মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখে স্বীকার না করলেও একটা কথা নিশ্চয়ই মানেন, ২০১১ সালে তিনি নেতিবাচক ভোটে জয়লাভ করেছিলেন। সিপিএমের প্রতি মানুষ বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছিল। তারা শুধু সিপিএমকে ভোট দেবে না বলেই দিয়েছিল তৃণমূলকে। আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছিল সে সময়। তৃণমূল এবং কংগ্রেসের মধ্যে জোট হয়েছিল। উত্তরবঙ্গে জোট প্রার্থীদের জয়জয়কারের পিছনে ছিল কংগ্রেস আর দক্ষিণে বামবিরোধী নেতিবাচক ভোট। ২০১৬ সালের নির্বাচনে সমীকরণ ছিল সম্পূর্ণ উল্টো। সেবার কংগ্রেসের সঙ্গে তৃণমূলের জোট হয়নি, হয়েছিল সিপিএমের সঙ্গে। ফলে উত্তরবঙ্গে তৃণমূলের ফলাফল আশানুরূপ হয়নি। দক্ষিণের ফলাফলে মুখরক্ষা হয়।
এবারের নির্বাচনেও তৃণমূল একা লড়ছে। এখনও পর্যন্ত যা খবর, কংগ্রেস এবং সিপিএমের মধ্যেও কোনও জোট হচ্ছে না। অর্থাৎ দুটি দল আলাদা লড়বে। এবারের নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে লড়াই হবে চতুর্মুখী। বিজেপি চতুর্থ পক্ষ। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচন থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক পঞ্চায়েত নির্বাচন পর্যন্ত দীর্ঘ পরিসরে বিজেপি রাজ্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম শক্তি হয়ে উঠেছে। নরেন্দ্র মোদীর বলিষ্ঠ নেতৃত্ব এবং অমিত শাহের কুশলী পরিকল্পনায় আগামী নির্বাচনেও বিজেপির ভালো ফল করার সম্ভাবনা ক্রমশ বাড়ছে। প্রশ্ন হলো সেই ভালো ফল ঠিক কীরকম? এবারও কি বিজেপি স্থানীয় ভিত্তিতে ভোট শতাংশ বাড়িয়ে দু-একটা আসন জিতে নির্বাচনী দৌড় শেষ করবে? নাকি, অমিত শাহ যেমনটি দাবি করেছেন, ২৩টি আসনে জিতে ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে জেতার লক্ষ্যে অনেকখানি এগিয়ে যাবে?
কোনও কোনও ভোট বিশেষজ্ঞ মনে করছেন রাজ্যে কংগ্রেস এবং সিপিএমের জোট হওয়ায় দুই দলের কমিটেড ভোটাররা যে-যার পছন্দের দলকেই ভোট দেবেন। ভোট ভাগাভাগি হবে না। তাতে লাভ তৃণমূলের। জোট হলে কমিটেড ভোটাররা অনেকেই বিজেপিকে ভোট দিতেন। সেক্ষেত্রে বিপদে পড়ত তৃণমূল। এই ব্যাখ্যাকে সম্পূর্ণ অযৌক্তিক নিশ্চয়ই বলা যাবে না। কারণ এই ধরনের ঘটনা আমরা ২০১৬ সালে ঘটতে দেখেছি। সেবার দুই জাতশত্রু সিপিএম এবং কংগ্রেস তৃণমূলকে হারাতে জোট গঠন করেছিল। এই অনৈতিক জোটগঠনের সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন দুই দলের কমিটেড ভোটাররা। লাভ হয়েছিল তৃণমূলের। ২০১১ সালের পর আরও একবার, মূলত সিপিএম-কংগ্রেসের কমিটেড ভোটারদের নেতিবাচক ভোটের কল্যাণে নির্বাচনী বৈতরণী পার হয়েছিল তারা। দক্ষিণবঙ্গে নেতিবাচক ভোট পড়েছিল সব থেকে বেশি। বেঁচে গিয়েছিল তৃণমূল। নয়তো পাঁচ বছর শাসন করেই তাদের পাততাড়ি গোটাতে হতো।
এবারে কমিটেড ভোট অন্য কোনও বাক্সে পড়ার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু অন্য একটি সম্ভাবনা আছে- যার কথা বিশেষজ্ঞরা কায়দা করে এড়িয়ে গেছেন। সিপিএম এবং কংগ্রেসের মধ্যে জোট হলে মুসলমান ভোট তিন ভাগে ভাগ হতো, এখন হবে চার ভাগে। এ রাজ্যের মুসলমানরা বিজেপিকে ভোট দিতেন না। কিন্তু কংগ্রেস এবং সিপিএমের দলগত অস্তিত্ব তলানিতে এসে ঠেকাতে যে রাজনৈতিক শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে সেখানেই জায়গা করে নিয়েছে বিজেপি। হাওড়া জেলার উলুবেড়িয়া একটি মুসলমান প্রধান কেন্দ্র। ২০১৬ সালে এখানকার মুসলমানদের একটা বড়ো অংশ বিজেপিকে ভোট দিয়েছিল। এবারও যে বিজেপি এখানে ভালো ভোট পাবে সেটা এলাকায় ঘুরলেই বোঝা যায়। মোদী সরকার তিন তালাক বিরোধী বিল আনার পর শিক্ষিত মুসলমান মহিলাদের বিজেপি সম্বন্ধে আগ্রহ বেড়েছে।
