তিল তালাক প্রথার বিরুদ্ধে বলায় এক সময় বসিরহাটের তৃণমূল প্রার্থী নুসরাত জাহানের উপর চটেছিলেন দলের নেতারা। পরে দিদি ক্ষোভ সামলাতে বলেছিলেন, নুসরত বাচ্চা মেয়ে, ও সব বোঝে না। ওই ব্যাপারটা নিয়ে দলের একটা অবস্থান রয়েছে।
কী অবস্থান, সেটা তৃণমূল গোটা গোটা শব্দে এখনও স্পষ্ট করল না। তবে যেটা সাদা-কালোয় স্পষ্ট হয়েছে তা হল— সংসদে তিন তালাক বিলোপ বিলের বিপক্ষেই ভোট দিল তৃণমূল। মঙ্গলবার রাজ্যসভায় এ ব্যাপারে বিতর্কে বিলের বিপক্ষে মত দেন তৃণমূল সাংসদ দোলা সেন। আপত্তির কারণ হিসাবে তিনি যা বলেন তার মোদ্দা বক্তব্য হল, বিলটি নিয়ে আরও আলোচনার জন্য সেটিকে সংসদের সিলেক্ট কমিটিতে পাঠানো উচিত ছিল। দুই, বিলটিতে যে ফৌজদারি ব্যবস্থা তথা শাস্তির বিধান দেওয়া হয়েছে তাতে আপত্তি রয়েছে তৃণমূলের। কারণ, পারিবারিক বিবাদ সংক্রান্ত এটি একটি দেওয়ানি আইন। তাতে ফৌজদারি দণ্ডের কথা বলা হবে কেন?
যদিও আপত্তির দুটো কারণই স্রেফ ছুতো তথা অজুহাত বলে মন্তব্য করেন সরকারের নেতারা। তাঁদের কথায়, সুপ্রিম কোর্টে নির্দেশে এই মধ্যযুগীয় প্রথা বিলোপ করার পথে হাঁটছে সরকার। গত দু’বছর ধরে এ ব্যাপারে বিভিন্ন স্তরে তর্ক বিতর্ক হয়েছে। এ নিয়ে যত দেরি করা হবে, তত মুসলিম মহিলাদের দুর্ভোগ ও তাঁদের প্রতি অবিচার দীর্ঘায়িত হবে। এবং দুই, দেওয়ানি আইনে শাস্তির ব্যবস্থা আগেও হয়েছে। হিন্দু বিবাহের ক্ষেত্রে পণ প্রথা বিরোধী আইনেই জরিমানা ও হাজতবাসের বিধান রয়েছে। বহুবিবাহ-বিরোধী আইনেও তা রয়েছে। সে কথা তৃণমূল ভুলে যাচ্ছে কেন?
তৃণমূলের আপত্তি সত্ত্বেও এদিন রাজ্যসভায় ভোটাভুটিতে জিতে যায় সরকার। তার পর টুইট করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মধ্যযুগীয় একটি প্রথা ইতিহাসের ডাস্টবিনে চলে গেল। ভারত আজ উচ্ছ্বসিত। যদিও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ ব্যাপারে কোনও মন্তব্য করেননি।
পর্যবেক্ষকদের মতে, তৃণমূলের আপত্তির কারণ ষোলো আনাই রাজনৈতিক। সুপ্রিম কোর্টে যখন তিল তালাক মামলা চলছিল তখন তার বিরোধিতা করে গোটা দেশে জনমত গড়ে তুলতে নেমেছিল মুসলিম পার্সোনাল ল’বোর্ড। ধর্মতলায় তাদের সভায় তাঁর মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম ও দলের তৎকালীন সাংসদ ইদ্রিশ আলিকে পাঠিয়েছিলেন মমতা। তিন তালাক প্রথার পক্ষেই তাঁরা সওয়াল করেছিলেন।
কারণ, তৃণমূলের আশঙ্কা রয়েছে তিল তালাক বিলের পক্ষে মত দিলে বাংলায় সংখ্যালঘু ভোট তাঁদের বিপক্ষে চলে যাবে। অথচ সংখ্যালঘু ভোটই এখন তাদের মূল পুঁজি। সেই কারণেই নুসরত তিন তালাকের বিরোধিতা করলেও মমতা ‘বাচ্চা মেয়ে’ বলে তা লঘু করে দিতে চেয়েছিলেন।
তৃণমূলের এই অবস্থানের পাল্টা রাজনৈতিক সুবিধা নিতে চাইছে বিজেপি-ও। তিন তালাক প্রথা বিলোপ করে এক তো তারা মুসলিম মহিলাদের সমর্থন পেতে চাইছে। অর্থাৎ তৃণমূলের সংখ্যালঘু ভোট বাক্সে ভাঙন ধরাতে চাইছে। দুই, বিজেপি মনে করছে মমতার এই তোষণনীতি বাংলার সংখ্যাগুরু হিন্দুরা প্রত্যাখ্যান করবেন। তাতে বাংলায় ধর্মীয় মেরুকরণ আরও তীব্র হবে এবং তা গেরুয়া শিবিরের অনুকূলে যাবে।
এই রাজনৈতিক আশা-আকাঙ্খার পাশাপাশি আপাতত বাস্তব হল, তাৎক্ষণিক তিন তালাক প্রথা পাকাপোক্ত ভাবেই নিষিদ্ধ হয়ে গেল। অনেকের মতে, লিঙ্গ বৈষম্য দূর করার লক্ষ্যে এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী।