তিন রায় তিন ধর্ম বেঙ্গাই গাঁ পর্ব ১

বেঙ্গাই গাঁ – শিব ও ধর্ম

হুগলী জেলার একটি প্রাচীন গাঁ বেঙ্গাই। সেখানে ব্রাহ্মণ , সদগোপ, দুলে, হাঁড়ি, বর্গক্ষত্রিয়, ডোম প্রভৃতি জাতির বাস। সপ্তদশটি পাড়া নিয়ে গঠিত হয়েছে বড় গ্রাম বেঙ্গাই। পাড়াগুলির মধ্যে আছে বাঁড়ুজ্যে পাড়া, ভট্টাচার্য পাড়া, রায় পাড়া, দুলে পাড়া, পন্ডিত পাড়া , হাড়ি পাড়া, তামলি পাড়া উল্লেখ্য।

বেঙ্গাই গাঁয়ে বেশিরভাগ মানুষই কৃষিজীবী। এছাড়াও নানা কুটিরশিল্পের সঙ্গে অনেকেই যুক্ত আছেন। অহল্যাবাঈ রোড এবং বর্ধমান মেদিনীপুর রোড বেঙ্গাইকে ছুঁয়ে গেছে । এছাড়া গ্রামের ভিতর একপাড়া থেকে অন্যপাড়ায় যাবার জন্য কাঁচা ও মোরাম বিছানো সুন্দর গ্রাম্য পথ ।

এই গাঁয়ে আছে অনেকগুলো প্রাচীন দেবস্থান । এর মধ্যে লৌকিক দেবতা #শ্যাম_রায়ের মন্দিরটি সর্বাপেক্ষা প্রাচীন এবং সুপ্রসিদ্ধ। আর আছেন গাঁয়ের শঙ্কেশ্বরশিবের প্রাচীন মন্দির । ঘটস্থাপিতা মা বিশালাক্ষী আছেন শ্যামরায়ের মন্দিরের পাশে। রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের পিতৃকুলের পূর্ণানন্দ ভট্টাচার্য প্রতিষ্ঠিত একটি কালীমূর্তি আছে। এছাড়া বাঁড়ুজ্যে পাড়ায় একটি মা লক্ষ্মীর মন্দির আছে। বেঙ্গাই গাঁয়ে কৃষিজ ফসল বলতে প্রধানত : ধান , আলু ও তিল।

গাঁয়ের নাম বেঙ্গাই কেন ? বেঙ্গাই নাম নিয়ে অনেক মত গাঁয়ে ও হুগলী জেলায় প্রচলিত আছে। অনেকে বলে থাকেন যে , কামারপুকুরগামী ও মেদিনীপুরগামী বড় রাস্তা থেকে বনজঙ্গলে ঘেরা এই গ্রামটিকে দেখা যেত । তাই গাঁয়ের নাম হয়েছিল বনগাঁই । সেখান থেকে গাঁয়ের নাম অপভ্রংশ হয়ে হয়েছে বেঙ্গাই।

আবার অনেকে বলেন এই গাঁয়ে আগে নাকি অনেক বেনে বাস করতেন। সেইসব বেনেদের অনেক গাইগরু , গোয়াল ছিল। গাঁয়ের যে লক্ষ্মীমন্দির , সেটি লক্ষ্মীতলা নামে পরিচিত গাঁয়ের লোকের কাছে। সেখানের আশেপাশে ছিল এইসব বেনেদের বাস। #বেনেদের_গাই থেকে নাম হয়েছে গাঁয়ের বেঙ্গাই। লক্ষ্মীতলা ও শঙ্কেশ্বরশিবের মন্দিরের সামনে দিয়ে যে পথ চলে গেছে গাঁয়ের ভিতর , তার পূব দিকের অংশটিকে বাসুদেবপুর বলা হয়। গাঁয়ের গরাম ঠাকুর শ্যামরায়ের মন্দিরটির অবস্থান ছিল এই বাসুদেবপুরের ভেতরেই।বর্তমানে বাসুদেবপুর নামে কোনো পৃথক অংশ মৌজা মানচিত্রে চিহ্নিত নেই। শ্যামরায় মন্দিরের অবস্থান দেখানো হয়েছে বেঙ্গাইয়ের মানচিত্রের মধ্যেই। যে বেনেদের অনেক অনেক গাইগরু ছিল তারা ছিলেন গন্ধবনিক।

