা ঘোষের বদলে তিনি বালুরঘাটে টিকিটিটি পাবেন। কারণ এলাকায় অর্পিতা ঘোষের উন্নয়নমূলক কাজের তেমন কোনো নজির এখনও দেখা যায়নি। দলের পোড়াখাওয়া এই নেতা এবং এলাকার বিশিষ্ট নাট্যকর্মী বিপ্লব মিত্র প্রকাশ্যেই বিবৃতি দিয়েছেন, এবারে অর্পিতা ঘোষের জয় নিয়ে কোনো গ্যারান্টি দেওয়া যাবে না। কারণ তিনি ছাড়া এখানে অনেক নেতাই রয়েছেন যাঁরা নির্বাচনে দাঁড়ালে অবলীলায় জিততে পারতেন। বার্তাটা স্পষ্ট। তিনিও দলনেত্রীকে এবার সবক শেখাবার অপেক্ষায়।
কোচবিহারের জয়ী প্রার্থী পার্থপ্রতীম রায়কে বিনা কারণে সরিয়ে প্রার্থী করা হয়েছে ফরোয়ার্ড ব্লক থেকে দলত্যাগী রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী এবং নানা দুর্নীতিতে অভিযুক্ত পরেশ অধিকারীকে। ইতিমধ্যেই পার্থপ্রতীম রায় বিজেপির সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছেন। স্থানীয় দলীয় নেতৃত্ব তো প্রকাশ্যেই বিবৃতি দিয়েছেন, “জলঘোলা হবেই। এখানে কি নেতার অভাব ছিল যে পরেশ অধিকারীর মতো অর্ধশিক্ষিত একজন দলত্যাগী বামপন্থীকে লোকসভায় পাঠাতে হবে?’ মালদা উত্তর আসনে প্রার্থী করা হয়েছে সদ্য কংগ্রেস ত্যাগী মৌসম বেনজির নূরকে। এ নিয়ে এলাকায় অসন্তোষ জোরদার।
মুর্শিদাবাদ আসনে এলাকার যুবনেতা এবং প্রখর সাংগঠনিক ক্ষমতাসম্পন্ন তৃণমূল নেতা সৌমিক হোসেনকে পাত্তাই দেওয়া হয়নি। তাকে উপেক্ষা করে প্রার্থী করা হয়েছে প্রায় সদ্য কংগ্রেস ত্যাগী বিধায়ক আবু তাহেরকে। উপেক্ষিত সৌমিকও যোগাযোগ রাখছেন গেরুয়া শিবিরে।
এলাকায় এলাকায় এখন ছড়িয়ে পড়েছে অসন্তোষের বীজ। নেত্রী যতই মনে করুন না কেন, তাঁর দল অভেদ্য, তাঁর দল রাজস্থানের কেল্লার মতোই মজবুত এবং বিগত নির্বাচনের মতোই তিনি হেসে খেলে ছাপ্পা ভোটের খেলা খেলে পার হয়ে যাবেন নির্বাচনী বৈতরণী, তাহলে ভুল করবেন। গত পাঁচ বছরে বিজেপি শুধু শক্তি সঞ্চয়ই করেনি, তৃণমূলের গোড়ায় গোড়ায় বাসা তৈরি হয়ে গেছে ধ্বংসাত্মক উইপোকার। যারা বার্তা বহন করছে, এবার পতন অনিবার্য। প্রতিদিন খসে পড়া তারার সংখ্যা বাড়বে এবং নিষ্প্রভ হতে থাকবে তৃণমূল।
প্রবাদ বলে, তুমি যেমন বীজ বুনবে, ফসল হবে তেমনি। তৃণমূল কংগ্রেস দলটার শেকড়ই হলো দলত্যাগের আদর্শ। নেত্রী নিজেই কংগ্রেস দলটির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে তৃণমূল কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি সেদিন ভুলে গিয়েছিলেন, এই কংগ্রেস দলই তার হয়ে প্রাণপণ লড়াই করে সিপিএমের সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের মতো দক্ষ সাংসদকে হারিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে জিতিয়ে এনেছিল। কৃতজ্ঞতাবোধের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করে তিনি দলত্যাগ করেই ক্ষান্ত হননি, সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, শোভন চট্টোপাধ্যায়, অজিত পাঁজা, মুকুল রায়ের মতো নেতাদেরও দল ভাঙতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। সেই প্রবাহ চলেছে অবিরাম। শুধুমাত্র ২০১৬ সালে দ্বিতীয়বার তৃণমূল সরকার প্রতিষ্ঠার পর বামফ্রন্টেরও ১৭ জন বিধায়ক এবং তিনজন সাংসদকে দলত্যাগ করিয়ে নিজের দলে টেনেছেন হয় ভয় দেখিয়ে, না হয় নানা লোভে প্ররোচিত করে। সেই প্ররোচনা আজও অব্যাহত। এমনকী শ্রদ্ধেয় কংগ্রেস নেতা, স্মরণীয় রেলমন্ত্রী, বাংলার নব রূপকার বরকত গণি খান চৌধুরীর পরিবারের কংগ্রেসি ঘরানার শিকড়েও তিনি আঘাত হানতে দ্বিধাবোধ করেননি।
এবার তার প্রতিফল ঘটতে শুরু করেছে। একথা সবাই জানে, তৃণমূল কংগ্রেস কোনও রাজনৈতিক দল নয়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যক্তিগত জমিদারি। দল চলে তার মর্জিতে। কোনো রাজনৈতিক মুনশিয়ানায় নয়। ফলত দলের কিছু মুষ্টিমেয় নেতা-কর্মী ছাড়া বাকি সকলেরই স্বাধীনতা সীমিত। প্রতি পদে তাঁদের অপমানিত, অবহেলিত, উপেক্ষিত, পদানত হতে হয়। কেউ জানেন না, কখন কার ডানা ছাঁটা হবে। এই ভাবেই অপমানিত হয়ে একসময় দল ছেড়ে গিয়েছিলেন প্রবীণ কংগ্রেস নেতা পঙ্কজ ব্যানার্জিও। জেলে বছরের পর বছর কাটাতে হয়েছে সাংসদ কুনাল ঘোষকে। চিত্রতারকা সাংসদ তাপস পাল জেলের হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা কষলেও নেত্রী ফিরেও তাকাননি। আজ যদি এই সব নেতা-কর্মীরা একযোগে বিদ্রোহ করেন, একযোগে গলা মেলান— দল আমাদেরও। দল কারও ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়, তাহলে কি অন্যায় হবে?
