সেই সপ্তডিঙা মধুকর, সেই যে রাজপুত্র , সেই যে পক্ষীরাজ ঘোড়া , সেই যে সাত সমুদ্র , সেই যে তেরো নদী , সেই যে তেপান্তরের মাঠ- সদাগরের ছেলে বাণিজ্যে যেত, রাজপুত্র রাজকুমারীর খোঁজে যেত আর সঙ্গে করে নিয়ে যেত কি ? কেবলই ব্যবসার সামগ্রী ? কেবলই রাজকুমারী পাবার আকঙ্খা ? না , সঙ্গে করে নিয়ে যেত আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের জীবনের গল্পগাথা, আমাদের দেবদেবীর কথা, আমাদের ঐতিহ্য , আমাদের সংস্কৃতিকে । সেসব লোককথা দেশ হতে দেশান্তরে কিংবদন্তি হয়ে পরিণত হত রূপকথায়। তবে তাতে অলৌকিক বিষয় দিয়ে মানবের নূন্যতম চাহিদার আর্তিটুকুর সঙ্গে থাকত জীবনের চলার নানা শিক্ষা , নানা লৌকিক বিষয়। তাই , লোককথা বা রূপকথার মাতা স্বরূপ অখন্ড ভারতবর্ষ , আফ্রিকা এবং দক্ষিণ আমেরিকার নানা লৌকিক ঘটনা কালে কালে ছড়িয়ে পড়েছিল গ্রিস, রাশিয়া, ইউরোপ ও আমেরিকার নানা স্থানে। সেখানে কেবলমাত্র স্থান নাম ও পাত্রের নাম বদল হয়েছিল বাকি আর্তি একই ছিল, আছে , থাকবে যুগ যুগান্ত ধরে।

পৃথিবীর বুকে গড়ে ওঠা প্রাচীন মানব সমাজের উর্বর ভূমিতে বৃদ্ধি পেয়ে ওঠা সব সভ্যতার অভিজ্ঞতাই এক, তাই লোককথা একই কাহিনী রূপ পায়। পার্থক্য ঘটে কেবল স্থান ও পাত্রের নামে। উক্ত নৃবিজ্ঞানীদের মতে , বিচ্ছিন্নভাবে সম্পর্কহীন অবস্থাতেই এইসব লোককথার জন্ম হয়েছে। পৃথিবীর অসংখ্য এলাকায় লোককথার জন্ম ইতিহাস সম্পর্কে এই তত্ত্ব অবশ্যই বিজ্ঞানসম্মতভাবে সঠিক।

ভারতে পঞ্চতন্ত্র খ্রিস্টপূর্ব ২০০ অব্দ থেকে খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতাব্দীর মধ্যে সংকলিত হয়েছিল। আর অষ্টম শতাব্দী সেগুলি ভাষান্তরিত হয় সিরিয়াক এবং আরবিক ভাষায়।সেখান থেকে ই সেই পঞ্চতন্ত্র গ্রিস হয়ে ইউরোপে ছড়িয়ে পড়েছিল। ঈশপের নীতিকথাও খ্রিস্টপূর্ব ২০০ অব্দ নিকটবর্তী সময়কালে সংকলিত হয়। কারন, তখন ভারতে ব্যাকট্রিয় গ্রীকদের আক্রমন ও রাজত্বের সূচনা হয়েছে। তাই স্বাভাবিক ভাবেই সেই কথা গ্রীসে গিয়ে ঈশপের রূপ নিয়েছে। তেমনি আমাদের দেশের মিজো উপজাতির রূপকথা #মিজোদে_কুংগরি। যার সঙ্গে রয়েছে গ্রীক রূপকথার মিল রয়েছে। সেই কোনো প্রাচীন কালে গ্রীকরা ভারতে এসেছিল। তারপর ব্যবসা বাণিজ্য , সাম্রাজ্য বিস্তার ইত্যাদি কোনো না কোনো ভাবে এই ভারতের উপকথা , রূপকথাকে নিয়ে চলে গেছে নিজেদের দেশে।