যাই হোক, মূল প্রসঙ্গে ফিরি। মুসলমান ভোট যত বেশি ভাগাভাগি হবে তৃণমূলের বিপদ তত বাড়বে। বিশেষ করে তৃণমূলের দুর্গ হিসেবে পরিচিত দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলিতে এর প্রভাব পড়বে সব থেকে বেশি। সেই সুযোগে বিজেপি যদি কয়েকটি আসন জিতে নিতে পারে তাহলে আশ্চর্য হবার কিছু থাকবে না। তেমন দুটি আসন হলো বসিরহাট এবং বনগাঁ। কয়েকবছর আগে বিজেপির শমীক ভট্টাচার্য বসিরহাট থেকে জিতেছিলেন। মুসলমানরা ভোট না দিলে এই জয়লাভ সম্ভব ছিল না। এবার বসিরহাটে ভোটের সমীকরণ তুলনামূলকভাবে জটিল। তৃণমূল গতবারের বিজয়ী প্রার্থী ইদ্রিশ আলিকে টিকিট দেয়নি। প্রার্থী করেছে নুসরত জাহানকে। নুসরত সিনেমার অভিনেত্রী। রাজনীতিতে নতুন মুখ। তরুণ ভোটারদের একাংশ নুসরতকে দেখে আহ্লাদিত হবেন। কিন্তু চল্লিশোর্ধ্ব হিন্দু ভোটারদের তিনি কতটা প্রভাবিত করতে পারবেন, সে সন্দেহ থেকেই যায়। সন্দেহ থেকে যায় ইদ্রিশ আলিকে নিয়েও। তিনি গতবারের বিজয়ী প্রার্থী। অথচ এবার টিকিট পাননি। তৃণমূলের অন্দরের খবর, দলের এই সিদ্ধান্তে ইদ্রিশ বেজায় চটেছেন। সুতরাং তিনি যদি অলক্ষ্যে থেকে নুসরতের পথে কাটা বিছিয়ে দেন তাহলে মুশকিলে পড়বে তৃণমূল। বিপুল গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে জর্জরিত তৃণমূলের নেতারাও চিন্তিত ইদ্রিশকে নিয়ে। কেউ কেউ তো ইদ্রিশের সঙ্গে তার পুরনো দল সিপিএমের লিংকও খুঁজে পেয়েছেন।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিয়াল্লিশে বিয়াল্লিশ পাওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতি বিচার করে বলা যায়, তার স্বপ্ন পূরণ হবার কোনও সম্ভাবনাই দেখা যাচ্ছে না। উল্টে, তৃণমূল গতবার যত আসন পেয়েছিল এবার তার থেকে কম পাওয়ার সম্ভাবনা দিন-দিন উজ্জ্বলতর হয়ে উঠছে। সম্প্রতি টাইমস-নাও চ্যানেলের প্রাক-নির্বাচনী সমীক্ষাতেও একই পূর্বাভাস মিলেছে। সমীক্ষার রিপোর্ট : তৃণমূল পরে ৩১টি আসন, বিজেপি ১১টি। বাম এবং কংগ্রেসের ঝুলি থাকবে শূন্য। এই ধরনের সমীক্ষার সঙ্গে বাস্তবের মিল সবসময় থাকে না। কিন্তু এই সত্যকে অস্বীকার না করেও বলা যেতে পারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মোটেও স্বস্তিতে নেই। তিনি জানেন সাধারণ বাঙ্গালিদের মধ্যে মমতা-বিরোধী মনোভাব বেশ শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। উন্নয়নের নামে প্রতারণা, পিসি-ভাইপোর হাতে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ, অবাধ মুসলমান তোষণ, চুরি, দুর্নীতি, সিন্ডিকেট রাজ—এসব বাঙ্গালি, বিশেষ করে হিন্দু বাঙ্গালি আর ভালো চোখে দেখছে না। সব কাজ করা হয়ে গেছে বলে তিনি যতই প্রলাপ বকুন, শিক্ষিত বাঙ্গালি তরণ জানে এ পোড়া পশ্চিমবঙ্গে তাদের কোনও ভবিষ্যৎ নেই। হয় দালালি নয় তো পার্টির হয়ে গুন্ডামি—এই দুটো রাস্তাই এখন খোলা।