এই গাঁয়ের নাম বেঙ্গাই হওয়ার আরো একটি জোরালো কারন আছে। একসময় এখানে পিতল কাঁসার ব্যাপারী কংসবনিকদের বাস ছিল। তারা বেঙ্গা পিত্তল নামক একপ্রকার পিতলের তৈজসপত্র নির্মাণ করতেন।এই পিতলের অন্য নাম রাজরীতি পিত্তল । এই পিতলকে ঘষে মেজে স্বর্ণের ন্যায় উজ্জ্বল করে তোলা হত। সংস্কৃত শব্দ ব্রাহ্মনী পিঙ্গলা থেকে বেঙ্গা পিত্তল শব্দটি এসেছে।বেঙ্গা পিত্তলকারবারীদের বসবাসের হেতু গাঁয়ের নাম হয় বেঙ্গাই।

একসময় আরামবাগ ও গোঘাট অঞ্চলে অনেক পিতল কাঁসার ব্যাবসায়ীরা বাস করতেন।বালিদেওয়ানগঞ্জে এখনও পিতল কাঁসার উৎকৃষ্ট তৈজস নির্মাণ হয়। তবে বেঙ্গাইতে এখন গন্ধবনিক বা কংসবনিক কারুরই বাস নেই।

বেঙ্গাই গ্রামে বর্গক্ষত্রিয় সম্প্রদায় সেবিত ধর্মরাজের নাম শ্যামরায়।প্রাচীন এবং লোক প্রসিদ্ধ দেবতা শ্যামরায়।বেঙ্গাই ও তার প্রতিবেশী গ্রামসমূহ একসময় ছিল প্রসিদ্ধ #ধর্মরাজক্ষেত্র। প্রতিবেশী অমরপুরেও ধর্মরাজ প্রসিদ্ধ। এছাড়াও খাটুল গাঁয়ে আছেন ক্ষুদিরাম আচার্য সেবিত #ক্ষুদিরায় ধর্ম।এই খাটুল গাঁয়ের উল্লেখ আছে ধর্মমঙ্গল পুঁথিতে । কিংবদন্তি আছে যে, ধর্মমঙ্গলের রচয়িতা মানিকরাম গাঙ্গুলি খাটুলের নিকট দেশাড়ার মাঠে আসাবাড়ি হাতে বৃদ্ধ ব্রাহ্মনের বেশে স্বয়ং ধর্মরাজের দর্শন পেয়েছিলেন।

তাই মানিকরামের রচিত ধর্মমঙ্গলের প্রথম পালার নমো ধর্মায় অংশে দেখি –

সূর্য অভিমুখ কর‍্যা গমন সত্ত্বর ।
খাটুল পৌঁছতে হল ক্ষীণ কলেবর ।।
কপালে থাকিলে লেখা কালে এসে ঘটে।
দ্বিজের সহিত দেখা দেশাড়ার মাটে।।

ধর্মমঙ্গল’ কাব্যের ধর্মঠাকুর নিজেই কৃষি দেবতা। বৃষ্টির দেবতাও। তাঁর কৃপায় কৃষক ভাল ফসল পায়। সপ্তদশতকের কবি রূপরাম চক্রবর্তী তার ‘ধর্মমঙ্গলে’ ধান, কাপাস, কলাই ইত্যাদির কথা উল্লেখ করেছেন। ধর্মমঙ্গল রাঢ়ের মহাকাব্য বলে বিবেচিত হয়। যদিও বিষয়টি বিতর্কিত।

এতশুনি কালুবীর নিদারুণ কয়।

উচিত বলিতে গালি দিবে অতিশয়।।

অদ্যকথা কহিলে পাইবে পারিতাপ।

গরুর রাখাল ব্যাটা ছিল তোর বাপ।।

কাননে রাখিত গরু মুখে নাই রা।

ঘরে ঘরে রাখালি সাধিত তোর মা।।

কেহ দিত চালু খুদ পুরান কলাই।

অন্ন বিনে অকালে মরিল তোর ভাই।।

মানিকরাম গাঙ্গুলি ধর্মমঙ্গলে বিপর্যস্ত কৃষি জীবনের স্পষ্ট চিত্র এঁকেছেন। তিনি বলেছেন যে,

, মাহুদ্যা রাজা হয়ে
জবুল জমির জমা বেশি করে ধরে।
যে না দেয় তার সদ্য গুণাগার করে॥
ক্ষেতে হাল খন্দ সে বেচে লয় সব।
বিব্রত হইল প্রজার পেয়ে আধি ভব॥
দেশ ছেড়ে দেশান্তরে পালাইয়া গেল।
শহর নগর গ্রাম শূন্যময় হল॥

রাঢ় বঙ্গ সহ তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় বহু বহু স্থানে তাই আজও তিনি কুলদেবতা রূপে পূজিত হন।