ভারতের বাংলা, অসম বিহার, উড়িষ্যায় অনেকস্থানে নীতি মূলক উপকথা বা লোককথাকে #সাধুকথা বলা হয়। ভারতের প্রতি প্রদেশের মানব রূপকথা , উপকথা এবং লোককথার গুরুত্বকে উপলব্ধি করে এসেছে। সাধুকথা নামকরণের মধ্যেই তার আভাস। ভারতের রূপকথায় রাজপুত্র , মন্ত্রীপুত্র , কোটাল পুত্র , রাক্ষস, খোক্ষস যেমন আছে তেমনই এখানে প্রকৃতি, জীবজন্তু, মানুষ মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে । প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যে মেলবন্ধনের এক সুন্দর দৃষ্টান্ত গড়ে উঠেছে। তাই পাহাড় হতে সমতল রূপকথা, উপকথারা সাদৃশ্য ময়।

যাক আজ একটা গল্প শোনাব । সময়ের গল্প। সময় অর্থাৎ কাল, মহাকাল যাকে নিয়ন্ত্রণ করেন। সেই গল্প …

সে অনেক অনেক দিন আগের কথা। এক গাঁয়ে খুব কুড়ে স্বভাবের একটি ছেলে ছিল ।ভোরবেলা সবাই যখন জমিতে চাষের জন্য বেরিয়ে যেতো , সে তখন ঘুমিয়ে থাকতো । জমিতে বীজ বুনে চাষীরা যখন ফসলের আশায় বসে আছে , তখন হঠাৎ একদিন ছেলেটির খেয়াল হল – তাইতো! জমি তো এখনো চাষ করা হয়নি । তখন সে চাষ করতে যেত। একদিন যথারীতি অসময়ে উঠে সে হাল বাইতে গেছে। এমন সময় এক বুড়ো তাকে দেখে বলল , “একি সময় তো চলে গেছে ,আর এখন কি না তুমি কাজ আরম্ভ করছো? “

ছেলেটি বলল ” ” আচ্ছা দাদু সবাই দেখি কেবল বলে- সময় চলে গেছে, সময় চলে গেছে ! তুমি বলতে পারো সময় কোথায় যায় ?”

বুড়ো বলল , “না ভাই আমি জানিনা। শুনেছি সময় আসে আর যায়
ঠিকমত তাকে ধরতে পারলে সবই ভালভাবে করা যায় । তা না হলে সব নষ্ট হয়।”

ছেলেটি তাকে ধরে বসল , “দাদু তোমার তো অনেক বয়স হয়েছে । অনেক কিছু দেখেছ । নিশ্চয় তুমি সময়ের ঠিকানা জানো । আমার ঠিকানা টা দাও না ।দেখি চেষ্টা করে ধরে আনতে পারি কিনা।”

বুড়ো তখন মাথা নেড়ে বলল , ” না ভাই সময়ের ঠিকানা কেউ জানে না ।”

ছেলেটিও নাছোড়বান্দা , “দাদু তোমার জীবনের সময় তো কতবার এসেছে ,গেছে ; তবুও তুমি তার ঠিকানা জানো না ? একথা আমায় বিশ্বাস করতে হবে ? তুমি নিশ্চয়ই জানো । কেবল আমাকে বলছো না ।”

ছেলেটি কিছুতেই যখন তাকে ছাড়ে না, তখন বুড়ো বলল , ” বেশ তাহলে বলছি: শোনো , সময় যখন চলে যায় তখন সে বহু দূরে চলে যায়। তাকে যদি ধরতে চাও তাহলে আর দেরি করোনা ।কাল ভোরে উঠে রওনা হয়ে যাও। পথে যেতে যেতে যখন শনের নুড়ির মতো চুলের তিন মাথাওয়ালা কোন বুড়োর দেখা পাবে তখন তাকে জিজ্ঞাসা করো। সে হয়তো তোমাকে সময়ের ঠিকানা দিতে পারবে ।