এমন এক আগ্নেয় পরিস্থিতিতে তৃণমূল নেত্রী হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন মুকুল রায়ের অভাব। এর আগে ২০১৬ সালে তৃণমূলের ছেঁড়া-ফাটা শাড়িতে রিফুকর্মের প্রধান কারিগর ছিলেন মুকুল। দলের দক্ষিণবঙ্গের দুর্গ অক্ষত রেখেছিলেন। মুসলমান ভোটব্যাঙ্কে ধস নামতে দেননি। কিন্তু এবার তিনি বিজেপিতে। মুকুলের ক্ষুরধার রাজনৈতিক মস্তিষ্কের সুফল পাচ্ছে বিজেপি। তৃণমূলকে ভাঙার কাজে তিনি যথেষ্টই সফল। অর্জুন সিংহ, সৌমিত্র খাঁ, অনুপম হাজরা বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন। এদের মধ্যে সব থেকে ওজনদার নাম অর্জুন সিংহ। হ্যাঁ একথা ঠিক, অর্জুন সিংহ আসায় কাকিনাড়া-ভাটপাড়া অঞ্চলের পুরনো বিজেপি কর্মীরা খুশি নন। কিন্তু তাদের একটা কথা বুঝতে হবে, এই নির্বাচনকে আমরা মুখে যতই সাধারণ নির্বাচন বলি না কেন, আসলে এই নির্বাচন সর্বস্ব পণ করার নির্বাচন। আদর্শ-অনাদর্শ, সত্যি-মিথ্যে, পাওয়া-না-পাওয়া লাভক্ষতি সব ভুলে শুধু দেশের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্বাচন। কারণ এনডিএ যদি সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে না ফিরতে পারে তাহলে দেশ বিপন্ন হবে। দেশের মানুষ এক চরম অনিশ্চয়তার সম্মুখীন হবেন। সব থেকে বড়ো কথা দেশ না থাকলে আমরা কেউ থাকব না। আমাদের ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ, ক্ষোভ-আনন্দ কিছুই থাকবে না।
সুতরাং বিজেপিকে আরও শক্তিশালী করে তোলাই এখন একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত। সৌভাগ্যক্রমে বিজেপি শক্তিশালী হয়ে উঠছেও। অন্তত তিনটি আসনে বিজেপি জয় নিশ্চিত করে ফেলেছে। দার্জিলিং আসানসোল এবং বারাকপুর। জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার, বালুরঘাট, রায়গঞ্জ, মুর্শিদাবাদ এবং মালদহ উত্তরে বিজেপির জেতার সম্ভাবনা প্রবল। বাঁকুড়া এবং মেদিনীপুর পূর্বের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।
পঞ্চায়েত নির্বাচনে বোঝা গিয়েছিল জঙ্গলমহল গা থেকে সবুজ রং মুছে অনেকটাই গেরুয়া হয়ে উঠেছে। পুরুলিয়ায় আশাতিরিক্ত ভালো ফল করেছিল বিজেপি। এবারের লোকসভা নির্বাচনে বীরভূম এবং পুরুলিয়ায় বিজেপি ভালো ফল করবে। তৃণমূল নেত্রী প্রায়ই বলেন জঙ্গল মহল হাসছে। ২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার পর কিছু কাজ তিনি করেছিলেন। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় তা নগণ্য। বরং প্রধানমন্ত্রী সড়ক যোজনায় সুফল পেয়েছে জঙ্গলমহল। নতুন রাস্তা তৈরি হওয়ার ফলে প্রত্যন্ত গ্রামগুলি এখন নাগালের মধ্যে এসেছে। যার ফলে নিরাপত্তা ব্যবস্থা শক্তিশালী হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় বাড়ি পেয়েছেন অনেকে। মিলেছে উজ্জ্বলা গ্যাস প্রকল্পে রান্নার গ্যাসের সংযোগ। সব থেকে বড়ো কথা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দু’টাকা কেজি দরে চাল দেওয়ার ধাপ্পাটি ধরা পড়ে গেছে। এখানকার মানুষ এখন জানেন এটি কেন্দ্রীয় সরকারের অন্তোদয় প্রকল্পের একটি কর্মসুচি।
২০১৬ সাল পর্যন্ত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তুরুপের তাস ছিল জনজাতি এবং মুসলমান ভোটব্যাঙ্ক। জনজাতি ভোটব্যাঙ্কে আগেই ভাঙন ধরেছিল, মুসলমান ভোটব্যাঙ্কও বড়োসড়ো ধসের সম্মুখীন। মুকুল-ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত ত্বহা সিদ্দিকি প্রায়শই মমতার সমালোচনা করছেন। এমনকী মুসলমানদের জন্য মমতা কী করেছেন তার কৈফিয়তও দাবি করেছেন তিনি।
এখন মমতা বুঝতে পারছেন তিনি বাঘের পিঠে সওয়ার হয়েছেন। বাঘও বুঝে গেছে সওয়ারিটির সঙ্গে তার খাদ্য-খাদক সম্পর্ক। সে সওয়ারিকে ফেলে দেওয়ার অপেক্ষায়। আর মমতা ভাবছেন সত্যিই যদি ফেলে দেয় তাহলে তিনি কী করবেন!
এই গল্পের শেষাংশ জানা যাবে ২৩ মে। তার আগে বাঙ্গালি প্রস্তুত হবে পশ্চিমবঙ্গে সত্যিকারের পরিবর্তন আনার জন্য।
চন্দ্রভানু ঘোষাল