প্রবীণ নেতা সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের হাত ধরে রাজনীতিতে এসেছিলেন মমতা। সেই সুব্রত মুখোপাধ্যায়কে এবার নির্বাচনে কলকাতা ছাড়া করেছেন নেত্রী। সুব্রত এবার বাঁকুড়ার প্রার্থী। বাহাত্তরো সুব্রতকে জীবনে কখনও কলকাতার বাইরে প্রার্থী হতে হয়নি। এবার যে বাঁকুড়া আসনটি তৃণমূলের হাতছাড়া হবার সমূহ সম্ভাবনা, সেখানে মমতা পাঠালেন তাঁর দীক্ষাগুরুকে। সুব্রত এ অপমান মেনে নেবেন?
সৌগত রায়, একা কুম্ভ হয়ে পার্লামেন্টে দলের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছেন। কিন্তু তার পরিচয় শুধুই এমপি। দলে এর চেয়ে বেশি সম্মান তিনি কোনোদিনই পাননি। তারও ক্ষোভ আছে অনেক। যদিও শিক্ষিত মানুষ বলে, তার ক্ষোভের প্রকাশটা অন্যরকম। আর তাছাড়া সুব্রত, সৌগত দুজনেই ফেঁসে আছেন নারদা মামলায়। ফেঁসে গিয়েও অবশ্য এবারও প্রার্থী হয়েছেন কাকলী ঘোষ দস্তিদার, অপরূপা পোদ্দার। সাজদা আমেদ নতুন প্রার্থী। তাঁর স্বামী সুলতায় আমেদও নারদা কাণ্ডে অভিযুক্ত ছিলেন। তিনি এখন প্রয়াত। সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ও ফেঁসে রয়েছেন রোজভ্যালি চিট ফান্ড মামলায়।তবুও তিনি এবারও প্রার্থী। এই সব অভিযুক্ত প্রার্থীদের নিয়েও দলে কোঁদল অব্যাহত।
নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে, দলের কোন্দল তত তীব্র হচ্ছে। আর ততই অপমানের বোঝা বাড়ছে নেত্রীর দিক থেকে। তার নয়া নির্দেশ— এবার প্রচারে সব প্রার্থীকেই বলতে হবে— প্রার্থী তিনি নন, প্রার্থী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এতদিন ‘অনুপ্রেরণা’-র রাজনীতি করেছেন। এখন সরাসরি ‘একমেবাদ্বিতীয়ম’ হিসেবে নিজেকে প্রোজেক্ট করা। অর্থাৎ প্রার্থীদের ব্যক্তিসত্তা বিপন্ন। এতদিন শুধু স্বাধীনতা ছিল না। এখন অস্তিত্বটাই হাওয়া হয়ে যেতে বসেছে। ভাবতে পারা যায়— সৌগত রায়, সুব্রত মুখোপাধ্যায়, শিশির অধিকারীর মতো পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদরা যাঁরা এখনও রাজনীতির দাবার চাল কী তা শিখিয়ে দিতে পারেন বহু রাজনীতিবিদকেই, তারা মঞ্চে দাঁড়িয়ে বলছেন—“আমাদের ভোট দিতে হবে না। আমার নামে আপনারা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভোট দিন।”
একসময় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গলায় ফাঁস দিতে চেয়েছিলেন প্রকাশ্য রাজপথে। এখন কি বাকি নেতাদের পালা? কী ভয়ংকর অসম্মান আর লজ্জার মুখোমুখি তারা। এ অপমানের প্রতিশোধ তুলবেন না তারা? একথা এখন দিনের আলোর মতোই পরিষ্কার—সর্বভারতীয় পর্যায়ে মোদী-জমানার রাজ হাজার অপপ্রচার সত্ত্বেও অক্ষুণ্ণ থাকছে। এমনকী পশ্চিমবঙ্গেও রাজনীতির হাওয়ার উড়ছে গেরুয়া রঙ। হয়তো রাতারাতি রাজপ্রসাদ গড়ে উঠবে না কিন্তু একটা শক্তপোক্ত ইমারত এবার গড়বেই মানুষ। অসহ্য তৃণমূলের বিকল্প হিসেবে।
আর তখনই শুরু হবে তারা খসা। ভোটের আগেই কিছুটা। বাকিটা ভোটের অব্যবহিত পরেই। তখন কবি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কানের কাছেও অন্য এক কবি গুনগুন করে শোনাবেন—
হঠাৎ ঘুম ভাঙে
তারা খসার শব্দে
আবার—আবার এক নক্ষত্রের পতন!
সনাতন রায়