বুড়োর কথায় ছেলেটি ভারি খুশি হয় । সে পরদিন ভোরবেলা পুঁটুলীতে চিঁড়ে, গুড়, কলা, মুড়ি এসব বেঁধে সময়ের খোঁজে বেরিয়ে পড়ল । তারপর দিন গেল, রাত গেল , কত পাহাড় নদী অরণ্য পেরিয়ে চলল…. কিন্তু সে বুড়োর দেখা নেই। এইভাবে দিন যেতে যেতে কতদিন যে কেটে গেল তা হিসাব রইল না তবুও সময়কে এসে ধরবেই এই তার পণ

অবশেষে হঠাৎ এক ঝরনার ধারে , গাছের তলায় সেই
ছেলে সেই তিনযুগ পুরানো বুড়োর দেখা পেল । দুই হাঁটুর মধ্যে মুখ গুঁজে সেই বুড়ো চুপচাপ বসে আছে। দেখে মনে হচ্ছে যেন তিন মাথা এক। মাথার চুলগুলো সব শনের নুড়ির মতো । ছেলেটির আর আনন্দের সঙ্গে সীমা রইল না। ছুটে গিয়ে তার কাছে বসে পরলো , বলল , “বুড়ো দাদু কত কষ্ট করে তবে তোমার দেখা পেলাম। তোমার সঙ্গে আমার বিশেষ কথা আছে।”

বুড়ো দাদু তো চোখেও দেখেনা । কানেও শুনেনা । যেমন মাথা গুঁজে বসে ছিল তেমনি বসে রইল। ছেলেটি তখন তার কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে চেঁচিয়ে বলল , ” দাদু ও বুড়ো দাদু তোমার কাছে, সময়ের ঠিকানা জানতে এসেছি । তুমি তার ঠিকানা দাও। আমি তাকে ধরে নিয়ে আসবো। তাহলে আমার ক্ষেত নষ্ট হবে না ,উপোস থাকতে হবে না ।”

অনেক চেঁচামেচি করার পর সেই তিনকাল যাওয়া বুড়ো মাথাটা কোনরকমে তুলে বলল , ” ভাই আমি তো তোমার মত সময়ের খোঁজে বেরিয়ে ছিলেম। সেই কোন ছোটবেলায়। কিন্তু তারা দেখা পেলেম না । এখনতো থুত্থুরে বুড়ো হয়ে গেছি । চোখেও দেখি না কানেও শুনি না। হাঁটতেও পারিনা। তাই সময়ের ঠিকানা বের করতে পারলাম না। এখন বুঝতে পারছি সময়ের কোন ঠিকানা নেই । সে মহাকালের অধীন, সে কেবলই চলে। তাকে ধরে রাখা যায়না। মহামায়া মহাকালী সেই সময়কে ধারণ করে আছে। আমার মত তুমিও আর মিথ্যা সময় নষ্ট করো না । ফিরে যাও। যত্ন করে জমি চাষ করো। ফসল নিশ্চয়ই হবে । একটা কথা সবসময় মনে রেখো , সময়ের কাজ সময়ে করতে হয়। মায়ার সংসারে সময় একবার চলে গেলে কিছুতেই তাকে ফিরে পাওয়া যায় না । “তারে ধরি ধরি মনে করি ধরতে গেলেম আর পেলাম না “

ছেলেটি এবার বুঝতে পারলো। সময় এর আসল ঠিকানা কি? সময়ের কাজ সময়ে করতে পারলেই তাকে ঠিক ধরা যায়…..

“যদাহতমস্তন্ন দিবা ন রাত্রির্নসন্ন চাসচ্ছিব এব কেবলঃ।”

আমার কথাটি ফুরোলো
নটে গাছটি মুড়োলো…

©দুর্গেশনন্দিনী

তথ্যঃ লোককথার লিখিত ঐতিহ্য

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.