বেঙ্গাই গ্রামে #ধর্মসায়র নামে দুইটি বৃহৎ পুষ্করিনী আছে।একটির বতর্মান মালিক গ্রামস্থ ঘোষরা , অন্যটি রায়দের। শ্যামরায় মন্দিরের পূর্ব দিকে আছে #পন্ডিতপুকুর ,যার আয়তন ১ একর ৮০ শতক। এটি শ্যামরায়ের সেবাইত পন্ডিত পদবীধারী বর্গক্ষত্রিয়গণ কতৃক প্রতিষ্ঠিত। এছাড়া গ্রামে পড়িৎ পুকুর এবং পড়িৎ খালি বলে দুটি জলাশয় আছে মা বিশালাক্ষী মন্দিরের নিকট। পন্ডিত শব্দটি থেকে পড়িৎ শব্দটি এসেছে।

শ্যামরায় ব্যতীত উগ্রক্ষত্রিয়দের অধ্যুষিত বেঙ্গাই উত্তরপাড়ায় ক্ষুদিরায় ধর্ম ছিলেন ছিলেন ডোম পন্ডিতদের উপাসক। মতিলাল সাঁতরা ছিলেন তাঁর শেষ সেবায়েত। তবে এই ডোম পন্ডিতদের চিরাচরিত তাম্র দীক্ষা হয় নি। সেই ক্ষুদিরায় এখন শ্যমরায় মন্দিরে অবস্থান করছেন।

এছাড়াও গর্ভগৃহে আছেন পশ্চিম অমরপুরের কৈলাস পন্ডিত সেবিত ক্ষুদিরায় ধর্ম – যিনি মৃত্যুঞ্জয় পন্ডিতের সময়কালে বেঙ্গাইতে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হন । এছাড়া গ্রামের সরসীমোহন আচার্য সেবিত #কালুরায় ধর্ম পূজিত হন আচার্যদের গৃহমন্দিরে।

রামকুমার আচার্য > ষষ্ঠীরাম আচার্য > সরসীমোহন আচার্য > তপন রায় বংশানুক্রমে ধর্মরাজ কালুরায়ের সেবাইত এবং পুরোহিত । এঁরা দৈবজ্ঞ বা গ্রহবিপ্র শ্রেণীর ব্রাহ্মন ।

বেঙ্গাই গ্রামে ধর্মরাজের প্রবল প্রভাব ছিল , এখনো আছে, যতদিন বেঙ্গাইয়ের মানুষ থাকবেন সেই প্রতাপও বজায় থাকবে। তিনি বেঙ্গাইয়ের রাজপুরুষ। তাঁর সেবকরা সংখ্যা গরিষ্ঠ।

গ্রামের শঙ্কেশ্বরশিব মন্দিরের পৌরোহিত্য করেন ধর্মরাজ কালুরায়ের সেবক দৈবজ্ঞ ব্রাহ্মন সরসীমোহন আচার্য। এই শিবের গাজনে #কেলকেজুজু বা #কালকেজুজু র মতো নানা আদিম লোকাচার পালিত হয়। শিবকে প্রদান করা হয় ধর্মরাজের প্রিয় মনুই ভোগ। শিব ও ধর্ম এখানে মিলে মিশে এক হয়ে গেছেন। সব মিলে এক হয়ে জয় হয়েছে সনাতনের।

ধর্মরাজ ঈশ্বর ধারণার অতীত। যা ধারণা করি, তা তিনি নন, তা আর-কিছু, তা সংসার। সুতরাং তাতে সংসারের সমস্ত লক্ষণ অবলোকিত হয়। সংসারের লক্ষণ বৈচিত্র্য, সংসারের লক্ষণ বিরোধ।

যা ধারণা করতে পারি, তাতে আমাদের তৃপ্তির অবসান হয়ে যায়, যা ধারণা করি, তাতে প্রতিক্ষণে বিকার ঘটতে থাকে। সুখের আশাতেই আমরা সমস্তকিছু ধারণা করতে যাই, কিন্তু যা ধারণা করি, তাতে আমাদের সুখের অবসান হয়। এইজন্য উপনিষদে আছে–

যো বৈ ভূমা তৎ সুখং নাল্পে সুখমস্তি।

সেই ভূমাকে যদি আমরা ধারণাযোগ্য করবার জন্য অল্প করে নি, তবে তা দুঃখসৃষ্টি করবে,–দুঃখ হতে রক্ষা করবে কী করে? অতএব সংসারে থেকে ভূমাকে উপলব্ধি করতে হবে, কিন্তু সংসারের দ্বারা সেই ভূমাকে খণ্ডিত-জড়িত করলে চলবে না।

ধর্মরাজের নাম শ্যামরায় । কিন্তু কে এই শ্যামরায়? কেন এমন না? বৈষ্ণব প্রভাব কি ? নাকি ভগবান বিষ্ণুই লৌকিক ভাবে হয়েছেন ধর্মরাজ ?…

ক্রমশঃ

©দুর্গেশনন্দিনী

তথ্যঃ শ্যামরায় : বেঙ্গাই ( হাওড়া জেলার লৌকিক দেব দেবী)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.